একজন কারিগর
বাংলার আনাচে কানাচে ছড়িয়ে রয়েছে হাজারো ইতিহাস। এক সাগর পরিমাণ রক্তের বিনিময়ে অর্জিত এই স্বাধীনতার ইতিহাস। সবার নাম হয়তো লিখা নেই ইতিহাসের পাতায়, তবুও কি তাদের অবদান অস্বীকার করা যায়?
দেখছিলাম, টেলিফিল্ম "কারিগর"। আর্টফিল্ম বলে শুরুর দিকে বেশ ধীরগতির কারণে একটু বিরক্ত লাগছিলো। তবুও, ধৈর্য্য নিয়ে বসে থাকি মূল কাহিনীর অপেক্ষায়। মূলকাহিনী খুব বেশী কিছুনা আবার অনেক কিছু। একগ্রামে ছিলেন একজন "ওস্তাকার" যাকে সবাই "কারিগর" বলে ডাকতো। গ্রামের ছেলেদের খৎনা করানো ছিল তার পারিবারিক পেশা। তাই, বাচ্চা ছেলেরা তাকে দূর থেকে দেখলে ছুটে পালাতো ভয়ে, পরিবারের বয়স্করা দেখলে শ্রদ্ধা করতো আর খৎনা হয়ে গেছে এমন ছেলেরা দেখলে সালাম দিত।
কারিগর বিয়ে করে ঘরে বউ তোলে। বিয়ের রাতে স্ত্রীকে নাচ দেখায়, স্ত্রীকে বলে, "স্বামী-স্ত্রীর মত ভালবাসার সম্পর্কে কোন নিয়ম নেই।" তার স্ত্রী তাকে বলে, "আপনি কি পুরুষ? কোথায় বিয়ের রাতে আমার সত্বীত্ব পরীক্ষা করে জানিয়ে দিবেন আপনার সাথে কেমন ব্যবহার করা যাবে, কিভাবে চলতে হবে, তা না করে আপনি কিসব বলছেন!" জবাবে, কারিগর স্ত্রীর পায়ে আলতা লাগিয়ে দেয়।
ঈদের দিন কারিগর ঈদের নামায শেষ করে বাড়ির সামনে দেখে গ্রামের একজন হিন্দু প্রতিবেশী তার জমিতে সেচ দিচ্ছে। কারিগর তাকে বাড়িতে সেমাই খেতে পাঠিয়ে নিজেই সেচ দেয় তার জমিতে। একবার গ্রামের এক মেয়ে কারিগরকে বেশ সমস্যায় ফেলে দেয় একটি প্রশ্ন করে। প্রশ্নটির জবাব খুঁজে পায়নি কারিগর। প্রশ্নটি করার কিছুদিনের মধ্যের মেয়েটি মারা যায়। প্রশ্নটি ছিল, ছেলেদের খৎনা করে মুসলমান বানানো গেলে মেয়েদের কিভাবে মুসলমান বানাবে কারিগর?
সময়কাল একাত্তর। সবার মত কারিগরও ৭ই মার্চে ঢাকা যায় শেখ সাহেবের মিটিং এ। মিটিং শেষে সে তার গ্রামে ফিরে আসে। নাহ, কারিগর সরাসরি স্বশস্র সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেনি। তবে কারিগর যা করেছে তার ফলস্বরুপ তাকে হতে হয়েছে সমাজবিচ্ছিন্ন, হতে হয়েছে একঘরে।
কারিগরের গ্রামে মিলিটারী আসে মুক্তিযোদ্ধা এবং হিন্দুদের খোঁজে। কারিগর রাতে ঘুমাতে পারেনা কি করে বাঁচানো যায় গ্রামের হিন্দুদের এই দুশ্চিন্তায়। তার স্ত্রী তাকে একটি বুদ্ধি দেয়। স্ত্রীর বুদ্ধিমোতাবেক সে পরদিন সরাসরি চলে যায় পাকিস্তানী সেনা অফিসারের কাছে। যেয়ে মাথায় কোরান শরীফ রেখে বলে, "আমি একজন ওস্তাকার, আমার বাবাও ছিলেন, আমার দাদাও ছিলেন। দেশ ভাগের পরে এই গ্রামে যারা হিন্দু ছিল আমার দাদা সবাইকে খৎনা করিয়ে মুসলমান বানিয়ে দিয়েছে। আর চার-পাঁচ জন বাকী ছিল, আমি তাদের খৎনা করিয়ে দিয়েছি। এই গ্রামে আর কোন হিন্দু নেই।" পাকিস্তানী সেনা অফিসার, তার কাছে নামের তালিকা দেখতে চেয়ে সেদিনের মত ফিরে যায়। আর বলে পরেরবার যেন নামের তালিকা তৈরী থাকে। সারারাত কারিগর আর তার স্ত্রী কুপি জ্বালিয়ে বসে একটি নোট খাতায় তালিকা বানায় হিন্দুদের যারা মুসলমান হয়েছে খৎনা করে। যতবেশী নাম ততবেশী হিন্দুদের বাঁচানো যাবে। তাই ঘুম বাদ দিয়ে তালিকা তৈরী করতেই রাত পার হয়ে যায়।
এভাবেই কারিগর তার গ্রামের হিন্দুদের জীবন বাঁচিয়ে হয় সমাজবিচ্যুত। মুসলমানরা তাকে একঘরে করে দেয় কুরানশরীফ মাথায় রেখে মিথ্যা বলার দায়ে, হিন্দুরাও অনেকে তাকে অবিশ্বাস করে এই ভেবে যে সে নিজধর্মের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ মাথায় রেখে মিথ্যা বলেছে। কিন্তু কেউ জানতো না, সেদিন কারিগর কাপড়ে মোড়ানো একটি সাধারণ বই মাথায় রেখেছিলো যা দেখে পাকি অফিসার ভেবেছিল সত্যিই তা কুরান ছিলো, আর একজন মুসলমান কুরান মাথায় নিয়ে মিথ্যা বলবে না সে বিশ্বাসে বেঁচে গিয়েছিল গ্রামের হিন্দুরা।
যারা দেখতে চান, তারা দেখতে পারেন ইউটিউব থেকে
https://www.youtube.com/watch?v=GrY2HdFbHX0
লিংক এর জন্য অনেক ধন্যবাদ। ভালো থাকবেন।
মিশু ভাই, ১৯৭১ এ পালিয়ে জীবন রক্ষা করার টুকরো টুকরো ঘটনাগুলো মা বাবার মুখে শোনা। আপনার লেখাটা পড়ে ভুলতে বসা সেই ঘটনাগুলো মনে পড়ে গেল।
দেখেছিলাম টিভিতে!
ধন্যবাদ লিঙ্ক দেবার জন্য। দেখার ইচ্ছা আছে।
দেখিনি। তবে দেখবো। ধন্যবাদ লিঙ্ক দেবার জন্য।
মন্তব্য করুন