ইউজার লগইন

কুতুববাগ কিংবা মনের বাঘ!

কুতুববাগ দরবারের কথা মনে আসলেই আমার মনে আসে, ফার্মগেটের পাশ দিয়ে যে পার্ক সেখানে কোরবানী স্টাইলে ছাগল গরু উট সংমিশ্রনে এক বর্জ্য নিঃসৃত গন্ধে লোকজনের ভীড়ের এক শ্বাসকষ্টের কথা । বছর সাতেক আগে আমার আড্ডাস্থল ছিল ফার্মগেট। চিটাগাংয়ের নানান বন্ধু ঢাকার অনেক জায়গা থেকে এসে একত্রিত হতাম সেখানে। সে এক সময় ছিল। নিজেদের মন মেজাজ সবার থাকতো উদাস। সবাই মিলে পিন্ডি চটকাতাম ঢাকা কত খারাপ, চিটাগাং কত অসাধারন। তবে সবার এক ব্যাপারে প্রশ্রয় ছিল ঢাকার মেয়েরা চিন্তা চেতনা স্মার্ট সুন্দরের দিক দিয়ে বেশী জোশ। আমার এই ব্যাপারের আপত্তি, বাসে- কারে- রিকশায়- পথে মেয়েরা দেখতে আকর্ষনীয় হলেই, কি পুরো শহরের মেয়েরা ভালো হয়ে যায়, চিটাগাংয়েও ভালো সুন্দরী ললনা নেহায়েত কম তো না, আমরা দেখি নাই বলে তাঁদের সমন্ধে এই অবিচার। আমার কথার বিপক্ষে সবাই, আমার তখন মেনে নিয়ে বলতেই হতো, বিজ্ঞানের সুত্র মানলে ঢাকাই ব্যাটার, কারন ঢাকার গুরুত্ব বেশী- জনসংখ্যা বেশী- তাই মেয়েও বেশী- মুভমেন্ট বেশী- তাই চোখে পড়ে মেয়ে বেশী। আমার এক বন্ধু তখন থাকতো মিরপুরে, সে মাজারে জিকিরের নামে কি ইন্ডিস্পিলিন্ড আকাম কাজ কর্ম হয় তা নিয়ে বয়ান দিতো। সেখানেও আমার বিপক্ষে অবস্থান, আমি বলতাম তুই শরীয়ত সম্মত নামায রোজা কিছুই পড়োস না, ওরাও পড়ে না, দুইজনই সমানে সমান। আমাদের তো রাইট নাই সেই শরীয়ত মারেফত নিয়ে বয়ান দেয়ার। আমাকে বানিয়ে দেয়া হলো, কুতুব বাগ দেওয়ানবাগের নাস্তিক ফ্যান। আমি ট্যাগ খেয়ে খালি কুতুববাগের বাঁশের সাথে বাঁধা কালো কালো গরুর দিকে তাকাতাম, আর ভাবতাম এত গরু না আনলেই কি হতো না? চিটাগাংয়েও ওরস-মেজবান খেয়েছি- কত কোটিপতিদের। এত গরু ছাগল উট খাসী কোথাও দেখি নি।

আজ সেই কুতুববাগ স্বয়ং আমার এলাকায় আরো স্পষ্টভাবে বললে যে এলাকার চায়ের দোকানে আমার দিনযাপন, সেখানেই এসে হাজির। আমি প্রথমে বিশ্বাস করি নি। মনে হয়েছে কুতুববাগের চ্যালা চামুন্ডা মার্কা হুজুর কাউকে পাঠাবে। পড়ে দেখি আসল লোকই আসবে। সীমিত জায়গায় ব্যাপক আয়োজন। আমার কাছে দাওয়াতের স্পেশাল কার্ড আসলো। এইসব অনুষ্ঠানের দাওয়াত সবার জন্যই, স্পেশাল কার্ড আসলেই বুঝবেন আপনার উপস্থিতি ও চান্দা দুটোই তাঁদের কামনা। আমি বুঝিয়ে বললাম, আমার টাকাটা বাকী রাখেন- পকেট গড়ের মাঠ। তাও তারা নাছোড়বান্দা। কি আর করা, পুলকের কাছ থেকে ৫০০ নিয়ে তুলে দিলাম, অথচ গত তিনদিন ধরে আমার নেট নাই, ওয়াইমেক্সের মেয়াদ শেষ। যাই হোক ব্যাপক সাড়ম্বরে, মাইক লাগানো, গরু ক্রয়, বাবুর্চিদের তেহারী রান্না প্রস্তুতি, চেয়ার প্যান্ডেল, ওয়াজ মাহফিলের ডাবল ত্রিপাল, নানান ব্যস্ততায় মুখরিত এলাকা। আমি খালি দেখছিলাম, কে কে আয়োজক, কার কি অবস্থা? দেখে যা বুঝলাম ছাত্র যুব লীগের লোকজনই এর আয়োজক। প্রারম্ভিক খরচাপাতি করছে এক ইয়াবা বিক্রেতা। যিনি আবার আমাকে অসম্ভব শ্রদ্ধা করেন, কারন তার আশ্রয়দাতা মামা শ্বশুরের সাথে আমার সেই খাতির, যেহেতু আমি সিগারেট খাই না তাই তিনি আদর করে আমার পিঠে হাত রেখে বসে চা খান। আর আয়োজক আর যাদের দেখলাম তারা সব রাস্তার পোলাপান। জীবনে এদের কাউকেই আমি জুম্মার নামায পড়তেও দেখি নাই, এমনকি ঢাকায় যে চার বছর ছিলাম তখন ঈদের নামাযও না। এই বছর ছয়েক ধরে তারা নানান ধান্দাপাতি কিছু করে টাকাপয়সার মুখ দেখছে, তার শোডাউন হিসেবেই কুতুববাগকে এখানে এসে হাজির করছে। এই আয়োজনের একটা বড় অংশের কর্মীদের সকাল বেলাতেই দেখলাম, এক জমি উদ্ধারের কাজ বাস্তবায়ন করছে, সেখানে থাকা ভাড়াটিয়াদের উচ্ছেদ করছে। জানি না জমিটা কার? তবে এইভাবে উচ্ছেদ করার অধিকার তাঁদেরকে কোন বাপেরা দিয়েছে তা আমি জানতে চাইবো কালকেই।

যাই হোক মাইকের অত্যাচার, গরুর মাংসের গন্ধ, কুতুববাগের উসিলায় আসা হুজুরদের বেক্কেলমার্কা সব ডায়লগ শোনার অত্যাচারের কারনে আমি বিকেল থেকে বেরই হয় নাই। কি বের হবো? আমি জানি সাউন্ডে সেখানে টেকা দায়। তাই অভিকে বলে আসছিলাম, এশার নামাযের জন্য বিরতিতে যাবে তার পাঁচ মিনিট আগে ফোন দিবা। সে তাই করলো। যেয়ে দেখি যেমন ভেবেছিলাম তেমনি। চায়ের দোকানে অনেক লোক। কাউকেই চিনি না। ছোট ভাইরা ধরলো, শান্ত ভাই তবারক খাবো। আমি বললাম হোক সময়। তোমাদের দিবে। আমি আয়োজকদের একজনকে লিষ্ট ধরিয়ে দিলাম যে প্যাকেট দোকানে দেয়ার জন্য আগে আগেই। আমি যখন ওখানে, তখনও কুতুববাগী হুজুর আসেন নাই। তাদের দরবার শরীফের মসজিদের ইমাম নামাযের ব্রেকের পর বয়ান দিচ্ছে। দশ মিনিট শুনলাম অসীম ধৈর্য্য নিয়ে। কথাই হয় না হুজুরের। কি যে বলেন, আর প্রতি দুই বাক্য পর পর কুতুববাগী হুজুরের নাম বলা। উনার এক নাম পড়তেই সময় যায় পাঁচ মিনিট। কানে হেডফোন দিয়ে বসে থাকতে থাকতে এমনিতেই টর্চার, তারপর আবার এই জিনিস নেয়ার মানে নাই, এক কাপ চা খেয়েই কাউকে না বলে কেটে পড়লাম। কারন বলে গেলে সবাই বলবে- থাকেন থাকেন আরে থাকেন। সেইসবে আমি নাই। দুনিয়ার সেরা তেহারী লোকজন খাক, আমি বাসা এসে তেলপিয়া মাছের তরকারী দিয়ে ভাত খাই, তাই ভালো।

আমার ধারনা শিক্ষিত মানুষ এইসব পীর ফকিরের ভক্ত হয় তখনি যখন ফাপড়ে পড়ে কিংবা বড় অন্যায় কাজ সমানে করে বেড়ায়। পীর ফকিররা ব্যাবস্থা করে পাপমোচনে, আর ভক্তরা উদ্ধার পায় বিপদ থেকে, পুরোনো মুরীদদের নানাবিধ কানেকশনের জোরে। আমি অনেক গল্প শুনছি, যে ওমুকের কাছে গেছিলাম তিনি তার এক ভক্তের সাথে দেখা করিয়ে দিলেন, তিনি আমাকে উদ্ধার করলেন। এরপর থেকে আমরা উনার মুরিদ। আবার কেউ বংশীয় ভাবেই নানান পীরের বংশে্র ভক্ত। ব্যাপারটাকে আমার পছন্দ না, আমি এর সাথে বাংলার লোকজও সুফীবাদেরও কোন মিল পাই না। ব্যাপারটা আদ্যোপান্ত এক ভন্ডামীর চেইন সার্কেল। তাও চলছে সমানে, যেমন ভাবে এই দেশে হাজারো অন্যায় চলছে। রাতারাতি কিছুই ভালো না। তা পাপমোচন কিংবা গায়েবী সাফল্য যাই হোক। আমি যদি ভালো থাকি, ভালো কাজ করি, তাহলে পীর আমার কোন বালটা ভালো করবে? আর আমি মানুষের সাথে অন্যায় করবো, হক মেরে খাবো তবে যত বড় পীর ধরি মানুষের কাছেই মাফ পাবো না, ইশ্বর তো অনেক দূরের ব্যাপার। তাই আমি চুপ থাকি। যার যা মন চায় করুক। যার যার মন, তার তার বাঘ। কেউই কারো কথা শুনে না, যে যার মনের পছন্দ পীর বা গরু বা ফেসবুক সেলিব্রেটির কথাই শুনে। লালন যদিও বলেছিলেন অন্য প্রসঙ্গে তাও আমি এই প্রসঙ্গেই বলি, 'শহরের ষোলজনা বোম্বেটে!

এই পোষ্ট উৎসর্গ করিলাম পারভীন আপু আর জ্যোতি আপুকে, তাঁদের কারনে খানাখাদ্যময় দারুন আড্ডায় আমার বোরিং দিনগুলোতে ভিন্নতা আসে। আমার মত ছোটভাইকে তাঁদের যে পরিমান আদর- ভালোবাসার- স্নেহ আপ্যয়ন, তুলনা হয় না তার।

পোস্টটি ২০ জন ব্লগার পছন্দ করেছেন

মেসবাহ য়াযাদ's picture


দারুন একখান লেখা পড়ে সকালটা শুরু হলো। ভালো থাকিস শান্ত। নিয়মিত লিখিস।

আরাফাত শান্ত's picture


থ্যাঙ্কস ভাইয়া। আপনি সকাল সকাল এসে এসব লেখা মন দিয়ে নিয়ম করে পড়েন সেটাই সবচাইতে বড় ব্যাপার!

জ্যোতি's picture


এসব পীর ফকিরের জলসা দেখলে মনে হয় অসুস্থ মানুষদের মিলনমেলা।
উৎসর্গ দেখে ব্যাপক খুশী হইলাম, শরম পাইলাম যে খানাপিনার আয়োজক তো আমি হইতে পারি না।পারভীন আপার কাছে তো ঋন বাড়ে শুধু Smile

আরাফাত শান্ত's picture


আরো ভালো পোষ্টে উৎসর্গ করা উচিত ছিল। যাই হোক কি আর করা, সময় শেষ হয়ে যায় নাই।

বিষাক্ত মানুষ's picture


প্রতি বছর এই এক অত্যাচার। আমার বাসার থিকা কুতুববাগ প্রায় আধা কিলোমিটার দুরে। কিন্তু বেটারা তার টেনে আমার বাসা পর্যন্ত মাইক বসাইয়া যায়। Stare

আরাফাত শান্ত's picture


কুতুব্বাগ নিয়ে লেখার সময় আপনার কথাই মনে আসছিল প্রথমে, আপনার ভিয়াইপি প্রতিবেশী!

নাজনীন খলিল's picture


টিপ সই

আরাফাত শান্ত's picture


থ্যাঙ্কস আপা!

সামছা আকিদা জাহান's picture


খুব ভাল টপিকসটা। আমার মেয়েটার ফিজিক্স ১ম পত্র পরীক্ষার আগেরদিন আমার রাস্তার ওপারে এই ওয়াজ রাত ৩টা পর্যন্ত। বাচ্চাটা যে কিভাবে পরদিন সকাল ১০টায় পরীক্ষা দিয়েছিল।
ঢাকা ভার্সিটির ক ইউনিটের পরীক্ষার আগের রাতে জাকের মঞ্জীল আমার বাসার বাউন্ডারী ওয়ালের উপর চারটা মাইক বসিয়েছি। উহহ অসহ্য।

১০

আরাফাত শান্ত's picture


আহারে আপু, কি খারাপ দশা। বেচারীর জন্য কষ্ট হইছে। আমি চিটাগাংয়ে যখন ছিলাম তখন এই যন্ত্রনা প্রতি সপ্তাহে হতো!

১১

জেবীন's picture


কুতুববাগের অইখানে নাকি কাবাবের দোকান আছে দেরুন একটা, সব্বাই আড্ডা দিয়ে এলো কতবার আমারই কেবল মিস হয়ে যায় Stare

এইসব ভন্ডামি বেচেঁ আজীবন কি আরামে কেটে যায় এদের, এতো দিনেও মানুষের হুশ ফেরে না

১২

আরাফাত শান্ত's picture


তাই নাকি? জানতাম না।
একদিন ট্রাই করতে হবে তো রহমত বরকতের কুতুব্বাগী কাবাব!

১৩

তানবীরা's picture


লেখা দারুন উপাদে্য হয়েছে, তেহারীর মতোই

১৪

আরাফাত শান্ত's picture


থ্যাঙ্কস আপু। আপনার প্রশংসা খুব ভালো লাগে!

১৫

ফাহিমা দিলশাদ's picture


অসাধারণ Applause

১৬

আরাফাত শান্ত's picture


থ্যাঙ্কস এ লট!

১৭

বিষণ্ণ বাউন্ডুলে's picture


ভালো বলছেন।

১৮

আরাফাত শান্ত's picture


ওয়েলকাম এগেইন!

১৯

বিষণ্ণ বাউন্ডুলে's picture


Tongue

মন্তব্য করুন

(আপনার প্রদান কৃত তথ্য কখনোই প্রকাশ করা হবেনা অথবা অন্য কোন মাধ্যমে শেয়ার করা হবেনা।)
ইমোটিকন
:):D:bigsmile:;):p:O:|:(:~:((8):steve:J):glasses::party::love:
  • Web page addresses and e-mail addresses turn into links automatically.
  • Allowed HTML tags: <a> <em> <strong> <cite> <code> <ul> <ol> <li> <dl> <dt> <dd> <img> <b> <u> <i> <br /> <p> <blockquote>
  • Lines and paragraphs break automatically.
  • Textual smileys will be replaced with graphical ones.

পোস্ট সাজাতে বাড়তি সুবিধাদি - ফর্মেটিং অপশন।

CAPTCHA
This question is for testing whether you are a human visitor and to prevent automated spam submissions.

বন্ধুর কথা

আরাফাত শান্ত's picture

নিজের সম্পর্কে

দুই কলমের বিদ্যা লইয়া শরীরে আমার গরম নাই!