আমিও জানি আমি গেঁথে গেছি আলপিনে, কত কি ছুটে চলে দুপাশে!
শরীরটা কেমন জানি ভালো লাগছে না। অবশ্য ঢাকায় ফেরার আগের রাত আমার শরীর মন কোনোকালেই ভালো থাকে না। তবে এবার বেশী খারাপ। পোলাও মাংস, ভাত গোশত খেতে খেতে মুখে রুচি নাই। চা পানেও টেষ্ট নাই। বাড়ীর চিনি দেখতে ভালো না। কিন্তু কেমন জানি একটা গন্ধ। তাই সেই গন্ধওয়ালা চিনির চা খেতেও খুব একটা ভালো না। তাও খেয়ে গেছি সমানে। এখন তা বিস্বাদের চুড়ান্ত অবস্থা। পুলকের মত চিনি ছাড়া চা খাওয়ার অভ্যাস থাকলে ভালো হতো। কিন্তু লিকার কড়া করে চা খেলেও, চিনি আমার সামান্য হলেও চাই। ভালো লাগে না প্রথম আলো ঈদ সংখ্যাটাও পড়তে। মোটামুটি পাঠযোগ্য লেখা আগেই পড়া শেষ। বাকী আছে উপন্যাসগুলো আর কয়েকটা গল্প। উপন্যাস পড়তে গেলে গাঁ জ্বলে, কি লিখে এইসব। সাগুফতা শারমীন তানিয়া কিংবা বদরুন নাহারদের উপন্যাসের এক পাতা গত দুই দিন চেষ্টা করে শেষ করতে পারলাম না। এর চেয়ে অভিনয় শিল্পী ফেরদৌসী মজুমদারের-- 'আমার অভিনয় জীবন' স্মৃতি কথাটা এক মুহূর্তেই পড়ে শেষ করে ফেলেছি। এখন আর বিরক্তিকর লেখা আগ্রহ নিয়ে শেষ করতে পারিনা, আগে পারতাম। এখন যা পড়তে মুগ্ধ হই না বা ভালো লাগে না তা আর পড়াই হয় না। যা বুঝছি না কঠিন, তা পড়া যায়। কিন্তু যে জিনিস অজস্র ত্যানা প্যাচানো, ইচ্ছে করে ভাষাকে জটিল করা প্রানান্তকর চেষ্টা, সেই সব লেখা আমার ভালো লাগে না।
আমার অবশ্য আজকাল অনেক কিছুই ভালো লাগে না। এই ভালো না লাগার লিষ্ট শুধু লম্বা হচ্ছে। অনেক আগে থেকেই আমার বিয়ে বাড়ী ও তার আনন্দ উচ্ছাস ভালো লাগতো না। এখনো লাগে না। হইহুল্লোড়, কাজের ব্যস্ততা, আনন্দ উত্তেজনা, বিয়ের বিষাদ এইসব আমাকে স্পর্শ করে না। আমি তাই নানু বাড়ীতে গিয়ে আশ্রয় খুঁজি টিভি আর ইন্টারেন্টে। সবাই আমার এটিচ্যুড দেখে বিরক্ত হয়, যারা বেশী আদর করে তাঁরা অহেতুক প্রশয় দেয়। যদিও নানু বাড়ীতে টিভি দেখা মানে গেঞ্জাম, শান্তি মতো চ্যানেল চেঞ্জ করা যায় না। কারন টিভি দেখছি পাশ থেকে কোনো পিচ্চি এসে বলবে 'এইটা এল্লা দাও, খালি পাল্টাও ক্যা?' নিজের বাড়ী হলে ধমক মারা যায় কিন্তু এখানে তো আর তা চলে না। আর প্রাইম টাইমে লোকজন বেশি থাকে তখন তাঁদের খেয়ালেই টিভি চলে। রাত বাড়লে আর টিভি দেখা হয় না। আমি বসে থাকি কিংবা চলে যাই নদী পাড়ের চায়ের দোকানে। জায়গাটা আমার খুব প্রিয়, কিন্তু শান্তি নাই সেখানেও, লোকজন আমার ও আম্মাজানে খোজখবর নিবে, আমার ভাইয়ার কি কি বৈষয়িক ব্যাপার এখন বিদ্যমান তা জানতে চাইবে। কেউ কেউ আবার আমি ছোটবেলায় কেমন ছিলাম তার ব্যাখ্যা দিবে। প্রথম প্রথম এইসব শুনতে ভালো লাগে। পরে শুরু হয় বিরক্তি। এত মানুষ আমারে চিনে কেন? তারপরেও আমি ভোরে ঘুম থেকে উঠেই হাঁটা দেই সেই নদীর পাড় দিয়ে। এত শান্ত স্লিগ্ধ নীরবতায় সম্মোহিত হই। নদী বলে সবাই, আসলে এইটা এখন বড় বিল অঞ্চল। নামটাও মিষ্টি 'ঝিনাই'। এইটার আগে নাকি কানেকশন ছিল যমুনার সাথে। এখন অবশ্য অতো রমরমা অবস্থা নাই। তাও বিশাল। বর্ষাতে ভালো পানি থাকে। এই একটা বিলকে কেন্দ্র করেই আছে মাঝিপাড়া। ভোর থেকেই তাঁদের মাছ নিয়ে হাটে যাবার ব্যস্ততা। প্রচুর ছোট মাছ বিলে ভর্তি। রান্না করলে খুব টেষ্ট। সকালে অনেক অবস্থাপন্ন বাড়ীর নাস্তা হলো-- গরম ভাত আর এই ছোট মাছগুলোর চচ্চড়ি কিংবা মাঝারী সাইজের মাছ ভাজা। আনকমন সব নাম মাছের। আমি অতো মাছ প্রেমিক না, তাই আর মাছের ডিটেইলসে গেলাম না। তবে ঐ জায়গা ছবির চাইতেও সুন্দর, ছোটবেলায় আমরা যে গ্রামের ছবি আকতাম, ঠিক তেমন সবুজ শ্যামল গ্রাম আর তার পাশে মিষ্টি একটা নদী। আমার খালতো বোনের দল মামার নেতৃত্বে সেই নদীতে নৌকা ভ্রমন দিলো। আমি সন্ধ্যায় নানু বাড়ীতে এসে দেখি তাঁরা নৌবিহারে। ছবি উঠিয়েছে। দারুন সব সিন। পানি বেশি না, কিন্তু স্বচ্ছ। সূর্য উঠে আর যখন সূর্য নামে দেখার মতো এক অপরূপ সৌন্দর্য। আর নানু বাড়ীতে প্রচুর গাছ। বিশাল বিশাল সব বৃক্ষ, আমার ছোটবেলা থেকেই এগুলো এমন দেখছি। এদের বয়স বাড়ছে কিন্তু কাউকে বুঝতে দিচ্ছে না। মোবাইলের নেটওয়ার্ক থাকে না বাড়ীতে কিন্তু বাড়ীতে আদর যত্নের কমতি নাই। সবাই ডায়নিং ঘরে গিয়ে খেয়ে আসে। আমি থাকি রুমে বসেই খাই। আহলাদ করে এর নাম দিয়েছি পার্সেল সার্ভিস। বাড়ীতে যদি এক কাপও চা বানানো হয় তবে আমার ভাগ আসে- রুমে বসেই পেয়ে যাই। আমার সমবয়সী খালাতো বোন আছে, প্রয়োজন ছাড়া তেমন কথা হয় না তার সাথে। আমার চেয়ে বছর আধেকের ছোট হয়েও সে আমার চেয়ে বেশী মেধাবী। স্বনামেধন্য প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে ফার্মাসীতে অনার্স কমপ্লিট, মাস্টার্স করবে। ছোটবেলায় তার সাথে অনেক কথা হতো। এক স্মৃতি মনে পড়ে, ও তখন ওয়ানে পড়ে না কেজিতে পড়ে, আমি স্কুলেই যাই না, ওর এক মিস ছিল, পড়াতে আসতো। আমি তখন ওদের বাসায় বেড়াতে গিয়েছি। আমাকে পড়া নিয়ে প্রশ্ন করে আমি কিছুই পারি না, ও সব পারে। আবার আমি তখন নাচ গান পাকনা পাকনা কথায় ওস্তাদ। ওর তখন লিজেন্ডারী ডায়লগ ওর মা কে 'মামনি আমি যেগুলা পড়া পারি, শান্ত ভাইয়া তার কিছুই পারে না, আবার শান্ত ভাই যা যা পারে আমি সেগুলা করতে পারি না; তাঁরা এই বিয়ে নিয়ে খুব উৎসাহী। ছবি টবি সাজসজ্জায় পুরো শহুরে ভাব। ছোটবোন বৃষ্টির সাথে আমার বেশি কথা হয়, সে ক্লাস এইটে পড়ে। তার স্কুলের গল্প শুনি, তাহসানের নাটক দেখতে কেন ভালো লাগে তা শুনি, তাঁদের স্কুলে পড়াশুনা কিভাবে চলে তা জানতে চাই, হুমায়ূন আহমেদের কোন কোন বই তার প্রিয় তা শুনি, তার কি কি ম্যাথ ও সাধারণ বিজ্ঞান ভালো লাগে তা শুনি, স্কুলে কি কি নিয়ে তাঁরা মজা করে তা বোঝার চেষ্টা করি। তবে জীবনের এত অসাধারণ সময়গুলো এরা পড়াশুনা আর তা নিয়ে টেনশন করে কাটাচ্ছে, তা ভেবে কষ্ট লাগে। আমি ক্লাস এইটে থাকতে পড়তেই চাইতাম না, আর এরা পড়া হচ্ছে না বাড়ীতে দীর্ঘদিন থেকে সময় নষ্ট হচ্ছে বলে কান্নাকাটি করে। কি আজব এই জামানা। আমার সময়বয়সী কাজিনের সাথেও এবার আগের চেয়ে বেশী কথা হয়েছে। আগে আমার শুধু খালা আর খালুকেই ভালো লাগতো। এখন দেখি এরাও অসাধারণ আন্তরিক মানুষ। কি ভালো টাই না বাসে আমার মতো খুবই কম কথা বলা ভাইটাকে।
বিয়েশাদী হয়ে গেল। তারপরেও আরো দেড় দিন ছিলাম। দেশ গ্রামের বিয়েতে যা হয় মনোমালিন্য তা হলো আর চললো যথারীতি। বিয়েতে মানুষ এত কথা ধরে ও আজাইরা ঝগড়া হয় তাতে মেজাজ খারাপ হয়। বরপক্ষরা কখনোই সন্তুষ্ট থাকে না। তাঁদের ধারনা এই মেয়েকে বিয়ে করে তাঁরা ঠকেছে, তাঁদের যথেষ্ট আদর আপয়্যন করা হয় নাই। ছেলের আরো ভালো সম্ভাবনা ছিল। আর মেয়ের পক্ষের কষ্টের জায়গা এত করেও মন পেলাম না, তাহলে বিয়ে করার জন্য এত উঠে পড়ে লাগার কারন কি? আমাদের মেয়ে তো ফেলনা না। এইসব করে করে একটা এডজাস্টমেন্ট প্রসেসে আসে, তখন মেনে নেয়া ও মানিয়ে নেয়া শুরু হয়। আমি বিয়েতে ছিলামই না, সবাই কাজ করে আমি বসে বসে বাবুর্চির রান্না দেখি। যখন খাওয়ার সময় তখন রুমে শুয়ে থাকি। আমার জন্য পার্সেল আসে, খাই। তবে আম্মুর হাতের রান্নার মতো ভালো না। তারপর যখন ঝগড়া টগড়া কথা কাটাকাটি চলে তখন আমি ঘুমাই লম্বা সময় নিয়ে। ঘুম থেকে উঠে দেখি বিয়ে শেষ। অজস্র আত্মীয় স্ব্জন বাড়ীতে।
কাল দুপুরে ট্রেন। ট্রেন যে লেটে আসে তা নিয়ে চিন্তিত। শেষ হলো আঠারো দিনের আরামের সময়। মা যে ভালোবেসে খাইয়েছে এ কয়দিন, ট্রেনে উঠার পর থেকে তা শুধু স্মৃতি হয়ে যাবে। সকালে ঘুম থেকে উঠেই গরম গরম নাস্তা সামনে আবার শুধুই কল্পনা। তবে ঢাকাও আবার আমাকে টানে। বাবার আদর মিস করবো গেলেই টেনশন ময় দিন গুলো শুরু, আবার শুরু আনন্দ আড্ডা, বন্ধু, চায়ের দোকান, পড়াশুনা, চাকরীর অপেক্ষা, সিনেমা দেখা, দ্রুত গতির নেট চালানো, বুয়ার জঘন্য রান্না, এইসব আর কি!
এ জীবনের কিছুই ফেলনা নয় । তুলে রাখুন সব । অবসরে স্মৃতির নেট খুলে দেখুন ! নিজের কাছেই বিস্ময় ঠেকবে ! আ ! জীবন কত সুন্দর ! পড়ে প্রীত হলাম ! ধন্যবাদ !
থ্যাঙ্কস ভাইয়া। আপনেই এখন একমাত্র লোক যে আমার পোষ্ট পড়ে অফিশিয়ালি মন্তব্য করে!
মন্তব্য করুন