পাঠপ্রতিক্রিয়া: শাহাদুজ্জামান-‘র ‘কয়েকটি বিহ্বল গল্প’
বিহ্বলতা ব্যক্তির একটি মনস্তাত্ত্বিক অবস্থা। এবং অবশ্যই একটি সামাজিক অনুষঙ্গ। ব্যক্তি মাত্রই তার জীবনযাপনে কখনো না কখনো বিহ্বল হয়ে পড়ে। বিহ্বল তাকে হতে হয়। তবে বিহ্বলতা একটি মনোজাগতিক অবস্থা হলেও এর কার্যকরণ এবং অভিঘাত একরৈখিক নয়। রীতিমত বহুমাত্রিক। অবশ্যম্ভাবীভাবে জটিলও। বিহ্বলতার কার্যকারণ ও অভিঘাতে থাকে ভিন্নতা। এ ভিন্নতাগুলো নির্ধারিত হয় শ্রেণী, ক্ষমতা, পেশা, শিক্ষার রকমফের সহ নানা সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং অর্থনৈতিক উপাদান দ্বারা। ঘরে-বাইরের লিঙ্গীয় ক্ষমতাকাঠামোও ব্যক্তির বিহ্বল হয়ে পড়া না পড়ার এক গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক। পাঠক এ-রকম অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হবেন ‘কয়েকটি বিহ্বল গল্প’ পড়ে। মোট চৌদ্দটি গল্পের সংকলন এটি। গল্পকার শাহাদুজ্জামান এর লেখা। প্রতিটি গল্পেই শাহাদু্জ্জামানের গল্পের মানুষরা কোন না কোন পর্যায়ে বিহ্বল হয়ে পড়ে। বিহ্বল হয়ে পড়তে হয়। কিন্তু তাদের বিহ্বল হয়ে পড়ার ধরন ও কারণসমূহ অভিন্ন নয়; বৈচিত্রময়। গল্পের মানুষদের বিহ্বলতা চিত্রায়নের মাধ্যমে লেখক তুলে আনেন আমাদেরই চারপাশের বড়বেশি পরিচিত বাস্তবতাকে; তবে ভিন্ন আঙ্গিকে। ভিন্ন মাত্রায়। যেটি পাঠককে নতুন করে ভাবতে উদ্দীপ্ত করে। আবার প্রতিটি গল্পের কেন্দ্রীয় বিষয় বিহ্বলতা হলেও গল্পের উপাদান এক নয়। আলাদা আলাদা। ফলে পাঠক কখনও গল্প পড়তে পড়তে একঘেয়েমিতে আক্রান্ত হবেন না। মুক্তিযুদ্ধ, সামরিক শাসন, এনজিও উন্নয়ন, এনজিও কর্মীর জীবনযাপন, গার্মেন্সকর্মী, সন্ত্রাস, ক্ষুধা, যৌনতা, জীববৈচিত্রময়তা, সমাজরূপান্তরের স্বপ্ন দেখা তরুনের স্বপ্নভঙ্গ-এ রকম নানা বিষয় খুব সফলভাবে উঠে এসেছে গল্পগুলোতে। কিন্তু এ-সব প্রসঙ্গ উপস্থাপনায় গল্পবর্ণনার যে স্বাভাবিক গতি-প্রকৃতি সেটি খুব মনোযোগের সাথে লেখক অক্ষুন্ন রেখেছেন। যেমন ‘ডোডো পাখির জন্য নস্টালজিয়া’-য় লেখক নিরেট গল্পই বলেছেন। পাঠান্তে তবু পাঠক বুঝবেন, পাঠককে বুঝতে হবে, উন্নয়নের নামে মানুষের অতিআগ্রহ কীভাবে পৃথিবীর জীববৈচিত্র নষ্ট করেছে। করছে। প্রাণীজগতের অনেক সদস্যের বিলুপ্তির কারণ মানুষ নিজে। মানুষের আচরণ। না, লেখক এ কথাগুলো এভাবে বলেন নি। বললে গল্পের মজাটা থাকতো না। লেখক কেবল ইংগিত দিয়েছেন। কিন্তু ইংগিতটা সুস্পষ্ট। সচেতন পাঠক না বুঝে পারবেন না। বরং গল্প শেষ হলেও তার মনে জীববৈচিত্রসম্পর্কিত একটা ভাবনা জারি থাকবে।
আরেকটি গল্প- ‘মিথ্যা তুমি দশ পিঁপড়া’। একজন তরুনের গল্প। যে একসময়ের নিয়মিত মিছিলের মুখ, বিপ্লবের স্বপ্নদেখা সে তরুন, মধ্যবিত্তের টানাপোড়নের জীবনে সমাজকাঠামো রূপান্তরের বদলে নিজেই রূপান্তরিত হয়েছিল, বিদ্যমান কাঠামো দ্বারা, যোগদিয়েছিল সেনাবাহিনীতে। ব্যক্তির অবস্থা ও অবস্থানের কারণে শুধু ব্যক্তির আচরণ বদলায় না। বদলায় তার ভাষা, সংস্কৃতি, প্রকাশভঙ্গিও। অন্যভাবে বলা যায়, ভাষা কখনও রাজনীতি, অর্থনীতি ও সংস্কৃতি নিরপেক্ষ নয়। ভাষারও আছে রাজনৈতিক অর্থনীতি। ভাষারও আছে শ্রেণীচরিত্র। এ গল্পে তরুনের যে রূপান্তর, সে রূপান্তর প্রক্রিয়ায় এ-বিষয়গুলোকে তুলে এনেছেন খুবই শিল্পিত কিন্তু সুক্ষভাবে। একই গল্পে এ-তরুনের মুখে শেষের দিকে গল্পকার যে ভাষা তুলে দিয়েছেন, সে ভাষার গঠন, শব্দচয়ন, প্রকাশভঙ্গি একইবারে ভিন্ন একটি দল ও সংস্কৃতির, যা সাধারণের নয়; এমনকি শিক্ষিত সাধারণেরও নয়। যা কেবল সেনাছাউনিতে বিশেষ তত্ত্বাবধানে, বিশেষায়িত, পরিকল্পিত সামাজিকায়ন প্রক্রিয়ায় উৎপাদিত হয়। তরুনের এ পরিবর্তনটি চিত্রায়িত করতে গিয়ে গল্প বলার যে ধারাবাহিকতা- সেটা পুরোপুরিই অক্ষুন্ন থেকেছে। লেখক সেটি বজায় রাখতে সফল হয়েছেন।
‘কয়েকটি বিহ্বল গল্প-‘র চরিত্ররা আমাদের দূরের নয়। কাছের। আমাদের চারপাশে তাদের অবস্থান। গল্পের মানুষগুলো রাষ্ট্রের তো বটেই, আমাদের সমাজ, এমনকি পরিবারেরই মনে হবে। ব্যক্তির বিহ্বলতা চিত্রায়নে লেখক কতখানি সফল তার চোট্ট একটি উদাহরণ দিয়ে শেষ করছি। একটি গল্পের নাম-‘ হারুনের মঙ্গল হোক’। হারুন একজন এনজিও কর্মী। লেখাপড়া ইতিহাসে। কিন্তু দেশে এত ঐতিহাসিকের দরকার নেই। ইতিহাসবিদের চাকরিও নেই। ফলে বিশ্ববিদ্যালয় জীবন পারকরে বেকার জীবনযাপন করে সে। কোথাও চাকরি না পেয়ে এনজিওতে চাকরি নেয়। শহর ছেড়ে মফস্বলে। যেখানে ইতিহাসের কোন কারবার নেই। দরকার একাগ্র পরিশ্রমের। হারুন তার একাগ্র পরিশ্রম দিয়েই তার একটি অবস্থান তৈরি করে। কিন্তু উন্নয়ন সংস্থাটির অভ্যন্তরীণ ক্ষমতাকাঠামোয় হারুনের যে প্রান্তিকতা, সে প্রান্তিকতা-ই তার মধ্যে একটি সার্বক্ষণিক বিহ্বলতার জন্ম দেয়। হারুনের মতো একজন প্রান্তিক এনজিও কর্মীর বিহ্বলতা চিত্রায়নে লেখক যে দৃশ্যপটের অবতারণা করেছেন সেটি পাঠক কিছুতেই ভুলতে পারবেন না। গল্পের ভেতরে বর্ণনাটা এ রকম- ‘
কাঙ্খিত মিলনের প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি তখন চুড়ান্ত। এ সময় শিরিন গদির নিচ থেকে বের করে আনে তার লুকানো প্যাকেটটি। আর তখনই ঘটে যায় দুর্ঘটনা। অফিসের সিল দেয়া কনডমের প্যাকেটটি দেখেই চমকে উঠে হারুন। মুহূর্তের মধ্যে তার চোখে ভেসে উঠে ডিরেক্টরের মুখ। একটা ত্রাস এসে জমে তার বুকে। ধস নামে তার শরীরে। ব্যর্থ হয়ে যায় মিলনের সব আয়োজন। ..... .. ঘুমের মধ্যে সেদিন রাতে স্বপ্ন দেখে। ঐ অফিসিয়াল কনডমটি পরে নগ্ন অবস্থায় সংস্থার সিনিয়র প্রজেক্ট অফিসার , ইতিহাসে এম, এ হারুনূর রশীদ দাঁড়িয়ে আছে ডিরেক্টরের টেবিলের সামনে। ডিরেক্টরের মুখে লেগে আছে সে দুর্জ্ঞেয়, নীরব, মৃদু মৃদু হাসি’।
শাহাদুজ্জামানের আরেকটি গল্প সংকলন পড়েছিলাম। মাত্র কয়েকদিন আগে। নাম-‘অন্য একগল্পকারের গল্প নিয়ে গল্প’। দু’টি বই-ই পড়ে আমার মনে হয়েছে, লেখক তার গল্পের অনেক মালমশলা-ই খুঁজেনেন তাঁর পেশাগত পরিসর থেকে। ব্যক্তিগত জীবনে চিকিৎসক। কাজ করেন জনস্বাস্থ্য নিয়ে। একটি উন্নয়ন সংস্থায়। শিক্ষাকতায় নিযুক্ত হলেও জনস্বাস্থ্য বিষয়ের পরিসরেই প্রধান বিচরণক্ষেত্র। সর্বোচ্চ ডিগ্রীটা চিকিৎসা নৃবিজ্ঞানে। শাহাদুজ্জামানের গল্পের মধ্যে তাঁর পেশাগত পরিসরের নানা উপাদান ঘুরেফিরে এসেছে। এ-সব বাস্তবতা থেকে চরিত্রগুলো তুলে এনে তাকে শিল্পের আদলে শিল্পিতভাবে উপস্থাপন করতে পেরেছেন বলেই গল্পগুলো পাঠকের ভাল লাগবে। আমার ভাল লেগেছে। ‘কয়েকটি বিহ্বল গল্প’ বইটি প্রকাশ করেছে মাওলা ব্রাদার্স। মূল্য একশত টাকা মাত্র।
চমৎকার রিভিউ!
ধন্যবাদ আরাফাত।
তার গলপ আজকের সময়কে ধারন করে যেটা বেশী টানে আমাকে।
চমৎকার রিভিউ!
তাঁর গল্পের সবচেয়ে ভাললাগা দিক হচ্ছে, অন্তত আমার কাছে, তিনি গল্পের উপাদানগুলো খুজেন চারপাশে। ফলে অনেক গল্পেই তার কর্মপরিধির প্রভাব রয়েছে। কিন্তু কর্মপরিসর থেকে উপাদান খুঁজতে গিয়ে গল্পের গুণগত মানের সাথে কম্প্রোমাইজ করেন নি।
...............
পড়ে মন্তব্য করার জন্য ধন্যবাদ।
গুড ওয়ান, ক্যারি অন।
ধন্যবাদ। চেষ্টা অব্যাহত থাকবে।
মন্তব্য করুন