ইউজার লগইন

নির্বাণের পথে

১.
এখন সকাল, এখানে সকাল
মেঘলা সকাল, মাটি ভেজা ভেজা গন্ধ,
তোমার আকাশে কতো তারা ভাসে
তুমি দেখোনাতো তোমার জানালা বন্ধ।

কিছু একটা করবো করবো করে প্রায় পুরো জীবনটা পার করে দিলাম, অথচ এখন পর্যন্ত কিছুই করলাম না। করতে পারলাম না কথাটা লিখতে গিয়েও লিখলাম না, কেননা সেভাবে চেষ্টাও করি নি কখনও। আবার উল্টোটাও সত্য, বেঁচে থাকা মানেই তো নিরন্তর সংগ্রাম করে যাওয়া। তার মানে চেষ্টা যে করি নি, তাও তো না।

২.
তোমার চিঠি কালকে পেয়েছি
ক'হাজার মাইল পেরিয়ে এসেছে
তোমার কথার ছন্দ,
একা একা রাত কাটানো কবরে
কুয়াশা জড়ানো ভোরের খবরে
পাওয়া না পাওয়ার দ্বন্দ।

সেদিন স্বপ্ন দেখলাম আলসেমি নামের আদুরে বন্ধুটা কোথায় যেন চলে গেছে আমায় ছেড়ে। আমি অনেকগুলো মার্ভেল সুপারহিরোর একটা মিক্স হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি। যদিও এই ভাবনাটা ক্ষতিকর। মানুষ যূথবদ্ধ প্রাণী। সুপারহিরোর ধারণাগুলো মানুষের প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যর সাথে যায় না। এটা এক ধরনের আফিম, যা সিনেমার মাধ্যমে মানুষের মনকে খাওয়ানো হয়। আর মানুষ সেই আফিমের নেশায় বুঁদ হয়ে ভাবে সব সংকট থেকে তাদের উদ্ধার করতে কোনো এক স্পাইডার ম্যান একদিন হাজির হবে। তার আগ পর্যন্ত নাক-মুখ বালুতে গুঁজে কোনমতে টিকে থাকতে পারলেই হলো। তাদের মধ্যে থেকে দলবদ্ধভাবে সমস্যা মোকাবেলার ইচ্ছেটা ধীরে ধীরে কর্পূরের মতো উবে যায়। এ সমস্যায় এখন সম্ভবত পুরো পৃথিবীই আক্রান্ত। বাংলাদেশে নববর্ষের দিন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সংঘটিত নারী নির্যাতনের মতো ঘটনা ঘটে গেছে জার্মানীতেও। মাত্রা ছিল কয়েকগুণ বেশি। অথচ মানুষ নির্বিকার। এ দেশের সরকার আর মিডিয়া ঘটনা ধামাচাপা দেয়ায় ব্যস্ত। সবাই অপেক্ষায় আছে কোনো এক মিরাকল-ম্যান এসে সব সমস্যার সমাধান করে দিয়ে যাবে!

যাহোক, বাস্তব জগত থেকে আবার ইউটোপিয়ায় ফিরে যাই। স্বপ্নে দেখলাম, অালসেমী কেটে যাওয়ার পর আমার যখন যা করা দরকার পরছে, মুহূর্তের মধ্যে করে ফেলছি। সবকিছু করে ফেলার পরও আমার হাতে বিস্তর সময় থাকছে। যে সময়গুলো ব্যায় করছি বই পড়া, গান শোনা, সিনেমা দেখা, চমৎকার সব জায়গায় ঘুরে বেড়ানো, ছবি তোলা, ছবি এডিট করা, সাঁতার কাটা, আড্ডা দেয়ার মতো কাজগুলোর পেছনে। তারপরও সময় ফুরোচ্ছে না। মনে হচ্ছে আমার একেকটা দিন ৩৬ ঘন্টার দৈর্ঘ্য পেয়েছে।

৩.
আমার এখানে একই কাঁদাজল
বর্ষাকালের দোহাই মাখানো,
বাড়িতে বাইরে সেই অবিকল
একই রকম সময় কাটানো।

তবে বিষয়টার মন্দ দিকও আছে। এক সময় যখন আসলেই আর কিছু করার থাকে না, আক্ষরিক অর্থেই করার মতো সবকিছু শেষ হয়ে আসে এবং শরীরে অবসাদের লেশমাত্র থাকে না, তখন খানিকটা ভয় ভয় লাগে। মনে হয়, এখন কি হবে? অনেকগুলো বই পড়ে ফেলেছি, দেখে ফেলেছি অনেকগুলো সিনেমাও, এই শেষ রাত্রিরে হিমাংকে ছয়-পাঁচ ডিগ্রি নিচে বহমান তাপমাত্রায় বাইরে কোথাও ঘুরতে যাওয়াও সহজ না, বন্ধুরাও কেউ জেগে নেই, গবেষণার কাজও আর করতে ইচ্ছে হচ্ছে না আপাতত; এখন কি হবে?

৪.
বাবার ছানিটা, বেড়াল ছানাটা, মায়ের পোনাটা,
সবই বেড়ে গেছে যাচ্ছে
রাত কেটে দিন, দিন কেটে দিন, জল ভেজা দিন
নীলাকাশে এই দিন ভাসছে।

তখন মৌসুমী ভৌমিকের গানের কথা মনে পড়ে। এক একটা দিন বড় একা লাগে। মৌসুমী ভৌমিক আমার অনেক পুরোনো দিনের বন্ধু্। সেই স্কুল জীবনের। এসএসসি পরীক্ষার সময়কার। জীবনের অনেক সুখস্মৃতির সাথে জড়িয়ে থাকার। স্মৃতিগুলো কখনও হারিয়ে যায় না। কখনও ভুলতে পারি না বগুড়ার সূত্রাপুরের ওই দোতলা বাড়ির কথা। সে বাড়ির ছাদের ওপরকার ছোট্ট রাজত্বের কথা। সকালে বন্ধুদের বাড়ি এসে কলিংবেল বাজিয়ে ঘুম থেকে ওঠানোর সময়ের কথা। এক বর্ষায় প্রতিদিন বেল বাজিয়ে আমার ঘুম ভাঙিয়েছিল শুভ্র, শাওন, ফুয়াদ, আপেলরা। আমি কাঁথা জড়িয়েই ঘুম ঘুম চোখে বারান্দায় এসে দাঁড়াতাম। ওখানে দাঁড়ালে নিচে গেটের বাইরে কারা এসেছে বোঝা কঠিন ছিল না। আমার কাজটা আরও সহজ করে দেবার জন্য ওরা স্থানীয় ভাষায় চিৎকার-চেঁচামেচি করে নিজেদের উপস্থিতি জানান দিতো। তারপর ঘর বন্ধ করে তাস খেলা, মাঝে মাঝে এক-আধটা সিগারেট সন্তপর্ণে ধরিয়ে দেয়া, কম্পিউটারে সিনেমা দেখা, এমপিথ্রি ফরম্যাটে সেভ করে রাখা পছন্দের গানগুলো শোনা, এবং আরও অনেক রকম কাজের মধ্য দিয়ে সারাটা দিন পার হয়ে যেতো। বিকালে বাড়ি যেতো সবাই, কিন্তু সেটা কেবলি খাওয়া-গোসলের মতো কিছু জরুরি কাজ সারার লক্ষ্যে। তারপর সন্ধ্যায় আবার রাব্বি মামার দোকানের সামনে সবাই হাজির। বাকিতে গোল্ড লীফ নিয়ে মহল্লার চিপা-চুপা এলাকায় গিয়ে দু'তিনজনে মিলে সেটা ধ্বংস করা, ভিডিও গেমসের দোকানে গিয়ে কিং অফ ফাইটার্স খেলা, এক অন্যরকম রুটিনের জীবন।

সে জীবনে আমরা নিষিদ্ধ কাজও করতাম মাঝে মাঝে। সবগুলো বলার মতো না। বলার মতো যেগুলো আছে সেগুলোর একটা হচ্ছে- পানযোগ্য স্পিরিট জোগাড় করে, ভার্জিন কোলার নারীদেহ আকারের বোতলে ঢেলে ভালো করে ঝাকিয়ে একজন একজন করে চুমুক দেয়া। ভার্জিন কোলার সেই বোতল কি আজও পাওয়া যায়? তপন স্যার কি আজও উনার রহমাননগরের বাসার বারান্দায় বসে উদাস চোখে আশপাশটা পর্যবেক্ষণ করেন?

৫.
বলতে ভুলেছি সেই যে গাছটা
আধমরা সেই ফুলের গাছটা
সেই গাছটাতে নতুন কুঁড়িতে
নতুন প্রাণের ছন্দ,
বাঁচার সেকি আনন্দ।

একই রকমের ঘটনারা ভিন্ন প্যাটার্নে এখনও ঘটে। অথচ প্রথম জীবনে যতোখানি শিহরণ অনুভূত হতো, আজকাল ততোটা হয় না। আজকাল আরও উইয়ার্ড কারণ ও সময়ে বন্ধুরা রুমের কলিংবেল বাজায়। আমি যথারীতি শরীরে কাঁথা জড়িয়েই করিডোর পারি দিয়ে সদর দরজা খুলে দিই। কাঁথা জড়িয়ে কাউকে দরজা খুলতে আসতে দেখলে মানুষের না হেসে উপায় থাকে না। হাসি বিনিময়ের মাধ্যমে আমরা শুরু করি। হোয়াট্সাপ ম্যান বলে হাত মেলাই। তারপর একইভাবে সেই ছেলেবেলার মতো সময় কাটাই। মানুষ কি আসলে তার জীবনটা ছেলেবেলাতেই কাটিয়ে ফেলে? তারপর কি শুধুই সবকিছু চর্বিত চর্বণ? নাহলে কোনকিছুই ছেলেবেলার মতো করে মনে দাগ কাটে না কেন?

৬.
ছেলেবেলার বিচ্ছিন্ন এবং আপাত দৃষ্টিতে যোগসূত্রহীন ঘটনাগুলো পরবর্তীতে জীবনে স্থায়ী ছাপ ফেলায় ভূমিকা রেখেছে। যে ছেলেগুলো সকাল সকাল আমায় ঘুম থেকে ওঠাতে আর দিনভর আড্ডা দিতে বাসায় আসতো (কারণ বর্ষাকালে মাঠ-ঘাট ভিজে থাকে বলে আউটডোর অ্যাকটিভিটিজ কমে যায়), তাদের একজন এখন আমার বোনজামাই। ছেলেবেলার প্রিয় ভিডিও গেইম কিং অফ ফাইটার্স এখন আমার গবেষণার মূল বিষয়বস্তু। স্পিরিট পানের অভ্যাসটাও সময়ের সাথে বিবর্তনের নানান পথ পেরিয়ে এখন একটা নিয়মতান্ত্রিক প্যাটার্নে থিতু হয়েছে।

তারমানে কি এখন আমার সাথে যে ঘটনাগুলো ঘটছে সেগুলো নির্ধারণ করে দেবে সামনের দিনগুলোর গতিপথ? আমি কি ধীরে ধীরে ৩৬ ঘন্টার দিনযাপনের সেই গতিশীল সময়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি? এক সময় কি এমন হবে যে, বেলাশেষে আমার যখন আর কোথাও যাওয়ার জায়গা থাকবে না, তখন আমি তোমার ছবির দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকবো? মনের ভেতরটায় সবকিছু ওলট-পালোট করে দেবার জন্য কি সে সময়েও স্মৃতিরা ঝড়ো হাওয়ার মতো হানা দিতে আসবে? আজকাল তোমার কথা এক মুহূর্তের জন্যও ভুলে যাই না জানো? এক মুহূর্তের জন্যও না।

সবচেয়ে ভয়াবহ সময়টা আসে তখন, যখন মস্তিষ্কের সবগুলো নিউরণ প্রাণপনে চিৎকার করে ওঠে, আমরা কেন এত অল্প সময়ের জন্য একে অপরের পাশে ছিলাম? কেন শুধু কয়েক মুহূর্তই একে অপরকে জড়িয়ে ধরার সুযোগ পেয়েছিলাম? কেন আমি শুধু একবারই তোমাকে বুকে আসতে বলেছিলাম? কেন শুধু একবারই তুমি মাথায় হাত বুলিয়ে আমায় ঘুম পাড়িয়েছিলে, আর কেন শুধু একবারই আমি চুমু দিয়ে তোমার ঘুম ভাঙিয়েছিলাম? আজকাল কেন বারবার এই প্রশ্নগুলো ঘুরে-ফিরে এসে ছুরির মতো বুকে বিঁধে? কেন পথে হাঁটতে হাঁটতে কেউ যেন আমায় হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে চোখ মুছতে না দেখে ফেলে, সেজন্য একটা ১২ দশমিক চার বর্গমিটারের রুমে নিজেকে বন্দি করে রেখেছি বহুদিন ধরে?

মৌসুমী ভৌমিকের গানের শেষ প্যারাটা সবচেয়ে সুন্দর। গানের নাম চিঠি। মন খারাপ লাগলে গানটা একটানা শুনতে থাকি। মনটা আরও খারাপ হয়ে যায়। তারপর এক সময় ঘুমিয়ে পড়ি। ধীরে ধীরে নিউরণদের চাঞ্চল্যও শিথিল হয়ে আসে। বেশ কয়েকটা হয়তো মারা যায়। যারা বেঁচে থাকে তারা প্রস্তুত হতে থাকে পরের বারের জন্য। প্রত্যেকবার আমি একটু একটু করে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাই।

আর কি জানাবো তোমাকেই বলো
কথায় কথায় বৃষ্টি নামলো
অবাক ফুলের গন্ধ,
তুমি ভালো থেকো
আমি ভালো আছি
ভালোবাসা নিও,
ভালোবাসা নিও
তুমি ভালো থেকো।

---

পোস্টটি ১২ জন ব্লগার পছন্দ করেছেন

শারমিন's picture


কথাগুলো কি সুন্দর। আমিও লিখতে চাই এমন করে।

মীর's picture


Smile আপনের লেখা কথাগুলো আরও বেশি সুন্দর।

উচ্ছল's picture


১ নং টা অসাধারণ। Smile

মীর's picture


ধইন্যা পাতা

নিয়োনেট's picture


''হয় ফিল্ম বানাতে হবে, নয়তো পৃথিবী পরিব্রাজক হয়ে যেতে হবে''

মীর's picture


রেডি থাকিস। যথাসময়ে খবর দেয়া হবে।

অতিথি's picture


Love কথাগুলো এতটা সুন্দর কেনো?? পড়তে পড়তে হারিয়ে যেতে ইচ্ছে হয়!!! আমিও লিখতে চাই এমন করে কিছু একটা!!!

বিষণ্ণ বাউন্ডুলে's picture


গানটা এত মন খারাপ করা সুন্দর, বলে বোঝানো যায় না। একটা সময় ব্লগরব্লগরের শেষে এই গানটার শেষ দুই লাইন ঢুকিয়ে দিতাম।

এই লেখার ব্যাপারটা ভাল্লাগছে অনেক, আরও কয়েকটা গান নিয়া এরকম একটা কিছু লেইখো।

ভালো থাইকো, সুপ্রিয় মীর ভাই। ভালোবাসা নিও। Smile

মন্তব্য করুন

(আপনার প্রদান কৃত তথ্য কখনোই প্রকাশ করা হবেনা অথবা অন্য কোন মাধ্যমে শেয়ার করা হবেনা।)
ইমোটিকন
:):D:bigsmile:;):p:O:|:(:~:((8):steve:J):glasses::party::love:
  • Web page addresses and e-mail addresses turn into links automatically.
  • Allowed HTML tags: <a> <em> <strong> <cite> <code> <ul> <ol> <li> <dl> <dt> <dd> <img> <b> <u> <i> <br /> <p> <blockquote>
  • Lines and paragraphs break automatically.
  • Textual smileys will be replaced with graphical ones.

পোস্ট সাজাতে বাড়তি সুবিধাদি - ফর্মেটিং অপশন।

CAPTCHA
This question is for testing whether you are a human visitor and to prevent automated spam submissions.

বন্ধুর কথা

মীর's picture

নিজের সম্পর্কে

স্বাগতম। আমার নাম মীর রাকীব-উন-নবী। জীবিকার তাগিদে পরবাসী। মাঝে মাঝে টুকটাক গল্প-কবিতা-আত্মজীবনী ইত্যাদি লিখি। সেসব প্রধানত এই ব্লগেই প্রকাশ করে থাকি। এই ব্লগে আমার সব লেখার কপিরাইট আমার নিজেরই। অনুগ্রহ করে সূ্ত্র উল্লেখ না করে লেখাগুলো কেউ ব্যবহার করবেন না। যেকোন যোগাযোগের জন্য ই-মেইল করুন: bd.mir13@gmail.com.
ধন্যবাদ। হ্যাপি রিডিং!