ইউজার লগইন

বিচ্ছিন্ন শতদল, বিক্ষিপ্ত জলরাশি

ক্রিং ক্রিং

-ইপি আপু?
কই তুমি?
-গ্যারেজে। গানজা খাই।
ওয়াক! সারাদিন যখনই ফোন করি তখনই কেন তুমি গ্যারেজে গানজা খাও?
-কারণ আপনি ফোন করে এটা শুনলে একটু ধমকান তাই।
কেন? ধমকানোর লোক কই গেছে?
-ওর কি আর ধমকানোর টাইম আছে? উন্নতির ট্রেন ছুটে যাবে তো।
তো তোমার কি উন্নতি করতে ইচ্ছা করে না?
-করে। সেই জন্যই তো ক্ষুধার্ত আর বোকা থাকি।
কিন্তু সেইটা তো শুধু এক্সট্রা অর্ডিনারী মেরিটওলা'দের জন্য। তোর মতো বলদ কি খালি কি ক্ষুধার্ত আর বোকা থাকলে চলে?
-কিন্তু আমার ইনটিউশন যে আমাকে সেরকমই থাকতে বলে।
ইনটিউশন না রে গাধা। অলস মন। ও সবসময়ই মানুষকে আলসেমী করার বুদ্ধি দেয়। ওর কথা শুনলে জীবনে উন্নতি করতে পারবি না।
-আচ্ছা না পারলে অসুবিধা নাই। আপনের কি অবস্থা? এত সকালে ফোন দিলেন যে?
এমনি ফোন করলাম। তোকে ফোন করতে আবার কারণ লাগবে নাকি রে পাগলা?
-তা অবশ্য লাগবে না। চলেন আজকের কড়কড়ে রোদে সারাদিন বেড়াই।

জানতাম ইপি আপু প্রথমে রাজি হবে না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত রাজি হবে। উনি এই জীবনে আমার কোনো কথা শেষ পর্যন্ত ফেলতে পারেন নি। আজকেও পারার কোনো কারণ নেই। আমার যখন ৩-৪ মাস বয়স তখণ থেকে উনি আমাকে চেনেন। অবশ্য উনারও তখন বয়স খুব বেশি না। ২-৩ বছর। তখন থেকে উনি আমাকে নিয়ে খেলেন। সকাল ঘুম থেকে উঠে কিছুক্ষণের মধ্যে মা আমাকে পাশের বাসায় রেখে না আসলে সেখান থেকে নাকি ভুবনকাঁপানো কান্নার শব্দ ভেসে আসা শুরু হতো। আমরা দু'জন একদম একসঙ্গে বড় হয়েছি। একই স্কুলে পড়াশোনা করেছি। একই কলেজেও। একই বিশ্ববিদ্যালয়ে না শুধু। ওখানেই সমস্যাটা হয়ে গেছে। বিশ্ববিদ্যালয় জীবন শেষ করে আবিস্কার করলাম, আমরা আসলে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছি। আমাদের ভেতরে আরো দুই জন। দুই পক্ষে। অথচ তাদের ঢোকার কোনো কারণই ছিলো না। আমরাই ছিলাম আমাদের প্রথম প্রেম। আমরা সেটা যথাসময়ে বুঝতে ব্যর্থ হয়েছিলাম।

তবে এতে আমাদের চিরাচরিত সম্পর্কে কোনো টান পড়ে নি। একটা ভালো বন্ধুত্বের চেয়ে বড় সম্পর্ক খুব কমই আছে পৃথিবীতে। আমাদের সেই সম্পকর্টা আজো পরিচিতদেরকে ভাবিয়ে তোলে।

আমি দ্রুতবেগে হাতের গানজাটা টেনে শেষ করলাম। তারপর ইপি আপুদের বাসার নিচে চলে গেলাম। দুলাভাই নাই। বিদেশে গেছে। অফিসের কাজে। দুই লাফে ইপি আপুদের ফ্ল্যাটের সামনে গিয়ে অনবরত কলিং বেল বাজানো শুরু করলাম। উনি দরজা খুলতেই কোনো কথা না বলে ভেতরে ঢুকে উনাকে জাপটে ধরলাম এবং ধরেই চারবার ৩৬০ ডিগ্রি প্রদক্ষিণ করলাম। উনাকে শূন্যে তুলে ফেলে। উনি বোধহয় জানতেন, আমি এমন করবো। তাই রিনঝিনে হাসি আর 'ছাড় ছাড় বদ্মাইশ' বলে কিছু কপট ধমকানি ছাড়া কিছু দিলেন না আমায়। আমিও আর কিছু চাইলাম না। তাকে ছেড়ে দিয়ে দুলাভাইয়ের নতুন কেনা দেড় লাখি সোফাটায় হাত-পা ছড়িয়ে শুয়ে পড়লাম।

আমার হাত থেকে ছাড়া পেয়ে ইপি আপু ভেতরের কোনো একটা ঘরে দৌড়ে চলে গেলো। উনি কালো একটা জিন্স আর শাদা একটা শার্ট পড়েছিলেন। উনার আবার জিরো ফিগার। বহু কষ্ট করে মেনে চলেন। চেহারায় এমন একটা কাটা কাটা ভাব আছে যে কেউ একবার দেখলে খানিক সময় চেয়ে থাকবেই। আমি ১০ মিনিটের একটা পাওয়ার ন্যাপ শেষ করার আগেই পুরো ঘরে খুবই ফ্রেশ একটা গন্ধ ছড়িয়ে হাজির হলেন ইপি আপু।

উনাকে সঙ্গে নিয়ে বের হওয়ার একমাত্র সমস্যা রাস্তায় সবাই উনার সঙ্গ পেতে চায়। কেউ চোখে চোখে, কেউ আশেপাশে থেকে যার পক্ষে যেভাবে সম্ভব হয়। বিষয়টায় আমরা অভ্যস্ত বলে বেশি চিন্তিত হই না। আর এসব ঠেকানোর উপায়ও আমাদের খুব একটা অজানা না। মাঝে মাঝে আমি ভাবি, দুলাভাই এমন একটা মেয়েকে শিংটোলার এ পুরান বাড়িতে বন্দি করে রেখে দিনের পর দিন চীন-জাপান ঘুরে বেড়ান কিভাবে? একটুও কি দুশ্চিন্তা হয় না?

আমাদের গন্তব্য খুব বেশিদূর ছিলো না। বুড়িগঙ্গার পাশ দিয়ে নতুন রিং রোড হয়েছে। চালু হয় নাই এখনও। সেই কারণেই রিং রোডটা ছিমছাম, নির্জন। ঘুরে অনেক মজা পাওয়া যায়। আমরা অনেকক্ষণ পর্যন্ত নদীর পার ধরে ধরে হাঁটলাম। ওদিকটায় পানিতে গন্ধও খুব একটা নেই। একটু পর পর বড় বড় কাঠ-চেরাইয়ের কারখানা। সেগুলোর নামও খুব সুন্দর। কুশিয়ারা স-মিল, তুরান কাঠকল। আরো অনেক নাম আছে। বড় বড় গাছকে মেশিনে ঢুকিয়ে দেয়া হচ্ছে। সেগুলো কিছুক্ষণের মধ্যেই কাঠের গুড়ি হয় বের হচ্ছে। আমরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছি আর হাসছি। দুলাভাই গতবার বিদেশ থেকে আসার সময় একটা নাইকন ডিথ্রি এনেছিলেন ইপি আপুর জন্য। ওইটার ওপর দিয় ঝড় বয়ে যাচ্ছিলো।

আর বয়ে যাচ্ছিলো সময়। বিকাল ৪টা যে কোনদিক দিয়ে পার হলো, টেরই পেলাম না। হঠাৎ একবার ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি বেজে গেছে। আর তখনই ক্ষুধা লাগা শুরু হলো। খুঁজতে লাগলাম দোকান-পাট। শেষ পর্যন্ত খাবারের আশায় আমাদেরকে আবার লোকালয়ে ফিরতে হলো। মিলব্যারাক মোচড়ে, গেন্ডারিয়া থানাটার ঠিক সামনে একটা বিরিয়ানীর দোকান আছে। আল্লাহর দান বিরিয়ানী হাউস। অসময়ের জন্য খুব ভালো অপশন। দু'জনে দুই হাফ বিফ তেহারী এক লহমায় শেষ করে ফেললাম। সঙ্গে শুধুই পেয়াজ আর কাঁচামরিচ। আর তারপর একটা হাফ লিটার ঠান্ডা কোক হাতে রওনা দিলাম পোস্তগোলার দিকে। আমাদের ঘোরা যেন শেষই হচ্ছিলো না।

আইজি গেট, ফরিদাবাদ, পোস্তগোলা ক্যন্টনমেন্ট এলাকাগুলোর সামনে দিয়ে পার হওয়ার সময় আমাদের দু'জনেরই খুব ভালো লাগছিলো। একজন আরেকজনের হাত ধরে রেখে ছিলাম খানিকটা সময়। তারপর একসময় পোস্তগোলা ব্রীজ পার হয়ে ফতুল্লা-পাগলা মহাসড়কে আমরা উঠে গেলাম। নির্জন মহাসড়কে মাঝে মাঝেই দু'একটা বিশাল বাহন আমাদের ভয় দেখিয়ে পার হচ্ছিলো, আর আমরা তখন একজন আরেকজনের হাত খুব শক্ত করে চেপে ধরছিলাম।

আমার কাছে কয়েকটা বানানো গাঁজার শলাকা ছিলো। সেগুলোর একটিতে আগুন ধরাতেই ইপি আপু কপট চোখে তাকালো। আমি তাকে শলাকায় দুই টান দেবার প্রস্তাব করলাম। সে খুব তাচ্ছিল্যভরে প্রত্যাখ্যান করলো। আমি তাকে দেখিয়ে দেখিয়ে শলাকাটা টানতে থাকলাম। আর আহা-উহু করে সেটার গুণমান প্রকাশ করতে থাকলাম। দেখে এক সময় রেগে-মেগে ইপি আপু শলাকাটা টান দিয়ে নিয়ে নিলো এবং রাস্তার পাশে ধূলিময় ফুটপাথে নিক্ষেপ করলো। অবশ্য তার আগেই ওই শলাকাটায় টানার মতো যা কিছু অবশিষ্ট ছিলো, তা আমি টেনে আমার ফুসফুসে নিয়ে নিয়েছিলাম।

ইপি আপুর সঙ্গে অনেকক্ষণ গাঁজা খাওয়া নিয়ে তর্ক হলো। তিনি অবশ্য শক্ত কোনো যুক্তি দেখাতে পারলেন না সেটা না খাওয়ার পক্ষে। বরং আমি যখন বললাম গাঁজা আসলে এখন একটা অভ্যাসে পরিণত হয়েছে, তখন উনি আমার কথাই মেনে নিলেন কি যেন মনে করে। তারপর উদাস হয়ে মহাসড়কের দুই পাশের বিস্তৃর্ণ ফাঁকা জায়গা, কল-কারখানা ইত্যাদি মনোযোগসহ পর্যবেক্ষণ শুরু করলেন।

আমরা চলতে চলতে পাগলা পানি শোধনাগারে পৌঁছে গেলাম। বড় বড় হাউজে পানি ধরে রাখা হয়েছে। একেকটা হাউজের আয়তন কম করে হলেও একটা প্রমাণ সাইজ ফুটবল মাঠের সমান। সাত-আটটা হাউজ আছে।এসব হাউজে নাকি পিরানহা আর আফ্রিকান মাগুর চাষ হয়। আমরা দু'জন একটা হাউজের ঢালু জমিতে শুয়ে শুয়ে আকাশ দেখতে লাগলাম আর সন্ধ্যাটা ঝুপ করে চারদিকে নেমে এলো।

তারপরও অনেকক্ষণ ওই খোলা চত্বরটায়, মুক্ত আকাশের নিচে আমরা শুয়ে ছিলাম। একজন আরেকজনের চোখের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হারিয়ে গিয়েছিলাম। নিজেদের পুরোনো দিনগুলোয়। আমার ১২ বছরের স্কুল জীবনে শুধু শেষের ১টি বছর উনি আমার সঙ্গী ছিলেন না। কারণ আগের বছর উনি মেট্টিক পাশ করে বের হয়ে গিয়েছিলেন।

আমরা কখনো প্রেম করি নি। আমাদেরকে কখনো সেটা করতে হয় নি। কারণ প্রেম করে আমাদের বন্ধুদের বেহাল দশা দেখে আমাদের শিক্ষা হয়ে গিয়েছিলো। আমরা বিশ্বাস করতাম, প্রেম হচ্ছে একটা ছেলে আর মেয়ের মধ্যে বন্ধুত্ব নষ্টের প্রথম উপাদান। এখনো কথাটা বিশ্বাস করি। অবিশ্বাস করার কোনো কারণ খুঁজে পাই নি।

আমাদের দু'জনের জীবনে অধিকাংশ ফার্স্ট এক্সপেরিয়েন্স একসঙ্গে হয়েছে। স্কুলে একবার ফার্স্ট হয়ে রেজাল্ট নিয়ে দৌড়ে পাশের ক্লাসে বসে থাকা ইপি আপুর ছুটে গেলাম। আর উনি রেজাল্টটা দেখে চিলের মতো একটা চিৎকার দিয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। সেদিন সন্ধ্যায় উনি বললেন, আজ নাকি জীবনে প্রথম একটা কাজ করেছেন। আমি জানতে চাইলাম, কি করেছেন? উনি বললেন, কাউকে জড়িয়ে ধরেছি। আমি বললাম, যাহ্ এর আগে বুঝি বাবা-মা কাউকে জড়িয়ে ধরেন নি? উনি বললেন, আরে গাধা সেগুলা তো আর হিসাবে পড়বে না। আমি বললাম, আমিও তো জীবনে আজকেই ফার্স্ট। বাইরের কাউকে জড়িয়ে ধরলাম। তিনি বললেন, তুই আমার বাইরের কেউ না রে সোনা। বলে আবার আমাকে জড়িয়ে ধরলেন।

সেই দিনের অভিজ্ঞতা আমরা দু'জনের কেউই ভুলতে পারি নি। পাগলায় শুয়ে শুয়ে এসব স্মৃতি রোমন্থন করতে করতে রাত বেড়ে গেলো। আমরা একসময় উঠে বাড়ি ফিরে আসলাম। ইপি আপুর ফ্ল্যাটের নিচে দাঁড়িয়ে বিদায়ী হ্যান্ডশেকের সময় উনি জানতে চাইলেন, এখন কই যাবি? আমি ঘড়ি দেখে জবাব দিলাম, গ্যারেজে, গানজা খাইতে।

উনি কপট চোখ রাঙানি দিয়ে বললেন, চুপচাপ ঘরে যা। অন্য কোথাও গেছিস শুনতে পেলে তোকে জ্যান্ত কবর দেবো।

শুনে আমি হাসতে হাসতে উনার কপালের সামনের গুচ্ছ গুচ্ছ চুলগুলোকে একবার এলোমেলো করে দিয়েই কেটে পড়লাম। আমি জানি উনি কখনোই আমাকে জ্যান্ত কবর দেবেন না। তাই এখন গ্যারেজে যাওয়াই যায়।

পোস্টটি ১১ জন ব্লগার পছন্দ করেছেন

শাফায়েত's picture


আর সঙ্গে জীবনানন্দ দাশের সেই কবিতা---

"হাজার বছর শুধু খেলা করে অন্ধকারে জোনাকির মতো :
চারিদিকে চিরদিন রাত্রির নিধান-
বালির উপরে জ্যেৎস্না- দেবদারু ছায়া ইতস্তত
বিচূর্ণ থামের মতো; দ্বারকার- দাঁড়ায়ে রয়েছে মৃত ম্লান
শরীরে ঘুমের ঘ্রাণ আমাদের- ঘুচে গেছে জীবনের সব লেনদেন :
‘মনে আছে?’ শুধালো সে- শুধালাম আমি শুধু, ‘বনলতা সেন?"

নিভৃত স্বপ্নচারী's picture


ভাল লাগলো, লিখতে থাকুন

শাফায়েত's picture


খুব ছোট্ট মন্তব্য হয়ে যাচ্ছে কিন্তু সবারটাই

তবে ধন্যবাদটা ছোট হবে না কখনোই।

আরাফাত শান্ত's picture


সত্যিই ভালো লাগলো লেখাটা!

শাফায়েত's picture


ধন্যবাদ আরাফাত ভাই।

শওকত মাসুম's picture


ভাল লাগছে

শাফায়েত's picture


Embarassed

তানবীরা's picture


সত্যিই ভালো লাগলো লেখাটা! মীর মীর গনধ আছে Big smile

শাফায়েত's picture


তাহলে তো মনে হয় আর লেখালেখি করা যাবে না Sad

মন্তব্য করুন

(আপনার প্রদান কৃত তথ্য কখনোই প্রকাশ করা হবেনা অথবা অন্য কোন মাধ্যমে শেয়ার করা হবেনা।)
ইমোটিকন
:):D:bigsmile:;):p:O:|:(:~:((8):steve:J):glasses::party::love:
  • Web page addresses and e-mail addresses turn into links automatically.
  • Allowed HTML tags: <a> <em> <strong> <cite> <code> <ul> <ol> <li> <dl> <dt> <dd> <img> <b> <u> <i> <br /> <p> <blockquote>
  • Lines and paragraphs break automatically.
  • Textual smileys will be replaced with graphical ones.

পোস্ট সাজাতে বাড়তি সুবিধাদি - ফর্মেটিং অপশন।

CAPTCHA
This question is for testing whether you are a human visitor and to prevent automated spam submissions.

বন্ধুর কথা

শাফায়েত's picture

নিজের সম্পর্কে

আমি শাফায়েত। ই-মেইল এ্যড্রেস শাফায়েত আন্ডার্স্কোর আলি ওয়ান @ ইয়াহু.কম। বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে কাপ-ঝাপ করেই আমার দিন কাটে সাধারণত। পিচ্চি দুইটা ভাগনে-ভাগনি আছে। লাবিব আর লামিয়া। ওরা অনেক দূরে থাকে এবং ওদের কথা যারপরনাই মনে পড়ে।