ফিরে দেখা ২৬শে ফেব্রুয়ারী
লিখতে হুট করে কার না ভালো লাগে। আমার আরও বেশী ভালো লাগে। অনেকদিন কিছুই লেখি না। সময় পাই না লেখার। আর লেখার সময় টুকুতে বই পড়ি, নয়তো সিনেমা দেখি। নয়তো অলস ভাবি। লেখার ভাবনা সব সময় থাকে আবার হারিয়ে যায়। এই জন্য আমার এক প্রিয় মানুষ বলছিলো-- সেই একদিন কখনোই আসবে না। যদি তুমি প্রতিদিন না লেখতে পারো অথবা লেখার ভেতরে না থাকলে। কোনও যাদুকর এসে বর দেবে না তোমাকে'। আমি অবশ্য উনার কথা শুনি নাই। ব্লগ লেখাই ছেড়ে দিয়েছি। ফেসবুকেও কম লিখি। একাউন্ট ডিএক্টিভেট করে বসে থাকি। মাঝে মাঝে ব্লগে আসি, চুপচাপ চলে যাই। কমিউনিটি ব্লগের এই দুর্দিনে আমার কিবা করার ছিল, হয়তো সপ্তাহে চারটা পোষ্ট দিতাম। লোকজন পিঠ চাপড়াতো। কিন্তু দিনশেষে সেই একই অবস্থা। আমাদের কারো জন্যেই কিছু যায় আসে না, কারো শুন্যতায় কিছু যায় আসে না। আজ আমি লিখতে আসলাম মেইনলি কারন, অভিজিৎ রায়ের নির্মম খুনের পর ১ বছর হয়ে গেল। মাসকাবারীতে খুন হলো আরো চার পাঁচ জন। বছর ঘুরে আমরা কোথায়? আমরা আরও অন্ধকারে তলিয়ে যাচ্ছি তা বলতেই, এই লেখা লিখতে বসা।
বদ্বীপ প্রকাশনী যেদিন বন্ধ হলো সেদিন আমি অফিস থেকে বেরিয়ে এসেছিলাম শাহবাগে। দেখি কোনও প্রতিবাদ টত্রিবাদ হয় কি না। সেদিন দুর্ভাগ্যক্রমে রাজীব হায়দারের মৃত্যু বার্ষিকী। মনটাই খারাপ হলো। আমরা রাজীবের জানাযায় ছিলাম, নামায পড়ি নাই। তবে সেদিন কান্না আটকানো কঠিন ছিল। শাহবাগের তখন গ্রোথের সময়, মানুষ আর মানুষ। তিন বছর পর এসে দেখি শাহবাগের মানুষ এখন শখানেক। তাঁদের ভেতরে কেউ কেউ আবার অনুষ্ঠান শেষে ইমরান সাহেবের সাথে সেলফি তোলার অপেক্ষায় । হাসান ইমাম ছিল সেই অনুষ্ঠানে। ভালো ভালো কথা হচ্ছিলো, এক বক্তা চিনি না, তিনি বলছেন 'রাজীব' ইসলামের বিরুদ্ধে কিছু বলেন নাই, জামাতের বিরুদ্ধে বলতেন। এই ধরণের কথা আমার সব চাইতে অপছন্দের। কে কি বলছে, না বলছে তা ডিফেন্ড করার জন্য তো আমরা আসি না, আমরা এসেছি খুনের বিচার চাইতে, বিচারের নামে প্রহসনের রায় বন্ধ করতে। কে ইসলামের বিরুদ্ধে কি বলেছিল নাকি বলে নাই তা আজাইরা, আসল ব্যাপার হলো খুন হয়েছেন আমার ভাই। আমি তো দেখি ইসলামের বিরুদ্ধে এই জাতির সবাই, মসজিদে মোট জনগোষ্ঠীর ২ ভাগ যায়। বাকী ৯৮ ভাগই ইসলাম অমান্য করে অন্য কাজ করছে তাহলে ওদেরকেও খুন করতে হবে। সাধারণ মানুষের সাথে আমি মিশে দেখেছি ইসলাম এই দেশের মানুষের মুখেই আছে খালি। বাস্তবে ছিটে ফোটাতেও নাই। যে কবি সে কবিতার বই বের করে, দু তিন জনের সাথে প্রেম করে, আবার রাতের বেলা ইসলামের স্ট্যাটাসও শেয়ার করে। আমি এক হুজুরকে যদি যিনি সাড়ে তিনশো গ্রামের তক্ষক খুঁজেন, পাইলে বেচে কোটিপতি হবেন, আবার আরবীও পড়ান, নানান বিষয়ে বয়ানও দেন সাথে সাথে এক মহিলার সাথে পরকীয়াও করেন। সব কিছুই আপেক্ষিক। যে ব্যাক্তিকে আপনি ধর্মের শত্রু মনে করছেন সেই ব্যাক্তি কাল খেজুর বাগানের হাজী হয়ে এক ওয়াক্ত নামায না পড়লে ৮৮ বছরে আগুনে পুড়তে হবে সেই কথা বলবে না তার গ্যারান্টি কি? কত নাস্তিকদের দেখলাম তাবলীগের খাদেম হতে। তাই যারা ভাবেন এন্টি ইসলামিষ্ট হবার কারনে মেরে ফেলা ঠিক, সেই ব্যাটারাও কতল হবার জন্য প্রস্তুত থাকেন। কারন রিয়েল ইসলাম নামের যে মিথ তা থেকে আমরা সবাই অনেক দূরে। কিন্তু টিস্যু পেপারের মত ইসলামকে ইউজ করছেন, মানুষ মারছেন, বাক স্বাধীনতার সীমানা নির্ধারণ করেছেন তাঁদের পরিনতি যে ভালো হবে না তা সময় হলেই সবাই বুঝবে। কারন অন্ধকারের শেষ নাই, খালি খাবি খেতে খেতেই হাঁটতে হবে, পথ আর পাবেন না।
যেখানে অভিজিৎ রায় মারা গিয়ে ছিলেন। সেখানে এক ব্যানার আছে, অভিজিৎ রায় রা হারলে হারবে বাংলাদেশ। আমি দেখছি বাংলাদেশ হেরেই গেছি। আলোর দেখা নাই। অন্ধকার থেকে আরও গভীর অন্ধকারে যাওয়া। জিডিপির হিসাবে আমরা এগুচ্ছি, অনেকেই স্মার্ট ফোন চালাচ্ছি, কিন্তু মননশীলতায় আমার মনে হয় আফ্রিকার কোনও আদিম জাতিও আমাদের চেয়ে এগিয়ে থাকবে। ধান্দাবাজি, অসততায়, লুটতরাজে দক্ষ হচ্ছি যত তার সাথে ব্যালেন্সিং করে বাড়ছে আমাদের ইসলামের নাম দিয়ে সব কিছু জায়েজকরন। ভারতের ইনটলারেন্ট নিয়ে এত কথা আমরা বলতে শুনতে খবর রাখতে ভালোবাসি। অথচ আমরা যে জাহান্নাম হচ্ছি সেটা কেউ ভাবে না। শুক্রবারের দিন ডেডপোল নয়তো বইমেলায় গিয়ে সেলফি তোলা এই এখন আমাদের কালচারাল এক্টিভিটি। আমি দেখে অবাক হই,অভিজিতের ব্যানারও মধ্যবিত্তের কাছে সেলফি তোলার জায়গা। আগামীতে আমরা নিজের মায়ের ডেডবডির সামনে সেলফি তুলতেও কসুর করবো না। সবাই বলেন একুশে চেতনা, একুশে ফেব্রুয়ারী, ভাষার মাস। আমার তো মনে হয় সেই আমলেই আমরা আছি। উস্কানী দেয়া যাবে না, ধর্ম নিয়ে লেখা যাবে না, সবাইকে লাইনে থাকতে হবে। আমরা লাইনেই আছি অন্ধকারের তলদেশের লাইন। রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে উস্কানী দিয়েই বাংলা ভাষা প্রতিষ্ঠা হয়েছে, দেশ স্বাধীন হয়েছে। উস্কানী নিয়ে এতই ভয় তাহলে ফিরে যাই উর্দু ভাষায়। আরবী হরফে লিখবো আর নেকী কামাবো সমানে। ইহকাল পরকাল সব ফকফকা। অভিজিৎ রায়ের মৃত্যুর পরের বই মেলায়, শহীদ দীপনের রক্তে ভেজা প্রকাশনীতে অভিজিতের বই নেই। মেলায় টু শব্দ নেই। আজ খালি এক মিনিটের নীরবতা ছিল। আমি বাজী ধরে বলতে পারি ৯৭ ভাগ লোক সেই কথার পাত্তায় দেই না। প্রকাশকেরা ব্যানার লিখে ইশারা ভাষায়। যেন নিহত লেখক প্রকাশকেরা নিষিদ্ধ কিছু তাই নাম যত আস্তে পারা যায়। কারও মৃত্যুতেই আমাদের আসলে কিছুই আসে যায় না। অভিজিৎ তো সেখানে গত হওয়া ইস্যু। বিজ্ঞাপন বঞ্চিত ডেইলী স্টার পিলখানা ট্রাজেডীর শোকে পাতায় পাতায় কালো করে ফেলে। কিন্তু অভিজিৎ রায়ের খবর চলে যায় সাত আট পাতায়। আর সারা বছর তো থাকে সাবেক হয়ে যাওয়া ইস্যুর শেষের দিকে। এক বছর আমি বুঝতে পারি, অভিজিৎ রায়ের সাথে আমার সেদিন মেলায় না দেখা হলেই ভালো লাগতো। নিজেকে খুনী ভাবতাম না। আমি জানি আমার মতো কতিপয় লোক নিজেদেরকে খুনীর লোক ভাবে। আহমদ ছফা এক ইন্টারভিউতে বলেছিলন- যখন চুপ থাকি তখন আসলে সব কিছুকেই সম্মতি দিয়ে ফেলি প্রত্যক্ষ ভাবে। সুতরাং এই খুনীর রাজ্যে আমরাও তো খুনী। কি করেছি আমরা? কিচ্ছু না। যে যাওয়ার সে চলে গেছে। দীপনের বাবার সাথে সুর মিলিয়ে অনেকেই বলে হত্যাকারীর বিচার চাই না। আমি বলি আমরা চাই বা না চাই কারও একটা চুলও ছেড়া যায় না। আমাদের কথা কেউ শুনে? কেউ শুনতে চায়। একদিক থেকে ভাগ্যবান অভিজিৎ। বীরের মৃত্যু হয়েছে। আমাদের মতো প্রতিদিন তো আর মরছে না এই ইতর অসভ্যদের জনপদে।
নিরাপত্তার খাতিরে যেসব মানুষ দেশ ছাড়ছে তাঁদের নিয়ে বিকৃত রুচির মানুষেরা যে ঠাট্টা তামাশা করে আমার হাসি আসে। তাঁদের হলুদ দাত দেখে আমার মনে আসে হে জারজ কূল তোরাও যেতে উদগ্রীব, ভালো অফার দিলে ইসলাম ধর্ম ত্যাগ করেই যাবি দূর দেশ। এত বড় বড় কথা। এই শহরের মানুষেরা কি পরিমান হিংসুটে তা তাঁরা নিজেরাই জানে না। খেলা দেখতে গিয়েছিল, সাকিবকে অশ্রাব্য ভাষায় গালি গালাজ করছে। আমার ছোটভাই ইভান জিগ্যেস করলো ভাই এত গালি শুনে যে মাথা ঠান্ডা রাখে তাই অবাক করার বিষয়। এই আমাদের আবেগের জায়গা ক্রিকেট নিয়ে আমাদের কাজকারবার। তাঁদের থেকে ভালো আর কি আশা করা যায়? আনিসুল হক বলেছেন জিন্স পড়ে কিন্তু বই পড়ে না কেন। বই পড়া জাতি আমরা কখনও ছিলাম না হওয়াও সম্ভব না। এই নষ্ট শহরে বিনোদনের জায়গা নেই তাই বইমেলায় এত মানুষের ভীড়। বই পড়া লোক কখনও বই লেখার অযুহাতে মানুষ খুন করে না। বই পড়া লোকেরা কর্তা ব্যাক্তি হলে বলে না, লিখতে গেছিলো কেন? অনেকের আইডল দেশের সেরা কিশোর সাহিত্যিক বই পড়ার মানুষ হলে বলতেন না, ওমুক বইটা যেন কেউ না পড়ে। আমাদের সবার মাঝে ভন্ডামী, সবাই অনৈতিক কিন্তু আশা করবো সত্য সুন্দরের জয় হবে। এইটা দুনিয়ার কোথাও হয় নাই, বাংলাদেশেও সেই জয় হবে না। অভিজিৎ রায়ের মৃত্যু আমাকে মনে করিয়ে দেয়, আমরা কতটা নিরুপায় অসহায় এই ভুখন্ডে। এই দুর্বিনীত মরার দেশে মরার আগ পর্যন্ত আমাদের রেহাই নেই। যে যত ভন্ড এইখানে সে তত ধর্ম নৈতিকতা নিয়ে বড় বড় ডায়লগ দেয়।
অনেকদিন থেকেই বাংলাদেশীদের ইসলাম চর্চাটা নিয়ে কিছু লেখার ইচ্ছা। ঈদের নতুন ড্রেস আর আজকাল ফ্যাশনেবল হিজাবের জন্য অনেকেই ইসলাম ধর্মীয় হয়ে উঠছে। আহারে আমার ধর্ম। কি লিখব , সহজ ভাবে কিভাবে লিখব বুঝে উঠতে পারছিলাম না। আপনার লেখা পড়ে দুঃখ শেষ। আর লিখতে হবে না আমাকে।
বাংলাদেশে না থাকলেও প্রায় প্রতিদিন পত্রিকা পড়ি। চোখ ঝাপসা হয়ে যায়। নিজের একটা স্বাধীন দেশ। তবু সবাইকে সারাক্ষণ কত ভয়েই না থাকতে হয়। একে আর যাই বলুক বেঁচে থাকা বলে না।
ক্রোধ আর ক্ষোভ একটা বৃত্তে ঘুরপাক খায়। অন্ধচক্রে পথ হারানো মানুষ আমরা
রুঢ় নির্মম বাস্তব সত্য --- অকপটে --- হ্যাটস অফ
মন্তব্য করুন