মরতে মরতে এবারও বেঁচে গেলাম
৩ জুন কোলকাতা যাবার প্ল্যান আমাদের তিন জনের। এটা পুরোনো গল্প। গত মাসের শেষের দিকে টিকেট করে রেখেছে এক বন্ধু। জিপি ব্যবহারের বদৌলতে ১০% ছাড়ের অফার ছিলো সৌদিয়া বাসে। বন্ধুকে বললাম। সে পাত্তা দিলো না। টিকেট কাটলো গ্রিণলাইন বাসের। পান্থপথ থেকে বাসে উঠলাম রাত ১১.৩০ এ। ছাড়ার সময় ছিলো ১১.১৫। গোড়ায় গলদ। ভয়াবহ গরম। বাসে উঠে টের পেলাম- এসিটা ঠিকমত কাজ করছে না। কী আর করা। আল্লার নাম নিয়ে রওয়ানা দিলাম।
কল্যাণপুর পার হতে না হতে ঘেমে গেলাম। এসি চলে না। কেবল ফ্যান চলে। ফলে বাস নো কুল। এদিকে আমরা ৪০ জন কুল কুল করে ঘামছি। গাইড বিনয়ের সাথে বললো, আর কোনো বাস ডিপোতে নাই। ফলে মোটামুটি চলে এমন বাস দিয়েছে কর্তৃপক্ষ। যেহেতু আগাম ৪০ টিকিটই বিক্রি হয়ে গেছে। বাসে ৭/৮ জন নারী। সাথে শিশু আছে ৪ জন। আস্তে আস্তে বাসের ভেতরটা ঠান্ডা হলো। আসলে আমরা গরমে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম ততক্ষণে। কিংবা বাইরের আবহাওয়া একটু একটু করে ঠান্ডা হচ্ছিলো।
পাটুরিয়া ফেরি ঘাটের আগে মাইল দেড়েক লম্বা লাইন। বাস থেকে নেমে পড়লাম আমরা। আকাশে বিশাল একখান চাঁদ। রাস্তার পাশে গরম পরোটা ভাজছে। পরোটা আর ডিম দিয়ে রাতের খাবার শেষ হলো আমাদের। মোবাইল হকাররা আম, লিচু, আনারসসহ বিবিধ মৌসুমি ফর বিক্রি করছে। হাঁটতে হাঁটতে অনেক দুর চলে আসলাম আমরা। বাইরে ঝিরঝির হাওয়া। ফেরিঘাটে দুইটায় পৌঁছলাম। ফেরিতে উঠলাম তিনটা ত্রিশে। ওপাড়ে গেলাম চারটা ১৫তে।
ফেরি থেকে বাস উঠার সময় টের পেলাম, আমাদের পাইলট রাস্তা চিনে না। বায়ে যাবার কথা, যাচ্ছে ডানে। গাইড তৈয়বকে ডেকে জানতে চাইলাম- "বাজান, তোমাদের গাড়িতে এসি নষ্ট। সিট ভালো না। গান বাজনা নাই। ড্রাইভার ভুল পথে চালাচ্ছে। ঘটনা কী ?" তৈয়ব হেসে বললো, স্যার ড্রাইভার ঠিক আছে। পুরোনো লোক। তবে এই রুটে জীবনে প্রথম আসছে...। শুনে বেকুব বনে গেলাম। ৪০ জন যাত্রী নিয়ে রাতের বেলা নতুন ড্রাইভার ? বললাম, তুমি চিনোতো ? আবার হাসলো তৈয়ব। অমায়িক হাসি। জ্বী স্যার, মুখস্ত রাস্তা আমার। শুনে কিঞ্চিত আশ্বস্ত হলাম। বাস চলছে। বেশিরভাগ যাত্রী ঝিমাচ্ছে। বন্ধুদের সাথে শেয়ার করলাম পুরো বিষয়টা। আর যে বন্ধুটি টিকেট করেছে- তাকে ঝাড়লাম। সে মুখ নিচু করে হাসছে...
ফরিদপুর পার হলাম। মধুখালী এলাকা। সকাল ৫ টা ৪০ বাজে। হঠাৎ বিকট আওয়াজ গাড়িতে। লাফ দিয়ে সামনে চলে আসলাম। বাসের পাইলট মহোদয় সামনের একটা কাভার্ড ভ্যানের সাথে প্রচন্ড জোরে বাড়ি মারলো। বাসের বাম পাশের গ্লাস, দরজা সব ভেঙ্গে গেলো মূহুর্ত্যে। আমাদের বাস রাস্তার ডানদিকে যাচ্ছে আস্তে আস্তে। পাশেই খাদ। এই অবস্থায় পাইলট তার বিশাল দেহ নিয়ে কী করে জানি জানালার ছোট্ট গ্লাস দিয়ে বেরিয়ে গেলো। বাস তখনো চলছে। তবে আস্তে আস্তে। পাইলটের পিছে পিছে হেলপারও লাফ দিলো বাস থেকে। আমি শুধু দেখছি। সব ঘটনা ঘটতে বড় জোর ২ মিনিট লেগেছে। বাস থেমে গেলো। মনে হলো অদৃশ্য কোনো পা এসে ব্রেক করে থামিয়ে দিলো। চিৎকার দিয়ে বন্ধুদের ডাকলাম। বাসের সব যাত্রী এক জোটে চেঁচাতে লাগলো। কার আগে কে নামবে, এই প্রতিযোগীতা শুরু হলো। সামনে দাঁড়ালাম আমি। চিৎকার দিয়ে বললাম, একজনও নামবেন না গাড়ি থেকে। গাড়িতে একবার চোখ বুলিয়ে দেখলাম, সবাই ভয পেয়েছে। কিন্তু শারীরিকভাবে ভালো আছে। আবার সামনে এসে দাঁড়ালাম।
মিনিট দশেকের ভেতর গ্রামের শ খানেক লোক চলে এলো। সবাই গাড়িতে উঠতে চায়। জানতে চাইলো, কেউ আহত হয়েছে কি না ? বললাম, কেউ আহত হয়নি। আমরা ঠিক আছি। তারপরও তারা নাছোড়বান্দা। গাড়িতে উঠবেই। আমিও গোঁ ধরেছি, কাউকে উঠতে দেবো না। গাড়িতে একবার উঠতে পারলে ওরা কী করবে, জানি। স্রেফ লুটপাট।
এর মধ্যে গাইড তৈয়বের কাছ থেকে নাম্বার নিয়ে ঢাকা অফিসে যোগাযোগ করলাম। ওদের বললাম, প্রথম কাজটি হলো পুলিশ পাঠানো। তারপর একটা গাড়ি। এর মধ্যে একটা ছেলে ভাঙ্গা দরজা দিয়ে কথা বলছে আমার সাথে। হাতে ব্রাশ। গলায় একটা গামছা আর লুঙ্গি। বললো, স্যার আমার নাম হাসান। আমি এই গ্রামের ছেলে। গ্রিণলাইনে কাজ করি। গাইড। এই বাসের গাইডকে আমার নাম বলেন, সে চিনবে। তৈয়বকে ডাকলাম। তৈয়ব চিনলো ওকে। তারপর হাসানের সহযোগিতা নিয়ে একজন করে যাত্রীদের নামালাম বাস থেকে। ভাঙ্গা দরজা আর গ্লাস বাকীটা ভাঙলাম। হাসানকে দেখে গ্রামের অতি উৎসাহী লোকজন আস্তে আস্তে সরে গেলো।
ঘন্টাখানেক বাদে গ্রিণলাইনের আরেকটা বাস আসলো। সেই বাসে সব মালামাল তুললাম। যাত্রীদের উঠালাম। হাসানকে ধন্যবাদ আর ঈশ্বরকে স্মরণ করে নতুন বাসে উঠলাম। আমরা সবাই। আমাদের বাসের পাইলট আর হেলপারকে কোথাও খুঁজে পেলাম না। আমাদের বাস ছাড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে, এমন সময় দেখলাম এক গাড়ি পুলিশ এলো। বাংলা সিনেমার মত। সব ঘটনা ঘটে যাবার পরে পুলিশ আসে। আমাদের বাস ছাড়লো ৭ টা ২০ মিনিটে। গন্তব্য: বেনাপোল।
বেনাপোল পৌঁছলাম সকাল দশটার দিকে। সেখানে বন্ধু অঞ্জনদের একটা বাড়ি আছে। সেখানে যেয়ে গোসল সেরে সামান্য কিছু খেয়ে নিলাম। মনের মধ্যে একটা ভয় আর আতঙ্ক। একবার ভাবলাম, রেস্ট নিয়ে ঢাকায় ফিরে যাই। আবার ভাবলাম, নাহ ঘুরেই আসি। তবে আসলেই বেশ ভয় পেয়েছি। দুঃস্বপ্নের মত লাগছে সব। বর্ডারে গিয়ে দেখি, হাজার হাজার লোক। সবাই মনে হয়, তীর্থে যাচ্ছে। ঘন্টা তিনেক লাইন ধরে গরমে সিদ্ধ হয়ে সারারাত জাগা আমরা যখন ওই পাড়ে গেলাম, তখন বেলা একটা। আবার বাসে। বাসে উঠে মরার মত ঘুমালাম। কোলকাতা পৌঁছার পরে সে ঘুম ভাঙলো। গালিব স্ট্রিটে নামলাম, স্থানীয় সময় ৫ টায়। শুরু হলো নতুন বিড়ম্বনা।
গোটা বিশেক হোটেল খুঁজেও কোথাও রুম পেলাম না। যেই ২/১ টায় পেলাম তাদের ১ হাজার টাকার রুম ভাড়া চাচ্ছে ৩ হাজার টাকা। আজ মনে হয় বাংলাদেশিদের মেলা বসেছে কোলকাতায়। সন্ধ্যা ৭ টা নাগাদ হোটেলে রুম পেলাম। মূল এলাকা থেকে মাইল খানেক দুরে। তবে রুওমে ঢুকে মন ভালো হয়ে গেলো। চমৎকার রুম। ফুল এসি ছেড়ে দিয়ে রেস্ট নিলাম। আবার গোসল করলাম। কোলকাতার তাপমাত্রা ৪২ ডিগ্রি। রুম থেকে বের হতেই ইচ্ছে করছে না। তারপরও খেতে বের হলাম রাতে।
পরদিন সারাদিন ঘুরলাম। মেট্রোতে এক্সপ্লানেড থেকে সেন্ট্রাল। বড় বাজার। সেখানে কিছু কাজ, কিছু কেনাকাটা সারলাম। ভরদুপুরে হাঁটা শুরু। মহত্মা গান্ধী স্টেশন থেকে আবার মেট্রো ধরে এক্সপ্লানেড। নিউ মার্কেট এলাকা। এখানে ফুটপাত, শ্রী লেদার, বাজার কোলকাতা, খাদিম, খাজানা হয়ে আবার হোটেলে। রাতে আর নামিনি গরমের জ্বালায়। হোটেলেই খেয়ে নিলাম। তারপর আড্ডা, টিভি দেখা আর ঘুম। পরদিন দুপুর বারোটায় বাস। এবার আর গ্রিণলাইন না, সৌদিয়া বাসে।
বাস ঠিক সময়েই ছাড়লো। বর্ডারে আসলাম ৪ টা নাগাদ। ইমিগ্রেশন, কাস্টম সেরে আবারও অঞ্জনদের বাড়িতে। দুপুরের খাবার এখানে সারলাম। বাস ছাড়লো ৬.৩০ এ। কিছুদুর আসার পরে চেকপোস্ট। ব্যাগ-ট্যাগ সব খুলে একাকার আমার বিজেবি ভাইদের। তিন জোড়া জুতা কেনো ? তিনটা থ্রি পিস কেনোরে ভাই ? এত্ত চকলেট কে খাবে ? এইসব প্রশ্ন শুনে মেজাজ খারাপ। তারপরও সব মেনে নিলাম। আমাদের বাস ছেড়ে দিলো।
ফেরিতে আজ আর দেরি হলো না। বাসায় আসলাম রাত ১.৫৫ মিনিটে। এসে দেখি, রোদ্দুর জেগে আছে। খেলা দেখছে বার্সেলোনার ফাইনাল ম্যাচ। বার্সা জিতলো ৩>১ গোলে। ঘুমাতে গেলাম সাড়ে তিনটা নাগাদ। ঘুম আর আসে না। কেবলি চোখে ভাসছে- সেই ভয়াবহ দূর্ঘটনার দৃশ্য। যদি কিছু হয়ে যেতো ? মরে টরে যদি যেতাম ? কি হতো তাহলে ? এ যাত্রাও মনে হয় বেঁচে গেলাম। আহ, জীবন কত আনন্দময়। সমুদ্দুর ঘুমিয়ে আছে। ওকে আদর করে বারান্দায় একটু হাঁটাহাঁটি করে তারপর আবার শুতে গেলাম। কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি জানি না...
"পাইলট জানালার ছোট গ্লাস দিয়ে বের হয়ে গেলো"- অভিজ্ঞতাতো ভয়াবহ। এরকম অভিজ্ঞতা সচরাচর দেখা যায় না। শেষটা পড়ে শান্তি লাগলো। এখানে অবশ্য রোদ্দুর-সমুদ্দরের মা কিংবা গৃহকত্রীকে মিস করলাম।
আসলেই অভিজ্ঞতা ভয়াবহ। ভয়টা দুর হচ্ছে না কিছুতেই। তবে আশার কথা হলো, এখনো দিব্যি বেঁচে আছি। বেঁচে থাকাটা অঅআনন্দের, সেটা আবারও টের পেলাম...
এরকম একটা নামকরা বাস কোম্পানী থেকে এ ধরনের অপেশাদার আচরন আশাই করা যায় না।
এসব দেখার কেউ নেই ক্যাপ্টেন। এটাই 'আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি...'
তবে আপনে যেভাবে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করেছেন, সেটা সবচেয়ে বড় দিক এই ঘটনার। স্যালুট বস্
এইরকম অবস্থায় কী করে জানি আমার ব্রেন বেশ ভালোই কাজ করে। মানুষও এত্ত খারাপ হয় ! খালি লুটপাটের ধান্দা... তবে বাসটা খাদে পড়লে খবর ছিলো।
বিশাল বিপদ থেকে বাঁচলেন। এইবার ভাদাইম্মার মত ঘুরাঘুরি কমান। ঘর সংসারে সময় দেন। পোলার ঘুরনের টাইম আসছে। আপনি বিশ্রাম করেন।
এইটা কী বললা বেলি। আমি ভাদাইম্মা ? ঘোরাঘুরি না করলে বাঁচুম কেমনে ? তয় আসলেই বড় বাঁচা বাঁচলাম। ডরাইসি...
আপনি ভাদাইম্মা না হইলে আর কে ভাদাইম্মা!!!!
চল বিষ্যুদবার রাইতের বাসে সিলেট যাই (শুরু হইবো হাজারটা বাহানা)
আমি তো বাহানা করার মানুষ না। জানেন তো এই দেশটা মেয়েদের জন্য কতটা নিরাপদ! আর সে কারণেই একটা মেয়ে যতক্ষণ বাইরে থাকে তার পরিবার উৎকন্ঠায় থাকে। এমনি বাবা-মাকে খুব স্বস্তি দিচ্ছি না, তাই আমাকে নিয়ে তাদের উৎকন্ঠা আর বাড়াতে চাই না। আর হ্যাঁ, এখন তো নিজেও উৎকণ্ঠায় থাকি নিজের নিরাপদ থাকা নিয়ে
মরতে মরতে এবারও বেঁচে গেলেন মানে? এর আগেও মরতে বসেছিলেন নাকি
হুম, কয়েকবার... কবে যে হুট করে নাই হয়ে যাবো- কেবল ওপরওয়ালাই জানেন।
ঘুরাঘুরি বন্ধ করেন। আর কত?
যতক্ষণ শ্বাস, ততক্ষণ আশ
ড্রাইভারে গরু ছাগল চিনে কিন্তু কভার্ড ভ্যান চিনে নাই
সদা সুস্থ থাকেন ভালো থাকেন। এই কামনা করি
জ্বী জনাব, ঘটনা সইত্য। ধন্যবাদ, শুভ কামনার জন্য।
রিপোর্ট করেন নাই গ্রীনলাইনের বিরুদ্ধে?
আর "এত চকলেট কে খাইল?"
আমাদের নিয়া বার হন না আর কই কই টইটই করে বেড়াচ্ছেন! ঠিক হচ্ছে না ব্যাপারটা.।।
রিপোর্ট কৈরা লাভ কী ?
আর তুমি চকলেট দিয়া কী করবা ? এমনি যা হাল...
ঘুরতে যাইবা, তোমরা ? হাজারটা বাহানা করবা পরে...
মন্তব্য করুন