ইউজার লগইন

দিনের অভিজ্ঞতা ২

বিকেল ৫টায় আনুষ্ঠানিক সমাপ্তির আগে এফ আর খান অনুরোধ করে বলেছিলেন "আগামী কাল অবশ্যই সবাই সকাল ৯টার সময় উপস্থিত থাকবেন।" জাপান এরোস্পেস এক্সপ্লোরেশন এজেন্সীর সদস্যরা সবাই দুপুরের ভেতরেই ঢাকা ত্যাগ করবেন, সে কারণে আগামী কাল হাতে কলমে শিক্ষার সম্পূর্ণ বিষয়টাই দুপুরের আগে শেষ করে ফেলতে হবে।

গদাইলস্করি চালে বাসা থেকে বের হয়ে হন্তদন্ত হয়ে যখন ছুটছি তখন ঘড়িতে ৯টা ছুঁইছুঁই। পায়ে হেঁটে যতটা দ্রুত যাওয়া সম্ভব, হনহনিয়ে হেঁটে ঠিক ততটুকু দ্রুতই মাঝের পথ অতিক্রম করছি, সেকেন্ডের কাঁটা এগিয়ে যাচ্ছে, ঘড়িতে দেখলাম ৯টা বেজে ৩ মিনিট, গেটের সামনে এসে দাঁড়িয়ে গতকালের পোশাকী পুলিশকে খুঁজি, তিনি আমাকে দেখে মাথা নেড়ে জানালেন আমি চলে যেতে পারি। তারপরও যখন পৌঁছালাম তখন ৯টা ৫।

গতকাল যার সাথে পরিচয় হয়েছিলো সে একটা টেবিলে বসে আছে, হল রুমের মাঝে অনেকগুলো টেবিল, সেগুলোর পাশে ৮টা করে চেয়ার রাখা, এই টেবিলের ৮জনই আছে, আমাকে দেখে আশ্বস্ত হয়ে হাসি মুখেই মুর্শেদ বললো "আমি ভেবেছিলাম আপনি আসবেন না।"

আমি অন্য একটা টেবিল খুঁজে নিলাম। গত রাত থেকেই একটা বিষয় ভাবছি, খুব দ্রুত নোট নেওয়ার মতো করে গাণিতিক সমীকরণ সাজিয়ে দেখলাম সমাধান করবার কোনো উৎসাহ নেই ভেতরে, একটা টেবিলে একা মাথা গুঁজে বসে আছি। অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার কোনো নামগন্ধ নেই।

সবাই এখনও উপস্থিত হতে পারে নি, তার চেয়ে বড় সীমাবদ্ধতা হলো যেসব বিষয় দিয়ে আমাদের হাতে কলমে শিক্ষা দেওয়া হবে সেইসব শিক্ষা উপকরণ এখনও সভাস্থলে এসে পৌঁছে নি। সুতরাং আমার হাতে করার মতো কিছু নেই, নভোথিয়েটারে আমি আগে কখনও আসি নি, ভেতরটাতে চোখ বুলিয়ে দেখছি, না এসে কি কি হারানোর সম্ভবনা ছিলো জীবনে?
হল রুমের বাম পাশের সিঁড়ির সামনে রোলার কোস্টারের বিজ্ঞাপন, টিকেট ছাড়া নীচতলায় প্রবেশ নিষেধ। মাটি থেকে আরও নীচে ৩টি তলা বানানোর প্রয়োজন কি আমি জানি না, তবে বাস্তবতা হলো বঙ্গবন্ধু নভোথিয়েটার আর ঢাকার পুরোনো বিমানবন্দর রাস্তার এপার ওপার। এসব স্থানে ৬০ ফুটের বেশী স্থাপনা নির্মাণ নিষিদ্ধ। যেকোনো ভবনই ছয় তলার চেয়ে উঁচু হতে পারবে না। সেই আইনের গ্যাঁড়াকলেই র‌্যাঙ্গস ভবনের সম্পূর্ণটাই ভেঙে ফেলতে হয়েছিলো। কিন্তু নভোথিয়েটারের প্লানেটোরিয়ামের শীর্ষ ৭০ কিংবা ৮০ ফুট উঁচু তবে সরকারী ভবন সরকারী নিয়মের বরখেলাপ করলেও সেটাকে অবৈধ ঘোষনা কিংবা ৬০ফুটের উপরের অংশ ভেঙে ফেলবার কোনো নির্দেশনা রাজউকও দিতে পারে না।

যেহেতু উপরে বাড়তে পারবে না, হয়তো সে কারণেই এই ভবনটি মাটির গভীরে শেকড় মেলেছে। ডান দিকে সামান্য আগালে সৌরজগতের রেপ্লিকা। বেশ বড় মাপের। ছাদের উপর থেকে শোলার তৈরি পৃথিবী, বৃহঃস্পতি, শনি ইউরেনাস নেপচুন আর প্লুটো ঝুলছে, কিন্তু সূর্যের দেখা নেই। সূর্যের খোঁজে আশেপাশে হাঁটি, একটু পর দেখলাম প্রেমের দেবি ভেনাসের সম্মানে নামকরণকৃত শুক্র গ্রহের কোনো খোঁজ নেই, নভোথিয়েটার থেকে প্রেম পালিয়েছে শুধু একটা শূণ্য সুতো ঝুলছে উপর থেকে। একই অবস্থা মঙ্গল গ্রহের ক্ষেত্রে। মাত্র নয় সদস্যের সৈর জগতের এক তৃতীয়াংশই অনুপস্থিত এই বাজারে। প্রেম নেই, মঙ্গল নেই এমন কি কোনো আলো নেই, সূর্য ও আলোবিহীন এই নভোথিয়েটারের অন্ধকারে আমাদের ভবিষ্যত সময়টা কাটাতে হবে।
আমি ইতস্তত পদচারনা বন্ধ রেখে আবার ফিরে আসি টেবিলের কাছে, এসে অবাক হয়ে দেখলাম টেবিলে আরও ৩জন মেয়ে বসে আছে। আমি তাদের দিকে না তাকিয়েই নিজের ব্যাগ খুলে দেখলাম, সন্দেহের বশবর্তী হয়ে এমন না, ইদানিং ভীষণ চাপে আছি সে কারণেই স্ফীতবক্ষ পুরুষের সাথেও কথা বলি না।

কোনো কাজ খুঁজে না পেয়ে বাইরে গিয়ে বিড়ি সিগারেটে টানবো ভাবলাম, মন্ত্রীআগমণের চাপে নভোথিয়েটারের গেট থেকে হারিয়ে যাওয়া সিগারেটের দোকান আবার ফিরে এসেছে। মন্ত্রীরা এদেশে রাজসিক জীবন যাপন করেন, তাদের গাড়ীবহরের সামনে পেছনে দুটো পুলিশের ভ্যান ছুটে, রাস্তার সকল গাড়ীকে থামিয়ে মন্ত্রী রাস্তা অতিক্রম করেন, সকাল নয়টায় যখন সমস্ত শহরটাই নাকে মুখে খেয়ে চোখে অন্ধকার দেখে দৌঁড়াচ্ছে তখনও মন্ত্রীর বাইরে যাওয়ার সময় হলে রাস্তার দুপাশের গাড়ীর বহর ১০ মিনিট আটকে রাখা ট্রাফিকের পবিত্র কর্তব্য। তিনি আসবেন, সে কারণে নভোথিয়েটারের গেটের সামনে কোনো কহুচরা সিগারেট বিক্রেতা ছিলো না, শরীর সচেতন নরনারীদের ২টাকায় নিজের ওজন সম্পর্কে জানিয়ে দেওয়া ব্যবসায়িও উপস্থিত থাকতে পারে নি মন্ত্রীর আগমনে তটস্ত পুলিশের দাবড়ানি তে। সিগারেট শেষ করে ফিরে দেখলাম ৮টা চেয়ারই দখল হয়ে গিয়েছে, আমার ব্যাগের কোনো হদিশ নেই, ৮জন মেয়ে বসে বসে গল্প করছে আর আমি তাদের সামনে বোকার মতো দাঁড়িয়ে ভাবছি বাক্যালাপের সূচনায় নাটকীয় ভাবে "আমার ব্যাগ কই লুকিয়ে রেখেছেন " বলাটা কতটুকু শোভন হবে?

আমাকে মনে রেখেছেন অন্তত একজন, ও আপনি এসেছেন, এই উনাকে সিট ছেড়ে দাও,
পাকা চুল দাড়ি নিয়ে ইদানিং বেশ বিব্রত হলেও এইসব ক্ষণিক সম্মান খুব একটা খারাপ না। আমার একটা ব্যাগ ছিলো, আমি বাক্যালাপের সূচনা করলাম।
ব্যাগটা মাটি থেকে তুলে আমাকে দেওয়াও হলো, আমি ৮জনের টেবিলে ৯ নম্বর হিসেবে বসে থাকলেম। অন্য কোথাও চলে যাওয়া অশোভন, অসম্মানজনক না কি অপমানসূচক হবে বলা মুশকিল।

আমার পাশে বেশ সুন্দরী যে বসে আছে তার নাম লাবনী, শের এ বাংলা হাই স্কুলের ভুগোলের শিক্ষক। তার নানি শ্বাশুড়ি এবং দাদা শ্বরুর মারা গিয়েছে মাত্র ২ সপ্তাহের ব্যবধানে, এসব নিয়েই কথা চলছে। ভাবলাম সবাই পূর্ব পরিচিত, একটা স্কুল থেকে এতজন আসতেও পারে এইসব প্রশিক্ষণে।

আজ আমাদের রকেট বানানোর কথা, হাতে কলমে রকেট বানিয়ে আমরা শিখবো এবং আশা করা যায় ভবিষ্যতে আমরা আমাদের ছাত্রদের রকেট বানিয়ে দেখাবো এবং তাদের বিজ্ঞান শিক্ষায় উৎসাহিত করবো। শিক্ষাউপকরণ এসে পৌঁছেছে, সুতরাং যেকোনো মুহূর্তেই শুরু হয়ে যাবে এটা। করিৎকর্মা স্বেচ্ছাসেবীরা বুকলেট আর কাগজের টুকরো ধরিয়ে দিচ্ছে, আমি মনোযোগ দিয়ে নিজের বুকলেট খুলে দেখি কি রহস্য লুকানো শেখানে। ১০টা সহজসাধ্য উড়ানোর মডেল, হট এয়ার বেলুন, রকেট আর ঘুড়ি, শেষেরটা কিভাবে কয়েকটি বৃক্ষের বীজ বাতাসে ভেসে অনেকটা দুর চলে যায় তার একটা মডেল। মেহগনির ফল ফেটে গেলে বীজটা ঘুরতে ঘুরতে মাটিতে পড়ে, গাছ থেকে সামান্য দুরেই, এভাবেই অন্য কোনো সক্রিয় সঞ্চালক না থাকলেও গাছের বীজ অন্যত্র চলে যেতে পারে।

সেটা করবার উপকরণ দিয়ে গিয়েছে, আমি নিজের মতো করেই সেটা বানানো শুরু করলাম, টেবিলের ৮জনের ৩জন উচ্চমাধ্যমিকের পরে বিজ্ঞান নিয়ে পড়েছে এবং বাংলাদেশের অর্ধেকের বেশী মানুষের মতো তাদেরও যন্ত্রভীতি এবং ব্যবহারিক পরীক্ষা ভীতি আছে। আমারও একদা এসব সীমাবদ্ধতা ছিলো, তবে ইদানিং সেইসব ভয়কে অতিক্রম করেছি, খুব বেশী হলে বিষয়টা নষ্ট হবে হয়তো হাজার টাকার ক্ষতি হবে কিন্তু এই হাজার টাকার ভয়ে নিজেকে বিরত রাখবার কোনো প্রচেষ্টা এখন আমার নেই।

প্রশিক্ষণ শুরু হলো, আমি প্রশিক্ষণের বাণী বলবার আগেই মডেল বানিয়ে পরীক্ষা করে দেখেছি, পড়বার সময় সেটা ঘুরতে ঘুরতে পরে, আর বাতাসে ভেসে পথ অতিক্রম করবে কি না সেটা যাচাই করে দেখবার কোনো উপায় নেই, টেবিলের অন্য সবাইকে শেখানোর বিনিময়ে সম্পর্কটা সহজ হয়ে গেলো। এমন জিনিষ আমরা স্কুলেও বানিয়েছি খেলার ছলে কিন্তু কখনও এটার শিক্ষণীয় দিকটাকে আমলে আনি নি। অধিকাংশ সাধারণ ঘটনারও একটা বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা আছে, সেটা আকর্ষণীয় কিন্তু অধিকাংশ সময়ই মোহিত হওয়ার বাইরে বিশ্লেষণের ঝোঁকটা আমাদের কম।

ওয়াটার রকেট ছিলো আমার মূল আকর্ষণ, কিন্তু সেটা তৈরি করার কোনো পরিকল্পনা আজকে নেই, অন্য যেকয়টি হাতে কলমে দেখানো হবে সেসব করেই সময় অতিক্রম করা। শিক্ষা উপকরণে সেসব জিনিষ সাজিয়ে আনা হয়েছে সেসবের অধিকাংশই ছাপানো। গতকাল একজন প্রস্তাব করেছিলো যদি বাংলাদেশের খেলনা নির্মাতাদের এসব দেখিয়ে দেওয়া হয় তাহলে তারা এইসব বৈজ্ঞানিক খেলনা তৈরি করে দিতে পারবে। আমাদের জিঞ্জিরার সাধারণ অনুসন্ধিৎসু মানুষেরা বড় বড় পাশ দেওয়া ইঞ্জিনিয়ারের চেয়ে ব্যবহারিক বিবেচনায় এগিয়ে। তারা বাতাসের চাপ ও গতি ব্যবহার করে অনেক ছোটোখাটো খেলনা বানিয়ে ফেলেছে ইতিমধ্যই। সেসব খেলনার বিপনন এখনও স্কুলের ব্যবহারিক ক্লাশে হচ্ছে না কিন্তু খেলনার নেপথ্যের কারসাজিটুকু বুঝতে আমার ভালো লাগে।

দুপুরের আগেই প্রশিক্ষণ শেষ, সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়ার পর জানলাম লাবনীর একটা মেয়ে আছে, সে স্কুলে যায়, ভবিষ্যতে ইংরেজী মাধ্যমের কোনো স্কুলেই তার মেয়েকে ভর্তি করবার ইচ্ছা কিন্তু ইংরেজী মাধ্যমের মেয়েদের " নৈতিকতা" বোধ নীচে, ইদানিং মোবাইল ফোনের ক্যামেরায় বিভিন্ন মেয়েদের ন্যাংটা ছবি কিংবা ভিডিও করবার তীব্র প্রতিযোগিতায় হয়তো গ্রাম এবং শহরের ব্যবধান নেই তেমন কিন্তু এরপরও সাধারণের ধারণা বাঙ্গালী মধ্যবিত্তের মূল্যবোধ এসব আচরণ থেকে ছেলে মেয়েডের বিরত রাখে, সে কারণেই ইংরেজি মাধ্যমের ছেলে মেয়ে আর প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির ছাত্ররাই এইসব আকাম-কুকাম করে বাঙ্গালী সংস্কৃতির ১২টা বাজাচ্ছে। প্রেম করে বিয়ে করেছে, গভীর প্রেমের বিয়ের পরবর্তীতে এখন প্রেম আছে কি না বুঝতে পারছে না। অতীতে প্রেমের সময়ে " আমি একদিন তোমায় না দেখিলে পরান আমার রয় না পরাণে" গানটা এখন জামাইয়ের জাতীয় সঙ্গীত নেই, বরং এখন জামাই নিজের জীবন নিয়ে ব্যস্ত, অফিস থেকে ফিরে এসে জানতেও চায় না "সারাটি দিন তোমার কেমন গেলো, বলো কেমন ছিলে সারা দিন"।

দিনের কার্যক্রম শেষ এরপর সনদ বিতরণের পালা। সনদ পাওয়ার জন্য অপেক্ষা করছি না আমি, কিন্তু অনুষ্ঠানের শেষটুকু কি হয় সেটা জানতেই বেশী আগ্রহী। আমার সাথে যারা বসেছে তারা সবাই টিচার্স ট্রেনিং ইনস্টিটিউটের ছাত্র-ছাত্রী। শিক্ষকতা বিষয়ে নিয়মিত প্রশিক্ষণের অংশ হিসেবে তারা এখানে এসেছে, তারা স্বদেশী এবং বিদেশী শিক্ষাপ্রদানের মানের তুলনা করতে পারবে নিজস্ব অভিজ্ঞতায়, সুতরাং লাবনী মুখ খুললো, ওদের দেখেই বুঝা যায় ওরা কেনো এত উন্নতি করেছে। বাচ্চাদের শেখানোর জন্য এত আকর্ষণীয় ভাবে বিষয়বস্তুর উপস্থাপনের কথা বাংলা মাধ্যমে ভাবাই যায় না। আমি স্কুলে গিয়ে ছেলেদের এটা পড়াবো কিভাবে। ওদের কতটুকু প্রয়োজন হবে? আমরা আছি আমাদের নিয়ে। রাজনীতিতে এরসাথে গালাগালি আর আমরা যারা সাধারণ মানুষ তারা নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত, অন্য কারো কথা ভাববার মতো সময় কোথায় আমাদের?

কথাটা ফেলে দেওয়ার মতো না। শিক্ষা একটা সামাজিক বিনিয়োগ, রাষ্ট্র তার নিজস্ব প্রয়োজনেই শিক্ষা ব্যবস্থাকে চালু রাখে, এই প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থাই তার দৈনন্দিন কর্মপরিচালনা করবার প্রয়োজনীয় কর্মচারীদের সরবরাহ অক্ষুন্ন রাখে। প্রয়োজনীয় দক্ষ মানুষের সরবরাহ নিশ্চিত করতে রাষ্ট্র এসব ক্ষেত্রে বিনিয়োগ করে নিজের মানবসম্পদ উন্নয়নের বন্দোবস্ত করতে পারে, কিন্তু বাংলাদেশে মানবসম্পদ নির্মাণের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় উদাসীনতার অভিযোগ নতুন না।

বাংলাদেশের বর্তমানের বিজ্ঞান শিক্ষার অনীহা হয়তো এটা দুর করবে না সফল ভাবে কিন্তু হয়তো এভাবেই একটা নতুন সূচনা হতে পারে। আমাদের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের ঝড়ে যাওয়া রোধ করতে কোঁচরে চাল বেধে তাদের বিদ্যালয়ে আটকে রাখবার একটা উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এমন কি অনেকগুলো প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দুপুরে খাওয়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, দারিদ্রতার কারণে যারা স্কুল ত্যাগ করতে বাধ্য হয় এই বন্দোবস্তে তারা হয়তো স্কুলে যাবে কিন্তু গৎবাধা মুখস্ত করবার রীতি ভেঙে নিজেদের সৃজনশীলতার ব্যবহার করতে শিখবে না।

স্বদেশী স্কুল আর বিদেশী স্কুলের শিক্ষা পাঠ্যক্রমে হয়তো খুব বেশী ব্যবধান নেই, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে সবাই একই পাঠ্যক্রম অনুসরণ করছে কিন্তু সৃজনশীলতাহীন আমাদের বাংলা মাধ্যমের শিক্ষা ব্যবস্থা এবং বাংলা মাধ্যমেই শিক্ষিত শিক্ষকদের দিয়ে পরিচালিত ইংরেজী মাধ্যমে অধ্যায়ন করা আমদের স্বদেশী ছাত্রেরা অন্য সবার চেয়ে পিছিয়ে পড়েছে।

শ্রেণীকক্ষে যেকোনো বিষয়ের উপস্থাপনের আনুসাঙ্গিক উপকরণ হয়তো তেমন কঠিন না বানানো, কিন্তু সে উদ্যমটুকু আমাদের শিক্ষকদের অনুপস্থিত কিংবা জীবিকার টানে ও চাপে আমাদের শিক্ষকেরা নিজেদের সৃজনশীলতার সেই ব্যবহারটুকু শিকেয় তুলে রেখে স্কুলের ঘন্টা বাজলেই নিজের কোচিং সেন্টারের দরজার তালা খুলেন। অনেকেই এটাকে উপভোগ করেন না কিন্তু স্কুল কলেজ থাকলে ছাত্র থাকবে আর ছাত্রের সাথে প্রাইভেট ট্যুইশন, মাস গেলেই বেতন আর ব্যচের সংখ্যা গুণে জীবন দুর্বিষহ করে ফেলছেন।

অথচ আমাদের চারপাশের জীবনেই অনেক উপকরণ ছড়িয়ে আছে, ছোটো বেলায় উড়ানো ঘুড়িতে কামান্নি লাগাতো সবাই, ঘুড়ি একদিকে ঝুঁকে পড়লে অন্য দিকে সামান্য একটুকরো কাগজ লাগিয়ে ভারকেন্দ্র মাঝামাঝি রাখার এই সহজ বিষয়টি শিক্ষকেরা হয়তো উপস্থাপন করতে পারতেন, বেলুন কেনো উপরে উঠছে, কিভাবে বেলুন চুপসে যায় এইসব বিষয়গুলো উপস্থাপন করলে ছাত্ররা মুখস্ত না করে অন্তত আশেপাশের বিষয়গুলো নিয়ে ভাবতে পারতো।

আমাদের শিক্ষাঙ্গনগুলোতে আমরা হয়তো আইসিটি ব্যবহার করতে পারবো না, প্রোজেকটর আর পাওয়ার পয়েন্ট স্লাইডে আর ভিডিওতে অনেক কিছু উপস্থাপন করতে পারবো না। সেইসব ছবি আর ছায়াছবির বিকল্প হয়ে উঠতে পারে আমাদের ভাষ্য- কিন্তু ঘটনার ধারাবর্ণনার কৌশল কি আমাদের শিক্ষকেরা রপ্ত করছেন?

প্রতি পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার সাথে শিক্ষাপ্রদানের বিষয় ও উপস্থাপন কৌশল বদলে ফেলে রাষ্ট্র। সামান্য সাইকেল, সাঁতার এবং নিজের ভারসাম্য বজায় রেখে জীবনযাপনের প্রতিটা মুহূর্তে আমরা নিজের অভিজ্ঞতা থেকে কান্ডজ্ঞান থেকে যেসব অনুশীলণ করছি সেসব কিছুর বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা আছে, সেই পঠের সন্ধান না দিয়ে নোট আর চোথা ধরিয়ে আমরা যা তৈরি করছি সেটা হয়তো আমাদের মানব সম্পদকে রাষ্ট্রীয় দায়ে পরিণত করছে।

সব কিছুর চুড়ান্ত বিবেচনা হয় আদতে অর্থনীতিতে, আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার সবচেয়ে বড় ত্রুটি এখানে শিক্ষকেরা যে সম্মানি পান তাতে ভদ্রস্ত জীবন যাপন নেহায়েত অসম্ভব, সে কারণেই তারা কেউই শিক্ষকতার সম্মানী নিয়ে আনন্দিত নন, শিক্ষকতা উপভোগ করেন না। যেখানে একজন প্রাথমিক শিক্ষক কোনো মতে ক্লাশ শেষ করে ক্ষেতে দৌড় দেন লাঙল চালাতে সেখানে বিদ্যা মহান ধন বলবার বিলাসিতা নেই। সে কারণেই সেমিনার শেষ করে গেটের কাছে দাঁড়িয়ে থাকা শিক্ষকের কথাটা আঘাত করলো নিজেকেই-

আপনি কি টাকা পেয়েছেন?
আমি তার দিকে তাকিয়ে বুঝতে চেষ্টা করলাম প্রশিক্ষণের বিনিময়ে কেউ নগদ সম্মানী প্রদান করে কি না।
তার সাথে তার দুই সন্তান দাঁড়ানো। তিনি বললেন যারা অংশগ্রহন করবে তাদের সবাইকে টিএ ডিএ দিবে বলছিলো, সেটা কি দিয়েছে, জানেন?

আমি সে খবর রাখি না। শিক্ষকতার মাণোন্নয়নের জন্য প্রশিক্ষণের শেষে যখন শিক্ষকের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে তার সাম্ভাব্য টিএডিএ বাবদ প্রাপ্ত ২০০টাকা, সেই পরিস্থিতিতে যুগোপযোগী আ্ন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন শিক্ষা ব্যবস্থা ও উন্নত বিশ্বের মতো মানব সম্পদ উন্নয়ন মূলক শিক্ষা কার্যক্রম অব্যহত রাখবার স্বপ্ন বিসর্জন দিলেও কোনো ক্ষতি নেই

পোস্টটি ৯ জন ব্লগার পছন্দ করেছেন

নুশেরা's picture


আমাদের সময় বিজ্ঞান বইতে 'এসো নিজে করি' বলে একটা কিছু ছিল, ওটাকে ছাত্ররা বলত 'এসো কেটে পড়ি'

লেখাটা খুব ভালো লাগলো। শেষটুকু বড় কঠিন সত্য।

নাম নাই's picture


'এসো নিজে করি' টা একটা জিনিস ছিল! আমি খুবি আগ্রহ নিয়া পড়তাম এইটা, টেস্টটিউব, বার্নার আরো কি কি জানি থাকত, আমার কাছে এইগুলি ছিল মহাআশ্চর্যের বস্তু, বুঝতাম-ও না এইগিলি কই পাওয়া যায়! একবার এইটাতে বোধহয় একটা প্যাকেটে কইরা দুইটা কুমড়ার বিচি দেয়া হইছিল গাছ লাগাবার জন্য...আমার মনে আছে আমি জীবনে প্রথম টেক্সটবুকে প্যাকেট করা একটা জিনিষ পাইছি, তাও আবার এইটাতে কোনো আজব অপরিচিত কিছু লাগেনা, তাই মহা উৎসাহে টবে চাষাবাদ শুরু করলাম। কিন্তু সরকারী জিনিষ মোটামুটি সব-ই অকম্মা, ৬ মাস পরেও যখন কুমড়া গাছের দেখা নাই, তখন মনের দুঃখে চাষবাস বিসর্জন দিয়া টেক্সট বই খুইলা 'পরীক্ষার পড়া' পড়তে লাগলাম। সেই কুমড়া গাছের দুঃখ আমি এখনো ভুলতে পারিনাই, বাচ্চা বয়সেই বিশাল দাগা Sad

ভাস্কর's picture


ঐ ২০০ টাকা'ই হয়তো ঐ শিক্ষকরে জন্য মাস শেষে কাজে লাগবো...সরকারী বা বেসরকারী বাংলা মাধ্যমের শিক্ষকগো পরিবার খুব ভালো চলে না। যারা কোচিঙে পসার পাইছে তাদের ক্ষেত্রে হয়তো ভিন্ন কথা...

তানবীরা's picture


লেখাটা অত্যন্ত ভালো। সত্য, কঠিন আর সুন্দর।

ভালো থাকবেন। পরের পর্বগুলোর অপেক্ষায় রইলাম।

রাসেল's picture


আর কোনো পর্ব নাই, সেমিনার শেষ, আমি হাতে সনদ নিয়ে বাসায় ফেরত আসছি।

মন্তব্য করুন

(আপনার প্রদান কৃত তথ্য কখনোই প্রকাশ করা হবেনা অথবা অন্য কোন মাধ্যমে শেয়ার করা হবেনা।)
ইমোটিকন
:):D:bigsmile:;):p:O:|:(:~:((8):steve:J):glasses::party::love:
  • Web page addresses and e-mail addresses turn into links automatically.
  • Allowed HTML tags: <a> <em> <strong> <cite> <code> <ul> <ol> <li> <dl> <dt> <dd> <img> <b> <u> <i> <br /> <p> <blockquote>
  • Lines and paragraphs break automatically.
  • Textual smileys will be replaced with graphical ones.

পোস্ট সাজাতে বাড়তি সুবিধাদি - ফর্মেটিং অপশন।

CAPTCHA
This question is for testing whether you are a human visitor and to prevent automated spam submissions.