সেই জীবনটা অবলীলায় আমায় ছুড়ে ফেলে দিয়েছিল
আজ ট্যাটু আঁকার দোকানে গিয়েছিলাম। আমার বাম হাতে বেশ কিছু ব্লেডের পোচের দাগ রয়েছে। গভীর দাগ। সেগুলোকে সুন্দরভাবে ট্যাটু দিয়ে সাজাবো বলে ঠিক করেছিলাম। যদিও বলছি সাজাবো, কিন্তু আসল উদ্দেশ্য ছিল সেগুলো ঢেকে দেয়া। এককালে সোনালী ডানার চিলের পিছে ছুটতে গিয়ে অমন বহু কাঁটা-ছেড়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছিল। 'সোনালী ডানার চিল' বাংলা সাহিত্যের এক অসাধারণ চরিত্র। বলতে হবে এই চরিত্রের স্রষ্টা কে? যাহোক, আমি জানি "কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালবাসে"- কথাটাতে একবিন্দু সত্যতা নেই। তারপরও ট্যাটু আঁকার দোকানে গিয়েছিলাম বেদনাবিধুর কাঁটা দাগগুলো ঢেকে ফেলতে।
দোকানে ঢোকার পরে যে কি হলো, দোকানীকে শরীরের সব জায়গা দেখাই, কিন্তু যেখানে ট্যাটু করাতে চাই সেখানটা দেখাই না! শেষমেশ দোকানী মানে ট্যাটুশিল্পী রেগে বললো, তুমি কি আসলেই ট্যাটু করাতে চাও? আমি উপর-নিচে মাথা নাড়ালাম, হ্যাঁ। সে বললো, কোথায়? আমি বললাম, কপালে। এবার সে হেসে ফেললো। বললো, তোমার হাতে প্রচুর ব্লেডে কাটা দাগ দেখছি। ওগুলো ঢাকার জন্য এসেছো?
-হুম, তুমি কিভাবে বুঝলে?
-আমি এখানে ব্যাবসা করি সাত বছর ধরে। তারও আগে মনস্তত্ব নিয়ে পড়েছি দুই বছর। স্কুলে যাওয়ার টাকা ছিল না বলে ব্যাচেলর শেষ করতে পারি নি। তবে মানুষের মুখ দেখে অনেক না-বলা কথা বুঝে নেয়া শিখতে ব্যাচেলর পাশ করা লাগে না।
-আচ্ছা বেশ। তবে এখানে আসার পর আমার আর হাতের দাগ ট্যাটু দিয়ে ঢাকতে ইচ্ছে করছে না। কি করা যায়?
-হিহিহি, ব্রেক-আপ কবে হয়েছে?
-অনেক আগে। সেই ২০১৩-তে।
-আজও ওকে ভালবাসো?
-নাহ্। একদমই না।
-তাহলে এই দাগগুলো ট্যাটুতে ঢেকে ফেলতে সমস্যা কি? এই দ্যাখো, চাইনিজ রাশিফল থেকে জন্মতারিখ অনুযায়ী তোমার ভেতরকার প্রাণী কোনটা- তা বের করে, সেটার ছবি গাঢ় নীল অমোচনীয় কালিতে তোমার হাতে এঁকে দিলে কতো সুন্দর লাগবে! ক'দিন পর মনেই থাকবে না যে, এর নীচে কিছু চাপা দিয়ে রেখেছো। দেবো নাকি এঁকে? আঁকার খরচ নেবো না যাও, শুধু কালির টাকাটা দিও।
-না থাক। তুমি অন্য কোথাও ট্যাটু করো।
-আর কোথায় ট্যাটু করবো? তোমার জন্য সেরা জায়গা ওটাই। চলো তোমার হাতের ছবিটা বদলে দিই।
-নোপ। হাতের ওপর হাতের পরশ রবে না, আমার বন্ধু-আমার বন্ধু, হবে না-হবে না, হাতের ওপর হাতের পরশ রবে না।
-এটা কি? গান?
-হুম। সুরটা সুন্দর না?
-হ্যাঁ। অনেক সুন্দর। আচ্ছা বাদ দাও ট্যাটুর চিন্তা। গানটা গাও তো আরেকটু।
-গানটা যে শিল্পী গেয়েছে, তাকে দিয়ে গাওয়ানোটাই ভাল হবে। এই যে নাও, আজকালকার যুগে সবকিছুই পাওয়া সম্ভব হাতের মুঠোয়।
-এটা কি? ফোন? আগে কখনও এমন ফোন দেখেছি বলে মনে পড়ছে না।
-এটার নাম চাইনীজ ফোন। আমাদের দেশে পাওয়া যায়। সস্তা কিন্তু অ্যান্ড্রয়েডের মতোই কাজ করে। শুধু সাউন্ড কোয়ালিটি অত্যন্ত লো।
-ঠিক, এটায় গানটা শুনে মনে হচ্ছে খুব বিচ্ছিরি, অথচ তুমি যখন গাইছিলে তখন ভালই লাগছিল।
-আচ্ছা তোমার ফোনটা দাও। ওটার কোয়ালিটি নিশ্চই ভাল হবে।
-আমার তো স্মার্টফোন নেই। পুরোনো আমলের একটা হাঙ্গেরিয়ান ফোন আছে। কাস্টমারদের সাথে টেলিফোনে যোগাযোগ রাখতে হয় বলে এটা আছে। আমি মোটেও মোবাইল ফোনের ভক্ত না।
-ওকে তাহলে তোমার কম্পিউটারে চালাও, একটা কাগজ দাও আমি নাম লিখে দিচ্ছি গানটার।
সঞ্জীব চৌধুরীর গানের নামটা লিখে দিয়ে, আমাদের হাসি আর শুভকামনা বিনিময় শেষে, আমি বেরিয়ে আসলাম পথে আবার। ডিসেম্বরের কনকনে ঠান্ডা চারিদিকে। যদিও সূর্যের আলো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে এলোমেলো। তাও ঠান্ডা লাগছেই। হাতমোজা বের করে পড়ে নিলাম। আগের দিন সন্ধ্যায় খানিক বরফ পড়েছিল। তাতেই রাস্তাটা পিচ্ছিল হয়ে আছে। স্নিকার পড়ে হাঁটার জন্য উপযুক্ত রাস্তা এটা নয়- বলে নিজেই সাবধান করলাম নিজেকে। সিগারেটে শেষ টানটা দিয়ে সেটাকে ছুড়ে ফেলে দিলাম কয়েক কদম সামনে।
মাথার ভেতর ভোঁতা একটা যন্ত্রণা অনেকক্ষণ ধরে বেজে চলছিল। আজ কাজে যাই নি। সকালে ঘুম থেকে উঠে যথাসময়ে ফোন করে জানিয়েছি যে, আমি অসুস্থ। তারপর জ্বরাক্রান্ত শরীরে আবার ঘুমিয়েছি। থেকে থেকে দুঃস্বপ্ন দেখে জেগে উঠছিলাম। স্বপ্নগুলোর কোনোটার কথাই মনে থাকছিল না। শুধু শেষ দৃশ্যটা বাদে। যেখানে আমি নিজের বুকের পাঁজরে একটা ধারালো ছুরি বসিয়ে সেটাকে টেনে যতদূর সম্ভব নিয়ে যাচ্ছিলাম। এই স্বপ্নটা আগের রাত থেকেই আমি ক্রমাগত দেখে আসছিলাম।
আজ বহুদিন প্রিয় বিষয়গুলো পড়ে আছে অযত্নে। শ্বাসনালী খুঁড়ে খুঁড়ে অতল অন্ধকারে পৌঁছে যাওয়ার উপায় ভাবা হয় না। বহুদিন ধরে ভুলে যেতে চাইছি সেই জীবনটা; যেটাকে নিয়ে এক সময় স্বপ্ন দেখেছিলাম। গভীর আনন্দে যে জীবনকে একসময় আঁকড়ে ধরেছিলাম। এতোটা নির্ভর করেছিলাম সে জীবনের ওপর যে, নিজের সবকিছু বিলিয়ে দিয়েছিলাম অবলীলায়। এমনকি ভাবনা-চিন্তাও ছেড়ে দিয়েছিলাম কেননা জানতাম যে, জীবন আমার জন্য সেটা ভেবে রাখবে। আমাকে শুধু ওর ঠিক করে দেয়া পথে চলতে হবে। নিজে নিজে একটা নতুন কিছু ঠিক করে নিয়ে এসে ওর কাজে বিঘ্ন ঘটানো চলবে না। আল্টিমেইটলি লাভও হবে না। কেননা জীবন আমাকে তার ঠিক করে দেয়া পথ ছাড়া অন্য কোনো দিকে চলতেও দেবে না।
সেই জীবনটা অবলীলায় আমায় ছুড়ে ফেলে দিয়েছিল। সে জানতো, আমি মাঝে মাঝে ওর ঠিক করে দেয়া পথে চলতে চাই না। বিদ্রোহ করি, কিন্তু দিনশেষে আবার ঠিকই ওর পথে ফিরে আসি। জানার পরও সে আমায় ছুড়ে ফেলে দেয়ার সময় একবারও আমার কথা ভাবে নি। সেই আঘাত আমার কতোটুকু যে ভেঙ্গে সাথে নিয়ে গেছে, তা কেবল আমিই জানি।
আজ যতোটুকু অবশিষ্ট আছে, তাতে খুব বেশি সৌন্দর্য খুঁজে পাওয়ার আশা করলে আহত হতে হয় বলে সেটা আর করি না। মাঝে মাঝে নিজেকে ওভাররেটিং করি ঠিকই, কিন্তু আমার আসল চেহারাটা আমি কখনও ভুলি না। তবে সৌন্দর্যের একেবারেই যে কিছু অবশিষ্ট নেই, তাও ঠিক না। হাতের কাটা দাগগুলো যেমন। ওরাই আমার সৌন্দর্য। আমি যে সত্যি একদিন কাউকে ভালবেসেছিলাম, সেটা নিয়ে তো কোনো রিগ্রেট ফিল করি না। তাহলে কেন হাতের কাটা দাগ ট্যাটুতে ঢাকতে হবে?
আজ যে জীবন আমি যাপন করছি, জানি নিজের জন্য এই জীবন আমি নিজেই বেছে নিয়েছি। ওই যে বললাম না, এক সময় ভাবনা-চিন্তাও করতাম না। কেননা সেটা করতে গিয়ে, আরেকজন যে আমার জন্য ভাবছে তার কাজে ব্যাঘাত ঘটাতে চাইতাম না। অতোখানি নির্ভরশীল হয়ে পড়ার মতো মানুষ খুঁজে পাওয়া সৌভাগ্যের ব্যাপার। সবাই পায় না। আবার এটাও ঠিক অতোখানি নির্ভরশীল হয়ে পড়ার খারাপ দিকও আছে। একটা সময় যখন আমাদের সবাইকেই ভেবে-চিন্তে কাজ করতে হয় কিংবা পদক্ষেপ নিতে হয়; তখন দেখা যায় মস্তিষ্ক যথাযথভাবে কাজ করছে না। কারণ আর কিছুই না। পর্যাপ্ত অনুশীলনের অভাব। আমার সাথে ঠিক সেই ঘটনাটিই ঘটেছিল একদিন। তারপর সেই মানুষটা, যার উদ্দেশ্যে একদিন এতোটাই নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছিলাম যে, আজ আমার ভেতর আর কাউকে দেয়ার মতো কিছুই অবশিষ্ট নেই; অনেক দূরে চলে গিয়েছিল।
এমি ওয়াইনহাউজের গানের কথাগুলোও সত্য না। আওয়ার ডে উইল কাম, অ্যান্ড উই উইল হ্যাভ এভরিথিং, উই উইল শেয়ার দি লাভ, ফলিং ইন লাভ ক্যান ব্রিং। আর কখনও ঘটবে না। ট্যাটু শপ থেকে বের হয়ে বাসায় ফেরার পথে এই কথাগুলো ভাবতে ভাবতে ক'টা সিগারেট টেনেছিলাম জানো? পাঁচ-ছটাতো হবেই। অথচ মাত্রই বিশ-বাইশ মিনিটের পথ ছিল সেটা।
ছোট ছোট বাচ্চারা এই লেখায় অনেক কুল বিষয়বস্তু খুঁজে পেতে পারে, কিন্তু সত্য কথাটা হচ্ছে- এসবের কোনোকিছুই কুল না। সিগারেট টানা কিংবা কারও কথা ভেবে এতোটা মুষড়ে পড়া, একদমই কুল কোনো বিষয় না। এসব নিয়ে লেখালেখি করা তো আরও প্যাথেটিক। বাট হু কেয়ার্স? যেসব রাতে একাধিকবার নিজের বুকে নিজেই ছুরি বসিয়ে টান দেয়ার স্বপ্ন দেখে ঘুম ভাঙে, তারপরের দিনগুলোতে 'নট কুল' টাইপের কাজ-কারবার একটু করাই যায়।
ডোন্ট ওরি লিটল ব্রাদার। ডোন্ট ওরি ফর এনিথিং এভার। একদিন তুমি শিখে যাবে, কিভাবে একা একা বাঁচতে হয়। একদিন তুমি ঠিকই শিখে যাবে, কিভাবে মুখের ওপর মানা করে দিতে হয়। ভুলে যেতে হয় আরেকজনের কথা। একদিন তুমি স্বার্থপর আর আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠবেই। সেদিন নিজের সাথে ঘটে যাওয়া অতীতের কথা ভেবে যদি হাসি পায়, তাহলে জেনো তুমি সুস্থ হয়ে গেছো। জেনো, আরও একবার স্বাভাবিক জীবনের জন্য তুমি প্রস্তুত হয়ে গেছো। নো প্রবলেমো, এনিমোর-ও।
আর যতোদিন পর্যন্ত সেটা না ঘটছে, ততোদিন সহ্য করে যাও। সুস্থ যারা, তারা তোমার সুস্থ হয়ে ওঠার পথকে কঠিন করেই রাখবে সবসময়। ওদেরকে উপেক্ষা করে সুস্থ হয়ে ওঠার চেষ্টা চালাও। শুভকামনা। আমি জানি তুমি ব্যর্থ হবে না।
---
মন্তব্য করুন