আমি বেঁচে ছিলাম একগাদা 'চুতিয়া'দের সময়ে!
গালি হিসেবে 'চুতিয়া' শব্দটা আমার ভীষন প্রিয়। গালিটা কাউকে দেইনা তেমন, তবে মনে মনে অনেক দেই। মনে মনে গালি দেবার খবর কেউ জানে না। তবে গালি দেয়া শেষে খুব শান্তি পাওয়া যায়। এই শান্তি একান্তই ব্যাক্তিগত। তবে 'চুতিয়া' গালিটা ভালো লাগার কারন বলি। আমরা আগে চায়ের দোকানে আড্ডা মারতাম সব বড় ভাইদের সাথে। সেখানে ব্রাক ইপিএলের এক বড় কর্মকর্তা আসতেন ও এনসিসি ব্যাংকের এক ভাই আসতেন। তাদের বন্ধু বান্ধবরা সবাই তাদের আসল নাম ভুলে গিয়ে ডাকতেন 'চুতিয়া' বলে। আমি অবাক হতাম এরকম এক বিশ্রী গালি একজন বড় ভাইয়ার নাম হয়ে যাবে জেনে। পরে দেখলাম ঠিকই আছে। উনারা এই নামের যোগ্য, কেন? কারন উনি যা বলে তা নিজেই মানে না, যে প্রতিশ্রুতি দেয় তা সবার আগে তা ভাঙ্গে, টাকার গরমে সবাইকে তুচ্ছ জ্ঞান করে, শবে বরাত কিংবা শবে কদরের দিনে উনার ইসলাম বিদ্বেষী সব ডায়লগ দেয়, আবার কঠিন বিএনপির ভক্ত, কথায় কথায় আওয়ামীলীগ মুক্তিযুদ্ধ এইসব নিয়ে রসিকতায় তাদের সুখ। চান্স পেলেই ইসলাম ও নীতিশিক্ষাও দেয়। কি আজব এদের ক্যারেক্টার। এখন মিশি না, দেখা হলেও মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে যাই। কিন্তু ডাকলে কথাতো বলতেই হয়।
ফেসবুকের বুকে, ঘুরে ফিরে, দু দিন ধরে নানান জনের স্ট্যাটাসে ও তাঁদের লাইক শেয়ার দেয়া স্ট্যাটাস দেখে শুনে মনে হচ্ছে-- এক চুতিয়া মার্কা আমাদের এই ভার্চুয়াল জগৎ। কারন এক দল আমজনতা যখন হ্যাশট্যাগ দিয়ে গাজায় নির্মম হত্যাকান্ডে সৌখিন প্রতিবাদ কিংবা শখের এক্টিভিজম করছে, তখন আরেকদল নেমেছে হ্যাশট্যাগ ভুয়া, লাভ হচ্ছে না কচু, আপনে আগে অমুক সময় কেন প্রতিবাদ করেন নাই, নাইজেরিয়া ইরাকে মুসলমানরা এত ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করছে তখন কেন চুপ ছিলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে এত অন্যায় অবিচার খুন দীর্ঘ দিন ধরে চলছে তার বিরুদ্ধে কেন প্রতিবাদ নাই? দেশের নানান প্রান্তে হিন্দু খ্রিষ্টানদের উপর যখন অত্যাচার হয়, অন্য দেশে চলে যায়, তখন আপনি চুপ ছিলেন কেন? এইসব নানান প্রশ্ন অনেকের মুখে।
প্রথমেই বলি, আমি হ্যাশট্যাগ দিয়ে কোনো স্ট্যাটাস দেই নাই। কারন নাই এমনিতেই দেই নাই, দুনিয়াতে কত কিছু হয়, দেশে কত কিছু হয় সব কিছু নিয়ে আমি উদ্বিগ্ন হই না। আর অনেক অনেক বড় উদ্বিগ্ন চিন্তা আমি নিজের কাছেই গোপন রাখতে ভালবাসি। যেমন অনেক আছে-- নাই বলি। আমার সমস্যা আমার কাছেই থাকুক। কিন্তু যারা উদ্বিগ্ন তাঁরা কেউ কেউ অনেক আগে থেকেই এই ব্যাপার নিয়ে স্ট্যাটাস ও শেয়ার দিচ্ছে, ইসরাইলের এই বর্বর হত্যাকান্ডের বিপক্ষে রুখে দাড়াচ্ছে। আবার কেউ কেউ এতদিন পর গত পরশু থেকে হ্যাশট্যাগ দিয়ে সেইভ গাজা, সেইভ ফিলিস্তিন আরো নানা নামে নিজের অনাস্থা পাবলিকলি ঘোষনা করছে। এইটাকে আমি খুব বেশি গুনের ভেতরেও দেখি না, আবার খুব বেশি দোষও দেখিনি। কিন্তু এইটার বিরুদ্ধে আমার অবস্থান হবে কেন, সেইটা আমি বুঝি না। মানুষের এই সামান্য শোওফের এক্টিভিজম যদি মেনে নিতে না পারি তবে সামনে তো আরো দিন আছে তখন আমরা কি করবো। প্রথমেই অনেকে বলছে লাভ হবে না খামাখা। ফেসবুক তো পুরোটাই লস।আমি এখানে সময় কাটানো ছাড়া লাভের কিছু দেখি না। সেটাও তো দিন শেষে লসই। আমরা তো মুদি দোকানদার না, যে সব কিছুই লাভের আশায় করবো। যদি সেই মুদি দোকান মানসিকতা থাকে তবে তা থেকে আশু পরিত্রান সবার জন্যই জরুরী। আরব দেশ গুলো যেখানে নির্লিপ্ত, দুনিয়ার মোড়লরা যেখানে পক্ষপাত দুষ্ট সেখানে লাভ ক্ষতি হিসাবে যেয়ে দরকার কি? মনের শান্তি যে আমি এর বিরুদ্ধে অনাস্থা জানাচ্ছি। সেটা জানানোই দোষের? দ্বিতীয়ত হলো অমুক সময় তমুক করি নাই বলে এই সময়ে এ নিয়ে দু তিনটা কথা নিজের একাউন্টে জানাতে পারবো না এ কেমন দাবী? যা ইস্যু সেই শ্রেনীর লোকেরা তুলছেন আমি বুকে হাত নিয়ে বলতে পারি এক্টিভিটি লগ খুজলে এই সব ইস্যুতেই আমি স্ট্যাটাস কমেন্ট লাইক শেয়ার করেছি সমানে। হয়তো সেলিব্রেটিদের মত জনপ্রিয় হয় নি, তাও নিজের মতো করে প্রতিবাদ জানিয়েছি। আবার কিছু ইস্যুতে হয়তো বেশী সরব ছিলাম না, তার কারন আমি আলোকিত মিডিয়া না- যে সব ঘটনা আমাকে আলোড়িত করবে আর আমি তা নিয়ে বিপ্লবী ও প্রতিবাদে মুখর হবে। আমি মানুষ ব্যাক্তিগত দিন যাপন সুখ দুঃখ ক্লান্তি নিয়ে জীবন যাপন করি। তাই দুনিয়ার সবার মতোই সব ঘটনা আমাকে সমান ভাবে স্পর্শ করে না। এইটা দুনিয়ার নিয়ম। এই নিয়মকে যারা অস্বীকার করে তাঁরা সেই বিশেষ শ্রেনীর লোকই। আমার এক বড়ভাই সেদিন এক স্ট্যাটাস দিয়েছিল, "এখন মানবতা নিয়ে কথা বলবেন না, খুব জ্বলে"- চুপিসারে, মনে মনে
"যখন টমেটোর সিজনে, রাস্তায় দাঁড়িয়ে আয়োডিনহীন লবণ দিয়ে বাদল শসা খেল, কোথায় ছিলেন আপনি? কোথায় ছিল আপনার মানবতা?" - জোরে জোরে, গলা চড়িয়ে। তাই খামাখা হ্যাশট্যাগ নিয়ে বিরুদ্ধে মাঠে নামার দরকার নাই। আপনারা যে কোন শ্রেনীর তা পোষ্টেই বলে দিয়েছি। অপেক্ষায় থাকেন কখন কার পা পিছলায় তখন মাঠে নামেন। নিজেদের নাক কাটা আপাতত বন্ধ করেন।
রিয়েল লাইফে কিংবা ভার্চুয়াল লাইফে অনেকের সাথে মিশতে হয়। দেখি কথা কাজে মিল নাই, যা বলে তা মানে না, আবার জেতার জন্য যা বলে তা নিজেই বিশ্বাস করেনা, মানুষকে মানুষ হিসাবে দেখে না, নিজের ভিতরে যত নৈতিক স্খলন তা অন্যদের ভেতরে খোজার চেষ্টা করে, পড়াশোনা নিজেরা করে না কিন্তু খুব জাহির করে, কথায় কথায় ধর্মের বানী দেয় কিন্তু নিজেই তার ধারে কাছেও নাই, নারীদেরকে হেয় করে সমানে খালি বয়ান দেয় আবার নিজের স্ত্রী কিংবা গার্লফ্রেন্ডের বেলায় তা মাফ, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে সারাক্ষণ আজাইরা বিদ্রূপের সুরে কথা বলে, নিজের চরিত্রের ঠিক নাই তবুও অন্যকে সার্টিফিকেটে দিতে নামা, চেনা অচেনা সব মানুষকে কথায় কথায় হেয় করা। এই টাইপের চুতিয়া মানুষে ভরে গেছে দেশ, সমাজ সংসারে। তা সব খানেই বিদ্যমান। এরাই সংখ্যাগরিষ্ট। সংবেদনশীল মানুষেরা পরাজিত- অসহায়- নির্লিপ্ত। তাই আমাকে আমার সময় নিয়ে বলতে গেলে বলতেই হবে-- ' আমি বেঁচে ছিলাম চুতিয়াদের সময়ে'
আমরা আরো বড় চুতিয়াদের সাথে বেঁঁচেছিলাম ! এই যেমন বর্তমান সরকারের এক প্রকান্ড মন্ত্রী,যিনি ষাটের দশকে ছিলেন আমাদের প্রাণপ্রিয় অগ্নিকন্যা এবং যিনি সে ষাটের দশকেই কিন্তু নীতি আর নেতা পরিবর্তন করে ছাত্রসমাজের কাছে চুতিয়া চৌধুরি নামে পরিচিত হয়েছিলেন । তার চুতিয়ামীর আরো নজির আছে । বঙ্গবন্ধুর জীবিতকালে বঙ্গবন্ধুর চামড়া দিয়ে ডুগডুগি বানানোর খায়েশ হয়েছিল ইনার একবার । সেই তিনি কিন্তু এখন বঙ্গবন্ধু-তনয়ার সরকারের বিশাল মন্ত্রী । আমরা যারা তাদের কথায় নাচতাম আজকে তাদের পরিবর্তীত অবস্থানে মূত্র ত্যাগ করতে যদি ইচ্ছে হয় খুব কি অন্যায় হবে !
কথায় কথায় ষাটের দশকের ছাত্ররাজনীতির ঊদাহরণ টানা হয় । ভাল ! কিন্তু একবার ভাবুনতো, সে সময়ের তূখোড় ছাত্রনেতাদের মাঝে কোন মহাজনের চরিত্র নিস্কলুষ অমলিন আছে ?
'রব' স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম পতাকা উত্তলনকারী, পরে আশির দশকে এরশাদের গৃহপালিত বিরোধী নেতা ! '
ইনু' সারা জীবন বাম রাজনীতির সাথে জড়িত থেকে এখন আপার আঁচল তলে স্বরণ নিয়েছেন ।'৭৫ এর ৭ নভেম্বর জিয়ার মুক্তিতে ট্যাংকে চড়ে ইনি সিপাহী জনতার সাথে উদ্বাহু নৃ্ত্যে মশগুল ছিলেন পুরোদিন । এখন আ লী-'র দূগ্ধ মাখনে তনূ তলতলে করে জিয়ার স্ত্রীকে মাইনাস করার কথা ঘোষণা করেন স্বরোষে !
'মেনন' ! ছাত্রদের কাছে কি রকম যে প্রিয় আর শ্রদ্ধ্যেয় ছিলেন তা ভাষায় প্রকাশ করা দূরুহ আমার পক্ষে ! দু'বার দেখা হয়েছিল । '৬৪তে একবার 'জে এম সেন' হলে ছাত্র ইউনিয়নের আঞ্চলিক সম্মেলনে । তখন আমি স্কুলের ছাত্র । ২য় বার '৬৯এ , রাঙ্গুনিয়া কলেজ প্রাঙ্গণে, মৌলানা ভাসানীর সাথে । অনুপ্রাণিত হয়েছিলাম তার বক্তৃতায় আর ব্যক্তিত্বে । শুনেছি সেই মেনন এখন ভর্তি বানিজ্যের এক বিশাল ব্যবসায়ী ! আল্লা খায়ের করুন !
'শাহজাহান সিরাজ' যার ছিল নেতৃেত্ব এবং দৈহিক সৌন্দয্যের এক বিরল সংস্করণ । কোথায় আজ তিনি ? নীতি ছেড়ে 'বি এন পি' তে গেলেন এবং হারিয়ে গেলেন ।
আর একজন কাজী জাফর ! পরবর্তীতে 'চিনি জাফর' নামে কুখ্যাত । এরশাদের গৃহপালিত 'পি এম' হয়েছিলেন ।
এইসব মহাচূতিয়ারাই ছিলেন আমাদের সময়ের ছাত্র নেতা । সম্ভবতঃ পৃ্থিবীর নিকৃষ্ঠতম চূতিয়া ।
[আপনার এই লেখাটি প্রতিদিন ২/৩ বার করে পড়েছি । মন্তব্য করিনি । অপেক্ষায় ছিলাম অন্য বন্ধুদের কেউ করুন । কেউ করেনি । অতঃপর নিজেই করলাম । এ বি 'তে উৎসাহী বন্ধুদের সংখ্যা প্রতিদিন কমছে ইদানীং । ]
আপনার বড় কমেন্টে মুগ্ধ হলাম! উৎসাহী পাঠক এখন এবিতে নেই বললেই চলে। তাও লিখি আপনারা কেউ কেউ পড়েন বলে। অনেক অনেক ধন্যবাদ!
ফেসবুকে খুব বেশী যাওয়া আসা নেই বলে এই হ্যাশ-ট্যাগের কাহিনীই জানি না
আর বাকী সব কথার সাথে একমত।
ফেসবুকে না কম আসা সব চাইতে ভালো সিদ্ধান্ত। আমিও সামনে এমন করবো। ভালো থাকেন আপু!
মন্তব্য করুন