Ice-cream, you scream....
১)
পোস্ট উৎসর্গ
নাজ রহমান, আনিকা আলম
বিন্দু বিন্দু করে গড়ে তুলি সৃষ্টির মহাসমুদ্র।
আইসক্রিম বললেই চোখ বন্ধ হয়ে আসে, মুখের ভেতর শিরশিরে ঠাণ্ডা অনুভূতি হয়। এমন কি কেউ আছেন যে আইসক্রিম পছন্দ করেন না? আমার তো আইসক্রিমের নামেই জিভে জল আসে। কোথা থেকে এল এই মজার জিনিষ? বাইবেলে আছে রাজা সলোমন নাকি ঠাণ্ডা শরবত পান করতে পছন্দ করতেন নতুন ফসল ওঠানোর সময়। খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকে আইসক্রিমের আবির্ভাব ঘটে কিন্তু ঠিক কবে আর কে এর আবিষ্কার করে বলা মুশকিল। রোমান সম্রাট নিরো এবং ক্লডিয়াস সিজার (খ্রিস্টাব্দ ৫৪-৮৬) লোক পাঠিয়ে পাহাড়ি বরফ আনাতেন। সে বরফের সাথে ফল আর ফলের রস মিলিয়ে খেতেন। সেটাকে বলা চলে আদি আইসক্রিম। চীনের তাং শাসনামলে (খ্রিস্টাব্দ ৬১৮-৯০৭) বরফের একরকম ডিশ রাজন্যরা মজা করে খেতেন। তাং রাজার নাকি ৯৪ জন বরফ-বাহক কাজ করতেন। সেই ডিশ গরম দুধ, ময়দা এবং কর্পূর দিয়ে তৈরি হত। এর পর ঐ মিক্সচার একটা ধাতব টিউবে ভরে মাটির নিচে রেখে দেয়া হত। অনেক পরে ভারতে কুলফি এভাবে তৈরি হত। মার্কো পোলো চীন থেকে ইতালিতে ফিরে এসে যে রেসিপি সবাইকে দিয়েছিলেন আজ সেটা শরবত বলে পরিচিত। নেপলসের স্পেনিয় ভাইসরয় আন্তোনিও লাতিনি (১৬৪২-১৬৯২) সর্বেত্তোর একটি রেসিপি লিখে রেখেছিলেন। তিনি দুধ দিয়ে যে শরবত বানিয়েছিলেন ইতিহাসে একেই প্রথম অফিশিয়াল আইসক্রিম বলে ধরে নেয়া যায়। ইংল্যাণ্ডে প্রথম চার্লসের টেবিলে ‘ক্রিম আইস’ নিয়মিত পরিবেশন করা হত, সুতরাং বোঝা যাচ্ছে ইতালিয়দের সাথে প্রায় এক সময়েই ইংলিশ রাজারা আইসক্রিম খাচ্ছিল। ইতালির ক্যাথারিন দে মেদিচি ফ্রান্সের রাজা দ্বিতীয় অঁরির সাথে ১৫৫৩ সালে বিয়ের সময়ে রুগেরি নামে এক রন্ধনবিশারদকে নিয়ে গিয়েছিলেন। সেই রন্ধনবিশারদ ফ্রান্সের রাজদরবারে আইসক্রিম পেশ করেন। ১৬৬০ সালের আগে আমজনতা আইসক্রিম খান নি। পালের্মোর প্রোকোপিও দেই কোলতেলি ১৬৮৬ সালে প্যারিসে খোলেন কাফে প্রকোপে। রাজা চতুর্দশ লুই বিশেষ লাইসেন্স মঞ্জুর করেন শুধু তিনিই এই মজাদার খাদ্য বানাবেন এই মর্মে। জানা যায় আমেরিকার প্রথম প্রেসিডেন্ট জর্জ ওয়াশিংটন ১৭৮৯ সালে ২০০ ডলার খরচ করেছেন আইসক্রিম খাবার জন্য।
সম্ভবত পৃথিবীর প্রথম আইসক্রিমের বিজ্ঞাপন
আইসক্রিমের রেসিপি বই আকারে প্রথম বের হয় ১৭৬৮/৬৯ যা ছিল কোন এক এম.এমি-র The Art of Making Frozen Desserts. ২৪০ পৃষ্ঠার বইটিতে শুধু আইসক্রিমের রেসিপিই ছিলনা, এর ধর্মীর ও দার্শনিক ব্যাখ্যাও ছিল! ১৭৭৪ সালে নিউ ইয়র্কের সংবাদপত্রে জনাব ফিলিপো লেঞ্জি জানাচ্ছেন যে তিনি সবে মাত্র লন্ডন থেকে পৌঁছেছেন এবং বিক্রি করবেন জ্যাম, জেলি , পেস্ট্রি আর আইসক্রিম। এটাই সম্ভবত ইতিহাসের প্রথম আইসক্রিমের বিজ্ঞাপন। ১৮৪৩ সালে ন্যান্সি এম. জনসন (১৭৯৫-১৮৯০) আবিষ্কার করেন হাত-আইসক্রিম তৈরি যন্ত্র। এই যন্ত্রের মূল নকশাটি এখনও ব্যবহৃত হয়। ঐ যন্ত্রের সাহায্যে ঘরে বসে সহজেই আইসক্রিম তৈরি করা যেত। ন্যান্সি ১৮৪৩ সালের ৯ সেপ্টেম্বর যন্ত্রটি পেটেন্ট করেন। ১৮৫০ সালে কার্লো গাতি (১৮১৭-১৮৭৮) পেনি আইস বিক্রি শুরু করেন। গাতি আইসক্রিমের গাড়িকে জনপ্রিয় করে তোলেন। মানুষের হাতে হাতে পৌঁছে যায় আইসক্রিম। প্রথম বিপুল পরিমাণে আইসক্রিম তৈরি করেন ১৮৫১ সালে মেরিল্যান্ডের জ্যাকব ফুসেল নিজের কারখানায়।
ন্যান্সি জন্সনের আইসক্রিম যন্ত্র
২)
আইসক্রিম বললে ছোটবেলার কথা মনে পড়ে। ১৯৭৫/৭৬ সালের দিকে যা খেতাম ওটাকে আইসক্রিম বলে না,বড় জোর কুলফি-মালাই। হাতে ১০ পয়সা থাকলে দুনিয়া কিনে ফেলা যেত। আমরা ২টা পিপাসা আইসক্রিম কিনতে পারতাম। এটা আসলে তেমন আহামরি কিছু না,ইংরেজি পপসিকল আইসক্রিমের বাংলা ভার্সন। ১ টাকায় লুসি আর বেবি আইসক্রিম পাওয়া যেত ১৯৭৮/৭৯-র দিকে যত দূর মনে পড়ে। ইগলু পয়সাওয়ালাদের জন্য। ৪ টাকা ছিল চকবার। বেবি আইসক্রিম আম্মা কিনে দিত না,কারণ ওটা সম্ভবত পাকিস্তানি মালিকানাধীন ছিল। আজকাল যেমন আইসক্রিমগুলো পুরো প্যাকেট করা থাকে ফুড গ্রেদ প্যাকেটে, তখন অর্ধেক প্যাক করা থাকত সাধারণ কাগজে। পোলার প্রথম ফুড গ্রেড প্যাক করা শুরু করে। পোলারের চকবারের সাইজ বেশ বড় ছিল ইগলুর তুলনায়। তোপখানাতে ইগলুর একটা পার্লার ছিল। আহারে কত যে মিস করি সেই একটা আইসক্রিম গ্লাসে সাদার ওপল লাল ডোরা আইসক্রিম বল,তার ওপরে একটু পাফ দেয়া। নিউ মার্কেটের যেখানে এখন আরজুদা ফ্যান্সি স্টোর, সেখানে ছিল নভেল্টি নামে একটা দোতলা আইসক্রিম পার্লার। আমি এত ছোট থেকেই ওটা দেখেছি, তাই অনুমান করি পাকিস্তানী আমল থেকেই ওটা ছিল। ওটা উঠে যাওয়ায় মর্মাহত হয়েছিলাম। এখন যেমন প্লাস্টিক আইসক্রিম বক্স কেনা যায়,তখন ইগলুওয়ালারা কাগজের শক্ত সুন্দর প্যাকেটে আইসক্রিম বিক্রি করত। কোন আইসক্রিম ঢাকায় প্রথম আনে প্রেস ক্লাবের কাছে সাবনুরিয়ান নামে একটা দোকান। কি সুন্দর করে যে দিত। প্রথমবার আম্মা নিয়ে খাইয়েছিল। পরে অভীক (অনিন্দ্য কবির) আর আমি প্রায় ১ মাসের টিফিনের টাকা বাঁচিয়ে একা গিয়ে খেয়েছিলাম। পোলার আইসক্রিমের সাইজ আর চকবারের চকলেটের স্বাদ খুব ভাল লেগে গিয়েছিল। কোয়ালিটির কিছু খেয়েছি বলে মনে পড়ে না। চাঁদনী চকের দোতলায় হরেক ফ্লেভারের আইসক্রিম খেয়েছিলাম ফ্লেমিঙ্গোতে। দোকানটা কি আছে এখনও? স্কুলের সামনে বাংলা কোন আইসক্রিম পাওয়া যেত, টিফিন পিরিয়ডে, মূল্য ২ টাকা মাত্র।
বাংলা কোন আইসক্রিম ওয়ালা শফি। ছবিটা তাতাপার বাসার সামনে থেকে তোলা।
আম্মারা পাকিস্তান রাষ্ট্র তথা নিজদের শৈশবে খেত কুলফি, ১ পয়সা করে। একটা কাঠির ওপর বরফ চেপে লাগিয়ে দিয়ে তার ওপর একটু সিরাপ ঢেলে দেয়া হত। ব্যস অমৃত তৈয়ার। আম্মা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পড়তে এসে খেয়েছিল বেবী আইসক্রিম। আইসক্রিমের গাড়ি কিন্তু আম্মার চোখে পড়েনি। গুলিস্তান সিনেমা হলের উল্টা দিকে ছিল বেবী আইসক্রিম পার্লার। ইগলুর আইসক্রিম পার্লার আসে আরও পরে, ১৯৬৪ সালে। ইগলুতে তিনটা করে স্কুপ থাকত উপরে ক্রিম পাফ- আম্মার ভাষায় বিলিতি সিস্টেম। বেবী আইসক্রিম পার্লারের কথা বলল রোজি খালাও। রোজি খালা আম্মার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের বান্ধবী। খালারা ছোটবেলা খেত কুলফি। ঐ বাংলা পপসিকল খালারাও খেয়েছে, চিনির পানিরটা ১ পয়সা, রঙিন পানিরটা ২ পয়সা। রোজী খালার ছোট মামা বা নওয়াব মামা (কাজী আনোয়ার হোসেন) খালাকে নিয়ে যেতেন বেবী আইসক্রিম পার্লারে। সেসব দিন নাকি খুব স্পেশাল লাগত। কি ভীষণ মেমসাহেবি ব্যপার ছিল পার্লারের ভেতর। আম্মার বান্ধবী শিরিন খালারাও ঐ কুলফিই খেত। বাজারে নিয়ে গেলে খালার বাবা কিনে দিতেন ১ পয়সার কুলফি। বেবী আইসক্রিমের মালিক পরিবাবের সাথে শিরিন খালাদের পরিবারের হৃদ্যতা ছিল। এই পরিবারের ছেলে হারুণ ‘তানহা’ নামে একটি সিনেমায় অভিনয় করেছিলেন, নায়িকা ছিলেন শাকিলা। শিরিন খালারা সপরিবারে ছবিটি দেখতে গিয়েছিল। জিজ্ঞেস করলাম কেমন লেগেছিল, খালা মুখ কোঁচকালো। ১৯৫৬ সালে বেবী মওদুদের পরিবার ঢাকার আজিমপুরের সরকারী কলোনীতে আসেন। বিডি আর্টসে তাঁর ধারাবাহিক শৈশব স্মৃতিতে জানিয়েছেন আজিমপুর-পলাশীর মোড়ে ছিল বেবী আইসক্রিম কারখানা। বেবী আইসক্রিম পাওয়া যেত এক আনায় লাল ঘ্রাণযুক্ত কাঠিতে। দুই আনায় পাওয়া যেত দুধসাদা আইসক্রিম।
৩)
দৈনিক কালের কন্ঠে সূত্রে জানা যায়-আইসক্রিম প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর বলেছে, বর্তমানে বাংলাদেশের আইসক্রিম বাজারের আকার প্রায় এক হাজার কোটি টাকার। বছরে বাজার প্রবৃদ্ধি প্রায় ৩০ শতাংশ। দেশেই উৎপাদিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক মানের আইসক্রিম। ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা ও ময়মনসিংহে স্থাপিত হয়েছে অসংখ্য আইসক্রিম পার্লার। বাংলাদেশের আইসক্রিম বাজারের ২০০৯ সালের একটি হিসাব দেখুন-
দেশে আইসক্রিম শিল্পে বিনিয়োগ বেড়েছে, বেড়েছে ভোক্তাও। আনন্দ-বিনোদনের উপাদান হিসেবে ফাস্ট ফুডের পাশাপাশি আইসক্রিমও যুক্ত হয়েছে। আইসক্রিম খায় যে ১০টি দেশ ১ থেকে ১০ ক্রমানুসারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, নিউ জীল্যান্ড, ডেনমার্ক, অস্ট্রেলিয়া, বেলজিয়াম/ লুক্সেমবার্গ, সুইডেন, কানাডা, নরওয়ে, আয়ারল্যান্ড এবং সুইজারল্যান্ড। সমগ্র আইসক্রিম শিল্পের মূল্য ১১ বিলিয়ন ডলার। হিসেবে দেখা যায় যে ২০১৫ সালের মধ্যে সারা বিশ্বে আইসক্রিম খাবার পরিমাণ দাঁড়াবে ১৫ বিলিয়ন লিটার। সারা বিশ্বের হিসেবে কি বাংলাদেশকে ধরা হয়েছে? বেবী আইসক্রিম থেকে নিউ জীল্যান্ড ন্যাচারালস বাংলাদেশ-আমাদের সামনে রয়েছে অনেক বড় রাস্তা।
আইসক্রিম এখন আর রাজা বাদশাহদের স্পেশাল খাবার নয়, সাধারণ মানুষের ঘরে ঘরে পৌঁছে গেছে তা। খাদ্য বিজ্ঞান করে এর পুষ্টি গুণের ওপর গবেষণা আর মার্কেটিং করে এর বাণিজ্যের লাভালাভের ওপর গবেষণা। কি হব এত চিন্তা করে? আইসক্রিম পাই, খাই সেটাই আসল কথা। ঘরে বসে আইসক্রিম বানাতে চান? আমরা বন্ধুর আনিকা আপার এই পোস্ট দেখে বানিয়ে ফেলুন ইয়াম্মি আইসক্রিম। তারপর এই গান শুনতে শুনতে খেতে থাকুন।
ICE Cream
গানের কথাগুলো মিলিয়ে নিনঃ
ICE CREAM
by Johnson, Moll, & King
In the land of ice and snow
Up among the Eskimo
There's a college known as Oogie-wawa.
You should hear those college boys
Gee, they make an awful noise
When they sing their Eskimo tra la la.
They've got a leader, big cheer leader, oh what a guy!
He's got a frozen face just like an Eskimo Pie.
When he says, "Come on, let's go!"
Though it's forty-five below
Listen what those Eskimo all holler:
I scream, you scream, we all scream for ice cream!
Rah, rah...Oogie de wawa rah rah rah!
Tuesday, Monday, we all scream for Sundae!
Sis, boom, Aurora borealea, bah!
Boola boola
Sasparoola
We've got the chocolate
I'll take vanoola
I scream, you scream, we all scream for ice cream!
Rah, rah, ice cream soda or gingerale po
দারুন পোস্ট!
চার টাকা থুক্কু ডলার দিয়ে ৪ লিটার বাটারস্কচ আইসক্রিম কিনেছি...সেটাই চলছে হরদম...
~
ক্ষুদে ব্রান্ড এম্বাসেডর

আহা বেশ বেশ বেশ!
দারুন ইতিহাস, চমত্কার পোস্ট।
আজ খেয়ে এলাম
হোকি পোকি, লাভড ইট!
আইসক্রীম খালা ওয়েলকাম ব্যাক। পোষ্ট প্রিয়তে রেখে দিলাম।আপনার লেখা মানে হইলো, স্যাকরার ঠুকঠাক আর কামারের এক ঘা
পোস্ট আর আইসক্রিম দুইটাই উপাদেয়
মজার আইসক্রীম পোষ্ট!
আই স্ক্রীম, ইউ স্ক্রীম , উই অল লাভ আইসক্রীম!!
পোষ্ট অনেক জোস, আইস্ক্রিমের আদিকথা, এরপরে তোমার নিজের কথা, আনিকার কীর্তি (ও ঘরে কেক বানায় জানি, এইটাও যে পারে জানতাম না) আর পরে গিয়ে নাজের আইস্ক্রীম পার্লারের খোঁজ দে্যা, সব মিলায়ে আহা, পুরাই দিন ঠান্ডা ঠান্ডা পোষ্ট!
শুরু করার আগে শোরুমে একদিন গেলাম, মেয়েটা কত্তো কি কষ্ট করতেছে, কত সমস্যা পদে পদে ফেস করতেছে! অনেক শুভকামনা ওর জন্যে যেন দারুন করে চলুক ওর আইসক্রিম পার্লারটা
মন্তব্য করুন