উপোষের দিন রাত্রী, সিজন টু, এপিসোড ফোরঃ সবুজ বাতাসের শহর!
কালই প্রথম বাসা ওরফে বাড়ী থেকে বেরিয়েছিলাম। বের হয়ে কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। তাও বের হই। ঘুরে ফিরে যাওয়ার জায়গা তো সেই এতটুকুই। বাড়ী থেকে বের হও, শহরের রেল স্টেশন যাও, পেপারের দোকানে বসে থাকো। গতকাল সেই মনে করে বাসা থেকে বের হলাম। হাটতে হাটতে মোড়ে যাই। রোজার দিন একযুগ ধরে রোজা রাখতেই হয় বলে চায়ের তেষ্টা পেলেও পর্দাওয়ালা দোকানে গিয়ে বসা হয় না। জানি কেউ জানবে না, তাও নিজেকে নিজে কখনো ফাকি দেই নাই। নিলাম রিকশা। জামালপুরে রিকশা এখন খুব দুর্লভ জিনিস। ইজি বাইক কিংবা ব্যাটারি চালিত অটোরিকশার প্রতাপ এখন সব খানে। ভাড়া কম ও এক সাথে ছয়জন উঠা যায়। আমার আব্বাজানের খুব পছন্দ এই জিনিস। আমার মোটেও পছন্দ না। কিছু না পেলে উঠি। উঠলেই ভয় করে, কোনসময় না উল্টে যায় গাড়ী, এত পাতলা। আর ড্রাইভাররা এই হালকা চায়নিজ গাড়ী নিয়েও রেসের মত চালায় নির্জন রাস্তায়। তাই রিকশাই আমার ভালো লাগে। রিকশা এখন এই শহরে বড়লোকদের বাহন, যখন উঠি তখন আশেপাশের মানুষ তাকায় এই যুবক কে? অবশ্য এখানকার বড়লোকদের বাহন মোটর সাইকেল। প্রায় প্রতি বাড়ীতেই একটা দুটো করে এই জিনিস চালায়। আব্বুর ইচ্ছে ছিল, আম্মুর কারনে কেনা হবে না কিংবা হয় নাই। আর আমার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নাই। বাইক আমার ভালো লাগে না। চালাতেও মনে হয় পারবো না। রিকশা দিয়ে মাত্র ১০ মিনিট লাগে। সাইসাই করে এসে পড়ে। হাটলে ২০-২৫ মিনিট। আমাদের বাড়ীর লোকেশনটাই অদ্ভুত, শহরের সাথেই এক গ্রাম!
যখন নামলাম তখন মনে হয় ঢাকা থেকে কোন ট্রেন আসলো। ভীড় আর মানুষে এক অদ্ভুত অবস্থা। আমার ওতো তাড়া নেই, আমি আস্তে ধীরে ঢুকি। আশপাশটা দেখি সেই একই রকম। চিরচেনা পত্রিকার দোকানে, শামীম বসা। আমাকে দেখে খুশী। আমিও তাকে দেখে আনন্দিত। আমার এই শহরে এক মাত্র শুভাকাঙ্ক্ষী। ছেলেটা ভালো। মেধাবী ও বুদ্ধিমান। কিন্তু কেন ম্যাট্রিকের পরে আর পড়লো না তা আমার মাথায় আসে না। একাধিক প্রেমে লিপ্ত, সারাদিন তাই কানে হেডফোন। এক সাথে ফোনেও কথা বলে আবার দোকানদারিও করে। এত আস্তে কথা বলে। আমি পাশে বসেই শুনি না। যদিও পত্রিকায় দেখার কিছু নাই তাও পত্রিকা খুলে খুলে দেখি। ঈদসংখ্যার ভালো সেল দেয় সেই দোকানে। দেখলাম আমার সামনেই নয়টা বিক্রি হলো। সমকাল, কালেরকন্ঠ, প্রথম আলো। সবার মুখে শুনলাম ঈদসংখ্যা অতি জঘন্য। তাই আমার আর সেই সব জিনিস কেনার সাধ নাই। এক পুলিশ কনষ্টেবলের সাথে দেখা হলো। ব্যাপক পত্রিকা পাঠক। তার দেখলাম জানাশোনাও ব্যাপক। মুগ্ধ হলাম দেখে। জামালপুরে প্রচুর ডিফেন্সে চাকরী করা লোকদের আবাস। এরা নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেনীর হলেও এলাকায় তাঁদের সামাজিক মর্যাদা ভাল। এরা পত্রিকার দোকানে এসে দুই শ্রেনীর কাজ করে। এক শ্রেনী আছে যারা ইসলামি বই কিনতে খুব ভালোবাসে। বঊয়ের জন্য নিজের জন্য ঢাউস সাইজের ইসলামি বই কিনতে ভালোবাসে, আবার এদের কেউ শরৎচন্দ্রে খুব অনুরক্ত, চিকন চিকন বই কিনে। আর আরেকদল আছে যাদের কাজই সুড়সুড়িময় ম্যাগাজিন কেনা। সবার সামনে তা দাত কেলাতে কেলাতে পড়তে শুরু করা। এরা সবাই খুব দামাদামি করে, শেষে লসই খায়। আরেকদল বেকার যুবক কিংবা ছাত্র আছে। যাদের কাজ হুট করে বই কেনা। এসেই ৩০ দিনে ইংরেজী বলুন, ৭ দিনে ফেসবুক শিখুন, ৩০ দিনে দুবাই ভাষা শিখুন বই কিনে হুট করে চলে যাবে। এদের উপর দোকানদাররা খুব খুশী। কারন লাভ ডাবল এইসব বই বেচলে। তবে জামালপুরে পত্রিকার দোকানে মেয়েদের উপস্থিতি কম। যদিও কেউ কেউ আসে বলে উঠবে 'ছেলেটাকে একটু দেখে রাখেন, আমি এখনি আসতেছি'। আর জামালপুরে এত বোরখাওয়ালী দেখে অবাক হই। আমি যতদূর চিনি জামালপুর মোটেও ধার্মিক অঞ্চল না। তাও ফ্যামিলি প্রেশারে হোক আর সামাজিক সম্মানে হোক কিংবা পর্দার কারনেই হোক প্রচুর বোরখা। আর শেষ এক দল আমার চোখে পড়েছে, এদের শুধু প্রশ্ন—ভাই তিস্তা কি ছেড়ে গেছে? রোজারদিনে ভালো ভাত খাওয়ার হোটেল কই? যমুনা সেতু যে যায় ট্রেনটা তা আসে কখন? ভাই ব্ল্যাকে টিকেট আছে? ভাই ১০ টাকার পত্রিকা কিনলে ১ হাজার টাকা ভাংতি হবে? ভাই আপনার দোকানে কি মাথা ব্যাথার ট্যাবলেট আছে? আজাইরা সব প্রশ্নে পত্রিকার দোকানদারের দিশেহারা অবস্থা। তাও তাঁরা মাথা ঠান্ডা রাখে। আমিও ঘন্টা দুয়েক বসে বাড়ীর দিকে রওনা হই।
কাল যখন রিকশায় ফিরলাম দারুন এক ওয়েদার। ঝড় নেই, বৃষ্টি নেই, আছে খালি শন শন করা বাতাস। গাছের পাতা দুলছে ছন্দে। দারুন এক সময়। চারিদিকে সবুজ অঞ্চল আর এক তালা সব সেমি পাকা দালান, আর নির্জন রাস্তায় রিকশা চলছে হাওয়ায় দুলে দুলে। আমি মুগ্ধ। হেঁড়ে গলায় গেয়ে উঠলাম, হায়রে আমার মন মাতানো দেশ, আমার গান শুনে রিকশাওয়ালা বেকুব। আমার মনে কি যে প্রশান্তি এই নয়নাভিরাম বিকেল দেখে। জ্যাম নেই, কষ্ট নেই, ট্রাফিক পুলিশ নেই, গাড়ী নেই, শব্দ নেই, কি নির্জন অপরূপ সুন্দর এই অঞ্চল। কে ছাড়তে চায় এই স্বর্গ ছেড়ে ঢাকায় যেতে। ঢাকার নাম তখন মনে করাও অভিশাপ। বাড়ীতে আসলাম, এখানেও বাতাস আর বাতাস। কি সতেজ অনুভুতি হয় এইসব সবুজ বাতাসে। আমি বারান্দায় বাতাস খেতে খেতেই হাতে নিয়ে পড়তে বসি ‘বাঙ্গাল নামা’ তপন রায় চৌধুরীর।
বাতাসের অংশটা পইড়া হিংসা লাগতাছে!
প্রথমেই তোমার কমেন্ট পেয়ে আমার খুব ভাল্লাগছে!
হ, ঢাকার বাইরে না আসলে বুঝা যায় না- ঢাকার আর বাইরের বাতাসে কত ফারাক। এখানকার বাতাস ঢাকার চেয়ে অনেক হালকা। ঢাকার বাতাসে শিসা ভরা। শ্বাস নিতে কষ্ট হয়। যে কয়দিন পার থেকে যাও বাড়িতে। শরীর আর মন দুটোরই উপকার হবে। শরীরের চলার জন্য ফুয়েল নিয়ে যাও। প্রকৃতি দেখ। খাও-দাও গান গাও তাইরে নাইরে না...
জী ভাইয়া সেরকমই আছি, অনেক আনন্দে!
আমি আরও ২ দিন থাকব ঢাকার দূষিত বাতাসে। বাড়ী যাওয়ার জন্য অস্থির লাগতেছে। অঅর তোমার পোস্ট পড়ে তো হিংসাই লাগতেছে রীতিমত।
এমন একটা বই লেখা দরকার

আপনিও তো এখন হেব্বী আরাম আয়েশে আছেন!
আপনার সহজসরল বর্ণনার দিনলিপির মতো লেখাগুলো পড়ি। উপভোগ করি।
সামাজিক নৃবিজ্ঞানের গবেষণায় ‘এথনোগ্রাফিক এপ্রোচ’ খুব জনপ্রিয় এবং কার্যকর গবেষণা পদ্ধতি। আপনার এসব লেখায় প্রচুর এথনোগ্রাফির উপাদান দেখতে পাই।
শুভেচ্ছা। ভালভাবে ঈদ করুন। তারপর ফিরে আসুন। ব্লগিং চলতে থাকুক।
আপনার মন্তব্যে মুগ্ধ হলাম ভাইয়া। আপনার দিন আনন্দে কাটুক!
ঢাকার বাইরে সত্যিই আরাম, স্বস্তি। আমিও ঘুরে এলাম। এখন আবার সেই যাঁতাকলে
লেখা ভাল লেগেছে।
থ্যাঙ্কস। ভালো থাকবেন। অনেক অনেক শুভকামনা!
মন্তব্য করুন