শাখা সরকারী গণগ্রন্থাগার
আমার বাসার সামনে সূচনা কমিউনিটি সেন্টারের পাশেই যে একটা পাবলিক লাইব্রেরীর ব্রাঞ্চ আছে তা আমি জানি মেলাদিন ধরে। যাওয়া হয় না রাজনীতির পরিবেশ ওখানে। নানকের লোকজন ওখানে বসে থাকে, নিজেদের ব্যাবসায়িক দাপ্তরিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে তাই ওমুখো আমি হই না সচরাচর, রাস্তা পার হয়ে বাসার দিকে এসে পড়ি। সেই কমিউনিটি সেন্টারে একবার দাওয়াত খেতে গিয়েছিলাম,পুলক জোর করে নিয়ে গিয়ে ছিল। দেখি ছাত্রলীগের ছেলের দল বাপের জন্মের খাওয়া খেয়েই চলছে, থামাথামি নাই। কমিউনিটি সেন্টারটা মাইর খাওয়ার একটা বড় কারন হলো সেটাই। বিয়ে শাদী অনুষ্ঠান যাই হোক ৩০-৪০ জন ছাত্রলীগ যুবলীগের এক দল গিয়ে বাপের ঘরের খানা খেয়ে আসবে বাধ্যতামুলক। এই দুর্মুল্যের বাজারে এক সরকারী কমিউনিটি সেন্টার নিয়ে- কে আর ত্রিশ জনকে মাগনা খাওয়াতে চায়। তাই ঘুরে ফিরে এই সেন্টারটা পড়েই থাকে। ঈদ কিংবা বৈশাখী মেলার আগে পাকিস্তানী লন আর ইন্ডিয়ান থ্রিপিচ বেচে ভাড়া নিয়ে। আর মাঝে মাঝে মিলাদ মাহফিল বা সরকারী দলের সভা এই মুলত এক্টিভিটি। যে কমিউনিটি সেন্টারের এই দশা তার পাশের লাইব্রেরীর কি অবস্থা হবে তা বলাই বাহুল্য!
যাই হোক এত কিছুর পরেও লাইব্রেরীতে ভালোই মানুষ আসে। ১০০ টা চ্যানেল দেখতে লাগে মাসে ২০০- ৩০০ টাকা, সেই মোহ বাদ দিয়ে অনেকেই আসে লাইব্রেরীতে। তবে উদ্দেশ্য বই পড়া নয়। উদ্দেশ্য পত্রিকা। আমি যখন দুই সপ্তাহ আগে প্রথম যাই তখন খুব অবাক হয়েছিলাম। এত আলমারী এত বই কিন্তু সবাই পড়ছে পত্রিকা। নতুন পত্রিকা না পেয়ে কেউ কেউ পড়ছে পুরানো পত্রিকা। কি আজব কান্ড! আলমারী গুলো ধুলোয় ধুলোময়। আমি যখন হাত দিচ্ছি বইয়ে তখন সবাই আমার দিকে তাকায়, আর আমি তাকিয়ে দেখি কত বছর এই বইয়ের তাক গুলোতে কেউ হাত দেয় না। যেখানে মানুষের স্পর্শ থাকে সেখানে এত ধুলো আসার কথা না।তাই বই খুজতে হলে নাকে মুখে হাত দিয়ে খুজতে হয়, আর যেটা পছন্দ হবে তা আগে ঝাড়তে হবে, ঝাড়া শেষে বইটা হাতে নিতে হবে। তবে বইয়ের সংগ্রহ ভালো, কিন্তু যেগুলো ভালো বই সেগুলার এই হাল যে খুঁজেই পাবেন না। খুজে পাবেন শুধু রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনা, বাংলাদেশের উন্নয়ন অগ্রযাত্রায় বিএনপি, আমার চোখে বঙ্গবন্ধু মানেই বাংলাদেশ, জিয়া এক সোনালী সূর্যের নাম এই ধরনের বইগুলো। কিসব লেখক বাপের জন্মে নাম শুনি নাই তাঁদের বইয়ে ভর্তি আলমারী। আমরা দলীয় লেখকদের তো চিনি, আব্দুল হাই শিকদার কিংবা সুভাষ সিংহ রায় এদের মতো লেখকদের বইয়েও সয়লাব আলমারীর তাক। সরকারী প্রচুর বড় বড় অফিসারদের বইও যথেষ্ট। সরকার যে বই কেনার নামে টাকা দিয়ে অখ্যাত প্রকাশকদের অজস্র তেল আর কাগজ কিনে তা দেখে খালি বিস্মিত হই। সরকার যদি ভালো প্রকাশকদের ভালো ভালো বই কিনতো, তবে প্রকাশকদের আর বইমেলার জন্য সারা বছর বসে থাকতে হতো না। কত দারুন বই স্রেফ টাকার অভাবে নতুন এডিশন বাজারে আসে না, সামান্য পৃষ্টপোষকতা পেলেই সেগুলো বই লোকজন পড়তে পারতো এইসব পাঠাগারে। ছফা বলেছিলেন কোথায় জানি, 'একটি পাঠাগার বইয়ের সংখ্যা বা কি ফ্যান এসি আছে তার উপর নির্ভর করে না। কোনো প্রান্তিক অঞ্চলেও যদি সামান্য কিছু বইও অনেক লোক মন দিয়ে পড়ে আলোকিত হয় সেটাই পাঠাগারের সফলতা।'
এই লাইব্রেরীতে আরেক শ্রেনীর বইয়ের সংখ্যা তা হলো ইসলামী ভাবাপন্ন ঘরানার সামাজিক উপন্যাস যা মুলত রোমান্টিক লেখকদের। কাশেম বিন আবু বকর, মেহেদী হাসান, মনিরুল হায়দার, হানিফ ইসলাম, এই টাইপের লেখকদের অনেক বই। যার কাভারে কোনো হিজাবী মেয়ের ছবির দেয়া। আরেক ক্যাটাগরির বই আছে যেগুলা এইসব ফালতু লেখকদের চেয়ে ভালো কিন্ত পাকিস্তানী ভাবাপন্ন। সাংবাদিক আবদুল গফুর, সৈয়দ আলী আহসান, মাহফুজুল ইসলাম, আশকার ইবনে শাইখ, সৈয়দ সাজ্জাদ হোসাইন, এবনে গোলাম সামাদ এদের বই। এদের ভেতরে সৈয়দ আলী আহসান বাদে কারও বইই আমার পাঠযোগ্য মনে হয় না। সৈয়দ আলী আহসানের একটা বই, 'যখন কলকাতায় ছিলাম; এই বইটা হাতে নিয়ে শাখা সরকারী গনগ্রন্থাগারে বই পড়া শুরু করলাম। বইটা খারাপ লাগে নি। সেই সময়ের কলকাতার গল্প পড়তে মজাই লাগে। কিন্তু সমস্যা একটাই যে আলী আহসান সাহেবের সেই সময়ের মানুষদের মতোই মুসলমান ট্রাডিশন প্রীতি, কথায় কথায় শুধু নিজের জাতির গৌরব গাথা বয়ান দেয়ার চেষ্টা, নিজেকে বাঙ্গালী কম, মুসলমান বেশী মনে করা, আমি অবশ্য তার যে সময় সেই তুলনায় দোষের দেখি না। ভালো লাগে তাঁর রেডিও জীবন, কলকাতার রথী মহারথী বাংলা লেখকদের সাথে উঠা বসার গল্প জানতে। তবে উনার বন্ধু ছিল ফররুখ আহমেদ, উনার বিচিত্র ডায়লগ ও জীবন যাপন আমাকে মুগ্ধ করছে। রশীদ করীম দেদারছে গেলার কারনে সেই আমলের কলকাতার জীবন আমার পাঠ সুত্রে চেনাজানা। তবে পার্থক্য হলো রশীদ করীমের দৃষ্টি অসাম্প্রদায়িক ও যুবকদের মতোই সাধারণ। সৈয়দ আলী আহসানের তা কেমন জানি বুর্জোয়া শিক্ষিত মুসলমান বিখ্যাত সব হিন্দু লেখদের সাথে উঠবস করলেও তাঁর ভালো লাগে ইকবালের কবিতা! আর তীব্র উর্দু প্রেম। এরপর পড়লাম পূর্ব পাকিস্তানের গল্প সংগ্রহ নামের একটা বই। মেলা দিন আগের, মলাট জীর্ণ। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ থেকে শুরু করে সিকান্দার আবু জাফর, আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ মতো লেখকদের গল্প। পড়ে ভালো লাগছে। ডক্টর আবদুল হাইয়ের ভাষা নিয়ে যে বইটা আছে তা পড়লাম আরেকদিন। পুরাতন অনেক ক্লাসিক বই আছে অনেক আগের সব এডিশনের, সেই সব নাড়াচাড়া করলাম, বঙ্কিম রবীন্দ্রনাথ, শরৎ, দীনেশচন্দ্র সেন, বিভুতিভুষন, মীর মশাররফ এদের বইও আছে মলাট দিয়ে বাধা। কিন্তু কেউ ছুয়েও দেখে না। হুমায়ুন আজাদ, তসলিমা নাসরীন, হুমায়ুন আহমেদ, মিলন এদের বই খালি লোকজন এক কালে পড়েছে বলে মনে হয়। কারন অনেক পেইজ গায়েব, কলম দিয়ে দাগানো, পেইজ হাতাতে হাতাতে কেমন জানি হয়ে গেছে। তবে আমি যে পাঁচ ছয়দিন গেলাম সে কয়দিন শুধু আমি একমাত্র লোক যে আলমারী থেকে বই পড়েছে, আর নয়তো সবাই পেপার আর কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের ছাত্ররা লেকচার শীট এনে সলভ করেছে। লাইব্রেরীতে কোনো এসি নাই, ফ্যান চলে আস্তে, কারেন্ট দিনে তিন বার গেলে গরমে ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা। তখন সবাই পাশের দোকানে চা খেতে বের হয়। লাইব্রেরীয়ান সারাদিন পত্রিকা পড়ে। আমার ধারনা উনার সব পত্রিকা ডেইলী মুখস্থ হয়ে যায়। আর যে শাখা প্রধান সে সারাটা দিন পান খায় চায়ের দোকানে বসে। আর আওয়ামীলীগের নামে আজাইরা সব ভালোবাসায় পরিপুর্ন ডায়লগ দেয়। বই চুরি করা কোনো ঘটনাই না এখানে, কারন বই যে কেউ পড়ে তাই কেউ জানে না। পাহারা দেয়া হয় গরম গরম পত্রিকাগুলো যেনো কেউ না নিয়ে যায়। গত তিন চারদিন যাই না ওই এলাকায়, তাই লাইব্রেরী কি হাল জানিনা। তবে প্রাউড টু বি মোহাম্মদপুরিয়ান, কারন এখানে এখনো লাইব্রেরী আছে, খেলার জন্য অনেক গুলা মাঠ আছে। যা এই ঢাকা শহরে দুর্লভ।
এই পোষ্ট উৎসর্গ করলাম তানবীরা আপুর নামে। কারন অনেককেই আমি অনেক বই দিয়েছি, অনেকের অনেক বইও আছে আমার কাছে। কিন্তু তানবীরা আপুর মতো কাউকে বই দেয়ার যে আনন্দ তা আর পাই নি। কারন আমি উনাকে যাই বই দিয়েছি অতি অল্প, উনি খুব সময় নিয়ে তা পড়ে, তা নিয়ে ফেসবুক বইপড়ুয়া গ্রুপে রিভিউ লিখে দারুন ভাবে, এবং সবাইকে জানিয়ে দেয় বইটা আমার দেয়া। সামনে যখন উনার সাথে আবার দেখা হবে আরো অনেক বই দিবো যা আছে নিজের অথবা নতুন কেনা। উনি মন দিয়ে পড়ে রিভিউ লিখবে, আর নাম উঠবে বারবার। নিজের নাম দেখতে কার না ভালো লাগে এই জামানায়!
সামনে হয়তো চাকরী থাকবে না তাই বইই ভরসা
চাকরী থাকবে না কেন?
উত্সর্গটা সুন্দর হৈছে।
থ্যাঙ্কস বর্ণ!
এ্যাকনলেজমেন্ট ইজ অলওয়েজ গুড টু সি
মন্তব্য করুন