কোলিয়া সিনিৎসিনের ডাইরী (পর্ব ৩)
কোলিয়া সিনিৎসিনের ডাইরী (পর্ব ২)
কোলিয়া সিনিৎসিনের ডাইরী (পর্ব ১)
জুন ৬
আমি সারাদিন সবাইকে জিজ্ঞেস করলাম কোথায় মৌমাছি পাওয়া যাবে, কেউই কিছু বলতে পারল না। সকাল্বেলা মনটা খারাপ লাগছিল। বাড়ী ফিরে দেখি আলিওশা কাকুকে।
“কি হয়েছে খোকা,” বললেন উনি “মন খারাপ কেন?”
“আমার মৌমাছি লাগবে, জানিনা কোথায় পাব।”
“মৌমাছি কি জন্য লাগবে আবার?”আমি আলিওশা কাকুকে আমাদের মৌমাছি পোষার ব্যাপারটি খুলে বললাম। “কিন্তু আমরা মৌমাছি কোথায় পাব?”
“দাঁড়া দাঁড়া,” আলিওশা কাকু বললেন। “আমি এক সময় গাঁয়ের এক মৌমাছি পুষিয়েকে চিনতাম। আমার যদি ঠিক মনে থাকে, তবে ও মৌমাছি ধরত ফাঁদ পেতে।”
“কি রকম ফাঁদ?”
“ওটা একটা ফুটোঅলা প্লাইউডের বাক্স। অনেকটা পাখির বাসার মত। ও ওটার মধ্যে মধু দিয়ে রাখত তারপর জঙ্গলের কোন গাছের সঙ্গে ঝুলিয়ে রাখত। মধুর গন্ধে মৌমাছি আসত, কখনো ঝাঁক বেঁধে ওটাতে বাসা বাঁধত। এরপর ও বাক্সটা বাড়ী নিয়ে যেত এবং মৌমাছিগুলোকে মৌমাছির ঘরে চালান দিত। তুইও এমন ফাঁদ বানাতে পারিস নিজে নিজেই, তারপর যখন গাঁয়ে যাবি মা’র সাথে ওটা ঝুলিয়ে দিবি গাছের সাথে। তুইও হয়ত এমন এক ঝাঁক পেয়ে যাবি।”
আমি মা’কে জিজ্ঞেস করলাম আমরা কবে গাঁয়ে যাব।
“খুব শিগগীরই না,” জবাব দিল। “আমার ছুটি জুলাইয়ের শেষে বা অগাস্টে পাব।”
আমি সেরিওঝাকে গিয়ে বললাম ফাঁদের ব্যাপারে।
“আয় আমরা একটা বানাই,” বলে ও।“আমরা গাঁয়ের বাড়ীতে নিয়ে যাব ওটা। ওখানে একটা সুন্দর জঙ্গল আছে। নদীও আছে।”
“কোথায় ওটা?”
“শিশিগিনোতে।”
“থাকা যাবে?”
“অবশ্যই। পোলিয়া মাসী ছাড়া আর কেউ ওখানে থাকে না।”
আমি দৌড়ে বাড়ী গিয়ে মা’র কাছে সেরিওঝাদের গাঁয়ের বাড়ীতে যাবার অনুমতি চাইলাম।
“বোকামো করিস না,” মা চটে গেলেন। “অপরিচিত জায়গায় তোকে কি করে একা ছেড়ে দেই?”
“ওটা খুব দূরে নয়, মাত্র ৫ কিলোমিটার।আমরা হেঁটেই যেতে পারব।”
“না, তোর যাওয়া হবে না,” মা বলে। “একা একা অখানে কি করে থাকবি?”
“আমরা একা না তো, পোলিয়া মাসীও থাকবেন।”
“পোলিয়া মাসী! উনি কোনমতেই তোদের মত ছেলেদের সামলাতে পারবেন না।”
“কিন্তু আমরা ভাল হয়ে থাকব, সত্যি ভাল”
“না, না। আমার যখন ছুটি হবে আমরা এক সাথে যাব। আমাকে ছাড়া গেলে হয় তুই নদীতে দুবে যাবি।নয় জঙ্গলে হারিয়ে যাবি।নয় অন্য কিছু হবে।”
আমি দিব্যি দিলাম যে, চানে যাবনা, নদীর কাছেই যাবনা। জঙ্গলে গিয়ে হাঁটবনা। কিন্তু মা কান দিলেন না।আমি ঘন্টাখানেক ধরে কাকুতি মিনতি করতে থাকলাম, যতক্ষণ পর্যন্ত মা বাবাকে বলে দেবার হুমকি দিলেন যদি আমি না থামি। তাই আমিও চুপ করে গেলাম। রাতে খেলাম না আর এখন ঘুমুতে যাচ্ছি পেতে ক্ষিদে নিয়ে। তাতে কিছু যায় আসে না।
জুন ৭
আজকে একটু বেশী আগে উঠলাম সকালে মাকে ভজানোর জন্য। মা চুপ করতে বললেও আমি চুপ করলাম না। চেষ্টা চালিয়ে গেলাম ওর অফিসে যাওয়া পর্যন্ত। তারপর আমি গেলাম সেরিওঝার ওখানে, ও বলল যে ও আর পাভলিক গাঁয়ে চলে যাবে। আমি যদি অনুমতি আদায় করতে না পারি, তাহলে আমাকে ফেলেই।সারাদিন বসে রইলাম একেবারে মন খারাপ করে। আর মা অফিস থেকে ফিরতেই আগের চাইতেও বেশী কাকুতি মিনতি করতে লাগলাম।মা ভয়ানক চটে গেলেন আর বাবাকে বলে দেবার ভয় দেখালেন। আমি দমলাম না। যা হয় হোক।বাবা বাড়ী ফিরলেন শেষ পর্যন্ত।
“কেনো যাবেনা?” মা কথাটা তুলতেই বাবা বলল।“এ তো খুবই ভাল। ও এখন বড় হয়েছে। এক্টু-আধটু স্বাধীন হবার সময় হয়েছে।”
মা বলল বাবা নাকি সবসময় নাক গলায় আর বাচ্চা (আমাকে) ঠিকভাবে মানুষ করা একেবারে অসম্ভব করে তোলে।আর বাবা বলল মা নাকি আমাকে ঠিকভাবে মানুষ করছে না। তাদের মধ্যে প্রায় ঝগড়া লেগে গেল, কিন্তু মিটমাট হয়ে গেল তাড়াতাড়ি। মা গেল সেরিওঝার মায়ের কাছে আর দু’জনে সব ঠিকঠাক করল।সেরিওঝার মা বললেন যে,আমাদের কোন ঝামেলা হবে না। পোলিয়া মাসী আমাদের দেখাশোনা করবেন আর রান্না করে দেবেন।
মা নিশ্চিন্ত হলেন এটা শুনে, তারপর বলল আমাকে ৩ দিনের জন্য যেতে দেবে। আর আমি যদি ভাল হয়ে চলি, তাহলে আবারো আসতে দেবে। আমিও ভাল চলার দিব্যি দিলাম।
সবাই মহা উত্তেজিত হয়ে উঠল যখন শুনল আমরা গাঁয়ে যাচ্ছি মৌমাছি ধরতে। ইউরা আমাদের একটা কম্পাস দিল যাতে আমরা বনের মধ্যে পথ না হারাই। তোলিয়া দিল একটা পেন্সিল কাটার ছুরি।ফেদিয়া দিল রান্নার একটা সেট যদি আমরা আগুন জ্বালিয়ে রান্না করতে চাই।আমরা একটা প্লাইউড দিয়ে ফাঁদ তৈরী করলাম। দেখতে দিব্যি হল। ওটার সামনে একটা একটা ফুটো দিলাম আর একটা ছোট্ট দরজা দিলাম। যা মৌমাছি ভিতরে ঢুকলে আটকিয়ে দেয়া যায়। একটা ঢাকনাও বানালাম মৌমাছির ঘরে যেমন বানিয়েছি, যাতে মৌমাছি ধরতে পারি।
মা অনেক খাবার দিয়ে দিল সঙ্গে নেবার জন্য-সিরিয়াল, ময়দা, মাখন, রুটি আর টিনের খাবার। আমার পিঠের ঝোলা এসব দিয়ে বেশ ভারী হয়ে গেল, সেরিওঝারটাও বেশ মোটা আমারটার মত। কিন্তু পাভলিকেরটার হল সবচে’ বড়। ওরটার মধ্যে আছে রান্নার পাত্র, পানির বোতল আরও অনেক কিছুই। সব তৈরী এখন। আমার তো মহা উত্তেজনা লাগছে, কালকে শিশিগিনোতে যাবার তর সইছে না।
জুন ৮
হুরররে! আমরা চলে এসেছি শিশিগিনোতে।সেরিওঝাদের গাঁয়ের বাড়ীটা কাঠের ছোট্ট একটা বাংলো যার আশে পাসে কতগুলো গাছ। কোন বেড়া-টেড়া পর্যন্ত নেই।কতগুলো খুঁটি মাটিতে পোঁতা দেখে বোঝা যায় যে, বেড়ার কাজ শুরু হয়েছিল কিন্তু শেষ হয়নি। আমরা যখন পৌঁছালাম কেউ ছিল না, বাড়ীতে তালা দেয়া ছিল।পোলিয়া মাসী কোথাও গিয়েছিল।আমরা অপেক্ষা করছি করছি, শেষটা ভাবলাম সময় নষ্ট না করে জঙ্গলে গিয়ে ফাঁদটা ঝোলান যাক।আমরা বাক্সের মধ্যে মধু দিয়ে ওটাকে একটা গাছের সাথে ঝুলিয়ে দিলাম। তারপর নদীতে গেলাম চান করতে। জল ঠান্ডা ছিল, কিন্তু আমাদের বেশ আমোদ হল ছিটিয়ে।এক সময়ে আমরা উঠে পড়লাম। আমাদের শরীর নীল হয়ে গেল ঠান্ডায় আর দাঁতে দাঁতে বাড়ি খাচ্ছিল। আমাদের মারাত্মক খিদে পেয়েছিল।
নদীর তীরে আগুন জ্বেলে, টিনের মাংস খুলে সে আগুনে রান্না করে খেলাম। দিব্যি হয়েছিল খেতে। খাবার পর আবার বাড়ী ফিরে গেলাম, পোলিয়া মাসী তখন আসেননি।
“আচ্ছা যদি আমরা একটা গাছের গর্তে একগাদা মৌমাছি পাই, তাহলে কি দারুণ হবে নারে?” পাভলিক বলে।
“তা হবে, কিন্তু এমন গর্ত আমরা কোথায় পাব?”
“চল আমরা মৌমাছিদের দেখি, দেখি ওরা কোথায় যায়।” বলে পাভলিক “ওরা মধু জোগাড় করে আবার মৌচাকে ফেরত যাবে যখন, আমরা ওদের পিছু পিছু গিয়ে দেখব ঝাঁকটা কোথায় থাকে।”
আমরা দেখলাম একটা মৌমাছি একটা ফুলের ওপর বসেছে, আমরা দেখতে লাগলাম। ওটা এক ফুল থেকে আরেক ফুলে উড়ে যাচ্ছিল। আর আমরা হামা দিয়ে ওটার পিছু নিলাম, একবারেই চোখের আড়াল করলাম না।
কতক্ষন পর আমার গা ব্যাথা শুরু হল হামা দিতে দিতে-দুই হাত,দুই পা আর পিঠ। কিন্তু মৌমাছিটা ফুলে ফুলে মধু খেয়ে যেতে থাকল। মৌচাকে ফিরে যাবার কোন লক্ষণই ছিল না।
শেষে সেরিওঝা বল্লঃ “আমার মনে হয় মৌমাছি অনেক দেরী করে বাড়ী ফেরে। চ’ আবার চান করি। মৌমাছির পিছু নেবার জন্য অনেক সময় আছে।”
আমরা আবার নদীতে নাইতে নামলাম।জলে থাকলাম সূর্য ডোবা পর্যন্ত।কাপড় পরে ঘরে ফিরে দেখলাম পোলিয়া মাসী তখনো আসেননি।
“হয়তো উনি শহরে গিয়েছেন আর আজ রাতে নাও ফিরতে পারেন।” আমি বলি।
“বোকার মত কথা বলিস না। উনি নিশ্চয়ই ফিরবেন।” বলে সেরিওঝা। “কোথায় যাবেন উনি?”
“ধর যদি না-ই ফেরেন, আমরা বরং বাড়ী ফিরে যাই।”
“আমি কোত্থাও যাবনা, আমি ভীষণ ক্লান্ত।” পাভলিক বলে।
“আমরা কোথায় ঘুমাব?”
“আমরা পড়শীদের কাছে যেতে পারি এক রাত থাকতে দিতে।” সেরিওঝা প্রস্তাব করে।
“না না , তা করিস না। আয় গাছের ডাল দিয়ে ছাউনী বানিয়ে খোলা জায়গায় ঘুমাই।” পাভলিক বলে।
“ভাল বুদ্ধি তো! ছাউনীতে ঘুমাতে মজা হবে। আমি কোনদিন ঘুমাইনি। কিন্তু কিভাবে বানাবি?” সেরিওঝা বলে।
পাভলিক জানে কিভাবে বানাতে হয়। আমরা কাজে লেগে পড়লাম। কতগুলো গাছের ডাল ভেঙে নিলাম, পাভলিক চারটে লম্বা লাঠি বের করল, তারপর সেগুলো কোণাকুণি করে দাঁড় করাল পিরামিডের মত করে। তারপর কতগুলো ডাল এর চারপাশে দিয়ে দিলাম। শুকনো ঘাস বিছিয়ে দিলাম মেঝেতে শোব বলে। আমাদের ঝোলাগুলো বালিশ হল। ভেতরটা বেশ আরামের, অবশ্য বেশ গাদাগাদি হচ্ছিল।
আমরা ঠিক করলাম আর কোথাও যাবনা কেননা আমরা খুবই ক্লান্ত। একবার ভাব সারাদিন কত্ত হাঁটাহাটি করেছি আমরা-প্রথমে শহর থেকে হেঁটে এলাম, তারপর গেলাম জঙ্গলে, নদীতে, ঘরে ফিরলাম, আবার গেলাম নদীতে, এলাম ঘরে, তারপর আবার ঘরে। এক মাসে একটা লোক যত হাঁটে, আমরা একদিনে তার বেশী হেঁটেছি। তারপর আবার ছাউনীটা বানালাম।
এখন ঘরের সিঁড়িতে বসে আছি, বিশ্রাম করছি। ফাউন্টেন-পেনটা দিয়ে ডাইরী লিখছি। সেরিওঝা আর পাভলিক আশ-পাস দেখে বাহ বাহ করছে। কি যে সুন্দর-নীরব একটা বিকেল।কোন বাতাস নেই। গাছপালাগুলো চুপ করে আছে। শুধু এ্যাসপেন গাছের পাতা একটু একটু নড়ছে। দেখে মনে হচ্ছে রূপো দিয়ে বানানো।আকাশটা পরিস্কার, সূর্যটা ডুবছে জঙ্গলের পেছনে। যৌথখামারের গরুগুলো ফিরছে ঘরে। আলসেভাবে এগোচ্ছে। ওরা প্রায় পঞ্চাশটার মত-কালো, বাদামী, পাটকিলে, বুটি বুটি, সাদা-কালো দাগওলা আর কতগুলো এমনকি গোলাপী।এখন সূর্যটা অর্ধেক ডুবে গেছে। একটু পর আমরা নিজেদের ছাউনীতে গুড়ি মারব আর ঘুমিয়ে পরব। এখনো অন্ধকার হয়নি, কিন্তু এখুনি হয়ে যাবে।এখানে এই অন্ধকারে বসে থাকার কোন মানে হয়না যখন আমাদের একটা আরাম করার জায়গা রয়েছে ঘুমুনোর।
(চলবে)
হি হি ... সুন্দর... তোমার অনুবাদ অনেক ভাল হয়, পড়তে মজা লাগে ... চলুক ...
চলবে, যদি আমি না মরি...
দারুণ অনুবাদ, প্রাণবন্ত! পরের পর্বের অপেক্ষায়।
অপেক্ষাটা এবার একটু বেশীই করালাম আপা, দুঃখিত।
এই সিরিজের পাংখা হইয়া গেলাম। চলুক চলুক।
গরমকালে পাংখার বাতাস? ধন্যবাদ।
আপনের অনুবাদের ভক্ত হইয়া গেলাম। সিরিয়াস।
পরের পর্ব আসুক তাড়াতাড়ি।
সরি ভাই, দেরী হয়ে গেল।
আমরাও মুগ্ধ হইয়া পড়তাছি...
তাই?? ধন্যবাদ।
...আপনি কি অনুবাদ বই বের কর্ছেন? করলে নাম দেন, না করলে অতি অবশ্যই করেন...অনুবাদের হাত আপনার অসাধারন, বিশেষ কৈরা রাশিয়ান রাদুগা স্টাইল...
রাশিয়ান "ভেরা পানোভা"র পিতা ও পুত্র পড়ছেন? অসাধারন একটা বই...
আশা করছি বের করব। আমি ইচ্ছা করেই রাদুগা স্টাইলটিকে রেখে দিয়েছি।
পড়েছি। আপনি ভেরা চাপলিনার আমাদের চিড়িয়াখানা পড়েছেন?
দারুণ অনুবাদ, প্রাণবন্ত! মুগ্ধ
অসংখ্য ধন্যবাদ।
চমৎকৃত
প্রাণবন্ত অনুবাদ
ধন্যবাদ দাদা।
আমি আসলে কোলিয়া সিনিৎসিন মানুষটা কে তাই জানি না। শুরু থেকে সব পড়া দরকার আমার। তাইলে বুঝবো।
সময় থাকলে পড়ুন।
পরের পর্ব কই??
দিলাম তো।
দারুন অনুবাদ
অসংখ্য ধন্যবাদ।
মন্তব্য করুন