ইউজার লগইন

ষড়যন্ত্র ও ভুলের মাশুল-৩ নভেম্বর

১৯৭৩ সালে আলজিয়ানে জোটনিরপেক্ষ সম্মেলনে ফিদেল ক্যাস্ট্রোর সঙ্গে দেখা হয় শেখ মুজিবুর রহমানের। দুইজনের মধ্যে একান্তে কিছুক্ষণ কথাও হয়। বাংলাদেশের অবস্থা সম্পর্কে বলতে গিয়ে শেখ মুজিব বলেন- দেশ গড়ার কাছে দক্ষ লোক না পাওয়ার ফলে কিছু পদে এমন কিছু লোককে বসাতে হয়েছে যারা স্বাধীনতা বিরোধী ছিল। ক্যাস্ট্রো তখন সর্তক করে মুজিবকে বলেন- “এ কাজ কক্ষনো করবেন না। দক্ষতার চেয়ে এসময় অনেক বেশি প্রয়োজন দেশপ্রেমের। দক্ষতা না থাকলেও যারা স্বাধীনতা যুদ্ধ করেছে তাদেরই দায়িত্ব দিয়ে দিন। দেশের প্রতি ভালোবাসা থাকলে দক্ষতা তৈরি হতে সময় লাগে না। আমার কিউবার অভিজ্ঞতায় তাই দেখেছি।”

ক্যাস্ট্রো যখন ক্ষমতা নেয় তখন ক্যাস্ট্রো’র বয়সও ত্রিশের কোঠায়। অতীতে দেশ পরিচালনার অভিজ্ঞতা তাঁর ছিল না। আমরা স্মরণ করতে পারি তাজউদ্দীনের কথা। তাজউদ্দীন যখন ৭১-এ স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন তখন তার বয়স ৪৫। সরকার প্রধান হিসেবে দেশ পরিচালনা করার অভিজ্ঞতা অতীতে না থাকলেও শুধু দেশ প্রেম ও বুদ্ধিমত্তার জোরে খন্দকার মোস্তাক থেকে শুরু করে সকল প্রকার ষড়যন্ত্র প্রতিহত করে তিনি বাংলার স্বাধীনতা এনে দেন।

নেতা যখন ভুল করেন তখন তার খেসারত সমগ্র জাতিকে দিতে হয়। দেশ স্বাধীনের পর শেখ মুজিব যখন ফিরে এলেন তখন তিনি উপলব্ধি করলেন, তাঁর নামে স্বাধীনতা যুদ্ধ জয় হলেও ব্যক্তি হিসেবে তিনি ছিলেন অনুপস্থিত। এই কারণেই হয়তো তিনি কখনো ৭১ এর নয় মাসের ঘটনা তাজউদ্দীন থেকে জানতে চান নি। ফলে খন্দকার মোশতাকদের চরিত্র ও কর্মকাণ্ডও ছিল অজানা। শেখ মুজিবুর রহমানের পিতা শেখ লুত্ফর রহমান মারা যান ১৯৭৫ সালের ১৬ জানুয়ারি। শেখ সাহেব পরিবারের সদস্যদের নিয়ে লঞ্চে টুঙ্গিপাড়া যান পিতার লাশ দাফন করতে। সেই লঞ্চে পরিবারের সদস্যদের বাইরে আর একজন ছিল! সে আর কেউ নয় খুনি মোশতাক। টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর পিতার লাশ দাফনের সময় মোশতাকও কবরে নামেন। এবং হাউ-মাউ করে কবরে বলতে থাকে-“আমার বাবা মরে গেছে। আমার বেঁচে থেকে কী হবে? আমাকে আমার বাবার সঙ্গে কবর দিয়ে দাও। ” মোশতাক শেখ মুজিব থেকে বয়সে কয়েক বছরের বড় হলেও রাজনীতিতে সবসময় জুনিয়র ছিল। তাই সবসময় সে একটা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকতো। শেখ মুজিব যখন স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে আসেন তখন মোশতাক আবারো শেখ মুজিবের প্রিয়জন হয়ে উঠে। এই প্রিয়জন হওয়ার তালিকায় আছে তাহেরউদ্দিন ঠাকুর। তিনিও শেখ মুজিব হত্যায় জড়িত ছিলেন। অথচ এই তাহেরউদ্দিন ঠাকুর ছিল শেখ মুজিবের প্রিয়ভাজন। এছাড়া শেখ মুজিবের ভাগ্নে শেখ মনির ৭১-এর যুদ্ধ থেকেই তাজউদ্দীনের বিপক্ষে অবস্থান নেয়। শেখ মুজিবের অবর্তমানে যুবলীগের নেতা শেখ মনির নিজেকে নেতৃত্ব নেওয়ার যোগ্য ব্যক্তি মনে করেন। তাজউদ্দীনের সাথে এই নিয়ে অনেক ঝগড়া, বিরোধীতা করে শেষে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’এর সহযোগিতায় তৈরি করে ‘মুজিব বাহিনী’।

বাংলাদেশ বলতে শেখ মুজিব বোঝায় না। বাংলাদেশ বলতে শেখ মুজিব ও তাজউদ্দীন বোঝায়। শেখ মুজিবের সীমাবদ্ধতা পূরণ করতো তাজউদ্দীন। কিন্তু দেশ স্বাধীনের পরে যখন শেখ মুজিব থেকে তাজউদ্দীনকে আলাদা করে ফেলা হয় তখন শেখ মুজিবের শরীর থেকে পাজরের হাড় চলে যায়। চাটুকার, ষড়যন্ত্ররকারীরা শেখ মুজিবকে ঘিরে ফেলে একসময় শেখ মুজিব ও তাজউদ্দীনের মধ্যে মতের পার্থক্য ঘটে এবং তাজউদ্দীন সরকার ও রাজনীতি থেকে সরে আসেন। শেখ মুজিবের সাথে তাজউদ্দীনের ৩২ বছরের রাজনৈতিক জীবনের সমাপ্তিতে অভিমান ছিল, ক্ষোভ ছিল না। চাটুকার বেষ্টিত জনগণের নেতা শেখ মুজিব বিশাল মানুষ থেকে দিনদিন ছোট হতে হতে আওয়ামী লীগের নেতায় পরিণত হোন। বাংলাদেশকে পাকিস্তান বানানোর যে প্রাথমিক ছক তৈরি করা হয় তার প্রথম বিজয় হয় তাজউদ্দীনের পদত্যাগের মধ্য দিয়ে। দ্বিতীয় বিজয় হয় ১৫ই অগাস্টে এবং শেষ সফলতা আসে ৩ নভেম্বর জাতীয় চার নেতার হত্যার মধ্য দিয়ে। জাতীয় চার নেতার সবাই ছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের জনপ্রতিনিধি। মোশতাক ঐ চার নেতাকেই জেলে হত্যা করেছে যারা বাংলাদেশের স্বাধীনতার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।

এখন কথা আসে ৭৫-এর ১৫ই অগাস্ট কিংবা ৩ নভেম্বর ঘটনার জন্য শুধু কী পাকিস্তানপন্থী আওয়ামী লীগ নেতারা দায়ী নাকি সিআইএর মতন যারা এসব খুনিদের সাহায্য করেছে তারা দায়ী। দায় দুপক্ষের হলেও দায় এড়াতে পারবে না শেখ মুনীরের মতন নেতা যিনি ১৫ অগাস্ট নিহত হয়। কারণ তাদের নিজেদের দ্বন্দ্বের কারণে ঘাতকদের পথ অনেক সহজ হয়েছিল। নিজের ভুল, অন্ধভাবে বিশ্বাস করার ভুল অস্বীকার করতে পারবেন না জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাই সেই ভুলের মাশুল দিতে হল সমগ্র জাতিকে। তাজউদ্দীনের মুখে শুনি সেই আক্ষেপের সুর-“মৃত্যুর আগে মুজিব ভাই জেনে যেতে পারল না কে তার বন্ধু কে তার শক্র।

প্রিয় কবি পাবলো নেরুদার কবিতার ভাষায় বলি-
দোষ অন্যের কাঁধে চাপিও না কখনো, অন্যের নামে কোরো না নালিশ
কারণ মূলত সে জীবনই তুমি পেয়েছ যা তুমি চেয়েছিলে
নিজেকে গড়ে তুলবার যে সংকট, মেনে নাও তাকে
সঞ্চয় করো নিজের ভুল শুধরে নেবার সাহস।
ভুলের ভষ্ম থেকেই উত্থিত হয় সত্যিকার মানবিক অর্জন।
নিজের ভাগ্য আর একাকিত্বকে দায়ী কোরো না কখনো।
তাকে গ্রহণ করো এব মোকাবেলা করো সাহসের সঙ্গে।
মনে রেখ কোনো না কোনোভাবে তা তোমারই কাজের পরিণতি এবং
এর ভেতর নিহিত আছে জয়ের লক্ষণ। (আংশিক)

(কবিতাটি শাহদুজ্জামানের “আধো ঘুমে ক্যাষ্ট্রোর সঙ্গে’ বই থেকে নেওয়া)

পোস্টটি ১৮ জন ব্লগার পছন্দ করেছেন

মন্তব্য করুন

(আপনার প্রদান কৃত তথ্য কখনোই প্রকাশ করা হবেনা অথবা অন্য কোন মাধ্যমে শেয়ার করা হবেনা।)
ইমোটিকন
:):D:bigsmile:;):p:O:|:(:~:((8):steve:J):glasses::party::love:
  • Web page addresses and e-mail addresses turn into links automatically.
  • Allowed HTML tags: <a> <em> <strong> <cite> <code> <ul> <ol> <li> <dl> <dt> <dd> <img> <b> <u> <i> <br /> <p> <blockquote>
  • Lines and paragraphs break automatically.
  • Textual smileys will be replaced with graphical ones.

পোস্ট সাজাতে বাড়তি সুবিধাদি - ফর্মেটিং অপশন।

CAPTCHA
This question is for testing whether you are a human visitor and to prevent automated spam submissions.

বন্ধুর কথা

সুব্রত শুভ's picture

নিজের সম্পর্কে

অকামের লোক