আহমাদ মোস্তফা কামালের তাঁহাদের সঙ্গে কথোপকথন-পাঠ প্রতিক্রিয়া।
হাতে এখন, রাজু আলাউদ্দীনের নেয়া এক ইন্টারভিউ গ্রন্থ। তা নেড়েচেড়ে দেখছিলাম। মোটা বই। তবে শুধু আজাদ- ছফার ইন্টারভিউ আর উনাদের ঝগড়া টুকুই পড়লাম, পুরোই দেখি লংকাকান্ড, তুমুল পারসোনাল এট্যাক, তীব্র সব প্রতিক্রিয়া। এই নিয়ে শুনেছিলাম আগেই তবে এত বাজে অবস্থা ছিল তা জানা ছিল না। সেই তুলনায় আহমাদ মোস্তফা কামালের ২০১৭ তে রোদেলা থেকে বের হওয়া বইটা অনেক বেশী গভীর ও প্রাসঙ্গিক আলোচনায় ভরা। একমাত্র মান্নান সৈয়দের ইন্টারভিউটা হয়তো একটু উসকে দিবে, এছাড়া সব গুলোই ব্যাক্তিকে বোঝার চেষ্টা, তাঁর সৃজন ভাবনা জগত কিভাবে চালিত হয় সে দিকেই থেকে গেছে। এই পোষ্টটা লিখছি চাইলে আমাকে কনগ্রাচুলেট করতে পারেন। কারন এটা ৩৫০ তম পোষ্ট। কোনোদিন ভাবি নাই ৩৫০ টা পোষ্ট দিবো। তাও তো মধ্যে অনেকদিন লিখি না, লিখলে মনে হয় ৫০০ ছাড়াতো। মিশ্র অনুভুতি হয়। ভালো লাগে এইজন্য নিজের অনেক কথা জানাতে পারা গেল, খারাপ লাগে লেখাগুলোতে যত্নের বড় অভাব, আরো ভালো হতে পারতো।
সাক্ষাৎকার গুলো বেশীর ভাগই বছর আটারো উনিশ বছর আগে। পড়তে গেলে অবশ্য মনে হবে সেদিনই নেয়া। আসলেই তো, তলে তলে সময় তো কম গেল না আমাদের জীবন থেকে। শুরুই হয়েছে বাংলাদেশের প্রধান কবি শামসুর রাহমানকে দিয়ে। এই সাক্ষাৎকারটি আমার কাছের খুব। কারন শামসুর রাহমান আমার প্রিয় কবি আর এই ইন্টারভিউতে উনাকে আমি যেমন কল্পনা করি তেমনই কোমল স্নিগ্ধ মনের কবি হিসেবেই দেখতে পেয়েছি, আসলেই হয়তো উনি তাই। উনি কবিতার কথা বলেছেন, নিজের সময়ের কবিদের কথা বলেছেন, নিজের জীবনের অপ্রাপ্তি প্রাপ্তির দোলাচলে থাকা নিয়ে বলেছেন, কামাল ভাইয়ের মতো মনস্ক পাঠকের প্রশ্নে মুগ্ধ হয়েছেন। বইটি তুমুল আগ্রহ নিয়ে শুরু করবার জন্য যথার্থ। এরপরে সৈয়দ হকের ইন্টারভিউ দুটি। প্রথমটি আমার কাছে তত বেশী ভালো লাগে নি। কারন সঠিক বলতে পারবো না। কেমন জানি টেলিফোন ইন্টারভিউয়ের মতো লেগেছে, কিন্তু ২য়টা পুরোই অসাধারণ। ২য় ইন্টারভিউটা আমি আগেও পড়েছিলাম এবার পড়ে মনে হলো, খাসা হয়েছে ব্যাপারটা। হক ভাইও অনেক সময় নিয়ে কথা বলেছেন, কামাল ভাইও দারুণ সব প্রশ্ন করেছেন। বিপুল যে লেখার জগত হক সাহেবের তা নিয়ে খুটিয়ে খুটিয়ে প্রশ্ন করা হয়েছে। উপন্যাস, গল্প, কবিতা তো ছিলোই সাথে হক সাহেবের বনাঢ্য জীবন লেখক হবার শুরুর কাল, ভাষা রীতি, আঙ্গিক, লেখার চিন্তাভাবনা সব নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। আমার সৈয়দ শামসুল হকের আরো অনেক গুলো সাক্ষাৎকার পড়ার তৌফিক হয়েছে, কিন্তু আমি বলবো এইটাই বেস্ট। হাসান আজিজুল হকের সাক্ষাৎকারটাও ভালো লেগেছে। উনার গল্প নিয়েই কথা বলা হয়েছে বেশী। হাসান আজিজুল হকের বিনয় আমাকে মুগ্ধ করেছে। সাধারণ ইন্টারভিউতে নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ ভাবানোর এক চেষ্টা থাকে, হাসান সাহেব সেদিকে হাঁটেনই নি। নিজেকে বরং ভাবাতে চেয়েছেন, সামাজিক মানুষ অনেক কিছু করতে হয়, লেখাটাও সেরকম, সব সময় তিনি লেখা নিয়ে ভাবতে চান না, সব সময় লেখার নিয়ন্ত্রণও তাঁর কাছে থাকে না। জীবন উপভোগ করতে ভালোবাসেন, জীবনকে তিনি সব সময় উদ্দেশ্যহীণ ভাবতে রাজী নন। মাহমুদুল হকের খুব বেশী ইন্টারভিউ আমার পড়া হয় নি। তাই এটাকে বলা যেতে পারে নতুন অভিজ্ঞতা। এক উদাসী কিন্তু সেন্সিটিভ মাহমুদুল হককে পাওয়া যাবে। আমাদের অনেকের খুব প্রিয় লেখক মাহমুদুল হক, সাক্ষাৎকারে তিনিও জানাচ্ছেন পাঠকের এই ভালোবাসার কথা, নিজের মায়ের কথা, লেখার সময় কি ভাবতেন তাও জানাচ্ছেন তিনি। উনার মায়ের একটা কথা কত প্রাসঙ্গিক এখনো, উনার মা ঢাকায় থাকার আগে কলকাতা থেকে দেখতে এসেছিলেন কি দশা প্রাদেশিক রাজধানীতে, দেখলেন মহিলারা রাস্তায় বের হয় না, বের হলেও বোরখা পরে বোরখাওয়ালা রিক্সায় তাই এই দেশকে তিনি আখ্যা দিচ্ছেন, বর্বরদের দেশ বলে। আসতেই চান নি কলকাতা থেকে। নিতান্তই উনার বাবার সরকারী চাকরীর জন্যই বাধ্য হয়ে আসা। মাহমুদুল হকের শহীদ সাবেরের স্নেহধন্য হওয়ার গল্পটা বেশ কৌতূহল উদ্দীপক। কেন তিনি নিজ থেকেই লেখাঝোকা ছেড়ে দিলেন তাও তিনি বলতে চান নাই তেমন ভাবে। তবে তাঁর মতো মানুষ লোভী স্বার্থপর লোকজনের সাথে চলবেন না সেটাই তো নরমাল। কামাল ভাই ব্যাক্তিগত ভাবে নিজেকে ধন্য ভাবতে পারেন যে মাহমুদুল হকের মতো এক লেখকের এত নিকটে ছিলেন অনেকটা দিন, এক জীবনে আর কি দরকার হয়!
আবদুল মান্নান সৈয়দ হকের ইন্টারভিউটা বেশ উদ্ভট আর উত্তেজক। তিনি বাংলাদেশে অন্যতম সেরা সাহিত্য সমালোচক হয়েও যেভাবে সব বড় সাহিত্যিককে তুলোধোনা করলেন ব্যাপারটা সুখকর না। যেমন তিনি আখতারুজ্জামান ইলিয়াসকে বলেছেন মোটিভেটেড, মাহমুদুল হকের গদ্যই হয় না, হাসান আজিজুল হকের লেখাকে খুব বেশী গুরুত্বের ভাবেন না, শওকত হকের লেখাই হয় না, সৈয়দ হক পলিটিক্যাল মুটিভেশনে লেখা হারিয়েছেন। ছফা তাঁর প্রতিক্রিয়াতে যথার্থই জানিয়েছেন, তিনি বড় লেখকের নীচে নামাতে গিয়ে কিছু ছোট লেখকদের উপরে তুলেছেন। রাহাত খানের ইন্টারভিউটাও ভালো। সাক্ষাৎকারটি পড়ে আমার মনে হলো, উনাকে আমার পড়া হয় নি। সামনেই পড়বো। শহীদুল জহিরের লেখার ভক্ত হিসাবে তাঁর ইন্টারভিউটাও আমার মনে দাগ কেটেছে। কেন তিনি এই ভাষারীতিতে লিখেন, কেন তাঁর লেখার পদ্ধতি ভিন্ন, কেন তিনি কালেক্টিভ ভাবে আমি-র জায়গায় আমরা দিয়ে লিখেন। কেন তিনি কোনও সিদ্ধান্ত পাঠককে চাপাতে দেন না তারও ব্যাখা আছে। আনিসুল হক আর আনিসুজ্জামানের এই দুইজনের সাক্ষাৎকারই আমার গড়পরতা লেগেছে, মা উপন্যাস নিয়ে আনিসুল হকের আবেগের জায়গা জানিয়েছেন, কত রাত দিন খেটেছেন তা জানাচ্ছেন। আমার বন্ধুরা মইনুল আহসান সাবেরের খুব ভক্ত, কিন্তু আমি তেমন নই। কম পড়েছি এই কারনেও হতে পারে। সাবের ভাইয়ের সাথে কামাল ভাইয়ের যে আন্তরিক সম্পর্ক তাঁর তুলনায় সাক্ষাৎকারটা আরো ভালো হলে ভালো লাগতো। সো ফার সো গুড। বদরুদ্দীন ওমরের সাক্ষাৎকারটা বইটি কমপ্লিট করেছে। বাম দল, আওয়ামীলীগ, বিএনপি, জামাত, এঞ্জিও কাউকে বাদ রাখেন নি বদরুদ্দীন ওমর ওয়াশ করতে। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে যেমন মতামত পোষন করেন তাঁর সম্প্রসারিত রূপ প্রকাশিত হয়েছে। কেন বাম দল দেশে দুর্বল, কেন আওয়ামিলীগ এরকম, কেন বিএনপি এমন, জামাতের শক্তির উৎস কোথায়, কেন দেশ এরকম সব পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে ব্যাখা করেছেন। আমি বদরুদ্দীন ওমরের লেখা খুব পড়ি, উনার লেখাতেও উনি এত চমৎকার করে বলেন না কথাগুলো।
সব মিলিয়ে আমার কাছে তাঁহাদের সঙ্গে কথোপকথন একটি দারুন অভিজ্ঞতা। মেলা থেকেই কিনলাম। পরে দুদিনের মধ্যেই শেষ করলাম। মুগ্ধ। সেই মুগ্ধতা নিয়েই লেখাটা লিখলাম। আমার লেখা এরকমই, এখনো নির্মোহ হতে শিখলাম না
বইয়ের নাম-- তাঁহাদের সঙ্গে কথোপকথন
লেখক-- আহমাদ মোস্তফা কামাল
মুল্য--৩০০ টাকা
প্রকাশক-- রোদেলা।
আপনার লেখা পড়াটাই আনন্দের। আপনার পুরনো লেখাগুলো মাঝে মাঝে পড়ি আমি। অভিনন্দন ২৫০ টা পোস্টের জন্য। আরো অনেক অনেক লিখবেন আশা করি। শুভকামনা।
আপনার লেখা পড়াটাই আনন্দের। আপনার পুরনো লেখাগুলো মাঝে মাঝে পড়ি আমি। অভিনন্দন ২৫০ টা পোস্টের জন্য। আরো অনেক অনেক লিখবেন আশা করি। শুভকামনা।
রিভিউ লেখা যে "আর্ট" তা শান্ত থেকে শেখা যেতে পারে
৩৫০তম পোষ্টের জন্য অভিনন্দন
মন্তব্য করুন