অভাজনের বইমেলা!
আগে একটা সময় আমি বইমেলা নিয়ে কত কিছু লিখেছি, দু হাতে যা পড়েছি তার রিভিউ লিখতাম। প্রায় বেশীর ভাগ দিন বইমেলা যেতাম, তাই করার মতো গল্প কম ছিল না। এখন সোলসের গানের মতোই-- হঠাৎ শুন্যতা। মেলাতে যাওয়াও হয়েছে অল্প কদিন। তেমন ভাবে দেখাই হয় নি কিছু। না আসলে মেলায় মনে হয় শহরে বইমেলা চলে তাও আসছি না, আর যেদিন যাই সেদিন মনে হয় কেন যে আসি ছাতার মেলায়। আমাদের এই আজব কমপ্লেক্স কাটে না, মেলা শেষ হয়ে যায়- দিন চলে যায়। আগের মত বই কেনা হয় না। আগে আমি চ্যারিটিতে বিশ্বাস করতাম, খালি লেখক পরিচিত বা চেনাজানা মানুষ হয়তো তার অন্য কাজ ভালো লাগে এইজন্য কত বই আমি কিনেছি। এখন আর সেসব দিন নাই, এখন পারতপক্ষে না কেনার জন্য থাকি। এছাড়া সারা বছরেই বই কেনা হয়, ফ্রেন্ডের কাছ থেকে আনা হয়, এভাবেই অনেক বই পড়া হয়ে যায়। তবে বইমেলা তো বইমেলাই তার সাথে তুলনা চলে না কিছুর। না কিনলেও কেনা হয়ে যায় কিছু বই। তার চেয়ে ভালো লাগে অবশ্য অনেকদিন পর এই দুর্বিনীত শহরে কিছু প্রিয় মানুষদের সান্নিধ্য পাওয়া, তাদের বই ও সাহিত্য ভাবনা জগত জানা, এরচেয়ে আর কি ভালো হতে পারে।
বইমেলা নিয়ে আসলে নতুন কোন কথাটা বলা যায় তাই ভাবছিলাম। কারন এই একটা বই মেলা ভাষা, বাহান্ন, চেতনা, ভাষা শহীদ, সবখানে বাংলার প্রয়োগ এইসব নিয়ে এত আলোচনা সমালোচনা হয় যে নতুন কথা বলাই বাহুল্য। এরপর আবার প্রতিদিন পত্রিকার পাতাজুড়ে বইমেলা নিয়ে কত খবর আর রঙ্গীন বিজ্ঞাপন। শুক্রবার আসলেই দেখি পত্রিকাগুলোর যার যার এজেন্ডার লেখক তাদের বই নিয়ে কত আলাপ। এখন অবশ্য পত্রিকা কিংবা মিডিয়ার চেয়েও সব থেকে বড় ব্যাপার হলো ফেসবুক ভিত্তিক বই মেলা। ফেসবুকে আমরা কার কার বই আসলো তা যেমন জানি, আরো জানি কিভাবে কত লেখক ধিমসে ফেসবুক বেইজড বাজারজাতকরণ করে অনেক লোককে বই কেনালো। লেখকের সাথে সেলফি, পাঠকদের সাথে সেলফি, বই নিয়ে সেলফি, অটোগ্রাফ নিয়ে সেলফি, লেখকের সিটিং অথবা স্ট্যান্ডিং অবস্থায় স্টলের সাথে লেপ্টে থাকা, সব মিলিয়ে এক ডেসটিনির মতো অবস্থা। আমার কাছে নিজের বই আসছে এই খবরটাই যেন লোকজন জানে সেটাই গুরুত্বপূর্ণ। এক দংগল লোকজন আমার বই কিনবে, আমি চামে দিয়ে মার্কেটিং করবো যে আমি এই যুগের হুমায়ুন, আমার বই সবাই মুগ্ধ চোখে কিনে এই জিনিসটাই বিরক্তিকর। কত বই বিক্রি হয়, যেমন বাচ্চা বাচ্চা ছেলেমেয়েরা স্টলে গিয়ে খুজে ভুত এফএমের বই, মজার হাসির বই, গোয়েন্দা ধরনের ফিকশন। যে যেভাবে পারছে ভজানোর চেষ্টা করেছে, লেখক হয়ে আপনার যদি ক্যানভাসার বা অটোগ্রাফদেয়ার মেশিন হয়ে কাজ করেন তবে আপনার প্রতি আমি একটু বিরক্ত। তবে হতাশ না, এই ১৬ কোটির দেশে করে কেটে খাওয়ার অধিকার আপনার আছে। আমি সাদাত হোসেনকে দেখলাম তার ইয়া মোটা উপন্যাসে তিনি অটোগ্রাফ দিচ্ছেন, ছেলে মেয়েদের লাইন, উনি জেইল পেন দিয়ে অটোগ্রাফ দিচ্ছেন, তার চোখে মুখে কি আমোদ। আবার এক লেখককে দেখলাম নিজের ফেসবুকে খালি পাঠকদের ছবি, যেই কিনে আর যাই টুকটাক বলে সব ফেসবুকে দেয়া হচ্ছে, আরেকজনকে দেখলাম সার্বক্ষণিক ক্যামেরা ম্যান সাথে, বিরতিহীন ছবি তুলছে। মিলন ভাই আনিসুল হকের ব্যাপার ভিন্ন। উনারা সেদিয়ে বসে থাকেন, আর মিনিটে দুটো অটোগ্রাফ দেন। পিয়াজু খান, চা খান আর টিভি ক্যামেরা অপেক্ষায় বসে থাকেন। কিছু কিছু পাঠক আবার অটোগ্রাফ ছাড়া বই কিনে না, যেন অটোগ্রাফ দিলেই সেই বইয়ের পাতা আরো ২০টা বেড়ে যাবে উনার জন্য। কিছু লোকদের দেখি বলেন স্টলে গিয়ে, কোন লেখক আছে? তাহলে উনার একটা বই দেন। যেন তিনি মাস্টার মশাই, উপস্থিতি দেখে বই কেনার কথা ভাববেন।
এবারের মেলায় ভালো জিনিস কিছু ছিল, ধুলা কম, প্রশস্ত। বড় বড় প্রকাশনীর বড় স্টল। তবে আমি তো আগের মতো মেলা ওউন করি না তাই আমার কাছে মনে হয় একই সার্কেলে ঘুরছি খালি আর পা ব্যাথা হচ্ছে। আর যা হয় মেলায় সেই যে আমাদের উচ্ছাস ছিল তা আর খুঁজে পাই না। আসলে ২০১৫ সাল আমাদের বইমেলা নিয়ে যত আদিখ্যেতা ছিল সব শেষ হয়ে গেছে। বইমেলার গায়ে লেগে আছে ২৬ শে ফেব্রুয়ারীর রক্ত। যে মানুষটাকে রেখে মেলা ছাড়লাম, বাসায় গিয়ে দেখি তিনি কোপের আঘাতে পর্যুদস্ত হয়ে খুন। ১৬ সাল তো তেমন মেলাতেই যাই নি। এবারও তো না যাওয়ার পক্ষে ছিলাম তাও গিয়েছি চার পাচ দিন। এই বেশী। আগে ২০ দিন মেলায় না আসলে পেটের ভাত হজম হতো না। এখন গেলে মনে হয় কেন যে আসি, আর না গেলে মনে হয় এই শহরে বইমেলা আর যাচ্ছি না, আমি মানুষ নাকি পাজামা? আর এবারের মেলায় আমার জন্য আরেক সমস্যা কোথাও বসার জায়গা নাই, চায়ের দোকান নাই। ফ্লাস্কের চা খেলে আমার বমি আসে। আগে টিএসসিতে দোকান ছিল। এখন কিছুই নাই কোথাও। হয় বই মেলার ভেতরে পর্যটনের কফি খাও নয়তো হাটতে হাটতে ইউনিভার্সিটির লাইব্রেরীর সামনে যাও। আগেই ভালো ছিল, মেলা থেকে বেরিয়েই চায়ের দোকান, বেগুনি পিয়াজু খাওয়ার ফাকে সেখানে দাঁড়িয়ে আড্ডা মারা। এখন আর সেই সুযোগ নাই। যেন চায়ের দোকানদারেরাই যত নষ্টের গোঁড়া। তারাই মেরেছে হুমায়ূন আজাদ আর অভিজিৎকে।মেলায় এবার পুলিশ আর পুলিশে লোকারণ্য। এত পুলিশ আগে আমি কখনো মেলায় দেখি নি। বই মেলার শুরুতে হুজুরদের ঢূকতে দেয়া হয় না এরকম প্রোপাগান্ডা চালানো হয়, কিন্তু আমি দেখি মেলায় ভরা মাদ্রাসার ছেলেরা। আর সব সময়ই মাদ্রাসার ছেলেরা মেলার প্রাণ, অভিধান আর কাশেম বিন আবুবকর কেনার প্রতি তাদের অসীম আগ্রহ দেখি।
বইমেলায় শেষ দিকের একটা দিনের কথা আমার এখনো মনে পড়ে।সন্ধ্যায় খুব ভীড়। এমন দেখি বিখ্যাত লেখক আনোয়ারা সৈয়দা হক, দাঁড়িয়ে কি জানি ভাবছেন উদাস হয়ে। আমার মনে পড়লো সৈয়দ হকের কথা, উনি বেঁচে থাকলে সুস্থ থাকলে চ্যানেল আইতে বই নিয়ে অনুষ্ঠান করতেন, নিজের আরো লেখা বই আসতো মেলায়। কিন্তু মানুষ চলে যায় থেকে যায় শুধু তার বই গুলোই। যেমন অন্য প্রকাশের এখনো প্রধান চার্ম হুমায়ূন আহমেদের পুরাতন বই গুলোই নতুন করে বিভিন্ন প্যাকেজে আনা। লোকজন তাই কিনছে। ভীড় আগের তুলনায় কম তো অবশ্যই। তবে আমার মনে হয় অন্য প্রকাশের স্টলের ছেলে গুলো ডামিশের বাপ। সৈয়দ মনজুরুল হকের মতো এত বিখ্যাত রাইটারের বই চোখের সামনে তাও খুঁজে পায় না। আমার মনে হয় মেলায় একটু বই পুস্তক পড়ে- জানা শোনা এরকম ছেলে রাখা দরকার। আবার আবার কিছু প্রকাশনীর ছেলে গুলো এত ভালো মন চায় তাদের সব বই কিনে বসে থাকি। বলতে ইচ্ছে করে ভাই আপনি কলেজ লেকচারার না হয়ে বইমেলায় কি করেন? বাংলা একাডেমী ও সরকারী দোকান গুলোর ফিচার হলো ভাংতি থাকবে না, আপনি ৩৩৮ টাকার বই কিনে ৫০০ দিলেও তারা বলবে ভাংতি দেন। তবে বাংলা একাডেমী বই কিনতে মজা কিন্তু এর জন্য সময় দিতে হবে, আপনাকে খুব খুঁজে খুঁজে দেখতে হবে, আর জিগ্যেস করতে হবে ওমুক বইয়ের প্রিন্ট আছে কিনা? কারন তাদের বেশীর ভাগ ভালো বইয়ের প্রিন্ট থাকে না, আর প্রিন্ট থাকলে তার যা অবস্থা তা কেনার মতো না। তবে কিছু কিছু বই পাওয়া যায় খুব সুলভে। বাংলা একাডেমীর কার্ড নাকি আছে তা করলে নাকি ৫০ ভাগ ছাড়ে বই পাওয়া যায়, ব্যাপারটা ইন্টারেস্টিং লাগলো আমার কাছে।
মেলা থেকে হারিয়ে গেছে অভিজিৎ রায়, শুদ্ধস্বর, যাবতীয় সরকারি হেফাজতি ভাষায় উস্কানিমুল্কু বই। পুলিশদের ডিউটিতে দেয়া হয়েছে বই নজরদারী। দীপন ভাইয়ের প্রকাশনী আছে তবে নেই সেখানে কিছু লেখকের বই। সব মিলিয়ে মেলাকে আগারগাও বানিজ্য মেলার এক্সটেনশন বই ভার্শন বলা যেতে পারে। আগে যে আমাদের উচ্ছাস, আবেগ, আড্ডা, বই নিয়েই সবার সাথে অন্তরের যে উষ্ণতা ছিল একটা ছোট প্রাঙ্গণে তাদের জন্য খুবই হোচট খাওয়ার সময়। এই মেলায় পরিচিত মুখেরাও উৎসাহী হয় না কথা বলাতে। মেলার বিভিন্ন চত্তর ও লাইটিং ঝর্নার সামনে দাঁড়িয়ে অগনিত সেলফি খিচা মানুষ বুঝবে না বইমেলার মর্ম, শুধু ঘুরতে আসা মানুষরাও বুঝবে না বইমেলার তাৎপর্য। তবুও অবশ্য আশার জায়গা কম নেই, প্রচুর ছেলে মেয়েরা বই কিনছে, সেবার সামনে এত স্কুলের ছেলে মেয়ে দাঁড়ানোর জায়গা নাই, প্রচুর কিশোর কিশোরী শিশুর দল বই কিনে বাসায় ফিরে। অনেক তরুণকে দেখি বিবিধ কারনে নানান বই কিনতে। বই কিনে তারা পড়বে, আরো বই কিনবে, একদিন বুঝবে ভালো ভালো লেখা আসলে কি? তারাই একদিন সমাজের সব দিকে যাবে এভাবেই বিস্তার হবে শুভবোধ বুদ্ধির। এই অলীক আশা নিয়েই বেঁচে থাকি।
বড় হয়ে যাওয়ার এই এক ঝামেলা --- সবকিছুতে মুগ্ধতা কমে যায় - যুক্তি বিবেচনা কাজ করে -- ভাল লাগা হারিয়ে - অসামঞ্জস্য চোখে পরে বিরক্তির উদ্রেক করে
লেখা অসাধারণ হয়েছে
সময় আমাদের মোহ কমিয়ে দেয়, রং বেরং সব ফিকে লাগে, কেবল পুরোনো দিনের কথা মনে পড়ে। এগুলো সত্য, স্বাভাবিক। এই যে দিন থেকে দিনের এই দূরত্ব তার পরিমাপ করতে করতেও লোকে নিজের সাথে দূরত্ব তৈরি করে ফেলে। এখন অনেক বেশি বই বিক্রি হয়, আয় বাড়ছে, কেবল নতুন কিছু খুঁজে পাওয়া কষ্টকর। মানুষগুলোকে আমার হুজুগে মনে হয়, ওরা কাজের চেয়ে অকাজের ঢোল বেশি পেটায়। ঢাকার বাইরে, তাই মেলায় যাওয়া হয়নি দুই বছর। পুরোনো বই পড়ি, ভালো লাগে। ফেসবুকে মানুষের উচ্ছ্বাস দেখি, আমোদ পাই। দিনান্তে নিজের কথা ভেবে হতাশ হই, সময়ের স্রোতে গা ভাসিয়ে দিতে না পারার ব্যর্থতা কষ্ট দেয়। দেখবেন দুই বছর পর আবার সব বদলে যাবে, আরো অনেক কিছু আসবে তবু ধুলোর সাথে মিশে যাওয়া স্মৃতিই মনে দাগ কাটবে।
আপনার লেখা এমনিতেই অনেক ভালো হয়, এটাও ভালো হয়েছে।
মন্তব্য করুন