গল্প: এক শীতে হারানো সুখের গল্প
আবার শীতকাল চলে এসেছে। অথচ এখনো চলছে কার্তিক মাস। তারপরও বুধবার দেশের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিলো ১২ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস, দিনাজপুরে।
শীতকালটা আমার খুব বেশি প্রিয় ঋতু না। আবার অপ্রিয়ও না। শীতের ভোরে ঘুম থেকে উঠতে ভালো লাগে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে কুয়াশার উড়ে বেড়ানো দেখতে ভালো লাগে। জিন্স-জ্যাকেট-কেডস্ ইত্যাদিতে নিজেকে আগাগোড়া মুড়িয়ে ধূমায়িত চায়ের কাপে চুমুক দিতে ভালো লাগে। এরকম কয়েকটা বিষয় আছে যেগুলো ভালো না লাগার কোনো কারণ নেই। তবে খারাপ যেটা লাগে সেটা হচ্ছে- অসহ্য ঠান্ডার কারণে পানিতে হাত দিতে না পারা। যেসব কাজে পানির সংস্পর্শে যেতে হয়, সেসব কাজ করতে না পারা। বরফের মতো ঠান্ডা শৈত্যপ্রবাহের মধ্যে সাইকেল চালিয়ে গভীর রাতে বাড়ি ফেরা। এ কাজগুলো শীতকালে করতে খুব বিরক্ত লাগে কিন্তু না করলেও চলে না। সব মিলিয়ে এ ঋতুটি একটি মিশ্র ঋতু।
প্রতিটি ঋতুই সম্ভবত তাই। আমার সবচেয়ে প্রিয় ঋতু বর্ষাকাল। বৃষ্টি দেখলেই আমার মন ভালো হয়ে যায়। ঝুম বৃষ্টি দেখলে আমি হাতে যতো জরুরি কাজই থাক না কেন, ক্যানসেল করে দিই। কি হবে অতো বেশি পেটের ধান্দা করে? দুই দিনের দুনিয়া। দেখা গেল, একটা ঝুম বৃষ্টি মিস্ করে অফিসের দিকে রওনা দিলাম আর মধ্যরাস্তায় ট্রাকপেষা হয়ে পরপারে চলে গেলাম। কোনো লাভ আছে তাহলে? তারচেয়ে কোনো বাড়ির ছাদে বা কোনো ব্রীজের ওপর (হাতিরঝিল হওয়ার পর ঢাকা শহরে ব্রীজের অভাব ঘুচেছে) কিংবা আর কোনো জায়গা না পেলে পার্কে গিয়ে বৃষ্টির ভেতর অচল হয়ে বসে থাকার এক ভিন্ন ধরনের মজা আছে। আর তাছাড়া বৃষ্টির ভেতর বসে বসে কান্নাপাওয়া ভাবনাগুলোও ভাবা যায় খুব সহজে। অবশ্য বর্ষাকালেরও খারাপ দিকও আছে। সাইকেলটা সবসময় ময়লা হয়ে থাকে। ওটাকে যতোই ধোয়া-মোছা করি, রাস্তায় বের হলেই আবার পুরোনো চেহারা। কাপড়ের স্যাঁতসেতে ভাবটাও যেতে চায় না সহজে এবং প্রচুর কাপড় পানি বা কাদা লেগে অকেজো হয়ে থাকে। যে কারণে কাপড়জনিত সংকটে পড়তে হয়। যেটাকে বলা যায়, কাপড় ধুয়ে কূল পাওয়া যায় না। ধোয়ার পর আছে সেগুলো শোকানোর সংকট।
গ্রীষ্ম অনেক ছিমছাম। ঠান্ডার যন্ত্রণা কিংবা প্যাঁচপ্যাচে কাদা নেই। যা আছে তা হচ্ছে কাঠফাটানো রোদ। তুমি যতোখানি রোদ সহ্য করার ক্ষমতা ধরো, ততোখানি সুখ তোমার ভাগ্যে বরাদ্দ। আমার জন্য ডিল হিসাবে ফাইন কিন্তু অনেককেই দেখেছি রোদে বের হলেই চেহারা চেঞ্জড্!
শরৎ-হেমন্ত-বসন্ত তিন ভাইকে নিয়ে বিশেষ কিছু বলার নেই। এসব ঋতু নিজে নিজে আসে, নিজে নিজে চলে যায়। মাঝে মাঝে গাছের চূড়ায় বা নদীর পাড়ে চোখ গেলে এসব ঋতুর আনুষাঙ্গিক লক্ষণ দেখতে পাই কিন্তু এছাড়া খুব বেশি প্রভাব টের পাই না। আর একটা বিষয় থাকে, এসব ঋতুতে তাপমাত্রাটা অপেক্ষাকৃত সহনীয় থাকে। যদিও আমার ধারণা ধীরে ধীরে এ তিনটি ঋতু বিলুপ্ত হয়ে কেবল শীত, গ্রীষ্ম আর বর্ষা টিকে থাকবে।
শীত সবসময়ই আমার জন্য অপয়া। আবার শীতে আমিও সবসময় সবার জন্য কুফা। আমার আর শীতের ভাইস ভার্সা রিলেশন। একবার এক শীতে এক লাকি গার্লের সঙ্গে দেখা হয়েছিলো। সেই শীতে সৌভাগ্যের বরপুত্র হয়ে উঠেছিলাম। ওই মেয়েটির সঙ্গে সকালে ঘুম থেকে উঠে একটু গল্প করলেই সারাদিন দারুণ কাটতো। আর কিছু লাগতো না।
সেবার একটা সংস্থায় ইন্টারভিউ দিতে গিয়েছিলাম। ওয়েটিং রুমে বসে ওই মেয়েটির সঙ্গে টেক্সট চালাচালি হচ্ছিলো। লিখে পাঠিয়েছিলাম, আগে থেকে ক্যান্ডিডেট সিলেক্ট করে আইওয়াশের ইন্টারভিউ হচ্ছে। বাজে সংস্থা। মেয়েটি লিখে পাঠালো, ইন্টারভিউ দেয়ার দরকার নাই, চলে আসেন। আমরা ওইটার চেয়ে বড় সংস্থা খুলে ওই লোকগুলোরই ইন্টারভিউ নেবো একদিন। সেইদিন চলে আসি নাই এবং শেষ পর্যন্ত চাকরিটা হয়েছিলো।
আরেকবার আমাদের সন্ধ্যা থেকে অ্যাক্সিডেন্ট করা শুরু হলো। আমিই উদ্বোধন করলাম। ভরপেট ভদকা গিলে বন্ধুর ১৮০ সিসি পালসার স্টার্ট করেই দিলাম পাগলের মতো টান। সামনে সত্তুর-আশি ফিটের মতো রাস্তা ছিলো। মাত্র তিন সেকেন্ডে রাস্তাটা শেষ হয়ে একটা দেয়াল চোখের সমানে চলে এলো। বন্ধু আমার পেছনেই বসা।
তারপর দেয়ালের সঙ্গে ধাক্কা খাই নি ঠিকই তবে সাইকেলটাকেও ভূমির সঙ্গে সমকোণে দাঁড় করিয়ে রাখতে পারি নি শেষ পর্যন্ত। ফলাফল হিসেবে সেদিন ছিলে গিয়েছিলো হাঁটুর মালাইচাকির ওপরকার নরম চামড়ার স্তর পুরোটাই।
আমার পর দুই ছোট ভাই-বোন আমার সাইকেল নিয়ে রোকেয়া হলের স্পীডব্রেকারে ব্রেক না কষে তিন ডিগবাজি খেলো এবং দুইজনের দুই হাসপাতালে ঠাঁই হলো। আমার ওই সাইকেলটার নাম ছিলো মেলমিন। মেলমিনের উইন্ডশীল্ড ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গিয়েছিলো। এরই মধ্যে শুনলাম এক বড় ভাই মদের বোতলসহ পুলিশের গাড়ির সঙ্গে অ্যাক্সিডেন্ট করেছে এবং অ্যাক্সিডেন্টে তাদের নয় হাজার টাকা দামের দু'টি মদের বোতল ভেঙ্গে রাস্তায় ভেসে গিয়েছে। যেটা ছিলো সে রাতে আমাদের জন্য সবচেয়ে বড় দুঃসংবাদ!
সেই কালনিশিতে সাড়ে এগারো বা বারোটার দিকে ফোন করলো মেয়েটি। জানতে চাইলো, কোথায় আপনি? বললাম, হাসপাতালে। জানতে চাইলো, কেন? তাকে ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ দিলাম। সে হেসে বললো, আচ্ছা আপনি দাঁড়ান আমি আসছি।
মেয়েটি আসার পর আর কোনো ঝুট-ঝামেলা হয় নি। সে রাতটি আমরা বেশ চমৎকারভাবে কাটাই এবং সারারাত মজা করি। এ ঘটনাগুলো কাকতালীয় অবশ্যই কিন্তু তারপরও এগুলোর সঙ্গে ওই মেয়েটির যোগসাজশ ছিলো বলে ভাবতেই আমার বেশি ভালো লাগে।
অথচ আমি কিন্তু মেয়েটির জীবনে চূড়ান্ত কুফা একটা লোক হিসাবে আবির্ভূত হয়েছিলাম। আমি স্বচক্ষে দেখেছিলাম আমাদের পরিচয়ের দিনগুলোতে ওকে কতো রকমের মানসিক যন্ত্রণার মধ্যে থাকতে হতো। হয়তো শারীরিক যন্ত্রণাও ছিলো, যেটা সে কখনো আমাকে জানতে দিতো না। সবচেয়ে বেশি খারাপ লেগেছিলো যখন ওকে একটা বিচ্ছেদের প্রক্রিয়ার মধ্য দিতে যেতে দেখেছিলাম। আমি যেমন আমার সৌভাগ্যের জন্য ওকে দায়ী করতাম মনে মনে, তেমনি ওর দুর্ভাগ্যগুলির জন্যও নিজেকে দায়ী করতাম।
আমার অনেক প্রিয় সেই বন্ধুটি তারপর একদিন হারিয়ে গেলো। এখনকার যন্ত্রকৌশলের যুগে মানুষের জন্য হারিয়ে যাওয়া সহজ না। ও কঠিন কাজটিই একদিন করে দেখিয়ে দিলো। আমি আর ওকে খুঁজে পেলাম না এবং মানবমনের অদ্ভুত আচরণের কল্যাণে ওকে খুব বেশি খোঁজাখুজিও করলাম না। আমার মনে হচ্ছিলো এটাই নিয়তি। আমার দুর্ভাগ্যপীড়িত জীবনে সাময়িক সৌভাগ্যের ঝলকানি নিয়ে যে হাজির হয়েছিলো, সে খুব বেশিদিন থাকার জন্য হয়তো আসে নি।
চিত্রা সিংয়ের একটি গান আছে। মনে করো যদি সব ছেড়ে হায়, চলে যেতে হয় কখনো আমায়। গানের কথাগুলো অসাধারণ। এক জায়গায় বলা হয়েছে, তোমারি নামে দিনেরও শেষে দীপ জ্বালাতো কে ভালোবেসে?
ওই বন্ধুটি এই কাজটি করতো। একেকটা কর্মব্যস্ত দিনের শেষে সে কেবল আমার কথা ভেবেই সময় পার করতো। আমি পুরো জীবনে তেমন আর কাউকে পাই নি যে লিটারালি না হলেও যেকোন এক উপায়ে, আমার চলার পথের কাঁটাগুলি সরায়ে ফুল ছড়িয়ে রাখতো নিয়মিত।
পরিচয়ের সেই দুর্দান্ত দিনগুলোতে এ ঘটনাগুলো যখন ঘটতো তখন আমি বুঝতাম না। স্বাভাবিক ঘটনাপ্রবাহ হিসাবে ধরে নিতাম শুধু। অথচ রাতের পর রাত, হাজারের পর হাজার ই-মেইল চালাচালির মধ্য দিয়ে কত শীতল-গভীর জলাশয় যে আমরা ডিঙিনৌকায় পাড়ি দিয়েছি তার হিসেব নেই। অদ্ভুত সময় ছিলো সে এক। আমরা কল্পনাতেই পাড়ি দিয়ে ফেলতাম গ্যান্ড ক্যানিয়ন, আপ-এর বুড়োর বাড়ির পাশে নিজেদের বাড়ি গড়ে তুলতাম নায়াগ্রা ফলসের চূড়ায় এবং অতিথি পাখির মতো স্রেফ উড়ে বেড়াতাম মহাদেশগুলোর আকাশে-বাতাসে। আমাদের পরিকল্পনা ছিলো টেক্সাসের ক্যাটরিনা বিধ্বস্ত এলাকার কোনো এক পোড়োবাড়িতে বিশাল আকারের ব্যাটারি কিনে নিয়ে যাবো এবং সেখানে কয়েক বছরের জন্য থিতু হবো।
চিত্রা সিংয়ের গানের মতো করেই বন্ধুটিকে একদিন চলে যেতে হয়। আমি তখন ওকে ধরে রাখতে পারি নি। আর এখন যখন চিত্রা সিং জানতে চান, মনে রবে কি রজনী ভোরে নয়ন দু'টি ঘুমে জড়াতে নিশিরাতে কে গান শোনাতো?- তখন আমি একদমই নিশ্চল হয়ে পড়ি। স্থবিরতা পেয়ে বসে এবং বুকে ভীষণ অস্থিরতা অনুভব করি। কারণ প্রশ্নটার কোনো উত্তর আমার কাছে নেই। হয়তো মনে থাকবে, হয়তো থাকবে না।
কারণ জীবনটা এমন যে, কষ্টের ভেতর ডুবে থাকা মানুষকেও সে চুলের মুঠি ধরে টেনে তুলে রাজপথে ছেড়ে দেয়। আর তারপর মানুষ নিজেকে বয়ে নিয়ে যায় অচেনা গন্তব্যে। সাময়িক সুখের আশায় ভুলে যায়, তারই কারণে কত অসংখ্য অসুখী চারপাশে গিজগিজ করছে। যে কারণে নিজেও হিসেবে খাতায় একসময় অসুখ ছাড়া আর কিছুই খুঁজে পায় না।
অংকটা আসলেই ভীষণ জটিল!
---
শীত বর্ষার গল্প বলতে বলতে সুরা পান চলে আসলেন!! সেই মেয়েটাকে নিয়ে গল্প গল্পের মতোই। এমন কি আর বাস্তবতা হয়!! কি জানি! হলে তো ভালোই। কত শত মধুর স্মৃতি জমা হবে।
এখন তো আপনার শীত গ্রীষ্ম সবই আনন্দে কাটার কথা। তাই যেন হয়। শুভকামনা সবসময়।
অনেকদিন পর ব্লগে দেখলাম আপনাকে। ব্লগ ছাড়া তো আর আপনার পাত্তা পাওয়ার উপায় নাই।
মীরের লেখা ছাড়াতো জ্যোতিকে ব্লগে পাওয়ার উপায় নেই
থ্যাংকিউ জয়িতা'পু। আপনি ঠিক বলেছেন, গল্প কখনও বাস্তব জীবনের মতো হয় না। গল্পের মতোই হয়। এইটা আমার বৃহত্তর আফসোসগুলোর মধ্যে একটা।
যাই হোক, আপনার পাত্তা যে ব্লগেও পাওয়া যায় না- সেটার কি হবে?
আর তানবীরা'পু কি বলে? উনাকে মনে হয় নিবৃত্ত করা দরকার, তাই না
ব্লগে যখন ঢুকি কাউকে পাই না। একা ভালো লাগে না তাই ব্লগ পড়েই বিদায় হই।
তাতাপুকে নিবৃত্ত আর কি করব! আমার তো মেইল নাই তাই মীরের পাত্তা পেতে ব্লগই ভরসা। গরীবের জন্য শুধুই ব্লগ।
বৃষ্টি একটা অভিশাপ
মেইল চেক করো
বৃষ্টি একটা অভিশাপ। মুবাইলে কুকাম আনোয়ারকে বলে বৃষ্টিকে খানিকটা শাসিয়ে দেয়া দরকার, কি বলেন?
বরাবরের মতোই বিষাদমাখা। সুন্দর।
থ্যাংকিউ নাজনীন আপু। আপনার প্রশংসা পেয়ে ধন্য
বরাবরের মতই মনকারা সাবলিল আবেগবর্জিত। অসাধারন উপস্থাপনা।
আবেগবর্জিত কথাটা দারুণ লাগলো! থ্যাংকিউ রুনা আপু। লেখালেখি কমিয়ে দিলেন কেন?
সময় কমে গেছে আশা করি অদূর সময়ে আবার সময়!হবে
চিত্রা সিং এর এই গানটা আমারও খুব পছন্দের। আপনার গল্প বলার ঢঙটা বরাবরই অনেক সুন্দর। ভাল লাগলো।
মনে আছে, এবি জীবনের প্রথম দিকে ভাস্করদা' আমার লেখার ধরন সম্পর্কে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করতেন। আর রায়হান ভাই। আজ আপনিও করলেন। যারপরনাই খুশি হলাম দাদা। ভালো থাকবেন। শুভেচ্ছা নিরন্তর।
আমার কাজিনদের ভিতরে আমিই সবার বড়, তাই বেশীর ভাগ কাজনরাই আমাকে দাদা ডাকে। আমি মাঝে মাঝে ঠাট্টা করে বলি- এত নাতি থাকলে আমার তো চিন্তাই নাই! দাদা-নাতি সম্পর্কটা খারাপ না, কি বলেন?
ইয়েয়েয়ে। মীর ভাই মীর ভাই মীর ভাই!
অঙ্ক ভাল্লাগে না।
ইয়েয়েয়ে!!! বাউন্ডুলে বাউন্ডুলে বাউন্ডুলে...
কেমন আছেন? কিভাবে আছেন? কি করছেন?
আপনের কমেন্টটা খুবই কিউট হইসে
ভালো-ই!
সব সময় যা বলি এবারো তাই
'দারুণ'
শীত ঋতুটা আমারও পছন্দ না।
তবে গল্প বেশ পছন্দ হয়েছে।
চিত্রা সিং এর গানটা খুব প্রিয় একটা গান আমার।
মন্তব্য করুন