কালচে রক্তের শহর
ঘটনা আসলে তেমন কিছু না। নতুন করে কিছু বলার না। যা ঘটছে চারপাশে তাই বলা। যা ঘটছে কিছুই নতুন না, কিন্তু বারবার ঘটছে আর আমরা বারবার ভুলে যাচ্ছি। ভাবছি সব ঠিকঠাক, দিব্যি চলছে বেশ। কেউ কেউ শুনতেই চায় না কিছু, কেউ আছে শুনেও না শোনার ভানে। দিন সপ্তাহ মাস চলে যাচ্ছে অবিরত বিছিন্ন ঘটনায়। তেমন এক বিচ্ছিন্ন ঘটনার কথা বলি গত সপ্তাহের। যা আমার মনকে পুরো চূর্ণ বিচূর্ণ করে বিষিয়ে ফেলেছে। বাসায় যাবো বৃষ্টি হচ্ছে। হুট করে দেখি ভারী কিছু পতনের শব্দ। আমার ধারনা ছিল ট্রান্সমিটারের কিছু হয়েছে। কিন্তু দেখলাম চারপাশ থেকে মানুষ দৌড়ে আসছে। আমিও গেলাম কৌতূহল বশত। যেয়ে মস্ত বড় ভুল করে ফেলেছি। সামনে আগালাম না। একজনের দেহ পড়ে আছে। আর বৃষ্টি আর রক্তে পুরো রাস্তা ভেসে গেছে। পুলিশরা দাঁড়িয়ে ছিল তাঁরা বিল্ডিং এর ভেতরে ঢূকে পড়েছে। মারা তো গিয়েছেই তবুও একটা গাড়ী পাওয়া গেল সেটা করে উনাকে ঢাকা মেডিকেলের আনুষ্ঠানিকতা সারতে নেয়া হলো। যাই হোক পুলিশ ভাইরা এবার যে বাড়ী থেকে লোকটা নীচে মরে গেল সেখানে গেল। লোকজনের ভীড় বাড়ছে। শুনলাম ঘটনা। ভদ্রলোকের নাম খলিল। বয়স ৪৫-৪৬। পেশায় কেয়ারটেকার কাম দারোয়ান। এই বৃষ্টির মধ্যে উনাকে বাড়ীওয়ালীর নির্দেশে টাংকি পরিস্কার করতে বলা হয়। উনি স্লিপ খেয়ে নিচে পড়ে যান। পুলিশ ভাইরা আর দেরী করে নাই। বাড়ীতে গিয়ে চা নাস্তা খেয়ে বের হয়ে নাকি বলেছে এইটা এক্সিডেন্ট, কি আর করা। পরে খোজ নিয়ে জানলাম পুলিশ ভাইরা পেয়েছে ৫০ হাজার। দাফন কাফনের খরচ বাবদ তাদের দেয়া হয়েছে ১ লাখ। যে বাড়ীওয়ালা সে প্রায় দু তিন ডজন বাড়ীর মালিক। সুতরাং স্ট্রং লাইন আপ। কিছুই হয় নাই করা। যে ভদ্রলোক মারা গিয়েছেন তার তিন সন্তান। সবার বয়স আন্ডার নাইন। তাদের ধারনা তাদের বাবা বাড়ীর হাসপাতালে। ফিরবে শীঘ্রই। আমি সিউর এই স্বামী হারা ভদ্রমহিলা যাকে তরুনী বলাই সমীচিন তার বিয়ে হয়ে যাবে সামনে বছর আসতে না আসতেই। আমি পুলিশকে পরের দিন রাস্তায় পেয়ে জিগ্যেস করেছিলাম এইটা তো প্রায় খুনের মতই, বৃষ্টির দিন কেউ কাউকে এই কাজে পাঠায়। এস আইয়ের হলুদ দাতে জবাব, শান্ত ভাই সব আল্লাহর হাতে। আমরা কে আর? আমাকে অফার করে চা সিগারেটের। আমি বলি না আমি চা খাবো না, আপনারাই খান। বিল দেয়ার সময় মানিব্যাগ দেখি ইয়া মোটা। খালি ১ হাজার টাকার নোট। আজ নামায পড়ে বাসায় ফেরার সময় আবার গেলাম সেখানে। দেখলাম এত বৃষ্টিতেও কালচে রক্তের দাগ অমলিন। মনে হয় গরু কোরবানী দেয়া হয়েছিল, পরিস্কার করা হয় নি।
ব্যাপারটা নিয়ে কদিন ধরে ভাবছি। স্বপ্নেও দেখি রক্ত। বিশ্রী রকমের সব স্বপ্ন। অফিসের কাজে, গানে, আড্ডায় ব্যস্ত দিন যায় তাও ভুলতে পারি না কালচে রক্তের দাগ। ভুলতে পারি না লোভাতুর পুলিশের মুখ, হাড্ডিসার ভদ্রলোকের সন্তানের মুখ। সামনে ঘটেছে বলেই হয়তো ব্যাপারটা নিয়ে এত ভাবছি। দূরে ঘটলে মনেই আসতো না কখনো। প্রতিদিন কত খুন হচ্ছে কিছুই মনে রাখি না। যে পত্রিকা পড়াটা আমার এত প্রিয় তা ছেড়ে দিয়েছি সেই কবে। টিভি দেখাও হয় না। যা জানা শোনা তা ফেসবুকেই। যেমন আজ একজন খুন হলো, হোমিওপ্যাথী ডক্টর, তার বন্ধু শিক্ষক প্রায় খুনের কাছাকাছি আহত। মসজিদের মুয়াজ্জিন, পুরোহিত, পাদ্রী, ফেসবুক এক্টিভিষ্ট, গায়িকার কাজের মেয়ে, এলজিবিটি মুভমেন্টের সাথে জড়িত, স্কুল কলেজ ছাত্রী, আদিবাসী ছাত্র, মধ্যবয়স্ক চাকুরে, খুন হলো না কে? আইন, গাইন, ফা, ক্বফের শাসন তো এইদেশের কখনোই ছিল না। তবে এখন অবস্থা এত খারাপ যে দেশ নিয়ে কেউ আশাবাদী কিছু বলা হলে তাঁকে মানসিক ভারসাম্যহীণ মনে হয়। ধন্যবাদ ঢেড়শ চাষে ব্যস্ত সরকার, ধন্যবাদ সুপারম্যান হেফাজত, ধন্যবাদ সুপার প্রোএক্টিভ কোপান্তিস দল, ধন্যবাদ মেট্রিক পাশ আওয়ামীলীগ, ধন্যবাদ বাল বিএনপি, ধন্যবাদ দালাল জামাত, ধন্যবাদ তাওহিদী জনতা, ধন্যবাদ বাদাইম্মা জনতা, ধন্যবাদ শুক্রবারে ভালো মন্দ খাওয়া জনতা, ধন্যবাদ দুপুরে শবে বরাত বিদআত না হালাল তা নিয়ে ডিবেটে লিপ্ত জনতা, ধন্যবাদ আমার মত আজাইরা বুদ্দিজীবি, ধন্যবাদ রাজনীতি সচেতন জনতা, ধন্যবাদ বাম ডান উচু নিচু সবাইকে। আপনাদের অক্লান্ত পরিশ্রম সফল হয়ে গেল। বাংলাদেশকে দোযখে রূপান্তর করতে আপনাদের এই ত্যাগ তিতিক্ষা জাতি আজীবন মনে রাখবে। আমরাই নৌকা মার্কা দেখে ভোট দিয়ে এসেছিলাম বছর সাত আগে। সেই সুত্রে নিজেকে খুনীদের দোসর মনে হয়। মনে হয় চাইলেই মানুষগুলোকে বাঁচানো যেত। সরকারের কাছে এইসব বিচ্ছিন্ন ঘটনা। অটো ক্ষমতার নরম গদিতেই তাঁরা আচ্ছন্ন। আমরাও তাদের মোহের আচ্ছন্নতা কাটাতে পারছি না। নিজে বেঁচে আছি তাই ভাবছি আমাদের কিছুই হবে না। আমরা এক সাথে মরছি না। আলাদা আলাদা ভাবে মরে ব্যাপার গুলোকে আলাদা করছি। যদি অনেকে এক সাথে মরতাম তাহলে প্রতিবাদ হতো বেঁচে থাকার তাগিদে। একাত্তরে আমরা প্রতিরোধ গড়তে পেরে ছিলাম কারন আমরা জানতাম সম্মিলিত ভাবে সবাই আক্রান্ত। এখন সবাই ভাবি আমি হয়তো টার্গেট না, আমাকে কে আসবে মারতে? এই ইন্টারনেটের সময়ে সবাইকে দূরের মানুষ বনিয়ে ফেলে আমরা, ভাবি ওমুকে মরলে আমার কি? তমুক খুন হয়েছে আমাকে কেন খুন করবে? অমুককে মারার তমুক কারন ছিল আমি তো অমুকের মত না। এইজন্যই বিচ্ছিন্ন ভাবে মরছি আর জন বিচ্ছিন্ন সরকার একটা চুলও ছিড়তে চাচ্ছে না সংঘঠিত খুনীদের। যেমন ব্যর্থ সরকার তেমন ব্যর্থ আমরা। এত ব্যর্থতা বোধহয় আফ্রিকার যুদ্ধবিধস্ত কোন দেশও না। ব্যর্থ রাষ্ট্রের তালিকায় আমরা শীর্ষে এটাই আমাদের সাম্প্রতিক অর্জন। এইসব নিয়ে লিখতে ইচ্ছে করে না। কারন সামান্য অক্ষম ব্লগও সরকার বাহাদুর ও হেফাজতিদের দুচোখে বিষ। কিন্তু লেখা ছাড়া এই ব্যর্থ আমার আর কি করার আছে, কোথাও কোনও সমাধান নাই, কারও কাছে আশার কথা নাই। প্রতিদিন শুধু আছে খুনের খবর, আমাদের জানোয়ার হবার খবর।
ব্লগ লেখবো না ঠিক করেছিলাম। লিখিও খুব কম। কিন্তু রক্ত নিয়ে ভাবনা থেকে বিচ্ছিন্ন হতে পারছি না তাই লিখতে বসা। জানি কেউ পড়বেনা। তাতে আমার কিচ্ছু যায় আসে না, কারন আমি নিজেও ব্লগ আর পড়ি না। ওতো পড়ে কি হবে? আমাদের মত মানুষকে টুডে অর টুমরো সেই চেনাজানা শয়তানদের কাছে পরাজয় বরন করতেই হবে। আমরা সাধু না তবে আমরা শয়তানও না। শয়তানরাই এখন সাধু, তাদের অনুভূতি আছে। আমাদের অনুভূতি নাই, আমাদের আছে স্বজন বন্ধু হারানোর রক্তের দাগ। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন রক্তের দাগ এখনও শুকায় নাই। আমি বলি রক্তের দাগ শুকিয়েছে অনেক আগেই, যাও একটু গন্ধ আছে তা মুছে ফেলতে সর্বশক্তি নিয়োগ করেছে আপনার দল, আপনার কাছের মানুষেরাই। রামপাল কিংবা বাঁশখালীতে বিদ্যুৎ কেন্দ্র করে বা সোনায় মোড়ানো দামে রাস্তা বানিয়ে জিডিপি বাড়ছে, আর গলায় ফাঁসি দিয়ে মরছে বেকার যুবক কিংবা অসম্মানের শিকার পল্লী গায়ের বধু। এত উন্নয়ন হবে দেশে, যে দেশ ভেসে ভেসে আটলান্টিকের পারে চলে যাবে। থাকবে খালি অথর্ব দলকানা মানুষেরা যাদের নিজেদের আত্মীয়কে ধর্ষণ করলেও বলবে, ঠিকই আছে মেয়ে হয়ে এই দেশে আছে কেন? পাকা পায়খানার খোজে বিদেশ যাই নি কেন? আমি অবশ্য তারপরেও এইদেশে থাকবো। মরলে এইদেশেই মরবো। এই কালচে রক্তই না হয় মনে রাখবে আমাদের কথা। থেকে যাবে স্মৃতি হয়ে। যেভাবে লিখতে চেয়েছিলাম, কিছুই হলো না। হলো না সেভাবে লেখা। অগোছালো লেখাই থাক পড়ে, এই শীত নিদ্রার ব্লগে।
''আমি অবশ্য তারপরেও এইদেশে থাকবো।
মরলে এইদেশেই মরবো।"
সেটাই
ছোট ভাই, সব নির্জলা সত্যি লিখেছো তুমি।, বড়ই হতাশ লাগে।
বাংলাদেশ কি আগে কখনো এমন আশাহীন দ্বীপ ছিলো নাকি আমারই আগে সচেতনতা কম ছিলো বুঝি না
সত্য কথার বেইল নাই আপু। তবে আপনার ফেসবুকের লেখাগুলো খুব ভালো হচ্ছে।
আম্মা বলে, দেশ থেকে দূরে থাকলেও নেটে প্রতিদিন দেশের খবর পড়িস। আমি বলি, কেন? কি হবে পড়ে?আমি বেঁচে থাকার জন্য আমাকে আমার দেশ থেকে আপনিই দূরে পাঠিয়েছিলেন। আমার মত অন্য মেয়েদের মৃত্যুর খবরটা আমার নিজের মৃত্যুর মতই মনে হয়।আমি এখনও শ্বাস নিয়ে বেঁচে আছি বলে লজ্জ্বা হয়।
হুমম। খুব বাজে একটা জীবন আমাদের!
মন্তব্য করুন