নানু বাড়ীর গল্প
ঘুম আসছে না। দুপুরে বৃষ্টি ছিল। ভালো ঘুমিয়েছি। বাড়ীতে বৃষ্টি হলে কোনো টেনশন লাগে না। ভাবা লাগে না যে রাস্তা ঘাট ভেসে গেল নাকি। মানুষের দুর্ভোগ নিয়ে ভাবনাও আসে না মাথায়। মনে হয় নামছে নামুক না। টিনের চালে ঝপঝপ শব্দ মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনি।দুটো শব্দ আমার খুব প্রিয়, এক আম্মু যখন সেলাই করে সেই মেশিনের শব্দ আর বৃষ্টির শব্দ ঢাকায় আগে যখন এক রুমের বাসায় থাকতাম, মাথার উপরে দীর্ঘ চার বছর ছিল টিনের চাল আর ফল সিলিং। গরমে কষ্ট হতো, কিন্তু বৃষ্টিতে যখন শব্দ শুনতাম কি যে ভালো লাগতো। আর বাড়ীতে ছাদ দেয়ার অবস্থা আমাদের ছিল কিন্তু আমার কারনেই দেয়া হয় নি এক যুগ আগে নতুন করে বাড়ী বানানোর সময়। কারন টিন আমার ভালো লাগে, মাথার উপরে টিন না থাকলে কি আর গ্রামের বাড়ীর ফিলিংটা আসে। আরতি মুখোপাধ্যায়, আমার এককালে কত ভালো লাগার শিল্পী। দেশটিভিতে লাইভ গাইছেন, সেই ভালো আর লাগে না। কারণ উনার বয়স হয়ে গিয়েছে, গলার সেই শার্পনেস ও মাধুর্যতা কমেছে! আমার স্মৃতিতে সেই ভাইয়ার পিসিতে শোনা গান গুলোই আছে। তা এত জলদি মুছে ফেলতে চাই না! তাই লিখতে বসলাম। নিয়ম করে ব্লগে বসা আর হয় না, কমেন্টের জবাব দিতেও ভালো লাগে না। খালি লেখার কথা মনে আসলে ব্লগে আসি, লিখে চলে যাই। এত ভালো সব লেখা, কমেন্ট করতে ইচ্ছে করে না। থাকি প্রতিক্রিয়াহীন, আমার মতামতের মুল্য কি আর!
নানু বাড়ী থেকে আসলাম আজই। আরো দু একদিন থাকার ইচ্ছে ছিল, হলো না। কারন মামা ঢাকায় চলে যাবে রাতের বাসে, আমিও এসে পড়লাম। নানু বাড়ী আমার খুব এখন পছন্দের জায়গা। গ্রাম যেমন হয় তেমন। এখনো বাজার বসে সপ্তাহে দুদিন, পাশে নদী, স্কুল, কাচা সড়ক এইতো।ছোটবেলায় ভালো লাগতো না কারন কিচ্ছু নাই শহরের মত তা ভেবে। আর ভাইয়া খুব পাত্তা পেত, মামার সাথে ঘুরতো, মামার বন্ধুদের সাথে মিশতো, নৌবিহারে যেত, সবাই চিনতো, আমি ছোটো ,বাড়ীর আশেপাশেই থাকতে হতো। পানিতে নামতে মানা, কত কিছু করতে মানা। আম্মুর সাথে যখন আসতাম তখন মামা বিজি, সময় নেই, আমি বাড়ীতে একা বসে বসে ক্যাসেট প্লেয়ারে গান শুনতাম। তারপর আরো বড় হয়ে এসে মিস করতাম ইন্টারনেটকে, সামুর তখন ব্লগার। ভাবতাম ব্লগে কত কি হলো। এখন নেট মেট কিছুই ভালো লাগে না। বাহির দেখি, আহ কি সুন্দর গ্রাম। ছায়া সুনিবিড় শান্তির নীড়। যদিও গ্রামের মানুষেরাও খুব শান্তিতে নাই, তবুও আমি দুদিনের মেহমান হয়ে খুব ইঞ্জয় করি।সবার প্রশ্ন, শান্ত কেমন আছো? তোমার ভাই কেমন আছে? নিয়োগের খবর কি? তোমার আম্মু আসছিলো দু মাস আগে, তোমার আব্বু কেমন আছে? আমি জবাব দিই। আর আমার প্রশ্ন ১টাই আপনি কেমন আছেন? যাদের চিনি তাদের প্রশ্ন করি ওমুকের কি খবর? সবচেয়ে ভালো লাগে সবাই আমাকে চিনে আম্মুর নামে, আম্মুর খোজ নেয়। মায়ের পরিচয়ে কথা বলা অনেক আনন্দের।অনেকে আবার আছেন আমার মরহুম নানার বয়সী। তাদের মুখে আমার আব্বু কেমন জামাই ছিল, আমার আম্মু কলেজ লাইফে কেমন ছিল সেই কথাও শুনি। এমন টোনে কথা বলা, যেমন ৪০-৫০ বছর কোনও সময়ই না। গ্রামে আরো শুনতে হয়, লোকজনের উত্থানের গল্প। অমুকের পোলা জজ হইছে, তমুক তো বারডেমের ডাক্তার। ঘুষের জয়গান শুনি, ঘুষ দিয়ে কে কিভাবে বড় চাকরি বাগাচ্ছে তার আলাপ শুনি বসে বসে। গ্রামের আরেক সমস্যা শুনলাম একজনের মুখে, বাল্য বিবাহ। ম্যাট্রিক পাশ দিয়েই ছেলে ক্লাস এইটের কোনো মেয়েকে বিয়ে করে ফেলে। ফ্যামিলি মানে না। ঢাকায় চলে যায়। কিছুদিন গার্মেন্টসে চাকরি করে, বাড়ীতে ফিরে। বাবা মার মন নরম হয়। বউ সহ পুত্রকে পালতে হয়, পড়াশুনা যায় লাটে। ঘরে ঘরে নাকি এই অবস্থা। আমি বলতে পারি নাই আমার পিতার গ্রামের অবস্থা আরো করুন, শহরের এত কাছে থেকে বিয়ে হয় কিছু মেয়ের বারো কিংবা তেরোতে। সেই বালিকা বধুরা তার জামাইকে মোবাইলে কল দিয়ে বলে, 'আপনে কই? আসবেন না আমগো বাড়ী, আব্বায় তো গোশত আনছে বাজার থুন।' তবে নানু বাড়ীর মানুষজনের একটা জিনিস ভালো, ছেলেমেয়েদেরকে পড়াশুনা করানোর খুব চেষ্টা করে। যতবার ফেল করুক সমস্যা নেই,আশা ছাড়ে না। ঘরে ঘরে জাতীয় বিশবিদ্যালয়ে অনার্স, ডিগ্রী পড়ুয়া ছাত্র ছাত্রী। আমাদের গ্রামে যা নাই, টাকা হলেই ইটালি- দুবাই পাঠাও, সুদে টাকা লাগাও, জুয়া খেলো, ৪ লাখ টাকা ঘুষ দিয়ে পিয়নের চাকরী নাও, ধান্দা শুধু এইসব।মেয়ে হলো তো কথাই না, বোরখা পড়ে ইন্টারের ক্লাস করো, তার মধ্যেই বিয়ে দেও, টাকা লাগলে জামাইকে তিন লাখ টাকা দাও।যত বিয়ে হয় এখানে বেশীর ভাগই টাকার আলাপ, টাকার জোরে কথা বলা। আমার চাচতো বোনেরও বিয়ে হয়েছে সেভাবে। এখন আমার চাচতো ভাই এই সাত বছর হতে চললো, ওর দুলাভাইকে বলে, 'আসবেন না ঘরে, তিন লাখ টাকা দিয়ে বিয়ে করছেন বাড়ীতে না আসার জন্য। সবাই হাসে এই কথায়। আমি ভাবি কত বড় মেরুদন্ডহীন জামাই!
বর্ষায় নানু বাড়ীতে যে নদী তাতে পানি আসে। দেখতে অপরূপ। মনে হয় সারাদিন বসে থাকি নদীর পারে। দীর্ঘকাল চট্টগ্রামে থাকার কারনে আমার সাগর খুব ভালো লাগে। এখন মনে হয় মাঝে মাঝে নদী আরো ভালো। একটা শান্তিময়তার ব্যাপার আছে।কি সুস্থির ভাবে দাঁড়িয়ে আছে, মৃদু স্রোত নিয়ে। পাশে চরের জমি। মানুষের জীবিকার জায়গা। তাকালে মনে হয় সবুজ এক দিগন্ত মাঝখানে জলধারা। এখন আমি বুঝি মামার কেন গ্রাম এত ভালো লাগে, এবার আসার কথাই ছিল না তাও ঈদের পরদিন ট্রেনে ঝুলে ঝুলে হাজির। এমন নয়নাভিরাম গ্রামে মামার এত দিন কেটেছে, সবাই চেনা জানা, নিজের বাড়ী, এমন মায়া কাটানো অসম্ভব। চা খাওয়া কমিয়ে দিয়েছি। কিন্তু নানু বাড়ীতে গেলে, দোকানে বসলেই আমার চা খেতে ইচ্ছে করে। চা যদিও বারেকের মতো না, কিন্তু যে চমৎকার ভাবে কাপ পরিষ্কার করে চা দেয়,দেখার মত এক সিন। যে গ্রামেই যান চ্যানেল এখন একটাই স্টার জলসা, চায়ের দোকানে তা হয়ে যায় জলসা মুভিজ।প্রসেনজিত রঞ্জিত মল্লিকের যত সামাজিক ক্ষেত মুভি সব দেখি মানুষ গিলছে। যাদের গেলার ইচ্ছে নাই তারা তাস খেলছে লুডু খেলছে, ১৬ গুটি খেলছে, ক্যারমও আছে আরেকটু সামনে। খেলাধুলা আমার আর ভালো লাগে না, আমি মানুষ দেখি। মানুষ নিয়ে জানা, মানুষকে নিয়ে ভাবতেই আমার ভালো লাগে। ক্ষিন্নীতলা নামের এক মাজা্র, ফকির টুকু শাহ নামের এক সাধকের মাজার। গান হয় সেখানে দারুন। লালন, বিজয় সরকার, জালাল এদের গানই ফিরে ফিরে আসে। এইতো গ্রাম, গ্রামীণ জীবন, আমাদের লোকজ জীবনযাত্রা। ফেসবুকে, টিভিতেই, বইপুস্তকে আর সেই জীবন কই?
চট্টগ্রামে বন্ধু সাগরের বিয়ে হলো আজ। যেতে পারলাম না। বন্ধুদের আপলোড করা ছবি দেখি ফেসবুকে। আহা, বন্ধুদের মুখ দেখাও আনন্দের। গেলে যে আনন্দটা পেতাম সেই কথা ভেবে শিহরন জাগে মনে। যাওয়া হলো না, আমার আসলে কোথাও যাওয়া হয় না ইদানিং। জামালপুর আর মোহাম্মদপুর করে করেই জীবনের সময় গুলো চলে গেল।
তোমার বিয়া কবে?
গ্রামের বর্ণনা পরে তো এখন গ্রামে যেতে ইচ্ছা করছে।
শান্তদা কি পোস্টের কিছু কিছু লেখাই স্ট্যাটাসে তুলে দেন, নাকি স্ট্যাটাসগুলো পরে পোস্টে যোগ করেন?
তোমার বিয়ে কবে?
তোমার বিয়া কোন পুরে ? শেরপুর, মিরপুর, ফরিদপুর, মাদারীপুর, লক্ষীপুর...!!!
মায়ের পরিচয়ে কথা বলতে সত্যিই অনেক আনন্দ লাগে!
মন্তব্য করুন