ইউজার লগইন

রশীদ করীমের গল্পগ্রন্থ নিয়ে কয়েক প্রস্থ আলোচনা

রশীদ করীম উপন্যাসিক হিসেবে খ্যাতিমান ছিলেন। শহুরে মধ্যবিত্তরা এককালে তাঁর উপন্যাস খুব পড়তো। কিন্তু এখন কাউকে উনার নাম বলতেই শুনি না। এমন তো না যে উনি স্রেফ পাঠক প্রাপ্তির আশায় লিখেছিলেন, উনি লিখেছিলেন তাঁর সময়ের গল্প তাঁর মতো করেই। তাঁর গদ্যের সহজিয়া, ভাষার গতিশীলতা, মধ্যবিত্তের- মন- সন্দেহ- প্রেম- রাজনীতি, দেশ বিভাগের আগেই সেই মুসলমান মধ্যবিত্তের উত্থান, নিয়ে লিখেছেন বলেই, পাঠক উনার উপন্যাস এক বসায় পড়ে ফেলতো। আমার এক বন্ধু আমার মুখে রশীদ করীমের গল্প শুনে, তাঁর বাবাকে বলছিল। তাঁর বাবা অবাক যে রশীদ করীমের নাম ছেলের মুখে শুনে, রশীদ করীমের উপন্যাস নাকি কতো পড়েছেন উনি ফটোকপি করে। যাক শান্তি পাওয়া গেল কারো না কারো মনে তো আছে। তবে গল্পকার হিসেবে রশীদ করীমের তেমন সুখ্যাতি আছে বলে আমি কারোর মুখে শুনি নাই। তাঁর ভাই আবু রুশদের বরং গল্পকার হিসেবে স্বার্থকতা এখনো বাংলা সাহিত্যের পাঠকরা মনে রাখে। রশীদ করীম যে গল্পকার তাই আমি জানতাম না। প্রথম জানি কামাল ভাইয়ের বই 'বাংলা গল্পের উত্তাধিকারে'। মেলা থেকেই কেনা হয় রশীদ করীমের গল্পগ্রন্থ 'প্রথম প্রেম"। অনেক বই পড়ার ভীড়ে কোথায় লুকিয়ে ছিল জানি না। বইটা পেলাম আর পড়ে ফেললাম তিন-চারদিন আগে।

বইটার ভুমিকা অথবা রশীদ করীমের ভাষায় 'কয়েকটি কথা', সত্যি অনবদ্য। তিনি ক্লাস এইটে থাকতে নাকি অংকে ছিলেন খুব কাঁচা। ঠাট্টা করে বলেছেনও গোল্লা পেলেও নাকি কেউই অবাক হতো না। এমন সময় একটা পত্রিকা তাঁদের হাতে আসে, তাঁদের ক্লাস ক্যাপ্টেন অরুন জানান দিলেন, আমরা এর চেয়েও ভালো পত্রিকা বের করবো। রশীদ করীমকে সেই অরুনই ভার দেয় গল্প লেখার। সবার ভাবনা ছিল, অংকে যে শুন্য পায় তাঁর পক্ষেই হয়তো গল্প লেখা সম্ভব। তখন রশীদ করীম এক কিশোরীর দৃষ্টি লাভের আশায় হকিতে ড্রিবলিং ছোটাতো, ছক্কা হাকানোর চেষ্টা করতো। কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। শেষে একটা গল্প লিখে ফেললো, যার শেষটা কি হবে তা তিনি মেলাতে পারছেন না। বাধ্য হয়ে সেই কিশোরীকেই দেখানো। সেই কিশোরী রশীদ করীমের চেয়ে ছোট হলেও, বুদ্ধিতে ছিলেন পাকা। তিনি গল্প পড়ে মুগ্ধ হয়ে বললেন, গল্প তো শেষ আর কি লেখবে? তাই জমা দিলো রশীদ করীম। এইভাবেই শুরু তিনি গল্প লিখেন। যেখানেই দেন সেখানেই দেখা যায় গল্প ছেপে দেয়। সওগাত, মোহাম্মদী, নবযুগ, মিল্লাত, ইত্তেহাদে সমানে তাঁর গল্প ছাপা হয়েছে। সেই লেখা ছাপা হবার পরে তিনি সুন্দরী চেনাজানা মেয়েদের উচ্ছসিত দৃষ্টিও কাড়তে সমর্থ হন। কিন্তু একটা মেয়ের জন্যেই তাঁর এত চেষ্টা। মেয়েটিও নাকি উচ্ছসিত ও মুগ্ধ হতো সওগাতের মত পত্রিকায় একটা আনকোরা ছেলের এমন গল্প লেখার প্রতিভা দেখে। ১৯৪২-৪৬ থেকে ছিল তাঁর গল্প লেখার দিন গুলো। রেডিওতে গল্প পড়েছেন সমানে। একদম কমবয়সে। ফ্যাসিবাদী বিরোধী গল্প লেখার ফরমায়েশ পালনে তিনি ইচ্ছে মতো খালি যুদ্ধের বর্ণনা দিয়ে চলেছেন তখন। চরিত্রে মুসলমান নাম ও জীবনযাপন থাকার কারনে ফররুখ আহমেদের উৎসাহ পেয়েছেন। সৈয়দ আলী আহসান, আহসান হাবীব, আবুল হোসেন এর অনুপ্রেরনা ছিল দারুন। একটা গল্পের কারনেই তিনি সেই আমলে সিগনেট প্রেসের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের মতো জায়গায় দাওয়াত পেয়েছিলেন। অল্পবয়সে এত খ্যাতি তখন আর কোনো মুসলমান তরুন পায় নি। সেই মেয়েটিরও বিয়ে হয়ে গেল। তিনিও গল্প লেখা ছেড়ে দিলেন। দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো রশীদ করীমের সেই গল্পগুলো দুটো বাদে আর সব হারিয়ে গেছে। গল্প গুলো আর খুজেই পাওয়া যায় নাই। আমি নিশ্চিত গল্প গুলো যার কাছে যেমন লাগুক, আমি দারুন উপভোগ করতাম। এরপর দীর্ঘ বিরতি দিয়ে তিনি ষাটের গোড়াতেই লিখে ফেললেন, বিখ্যাত উপন্যাস উত্তম পুরুষ!

রশীদ করীমের গল্পের সব চেয়ে দারুন ব্যাপার হলো সহজ জীবনের গল্প। তিনি গল্পকে অহেতুক এক্সপেরিমেন্টের জ্বালাতন দিয়ে কঠিন করেন নি। জীবন যেমন, তিনি যেভাবে ভাবতেন, যা করতেন তাই নিয়েই গল্প। আর তাঁর ছন্দময় ভাষার সহজ গদ্যে আপনি মুগ্ধ হতে বাধ্য। তবে এখনকার সমালোচকদের কাছে তাঁর গল্পগুলো তেমন উত্তম কিছু মনে হবে না। কিন্তু আমার তো রশীদ করীমের সবই তো পড়া, তাই আমি পড়েই বুঝতে পারি তিনি তাঁর সময়ের চেয়ে কত আধুনিক গল্প লিখতেন। 'প্রেম একটি লাল গোলাপ' গল্পটা সত্তর দশকের শুরুতেই লেখা। গল্পে দুজন নায়ক নায়িকা মধ্যবয়স্ক। একই সময় একই রাস্তায় গাড়ী চালাতে চালাতে দেখা হয়। কথা হয় না। কিন্তু নায়ক কত কথা প্রতিদিন ভাবে সেই নায়িকার কথা চিন্তা করে। নায়কের সংসার আছে, সন্তান আছে। নায়িকারও তাই। কিন্তু নায়ক ভেবে যায় প্রেমে পড়লো সেই নায়িকারই, এক দিন না দেখা হলে নায়কের মনে রাজ্যের হতাশা ঘিরে রাখে। কিন্তু কোনোদিনও তাঁদের কথা হয় না, গল্পটা চমৎকার। 'জোড়াতালি দিয়ে গল্প' গল্পটা ব্লগ লেখার মতো গল্প। লেখক এক সাহিত্য সভায় যাবে। সঙ্গে শামসুর রাহমান, শওকত আলীরা। দিনলিপি ও কত কি ভাবছেন কতকিছু নিয়ে তাই লিখে গেছেন। এখনকার এক ব্লগ পোষ্টের মত। মাঝে মাঝে ভাবি রশীদ করীমের মতো লেখক যদি কোনো ব্লগে লিখতেন তবে কি দুর্দান্ত এক ব্যাপার হতো। 'মৃত্যু সংবাদের পর দু ঘন্টা' গল্পটা ছাপা হয় ৭৯ সালে সাপ্তাহিক চিত্রালীতে। গল্পের নায়কের ভাই মারা গেছে তিনি কলকাতা নিবাসী, ঢাকায় থাকা তাঁর ছোটভাই কিভাবে নানান স্মৃতি রোমান্থন করছেন ও শোকেও তেমন কান্না পাচ্ছে না এইসব ভেবে চিন্তিত, তেমন একটা গল্প। নাগরিক ভনিতা, জীবন জীবিকার টানাপোড়েন না থাকলেও যে মানুষ কত কিছু নিয়ে ভাবে তেমন এক গল্প। 'গাছে আটকা ঘুড়ি' গল্পটা মনে হয় আগে কোথাও পড়েছিলাম। খুবই ইউনিক আইডিয়া। একটা ছেলে দুদিন ধরে চেষ্টা করছে গাছ থেকে ঘুড়ি নামানোর। কিছুতেই পারছে না। এলাকার সবাই দেখছে, গরীব মানুষের ছেলে ঘুড়ির জন্য চেষ্টা করছে। অনেক কষ্টে সে পাঁচিলে হেটে ঘুড়িটা উদ্ধার করে। লেখক তাকে ঘুড়ি কেনার প্রলোভন দেখায়, দুটো টাকাও দেয়। কিন্তু ছেলেটার ঘুড়ি কেনার কোনো ইচ্ছা নাই তাই সে তীব্রভাবে প্রত্যাখান করে। বুকে চেপে নিয়ে বসে থাকে সেই গাছে আটকা ঘুড়ি। প্রথম প্রেম গল্পটা আমার খুব প্রিয়। রবীন্দ্রনাথের প্রয়ান, এক ক্লাস টেনের ছেলের উদাসী জীবন, রুপম হলে গিয়ে সিনেমা দেখা, সর্বপরি কবিগুরুর কফিন থাকা শোক সভায় সেই ছেলের এক মেয়েকে ভালো লাগার গল্প। সেই মেয়েও তাতে সাড়া দিয়ে অনেকজনের ভীড়ে শুধু তাকেই প্রবেশের অনুমতি দেয়া। গল্পটা পড়তে দারুন। রশীদ করীমের জীবন থেকে নেয়া গল্প। তিনি ছিলেন শরৎচন্দ্রের উপন্যাসের পোকা। কেন শরৎচন্দ্রের প্রয়ানে রবীন্দ্রনাথের এত ছোট কবিতা লিখলেন তাতে বিক্ষুব্ধ। রবীন্দ্রনাথের গান ও কয়েকটি কবিতাই তাঁর প্রিয়। এর ভেতরে 'শাজাহান' বেশী ভালো লাগে। কারন শাজাহান মুসলমান। বিখ্যাত আবু সাইয়ীদ আইয়্যুবের সাথে তা নিয়ে তিনি তর্ক করেন। তাঁর বাবা মা উর্দুভাষী। তাঁদের প্রিয় কবি ইকবাল বড় না কবিগুরু বড় তা নিয়ে আলাপ হয়। গল্পটা পড়তে দারুন সুখ। চা খানার গল্পটা আমার ভালো লাগে নাই। শুধু একটা উপমাই দারুন লাগছে। খেয়ে দেয়ে যে ঢেকুর তুলে মানুষ জোরে, তার সাথে তিনি 'পঞ্চাশটা সোডার বোতল খোলার' শব্দের সাথে তুলনা করছেন। 'চিঠি' গল্পটাও মোটামুটি। বেড়াতে গিয়ে বড় ভাবীর কাছে চিঠি লিখছে দেবর। সেই সময়ের হালচাল, কথাবার্তার ধরন, সেখানে গিয়ে এক কিশোরীর প্রতি ভালোবাসা, পরে জানা যায় সেই কিশোরীর বিয়ে আসন্ন। বাড়ীতে আসা যে লোকটাকে সব চেয়ে বেশী অসভ্য মনে হয়েছে তাঁর সাথেই। 'কাহিনী নয়' গল্পটা আমার ভালো লেগেছে। নব্বই দশকের টিভি নাটকের গল্পের মতো। গল্পটা নিজেই এক ইতিহাস, কারন এই গল্পের হেডপিইস শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীনের আকা। এই মোটামুটি গল্পগুলো নিয়ে আলোচনা।

গল্পগ্রন্থটিকে বোদ্ধা পাঠকদের কাছে খুব একটা মানসম্মত মনে হবে না। কিন্তু আমার কাছে খুব ভালো লেগেছে। পড়া শেষে মনে হচ্ছিলো রশীদ করীমের উপন্যাস পড়তে যেই আনন্দ, ঠিক তেমনি লাগলো। সমস্যাটা মনে হয় আমার। আমার কাছে যেই লেখককের কিছু লেখা ভালো লাগে। দিনে দিনে সেই লেখকের সব লেখাই ভালো লাগতে শুরু করে। তারপর অনেক দিন পর আরো অনেকের অনেক লেখা পড়ে মনে হয় কই ওতো বেশি মুগ্ধ হবার মতো তো কিছু নেই। আশা করি রশীদ করীমের বেলায় তেমন হবে না। কারন কলকাতা মোহামেডান যখন গত বছর ডুরান্ড কাপ জিতলো ৪২ বছর পর, তখন আমি ভাবছিলাম রশীদ করীম থাকলে কি খুশীটাই না হতেন। গ্যারি কুপারসের মুভির গল্প কারো মুখে শুনলে রশীদ করীমের কথাই আমার মনে পড়ে। তাঁর কারনেই তো নায়ক প্রমথেশ বড়ুয়া, ব্যাটসম্যান সৈয়দ মুশতাক আলী, শিল্পী পংকজ কুমার মল্লিক আরো কতজনের কত নাম জেনেছি। আসলে একজন ভালো লেখকের পক্ষেই সম্ভব নিজের পছন্দ অপছন্দ দিয়ে পাঠককে আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে ফেলা!

পোস্টটি ১৬ জন ব্লগার পছন্দ করেছেন

তানবীরা's picture


উপন্যাস সমগরো কিনেছি কিনতু এখনো পড়া হয়নি। লেখা দারুন হয়েছে

আরাফাত শান্ত's picture


পড়ে ফেলান ঐ জিনিস, একদম খাসা!

নিভৃত স্বপ্নচারী's picture


বাহ! রশীদ করিমকে নিয়ে একটি চমৎকার লেখা।
উত্তম পুরুষ এবং প্রেম একটি লাল গোলাপ এই উপন্যাস দুইটি কেবল পড়েছি। Smile
সেই কলেজ জীবনে পড়েছিলাম। উত্তম পুরুষ-টা এক বন্ধু নিয়ে আর ফেরত দেয়নি

আরাফাত শান্ত's picture


বই না দিলেও ভালো। কত লোক হয়তো পড়লো সেই বইয়ের উসিলায়!
ভালো থাকেন ভাইয়া!

জ্যোতি's picture


চমৎকার একটা লেখা, দারুণ আলোচনা। তোমার লেখা পড়েই মুগ্ধ আমি Smile

আরাফাত শান্ত's picture


আর আমি মুগ্ধ আপনাদের ভালোলাগায়!

আনোয়ার সাদী's picture


উপন্যাস সমগ্রের শেষ দিকে আছি। কাজেই আপনার লেখা না পড়ে থাকা গেল না। একটা প্রশ্ন করি। এতো ভালো লিখেও রশীদ করিম কেন এদেশে হাসান আজিজুল হকের মতো মর্যাদা পেলেন না?
জবাব যে দিতেই হবে এমন দিব্যি নেই। কিন্তু যদি আপনার কাছে সত্যিই জবাবটা থাকে তাহলে জানাবেন, কেমন?

মন্তব্য করুন

(আপনার প্রদান কৃত তথ্য কখনোই প্রকাশ করা হবেনা অথবা অন্য কোন মাধ্যমে শেয়ার করা হবেনা।)
ইমোটিকন
:):D:bigsmile:;):p:O:|:(:~:((8):steve:J):glasses::party::love:
  • Web page addresses and e-mail addresses turn into links automatically.
  • Allowed HTML tags: <a> <em> <strong> <cite> <code> <ul> <ol> <li> <dl> <dt> <dd> <img> <b> <u> <i> <br /> <p> <blockquote>
  • Lines and paragraphs break automatically.
  • Textual smileys will be replaced with graphical ones.

পোস্ট সাজাতে বাড়তি সুবিধাদি - ফর্মেটিং অপশন।

CAPTCHA
This question is for testing whether you are a human visitor and to prevent automated spam submissions.

বন্ধুর কথা

আরাফাত শান্ত's picture

নিজের সম্পর্কে

দুই কলমের বিদ্যা লইয়া শরীরে আমার গরম নাই!