পাঠ প্রতিক্রিয়াঃ আহমাদ মোস্তফা কামালের, 'যে পথে হেঁটে এসেছি'!
আমরা যারা বই পড়ি, সব বই কি আর আমাদের ভালো লাগে। কিছু নন-ফিকশন তো মানুষের মুখে শোনার পর পড়তে হয়, কিছু বই ভালো হতে পারে ভেবে পড়া হয়, কিছু বই আমরা চ্যালেঞ্জ নিয়ে পড়ি যে এটা আমি শেষ করবোই। আর অল্প কিছু বই মন ছুঁয়ে যায়। মনে হয় বইটার আরো দু তিন ফর্মা বেশি থাকলেও চলতো। আহমাদ মোস্তফা কামালের, 'যে পথে হেঁটে এসেছি' সে ধরনের একটা বই। প্রথমেই বলে রাখি আমার মতামত সাব্জেক্টিভ। আহমাদ মোস্তফা কামালের লেখা আমি নিয়মিত পড়ি দেড় দশক ধরে। তিনি সবসময়ই আমাকে মুগ্ধ করেন। এবারেও ভিন্নতা নেই।
তার আগে এবার একটু শিবের গীত গাই। ধান না হয় পরেই ভানতে যাই। প্রায় দেড় দশক ধরে আমি ঢাকায়। এই পনের বছর ধরে সব বইমেলাতেই যাতায়াত। এবারের বই মেলাকে আমার সবচেয়ে কম উপভোগ্য লেগেছে। যে উদ্ভট সময়ে মেলা, কড়া রোদে কটা লোক যায়। তার ভেতরে তখন লকডাউন আসি আসি করছে। এ পরিস্থিতিতে মেলাতে পাঠক তো দূরে থাক লেখকদেরই হদিস নেই। আমি ঢাকায় একা থাকি, কোভিড প্রটোকল নিয়ে চিন্তায় ছিলাম না। সমানে মেলায় গিয়েছি চৈত্রের গরমে। সেই শুন্যতা আর খা খা রৌদ্রময় দিন। আমি নিঃসঙ্গতা পছন্দ করি। তাই বলে এতটা। এরভেতরে আমার স্থির করা বই গুলো যে কিনতে পেরেছি তাই অনেক। কারন কিছু বই ভেবেছি পরে কিনবো সেসবের প্রকাশককে দেখেছি লকডাউনের আগেই চলে গেছে।
আহমাদ মোস্তফা কামালের 'যে পথে হেঁটে এসেছি' একটা মুক্তগদ্যের সংকলন। লেখকের আরো কয়েকটি মুক্তগদ্যের বই আমার পড়া। সেসব নিয়ে লিখেছিও। তবে এই মুক্তগদ্যের সিরিজটা বেশী আপন। কারন এখানে লেখক আমাদের পর্যায়ে নেমে এসেছেন। যে চিরন্তন আবেগের জায়গা গুলো আছে সেখানে গেছেন। একজন লেখকের লিখতে না পারার দিনগুলো, লেখককে যারা মানুষ হিসাবে বড় করেছেন তাদের কথা, বন্ধুদের গল্প, ক্যাম্পাস জীবন, ঈদ পালন, একাকীত্ব, উপন্যাসের প্রিয় চরিত্র, শৈশবের বিভিন্ন অনুসঙ্গ, ভার্চুয়াল সম্পর্ক, আগের আমলের ঈদ সংখ্যা এসব নিয়েই লেখা। লেখাগুলো এত সুখপাঠ্য ও মেদহীন,যেন লেখক আমাদের সাথে বসে গল্প করছে। আর গল্পগুলো এত বেশী রিলেটেবল মনে হয়, আহা দু দশক আগে জন্ম নিলে জীবনটা খারাপ হতো না। উনি যেসব মানুষের গল্প করেছেন তাদের কথা ভাবলে মনে হয় এত মিষ্টি সব মানুষ। আমাকে টেনেছে লেখকের বাবা কিংবা সেই সব্জী বিক্রেতা অথবা লেখকের কোনো আত্মীয়র কথা। মানুষ গুলো সাধারণ, অথচ কি বর্ণীল। দীর্ঘদিন ধরে আহমাদ মোস্তফা কামাল পড়তে পড়তে আমি জানি, কেমন লেখা হবে। আমার আশার চাইতেও ভালো সব লেখা এ বইতে। আমি বাবার বাড়ীতে বসে যখন লেখাটা পড়ছি, লেখকের ভিটে মাটি নদীতে যাওয়ার দুঃখ, ঈদে হলে থাকার একাকীত্ব সব আমাকে ছুঁয়ে যাচ্ছে। পারসোনাল লাইফে আমার কোনো ট্রাজেডি না থাকলেও লেখকের ট্রাজেডি আমাকেও ভাবিত করছে। আবার সব স্মৃতি তো দুঃখের না। উনাদের শহীদুল্লাহ্ হলের গল্প, গুলতেকিন খানের সামনে কবিতা পাঠ, কালচারাল জীবন, বন্ধুদের প্রেম এসব জেনে ভারী মজা লেগেছে। লেখকের বাবার কাছে মাসুদ রানা পড়তে গিয়ে ধরা পড়া, উনাদের গ্রামের বাড়ীর বর্ণনা, মানুষের বিভিন্ন বয়ান মুগ্ধ করেছে যথারীতি। এই বইয়ের কয়েকটা লেখা আমার আগেই পড়া সেসব পুনঃ পাঠেও আনন্দ কমেনি। ঘোর আর প্রেম নিয়েও এত সুন্দর করে লেখা তো সচারাচর পড়া হয় না। লেখকের বেড়ে উঠার কালে এরশাদের দানবীয় শাসন নিয়ে এত মনোগ্রাহী সামাজিক ইতিহাস পাঠ পড়ে ভালো লেগেছে। বইটা একটা টাইম ট্রাভেলের মতই। হুট করে আশির দশকে নিয়ে যাবে আবার ঠাস করে করোনা কালীন যে আশা নিরাশা সেখানেও পৌঁছে দিবে। আমি বইটি আমার লেখা যারা ভালোবাসেন তাদের সবাইকে পড়তে অনুরোধ করবো। এরকম আনন্দময় পাঠ কম বইতেই পাবেন।
গ্রন্থের নামঃ যে পথে হেঁটে এসেছি
প্রকাশকঃ নাগরী
মূল্যঃ ৩৬০ টাকা।
মন্তব্য করুন