শহীদ বুদ্ধিজীবিদের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি - পর্ব এক
জহির রায়হান
বিখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা এবং লেখক জহির রায়হান ১৯শে আগষ্ট ১৯৩৫ সালে ফেনী জেলার একটি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ১৯৫০ সালে আমিরাবাদ উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মেট্রিকুলেশন পাশ করে ঢাকা কলেজে ভর্তি হন যেখান থেকে তিনি পরবর্তীতে আই এস সি পাস করেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় স্নাতক (সম্মান) ডিগ্রী অর্জন করেন।
প্রথম জীবনে তিনি কমিউনিস্টদের আন্দোলনের প্রতি ঝুঁকে পড়েন। পরবর্তীতে যখন কমিউনিস্টদের রাজনীতি নিষিদ্ধ হয় তিনি তখন আত্মগোপনে চলে যাওয়া নেতাদের বার্তাবাহক হিসেবে কাজ করতেন। মজার তথ্য হলো তার নামের শেষাংশ "রায়হান" আত্মগোপনে যাওয়া নেতাদের দেয়া। জহির রায়হানের প্রকৃত নাম জহিরুল্লাহ।
ছাত্রজীবনে তার সাহিত্যচর্চার প্রতি ছিলো ব্যাপক উৎসাহ। তার রচিত গল্প নিয়ে তার প্রথম বই "সূর্য গ্রহণ" প্রকাশিত হয় ১৯৬২ সালে। তার রচিত অন্যান্য বইসমূহ হলো শেষ বিকেলের মেয়ে, হাজার বছর ধরে, আরেক ফাল্গুন, বরফ গলা নদী এবং আর কত দিন। ১৯৭০ সালে ইংরেজী সাপ্তাহিক এক্সপ্রেস প্রকাশের একজন অন্যতম উদ্যোক্তা ছিলেন তিনি।
১৯৫২ সালে জহির রায়হান কলকাতার প্রমোতেশ বড়ুয়া মেমোরিয়াল ফটোগ্রাফী স্কুলে ভর্তি হন। চলচ্চিত্র জগতে তার পদার্পন হয় ১৯৫৬ সালে। তার পরিচালিত প্রথম চলচ্চিত্র "কখনো আসেনি" মুক্তি পায় ১৯৬১ সালে। তার পরবর্তী চলচ্চিত্রসমূহ হলো কাজল, কাঁচের দেয়াল, বেহুলা, জীবন থেকে নেয়া, আনোয়ারা, সঙ্গম এবং বাহানা। তার পরিচালিত "জীবন থেকে নেয়া" চলচ্চিত্রে ততকালীন পাকিস্তান সরকারের স্বৈরাচারী মনোভাব ফুটিয়ে তোলা হয় এবং এই অঞ্চলের মানুষকে তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে উৎসাহিত করে। তার অসমাপ্ত ইংরেজি চলচ্চিত্রের নাম, Let there be light। ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চের তিনি কলকাতা যান পাকিস্তানীদের গণহত্যা নিয়ে Stop Genocide নামক প্রামান্যচিত্র নির্মানের লক্ষ্যে।
ঐ বছরের ডিসেম্বর মাসে আলবদর বাহিনীর কতিপয় সদস্য জহির রায়হানের বড় ভাই বিশিষ্ট লেখক শহীদুল্ল্যাহ কায়সারকে তার নিজ বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যায়। ৩০শে ডিসেম্বর ১৯৭১, জহির রায়হানকে কেউ একজন মিরপুরের একটি ঠিকানায় তার ভাই রয়েছে বলে খবর দেয়। সেদিন তার ভাইয়ের খোঁজে বের হয়ে জহির রায়হান আর ফিরে আসেনি।
শহীদুল্লাহ কায়সার
বিশিষ্ঠ সাংবাদিক ও প্রাবন্ধিক শহীদুল্লাহ কায়সার ১৯২৭ সালের ১৬ই ফেব্রুয়ারী ফেনীর মজুপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার প্রকৃত নাম আবু নাঈম মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ।
প্রেসিডেন্সী কলেজ হতে ১৯৪৬ সালে অর্থনীতিতে স্নাতক (সম্মান) ডিগ্রী নিয়ে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় হতে অর্থনীতিতে মাস্টার্সে পড়াশোনা করে ফাইনাল পরীক্ষা দিতে পারেননি। ছাত্রাবস্থায় বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং রাজনীতিতে যুক্ত ছিলেন। পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টির আঞ্চলিক শাখার সদস্য থাকাকালীন তিনি ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ফলশ্রুতিতে তিনি একাধিকবার কারাবরণ করেন।
শহীদুল্লাহ কায়সার ১৯৪৯ সালে সাপ্তাহিক ইত্তেফাক এর সাংবাদিকতার মাধ্যমে তার পেশাগত জীবন শুরু করেন। ১৯৫৮ সালে তিনি সংবাদের সহ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব নেন এবং মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সে দায়িত্ব পালন করেন।
শহীদুল্লাহ কায়সার ১৯৬২ সালে সারেং বউ রচনার মাধ্যমে জনগনের কাছে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেন, যার অবলম্বনে পরবর্তীতে চলচ্চিত্র নির্মিত হয়। তার রচিত গ্রন্থসমূহের মধ্যে সংশপ্তক (১৯৬৫), কৃষ্ণচূড়া মেঘ, তিমির বলয়, দিগন্তে ফুলের আগুন, সমুদ্র ও তৃষ্ণা চন্দ্রবনের কন্যা, কবে পোহাবে বিভাবরী উল্লেখযোগ্য। তিনি ১৯৬২ সালে আদমজী সাহিত্য পুরুষ্কার পান। ১৯৭১ সালের ১৪ই ডিসেম্বর তাকে নিজ বাসভবন থেকে আল বদর বাহিনীর সদস্যারা তুলে নিয়ে যায়।
সন্তোষ চন্দ্র ভট্টাচার্য্য
সন্তোষ চন্দ্র ভট্টাচার্য্য ছিলেন একজন শিক্ষক এবং বুদ্ধিজীবি। তিনি ১৯১৫ সালের ৩০শে আগষ্ট ঢাকা জেলার নবাবগঞ্জ উপজেলায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ১৯৩৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে ইতিহাসে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী অর্জন করেন এবং এম এ পাশ করেন। উভয় পরীক্ষায় তিনি প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান অর্জন করেন।
জগন্নাথ কলেজে ১৯৩৯ সালে প্রভাষক হিসেবে তিনি তার পেশাগত জীবন শুরু করেন এবং সেখানে তিনি ১৯৪৯ পর্যন্ত কর্মরত ছিলেন। এরপর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে সিনিয়র লেকচারার হিসেবে যোগ দেন। ১৪ই ডিসেম্বর ১৯৭১ এ পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর হাতে তার নির্মম মৃত্যূর আগ পর্যন্ত তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন সংস্কৃত সাহিত্য এবং ভারত-বাংলার প্রাচীন ইতিহাসের শিক্ষক ছিলেন।
অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী
অধ্যাপক মুনীর চৌধুরীর জন্ম ১৯২৫ সালে ঢাকার মানিকগঞ্জে। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে ১৯৫৫ সালে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন। এর আগে তিনি ইংরেজী বিভাগের পার্ট টাইম শিক্ষক ছিলেন। ভাষা আন্দোলনের সময় তিনি ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে (১৯৫৩-১৯৫৪) থেকেই বাংলাতে মাস্টার্সে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান অর্জন করেন। এছাড়া ইতিপূর্বে তিনি ইংরেজিতে মাস্টার্স করেন।
তিনি ১৯৭০ সালে অধ্যাপক হিসেবে পদোন্নতি লাভ করেন এবং ১৯৭১ সালে মানবিক বিভাগের ডীন হিসেবে কর্মরত ছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় সেনা অভিযানের সময় তিনি ভাগ্যক্রমে পালিয়ে হাতিরপুলে তার বাবার বাসায় আশ্রয় নেন। তিনি মানসিকভাবে একেবারেই ভেঙ্গে পড়েছিলেন। তার অনেক ছাত্র এবং শুভাকাঙ্খী তাকে মুক্তাঞ্চলে চলে যেতে অনুরোধ করে। কিন্তু তিনি কখনই তার মাতৃভূমি ছেড়ে যেতে চাননি। তাই তিনি থেকে যান এবং আল বদর বাহিনীর সদস্যরা তাকে তার বাসা থেকে ধরে নিয়ে যায়।
মুনীর চৌধুরীর মরদেহ সনাক্ত করা যায়নি।
মোফাজ্জেল হায়দার চৌধুরী
মোফাজ্জেল হায়দার চৌধুরী ১৯২৬ সালে নোয়াখালীতে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৫৫ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে যোগ দেন। তিনি বেশ কিছু বছর লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন। তিনি শান্তিনিকেতনের বিশ্বভারতী থেকে "সাহিত্য ভারতী" পুরুষ্কার পান।
১৯৭১ সালের ১৪ই ডিসেম্বর তাকে আলবদর বাহিনীর সদস্যারা তুলে নিয়ে যায়।
রশীদুল হাসান
১৯৩২ সালে পশ্চিম বাংলার ভীরভুম জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৪৯ সালে তার পরিবার পাকিস্তান শাসিত অঞ্চলে চলে আসে। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে ১৯৫৭ এবং ১৯৫৮ সালে যথাক্রমে ইংরেজীতে স্নাতক এবং মাস্টার্স পাশ করেন। তিনি নরসিংদী, পাবনা এডয়ার্ড কলেন, এবং পশিমবঙ্গের ভিরভুমের কৃষ্ণচন্দ্র কলেজ সহ একাধিক কলেজে শিক্ষকতা করেন। অবশেষে তিনি ১৯৬৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন।
তিনি এখন স্বাধীনচেতা মানুষ ছিলেন এবং আমরণ মৌলবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছেন। তাকে এবং তার ঘনিষ্ট বন্ধু আনোয়ার পাশাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস এলাকা থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। ঐসময় উভয় পরিবার ঈসা খাঁ রোডের একই বাসায় বসবাস করতো।
আনোয়ার পাশা
ভারতের মুর্শিদাবাদের ডাবকাই গ্রামে ১৯২৮ সালের ১৫ই এপ্রিল জন্মগ্রহণ করেন আনোয়ার পাশা। ১৯৪৬ সালে মাদ্রাসা হতে হাইস্কুল পাশ করে আনোয়ার কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় হতে ১৯৫৩ সালে বাংলায় স্নাতক এবং মাস্টার্স পাশ করেন। মানিকচক উচ্চ মাদ্রাসায় তার শিক্ষকত জীবনের শুরু। পরবর্তীতে তিনি ভাবতা আজিজিয়া মাদ্রাসা (১৯৫৪) এবং সাদিখান দিয়ার বহুমুখী উচ্চ মাধ্যমিক স্কুলে (১৯৫৭) শিক্ষকতা করেন। ১৯৫৮ সালে পাবনা এডয়ার্ড কলেজে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন এবং পরবর্তীতে ১৯৬৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে যোগ দেন।
আনোয়ার পাশা তার প্রথম প্রবন্ধ সংকলন "হাসনেহেনা" এর মাধ্যমে প্রথম লেখক হিসেবে পরিচিত পান। পরবর্তী দুই দশকে তিনি বহু প্রবন্ধ, রচনা, গল্প লিখেন। তার রচনাবলীর মধ্যে নীড় সন্ধানী (১৯৬৮), নিশুথী রাতের গাঁথা (১৯৬৮), নিরুপায় হরিনী (১৯৭০) উল্লেখযোগ্য।
আনোয়ার পাশাকে তার নিজ বাসা থেকে তুলে নিয়ে যেয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে আল বদর বাহিনীর সদস্যরা।
চলবে ................
শ্রদ্ধা!
- জহির রায়হান হারিয়ে যাওয়ার দিনটি ছিল ৩০ জানুয়ারী ১৯৭২, ৩০ ডিসেম্বর ১৯৭১ নয়।
মন্তব্য করুন