এলোমেলো কিছু ভাবনা
লম্বা একটা সময় কোন জাতিকে নিজেদের পায়ের তলে রাখতে পারলে সেই অঞ্চলের সবকিছুই বদলে দেয়া সম্ভব। যেমন ব্রিটিশরা বদলে দিয়েছে আমাদের এই অঞ্চলের মানুষের চিন্তা ভাবনা, আচরণ। শুধু তাই নয়, ব্রিটিশরা ছেড়ে যাবার এত সময় পরেও এখনো আমাদের চিন্তা-ভাবনায় তাদের প্রতি আনুগত্যের ছাপ পাওয়া যায়। ব্রিটিশ শাসনামলে জাহাজে করে উচ্চ শিক্ষার জন্য বিলেতে যেত সামর্থ্যবান পরিবারের সন্তানরা। সেই থেকে এখন পর্যন্ত আমাদের দেশে একটা বড় অংশ মনে করে বিশ্বের আর যে কোন দেশের চেয়ে যুক্তরাজ্যেই সবচেয়ে ভাল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো। দেশের বাহিরে যারা থাকেন, তাদের মধ্যে ইংল্যান্ডে থাকলেই তারা অনেক কিছু। বাকী সবদেশেই যারা থাকেন তারা সবাই শ্রমিক শ্রেণীর লোকজন। এই যে শ্রেণীভেদ মানসিকতা, এটাও আমরা ব্রিটিশদের কাছ থেকেই পেয়েছি। অবশ্য, তার আগে আরো বেশীই ছিল। এটা নিয়ে মতপার্থক্য আছে বেশ। অনেকের ধারণা, ব্রিটিশদের আগে যেই ধরণের শাসনব্যবস্থা ছিল আমাদের অঞ্চলে তাতে শ্রেণীভেদ আরো বেশী ছিল। অস্বীকার করার কোন উপায় নেই। দুই পক্ষের যুক্তিই যথেষ্ঠ শক্তিশালী।
তবে, একথা সত্যি আমাদের চিন্তা ভাবনায় এখনো ব্রিটিশদের পদলেহনের যে নমুনা পাওয়া যায় তা থেকে অন্তত এটা বোঝা যায়, পাকিস্তানিদের হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার সাথে সাথেই জামায়াতীরা এটা উপলব্ধি করেছিলো ব্রিটেনে তারা শক্তিশালী হতে পারলে ভবিষ্যতে বাংলাদেশে র নতুন প্রজন্মের অনেক বড় অংশকে হাত করা সম্ভব হবে। ব্যাপারটা এমন, যে এখনো আমাদের দেশে কেউ বাহিরে পড়াশুনা করতে যাচ্ছে শুনলে প্রথমেই প্রশ্ন আসে কোথায় যাচ্ছে? ইংল্যান্ড? ইংল্যান্ড শুনলে বলবে, "বাহবা!" অন্য কোন দেশের নাম শুনলে বলবে, "ওহ, যেয়েতো ঠিকই কামলা দিয়ে থেকে যাবে।" আর এই ধরণের চিন্তাভাবনা করার মানুষের সংখ্যাই আমাদের সমাজে বেশী। তারা যেমন অন্যের সন্তান বিদেশে পড়াশুনা করতে যাবার কথা শুনলে এমন ভাবতে পারে, তাদের নিজেদের সন্তানদের সেক্ষেত্রে বিদেশে পড়াশুনা করতে পাঠানোর সময় অবশ্যই তারা চায় ইংল্যান্ডেই পাঠাতে।
আমার দেখা বেশীরভাগ ইংল্যান্ড ফেরত ছেলেমেয়ের ল্যাঞ্জা বের হয়েছে গত ২০১০ সালে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু হবার পরে। তখনই বুঝতে পেরেছি তারা ইংল্যান্ডে যেয়ে আসলে কোন বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করেছে। আর যারা ইংল্যান্ডে থাকেন তারাতো প্রতিনিয়ত প্রত্যক্ষ করছে এসব। আমার ভয়টা অন্য ক্ষেত্রে। যারা বড় হয়ে ইংল্যান্ডে পড়াশুনা করতে যাচ্ছে তাদের মগজ ধোলায় দেয়া সম্ভব হচ্ছে, আর যাদের জন্ম সেদেশে তারাতো একসময় নিজেদের বাংলাদেশী বংশোদ্ভোত পরিচয় না দিয়ে পাকিস্তানী বংশোদ্ভোত পরিচয় দিবে। যেমনটি, আমাদের দেশের নতুন প্রজন্মের একটা অংশ এখনো মনে করে ১৯৭১ সালে পাকিস্তান থেকে আলাদা হওয়া আমাদের রাজনৈতিক নেতাদের উচ্চাভিলাষ ছিল। তাদের জন্য করুণা হয়। করুণা হয় একারণে যে, আপন মাটিতে থেকেও এই মাটিকে ভালবাসতে না পারার মত অভাগা এরা।
আমার একটি বেশ বড় সমস্যা, যা নিয়েই লিখতে বসি তাতেই ঘুরে ফিরে রাজাকারদের প্রতি ঘৃণার ছাপ চলে আসে। আসলে এখানে এসব নিয়ে লিখতে চাইনি। যে ব্যাপারে লিখতে চেয়েছি সে প্রসঙ্গে ফিরে আসি। আমাদের দেশে ইংল্যান্ডে পড়তে যাওয়া সংস্কৃতি যেমন ভয়ঙ্কর তেমনি ভয়ঙ্কর হলো অভিভাবকদের সিদ্ধান্ত সন্তানদের উপর চাপিয়ে দেয়া। আমাদের দেশে সন্তান জন্মানোর সাথে সাথেই মোটামুটি বেশিরভাগ বাবা-মা কিংবা পরিবারের মুরব্বীরা ঠিক করে ফেলেন সন্তান বড় হয়ে কোন পেশায় যাবে। এক্ষেত্রে বেশীরভাগ সময় ডাক্তার অথবা ইঞ্জিনিয়ার প্রাধান্য পায়। আর এই মানসিকতা থেকেই বুঝা যায় তারা এই দুই পেশার বাহিরে ভিন্ন পেশাজীবিদের গন্য করেন না নতুবা কম মেধাবী ভাবেন। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, সন্তানকে শিক্ষা দেবার সময় যে ধরণের প্রবাদ-প্রবচনসমূহ ব্যবহার করে থাকেন সেগুলো বেশীরভাগ ক্ষেত্রে এই দুই পেশার বাহিরের মানুষদেরই তৈরী। একটি জাতি গড়ার কারিগর শিক্ষকরা। অথচ শিক্ষক হতে চায় কয়জন? কয়জন শিক্ষার্থীকে জিজ্ঞাসা করলে তারা জবাবে এই মহান পেশার প্রতি আগ্রহ প্রকাশ করবে? এর জন্য কি তাদের দোষ দেয়া যায়? মোটেই না। এর জন্য দায়ী আমাদের সমাজ, আমাদের পরিবার এবং আমাদের মিডিয়া।
ছোট বেলা থেকেই একটি শিশুকে তার বাবা-মা এমন এমন পেশার প্রতি আগ্রহী করে তোলে যেন নামের পূর্বে একটি টাইটেল বসানো যায়। যেমনঃ ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, ব্যারিস্টার ইত্যাদি। আমি কখনোই এই পেশাগুলোকে খাট করে দেখিনা। সমাজে সকল পেশাজীবি মানুষেরই প্রয়োজন এবং গুরুত্ব আছে। কিন্তু এই বাবা-মা একটু ভেবে দেখা উচিত নেমপ্লেটের টাইটেলের চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপর্ুণ তার বাস্তবজীবনের টাইটেল, তার নিজ ইচ্ছা-অনিচ্ছা। সমাজে কিভাবে আমাদের নতুন প্রজন্মকে ধীরে ধীরে মহান পেশাগুলো থেকে দূরে ঠেলে দিচ্ছি। ডাক্তারী একটি মহান পেশা। এই পেশার মাহাত্ব্য আসলে মুখে বলে কিংবা লিখে প্রকাশ করা যাবে না। মানুষের জীবন নিয়ে যারা প্রতিনিয়ত কাজ করেন তাদেরকে খাট করে দেখার কোন অবকাশ নেই। কিন্তু, আমাদের দেশে শুধুমাত্র বাবা-মা কিংবা সমাজের চাপের কারণে ডাক্তার হতে চাওয়া প্রজন্মের এই বড় অংশ আসলেই কি এই পেশার গুরুত্ব বুঝে এই পেশায় আসছে? এরা কি আসলেই এই পেশার মাহাত্ব্যকে ধরে রাখতে পারে তাদের পেশাগত জীবনে? দেশে মানুষের সেবার জন্য ডাক্তার হবার চেয়ে পেশা হিসেবে নামের সামনে ডাক্তার লাগানোর জন্য যেহারে এই পেশার চাহিদা বেড়েছে সে চাহিদা মেটানোও সম্ভব হচ্ছেনা ব্যাঙের ছাতার মত গজে উঠা প্রাইভেট মেডিকেল কলেজগুলো দ্বারা।
বর্তমানে বাংলাদেশে প্রাইভেট মেডিকেল কলেজগুলোর অবস্থা দেখে মনে পড়ে আমাদের সময়কার কম্পিউটার সায়েন্স কিংবা বিবিএ এর চাহিদার কথা। তখন একটি কথা প্রচলিত ছিল, ঢাকা শহরে রাস্তায় হাঁটলে যদি ১০জনের সাথে ধাক্কা লাগে গায়ে তার মধ্যে ৮জনই হয় কম্পিউটার সায়েন্সের শিক্ষার্থী নতুবা বিবিএ এর। সেই যে শুরু হয়েছিলো কম্পিউটার সায়েন্স আর বিবিএ এর দিন তা থেকে বাদ পড়েনি আমাদের কিংবা ভারতের চলচ্চিত্রের নায়কেরাও। গত কয়দিন আগে বাসায় বসে একটি সিনেমা দেখছিলাম। সিনেমা শুরু হতে না হতেই নায়ক বেশ উঁচু গলায় বলে উঠলে সে সফটওয়ার ইঞ্জিনিয়ার। পাশে বসে থাকা স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে ইচ্ছে করছিলো তাৎক্ষণিক গায়েব হয়ে যেতে। স্কুলে পড়ার সময় আমাদের একজন শিক্ষক একটি কথা বলেছিলেন। তা হলো, কেন আমাদের বাবা-মা রা সবাই তার সন্তানের জন্য তিনটি পেশাকেই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেন তার পেছনে একটি মানসিক কারণ আছে। যেমনঃ উত্তম কুমার তার বেশীর ভাগ সিনেমাতেই নাকি হয় ডাক্তার, নতুবা ইঞ্জিনিয়ার অথবা ব্যারিস্টার এর ভূমিকায় অভিনয় করতেন। আর সেকারণে সব বাবা-মা তার সন্তানকে প্রিয় নায়কের ভূমিকায় দেখতে চাইতেন বলেই সবাই এই তিন পেশা নিয়েই তার সন্তানের জন্য স্বপ্ন দেখতেন।
ভাবি এই ধরণের চিন্তা ভাবনা থেকে কবে আমাদের চারপাশের মানুষজন বের হয়ে আসবে। কবে কোন বিশেষ পেশা কিংবা শ্রেণীর মানুষ শুধু বেশি গুরুত্ব না পেয়ে সকল পেশার সকল শ্রেণীর মানুষই সম্মান পাবে আমাদের সমাজে। কবে আমাদের বাবা-মায়েরা তার সন্তানদের উপর নিজেদের ইচ্ছেকে চাপিয়ে দেয়া বন্ধ করবেন। অন্তত এই একটি ব্যাপারে সন্তানদের স্বাধীনতা দিলে তারা অনেক ধরণের মানসিক চাপ থেকে মুক্তি পাবে। তাদের এই মুক্তি তাদেরকে অনেক বেশী সৃজনশীল করে তুলবে বলে আমার ধারণা।
ভাবনার বিষয় বটে । এখনকার তরুণ মা-বাবারা গুরুত্ত্ব দিয়ে ভাববেন বিষয়টা আশা করি ।
"ব্রিটিশ" শব্দের বানানটা 'বৃটিশ' হবে আমার জানামতে ।
ভাবনাগুলো আসলেই চিন্তা করার মতো!
মন্তব্য করুন