ময়না কাহিনী
ছোট বোনের নাম সুলতানা শিপলু। তার এক বান্ধবীর নাম মিতু। ক্ষাণিকটা 'স্থুল' স্বাস্থ্যের অধিকারীনি বলে তাকে ছাত্রজীবন থেকেই 'পরোটা' ডাকা হয়। আরে না, আমি না। ডাকে আমার ছোট বোন আর তার অন্য বান্ধবীরা। সম্প্রতি ছোট বোনের বাচ্চা হবার পরে হাসপাতালে সেই 'পরোটা'র সাথে দেখা হয়েছে। তিনি এখন আর পরোটা নাই। মাশাল্লাহ দেখতে তিনি 'পাঁচ পয়সা'র মতন। বাংলাদেশে একসময় পাঁচ পয়সার মুদ্রা ছিলো, যারা দেখেছেন তারা বুঝতে পারছেন আশা করি। আর যারা দেখেননি, তাদের জন্য বলি, পরোটা আপা এখন আক্ষরিক অর্থেই চারকোনা। নায়িকা মৌসুমি, শাবনুরের মতন। তো, আজকের লেখার ক্যারেকটার কিন্তু পরোটা আপা না। তার খালাতো বোন ময়না।
আমার দেখা দুজন মানুষ। যাদের সেনস অব হিউমারের কাছে পৃথিবীর কারো তুলনা চলে না। একজন প্রিয় লেখক হুমায়ূন আহমেদ, অন্যজন রায়হান। রায়হানরা কুমিল্লা থাকতো। কুমিল্লার আগে ওর বাবার পোস্টিং ছিলো নোয়াখালী। ওর বাবা ছিলেন জনতা ব্যাংকের কর্মকর্তা। ওরা দুই ভাই বোন। রায়হান আর ময়না। এই ময়নার গল্প আমি এত্ত শুনেছি যে, ওর সাথে প্রথম দেখা হবার পর আমি বেশ কিছুটা সময় ওর দিকে তাকিয়ে বুঝার চেষ্টা করছিলাম যে, এইটা কি সেই ময়না ? কী ব্যাপার, আপনার এমন অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন কেন ? ঘটনাটা বিস্তারিত না বললে, আপনাদেরর মধ্যে একটা কৌতুহল বা ভুল বুঝার সুযোগ থাকবে। সে সুযোগতো আমি আপনাদের দিতে পারি না, তাই না ?
আমার জনৈক বন্ধু। জনতা ব্যাংকে চাকুরি করে। দেখতে শুনতে ভালোই বলা চলে। লম্বায় ক্ষাণিকটা খাটো। এই ৫ ফুট ৪ ইঞ্চি হবে। ধরে নেই ওর নাম শাহনুর। আমরা ওকে আদর করে ডাকতাম শানু বলে। এই শানুর সরাসরি বস ছিলেন, আমাদের ময়নার বাবা। আর শানুও ছিলো নোয়াখালীতে। তো, আমাদের শানুকে কী কারণে জানি ময়নার বাবা পছন্দ করতেন। একটু বেশিই বোধকরি করতেন। একদিন তিনি শানুকে ডেকে যা বললেন, তার শানে নজুল হচ্ছে: অফিসের পরে যেহেতু সে ফ্রি থাক, সেহেতু ভদ্রলোকের ছেলে মেয়ে দুটিকে একটু পড়াশুনাটা দেখিয়ে দিতে পারে। যদি তার কোনো আপত্তি না থাকে।
আপত্তি থাকার কোনো কারণও ছিলোনা। তিনটে কারণে শানু রাজি হয়ে গেলো। এক: নয়টা- পাঁচটা অফিস করার পর শানুর আর তেমন কোনো কাজ ছিলো না। দুই: কিছু বাড়তি টাকাও উপার্জন হবে। তিন: সে জেনেছে, তার স্যরের মেয়ে ময়না আট বা নয় ক্লাসে পড়ে। আচ্ছা, কোন কারণটা আগে হবে বলুনতো ! বা বলা যায়, কোনটা ছিলো শানুর কাছে গুরুত্বপূর্ণ ? শানুকে অবশ্য ফোন করে জিজ্ঞেস করা যায়। সেটা কি ঠিক হবে ? কতদিন আগের ঘটনা ! তাছাড়া 'কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে চায়...' ! আমরা বরং সামনের দিকে আগাই।
শানু যথারীতি পরদিন থেকে ময়না আর রায়হানের প্রাইভেট শিক্ষক হয়ে যায়। সন্ধ্যার পরে পড়াতে যায়, ফিরে নয়টা নাগাদ। প্রায় দিনই শানুর স্যারের স্ত্রী মানে আমাদের পরোটার খালা শানুকে রাতের খাবার খাইয়ে দেন। ছেলেটা মেসে থাকে। কী না কী খায়। আহারে মায়ের মন। ক্রমে শানু ওই পরিবারের একজন হয়ে যায়। সেটাইতো স্বাভাবিক, নাকি ? আগে প্রতি সপ্তাহের শেষ দিনে চলে যেত নিজের এলাকায়। ছুটি কাটিয়ে ফিরতো একদিন পর। ইদানীং মাসে একবার যায় কী যায় না।
একদিন পেলাম তাকে। আমাদের আড্ডার যায়গায় এসে হাজির শানু। ৪ বন্ধু মিলে আড্ডা দিচ্ছি। আমি, মনু, বাসু, জহর। রাত নটার মত বাজে। শানু এল, সবাই হৈ হৈ করে ওকে ঘিরে ধরলো। ঘোষনা দেয়া হলো, আজকের আড্ডার সব খাবারের বিল শানু দেবে। ও এককথায় রাজি হয়ে গেলো। সবাই খুশি। আমি খুশি হতে পারলাম না। এত সহজেতো ওর রাজি হবার কথা না। 'ডাল ম্য কুছ কালা হ্যায়'। আড্ডার এক পর্যায়ে 'প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেবার নাম করে' শানুকে ডেকে নিলাম আড়ালে। তারপর ওর কাছে শুনলাম, ওকে ঢাকা অফিসে বদলি করা হয়েছে। কথাটা এমনভাবে বললো, যেনো ওর ফাঁসির আদেশ হয়েছে। আমি বললাম, ভালোইতো, যা ঢাকায়। শানু বললো, সে কিছুতেই নোয়াখালি ছেড়ে ঢাকা যাবে না। আমার হাত চেপে ধরে রাখলো বেশ কিছুক্ষণ। আমি যা বুঝার বুঝে গেলাম। আপনারা বুঝতে পেরেছেন কিছু ? বুঝলে ভালো, না বুঝলে আমি কী করতে পারি !
তারপর কি হলো ? বলছিরে ভাই। এত অধৈর্য্য হলে চলবে ? শানু যথারীতি নোয়াখালি ছেড়ে ঢাকায়। আমিও বদলি হয়ে চলে এলাম ঢাকায়। আমি তখন স্কয়ারে। সেটা ১৯৯৩ সাল। মাস তিনেক বাদে ময়নার বাবাও বদলি হয়ে গেলেন নোয়াখালি থেকে। এবার তার কর্মস্থল কুমিল্লা। আর আমাদের পরিবারের বসতিও কুমিল্লায়। ছোট দুই ভাই আর বোনকে নিয়ে বাবা থাকেন কুমিল্লায়। বড় ভাবী ঢাকায়। আমি ঢাকায়। আমাদের 'মা' নেই। সেটা কি বলেছি কোথাও ? না বললে এখন বলছি। 'মা' মারা গেছেন ১৯৮৮ সালে।
আমি মাসে এক দুবার যাই কুমিল্লায়। বৃহস্পতিবার রাতে যাই। শুক্রবার রাতে ফিরে আসি ঢাকায়। আমি কুমিল্লা গেলে শুক্রবার আমাদের বাসায় বন্ধু/বান্ধবীদের হাট বসে। আমাদের বাসার নাম জানেনতো ? না জানলে বলছি। আমাদের বাসার নাম 'যন্ত্রণা'। ভাবছেন, এটা কেমন নাম ! কী করবো বলুন আপনারাই। যে বাসায় সারাদিন জুড়ে চলে আড্ডা আর খাওয়া দাওয়া। এত্ত এত্ত বন্ধু/বান্ধবী আমাদের ছিলো যে, ওরা আমাদের বাসাটাকে নিজেদের মনে করতো। যখোন তখোন এসে আমাদের রান্না করা খাবার চেটে পুটে খেয়ে নিতো। বেশিরভাগই ছিলো ছোট ভাইবোনদের ক্লাসমেট। আমাদের কমন ফ্রেন্ডও ছিলো কয়েকজন। আর সে কারণেই বাসার এই নামকরণ।
কোনো এক শুক্রবার মিস পরোটা, তার খালাতো ভাই রায়হান, বোন ময়না এলো আমাদের বাসায়। এই প্রথম রায়হান আর ময়নার সাথে আমার দেখা। কথাবার্তা আর অাড্ডার এক পর্যায়ে জানলাম, এই সেই ময়না। যার বাবা জনতা ব্যাংকে জব করেন। যারা কিছুদিন আগে নোয়াখালি ছেড়ে কুমিল্লায় এসেছে। যাদের একজন গৃহশিক্ষক ছিলেন, যার নাম শাহনুর। আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকি ময়নার দিকে। অনেকক্ষণ বাদে আস্তে করে ওদের বলি, শাহনুর আমার ন্যাংটা কালের বন্ধু। একথা শোনার পরে ময়না হঠাত করে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকায়। আমিও তাকিয়ে থাকি। চোখের ভাষায় অনেক কথা বলা হয়। অনেক আকুতি ঝরে পড়ে ওর চোখে।
সেদিন সন্ধ্যায় ফিরে আসি ঢাকায়। পরদিন শানুর বাসায় যাই। ওর সাথে কত শত কথা হয় আমার। ময়নার প্রসঙ্গও আসে। আমি একবারের জন্যও বলি না ওকে যে, ময়না আমাদের বাসায় এসেছিলো কাল। ময়নাকে আমি চিনি। বা ময়নার সাথে 'চোখে চোখে' আমার অনেক কথা হয়েছে। কেনো বলিনি জানি না। বললে হয়তো নিজেই জড়িয়ে যেতাম ওদের ঘটনার সাথে। বা ওদের জীবন কাহিনী অন্যভাবে লেখা হতো। বা হয়তো কিছুই হতো না। কে জানে ?
লেখাটা পড়ার তীব্র ইচ্ছা গিলে ফেললাম।
গলায় আটকায় নাইতো !
না। কিভাবে গিলে ফেলতে হয় সেটা শিখে গেছি। তাই কিছুই আর আটকায় না।
এভাবে ব্রেক করার কোন মানে হয়
মাঝে মাঝে হঠাতই ব্রেক করতে হয়। লোকজনের উচ্ছাসে পানি ঢেলে দেবার মধ্যেও এক ধরণের আনন্দ আছে... হা হা হা
ছুডুকালের ভালুবাসার গল্প! বিয়াপুক মজা পাই আমি এইরকম গল্পগুলো পড়তে
কী সৌভাগ্য আমার। আপনার মতো প্রখ্যাত লেখিয়ে আমার এলেবেলে লেখা পড়ে মজা পান ! তাও বিয়াপক... ধন্যবাদ, ধন্যবাদ
ভাল লাগলো।
বাকিটা কি পরের পর্বে?
গল্পটা পড়ে ভাল লাগল কিন্ত ভারতীয় সিরিয়ালের মতো অসমাপ্ত রেয়ে গেল।আশা করি পরবর্তি অংশটুকু আবার লিখবেন। ধন্যবাদ সুন্দর হয়েছে চালিয়ে যান
ছোট্ট বেলার প্রেম
মন্তব্য করুন