আনন্দের পোস্টমর্টেম
ছেলেটাকে খুব কাছ থেকে চিনি আমি। তার শৈশব, কৈশরের অনেক গল্প আমার জানা। কিছুটা সে জানিয়েছে। কিছুটা জেনে নিয়েছি। শৈশবের ডানপিটে স্বভাবের একটি ছেলে কী করে ধীরে ধীরে পাল্টেছে-সেটাও আমার চোখে দেখা।
ছেলেটার একটা নাম দেওয়া দরকার। মনে করুন, তার নাম আনন্দ। তো, আনন্দের ছোট বেলা বেশ আনন্দেই কেটেছে। মফস্বল শহরের ছেলে। প্রাইমারি স্কুল পর্যন্ত গ্রামেই কাটিয়েছে সে। সকালবেলা স্কুলে যাওয়া, স্কুল থেকে ফিরে পুকুরের ঘোলা জলে সাঁতার কেটে চোখ লাল করা, তারপর মায়ের বকুনি খেয়ে পুকুর থেকে ওঠা, গরম ভাত খাওয়া, বিকালবেলায় হাডুডু খেলা, বৃষ্টির দিনে স্কুল মাঠে জাম্বুরা দিয়ে ফুটবল খেলা, সন্ধ্যায় হাত মুখ ধুয়ে পড়তে বসা... এই ছিলো তার নিত্যদিনের কাজ।
গ্রামের সেই ডানপিটে ছেলেটিকে একদিন বাবা নিয়ে গেলেন শহরে। বাবা যেখানে চাকরি করতেন। পাহাড় আর হ্রদে ঘেরা শহর। রাঙ্গামাটি। সেখানে সরকারি কোয়ার্টারে থাকতেন বাবা। ২ রুমের বাসা। মানুষ পাঁচ জন। বাবা-মা-বড় ভাই-বড় আপা আর আনন্দ। লেকের পাড়ে কী সুন্দর সে বাসাটা। জায়গাটার নাম কাঁঠালতলী। সকালে তিন ভাইবোন মিলে স্কুলে যেত। ফিরতো দুপুরে। তারপর খেয়ে ঘুম। বিকালে পাশের বাসার ছেলে-মেয়েদের সাথে খেলে আবার সন্ধ্যায় পড়তে বসা। রাতের খাবার খেয়ে দশটা নাগাদ শুয়ে পড়া। আবার সকালে উঠে স্কুলে যাওয়া। এই জীবনের রুটিন পাল্টে গেলো। আনন্দের ছন্দময় জীবনে ঘটলো ছন্দপতন।
মন বসতো না তার। এখানে পুকুর নেই। বাথরুমের পানিতে গোসল করতে তার ভালো লাগতো না। পাখির বাসা খোঁজা হতো না। ডাংগুলি,কাবাডি বা ফুটবলের নামে জাম্বুরা দিয়ে খেলা খুব মিস করতো আনন্দ। বনের পাখিকে খাঁচায় বন্দী রাখার মত অবস্থা...।
কী করবে আনন্দ ! ধীরে ধীরে চুপসে যেতে থাকে। সারাবছর অপেক্ষায় থাকে। কখন ফাইনাল পরীক্ষা শেষ হবে। তারপর সবাই মিলে গ্রামে চলে যাবে বেড়াতে। আহ, তার প্রিয় গ্রাম। যেখানে রয়েছেন নানী-দাদীর ভালোবাসা। তার প্রিয় পুকুর। গাছের ডালে পাখির বাসা। আর কৈশোরের বন্ধুরা। নানী-দাদীর হাতের কত শত রকমের শীতের পিঠা। বাড়িতে বানানো মুড়ির মোয়া। খেজুরের রসের পায়েস। ছুটি ফুরিয়ে যেত। মন খারাপ করে মাসখানেক বাদে আবার ফিরে যেতো শহরে।
মানুষ অভ্যাসের দাস। আমাদের আনন্দও একসময় শহুরে জীবনে অভ্যস্ত হয়ে পড়লো। তার বাবার সাথে আবার শহর পাল্টালো। এবার চাঁদপুর। নতুন জায়গা। নতুন সব বন্ধুদের সাথে সখ্যতা। এখানেও সরকারি কলোনীতে ওদের বাসা। আট ক্লাসের ছাত্র তখন আনন্দ। কলোনীর এক মেয়েকে ভীষন ভালো লাগতো তার। মেয়েটিও তাকে অনেক পছন্দ করতো। তার গাল ধরে আদর করে দিত। লজ্জায় আনন্দের অবস্থা তখন কাহিল। সমস্যা হলো এক জায়গায় গিয়ে। মেয়েটি পড়তো দশ ক্লাসে আর আনন্দ আট ক্লাসে। অত শত কী আর সে বুঝতো ! বাবা মা রাজি না হলে একদিন মেয়েটিকে নিয়ে পালিয়ে যাবে- এমনটাই ছিলো তার প্ল্যান। একদিন সাহস করে মেয়েটিকে বলেই ফেললো- আমি তোমাকে ভালোবাসি আপু। শুনে মেয়েটি কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে রইলো ওর দিকে। তারপর মেয়েটির সেকি হাসি। হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়লো। এতেও আনন্দের খারাপ লাগেনি। কিন্তু মেয়েটি যখন এই কথাটা কলোনীর সবাইকে বলে দিলো- তখন আনন্দের মনে হলো- এর চেয়ে মরণ ও ভালো ছিলো। রাগে-দুঃখে আর অপমানে আনন্দ আর সেই মেয়েটির সাথে কোনোদিন কথাও বলেনি। সমস্যাটা তোথায়, সেটাই বুঝতে পারেনি বেচারা। আহারে তার প্রথম প্রেম !
তারপর বাবার কারণে খুলনা, কুষ্টিয়া, নারায়ণগঞ্জ, ফেণী, কুমিল্লা কত জায়গায় যে থাকতে হয়েছে তাকে। এর মধ্যে মেট্রিক পরীক্ষা দিলো। কলেজে ভর্তি হলো। কত মেয়েকে যে ভালো লাগলো। কিন্তু সাহস করে কাউকে আর বলতে পারেনি- 'ভালোবাসি'। যদি সেই মেয়েটিকে কাউকে বলে দেয় ? যদি আবার হাসে। আনন্দ মিয়ার জীবনে আর প্রেম করা হলো না।
প্রেম না হলেও একটা অভ্যাস ইতিমধ্যে তার হয়ে গেছে। বেড়ানো। অজানা, অচেনা শহরে চলে যেতো সে। একা, কখনো বা বন্ধুদের সাথে। এই ঘোরাঘুরির কারণে কত্ত বকা যে খেয়েছে জীবনে। একসময় পরিবারের সবাই হাল ছেড়ে দিয়েছে। আর একটি অভ্যাস ছিলো আনন্দের। বই পড়া। দস্যু বনহুর, মাসুদ রানা, কুয়াশা দিয়ে শুরু। তারপর হুমায়ুন আহমেদ। কিশোর ক্লাসিক। অনুবাদ। সব ধরণের বই পড়তেই ভালো লাগতো। সুনীল, শীর্ষেন্দু, শংকর...। এছাড়াও ম্যাগাজিন পড়তো। কেনার সাধ্য ছিলো না। কিন্তু পত্রিকা স্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে সব ম্যাগাজিনই পড়তো। একসময় মনে হতো- লিখবে। সাহস করে দু-একটি ম্যাগাজিন আর পত্রিকায় লেখাও পাঠালো। অবাক কান্ড। সেসব লেখা ছাপাও হতে থাকলো। আনন্দের আর আনন্দের সীমা ছিলো না।
সময় যেতে থাকলো এই ভাবেই। আনন্দ আরো বড় হলো। লেখাপড়ার পাঠ চুকলো তার। চাকরী জীবনে ঢুকলো। জীবনের প্রথম বেতনের টাকা দিয়ে মাকে একটা শাড়ি কিনে দিলো। আহ, সেকি আনন্দ। বিশ্ব জয় করলেও বুঝি এত আনন্দ হতো না। ঈদের সময় ভাই বোনদের জামা কাপড় কিনে দিত। যা আয় করতো তার চেয়ে বেশি খরচ করতো। বাজে অভ্যাস একটা অবশ্য এর মধ্যে রপ্ত করে ফেলেছিলো। সিগারেট খাওয়া।
এর মাঝে বলা নেই, কওয়া নেই, হঠাৎ করে তার মা মারা গেলেন। খুব চুপসে গেলো আনন্দ। বাবার সাথে কোনোদিনই তার সখ্যতা ছিলো না। যা আবদার আর খুনশুটি সবই মায়ের সাথে। সেই মা চলে যাওয়ার পর আনন্দের জীবনে আবারো ছন্দপতন ঘটলো। বড় বেশি একা হয়ে গেলো আনন্দ। কেমন জানি চুপচাপ হয়ে গেলো।
সময় চললো তার আপন গতিতে। বড় ভাই বিয়ে করলেন। বড় বোনটার বিয়ে হলো। এবার আনন্দের পালা। ছন্নছাড়া আনন্দ। বাউন্ডুলে জীবনে অভ্যস্ত ছেলেটিকে সংসারি হবার তাগাদা দেওয়া শুরু করলো সবাই। কিন্তু যাযাবর জীবনে কাউকে সঙ্গী করতে চায় না সে। এভাবেইতো ভালোই চলছে জীবন। চলুক না। বললেই কী আর হয়। একসময় তাকেও সংসারি হতে হলো। শুরু হলো আনন্দের নতুন এক জীবন। যেখানে কোনো প্রত্যাশা ছিলো না। তাই প্রাপ্তির কথাও অবান্তর। দায়িত্বের বেড়াজালে পড়ে আনন্দের জীবন কাহিল। সংসারের নিত্য দিনের প্রয়োজন। কত-শত সামাজিকতা। জীবন নামের শেকল।
সংসার করছে সেও অনেকদিন। পনের বছর কম সময় না। সবকিছু চলছিলো মানে 'তবুও জীবন যাচ্ছে কেটে জীবনের নিয়মে...'। এর মাঝে হঠাৎ করেই আবারো ছন্দপতন । বলা নেই, কওয়া নেই আনন্দ প্রেমে পড়লো কিংবা ভালোবাসায়। কেনো ? সেটা নিজেকে নিজে প্রশ্ন করেও উত্তর মেলেনি। ভালোবাসাতো বলে কয়ে হয় না। আনন্দ আমার কাছে জানতে চায়। আমি কী বলবো ? ব্যাটা ভালোবাসায় জড়িয়েছিস তুই, আর জিজ্ঞেস করছিস আমাকে ? ওর নতুন ভালোবাসার নাম জানতে চাইলাম। কী করে, কোথায় থাকে, কীভাবে হলো- কিছুই বলে না। খালি হাসে। শুধু একদিন বললো- তার নতুন ভালোবাসার নাম 'পেতনি'। মানে এই নামেই ডাকে তাক। ব্যস, আর কিছু নয়। আজকাল মহা চিন্তায় আছি আনন্দকে নিয়ে।
ফুটনোট: আনন্দ আসলে বন্ধুটির নাম নয়। আর পেতনিও তার ভালোবাসার মানুষটির নাম নয়। একদিন নিশ্চয়ই আনন্দের ভালোবাসার বিত্তান্ত জানবো। সেদিনের অপেক্ষায় আছি আমি। প্রিয় পাঠক: আপনিও অপেক্ষায় থাকুন...
অনেকদিন পর ব্লগে মেসবাহ ভাইয়ের লেখা পেলাম।
আনন্দ মিয়ার ঘটনা বেশ ইন্টারেস্টিং মনে হইতেছে।
বিত্তান্ত জানার অপেক্ষায় থাকলাম....
ম্যালাদিন পর বস
অপেক্ষায় আইজুদ্দিন
আন্নদের নাম ক্রে আপ্ন কিছু পরিবেশ্ন হচ্ছেনাতো ? অনেকদিন পরে এলেন । ভাল থাকুন ।
আনন্দকে আমি চিনি কিন্তু পরিচয় ডিসক্লোজ করে তাকে লজ্জা দিতে চাই না আর। একবার এক মেয়ে দিয়েছে
মোশাররফ করিম বলেছে, "প্রেম হইলো কাকের গু, কখন কার ওপরে পইড়্যা যায় আগে থেকে বুঝন যায় না"
প্রেম চলুক
আনন্দ আনন্দে থাকুক!
আনন্দের কী হলুদ রংয়ের প্রতি দূর্বলতা আছে?
আনন্দ নামটা সৌন্দর্য আছে। আনন্দ আনন্দে থাকুক
আনন্দের পথচলা আনন্দময় হোক।
মন্তব্য করুন