রশীদ করীমের জন্মদিনে!
আজ রশীদ করীমের ৯৬ তম জন্মদিবস। অকালে তিনি প্রয়াত হননি। দীর্ঘ দিন তিনি অসুস্থ ছিলেন, দীর্ঘ জীবন পেয়েছেন। কথাবার্তা বলতেন না। চুপচাপ শুয়ে বসে লং প্লেয়ারে গান শুনতেন, সহধর্মিণী বই ও পেপার পড়ে শোনাতেন। উপন্যাসিক হিসেবে তিনি সফল কিনা জানি না, তবে তাঁর উপন্যাস সব বহুলপঠিত। যাদের বাসায় ব্যক্তিগত সংগ্রহে বই আছে, রশীদ করিমের 'উত্তম পুরুষ', 'প্রষন্ন পাষান' অথবা 'আমার যত গ্লানি' পাওয়া যাবেই। তার উপন্যাসের মতই তিনি আধুনিক ও স্মার্ট কালচার্ড এক মানুষ। মধ্যবিত্ত উর্দুভাষী এক মুসলিম পরিবারে জন্ম নিয়েও তিনি ক্রিকেট সমানে দেখতেন, কলকাতার ফুটবল দেখতেন, সারাদিন ইংরেজী সিনেমা হলে গিয়ে দেখতেন, প্রেম করতেন, ভালো রেস্টুরেন্টে খেতেন, বড়দের কাছ থেকে চেয়ে চেয়ে টাকা নিতেন। অনেক বন্ধুর মা তাকে স্নেহ করতেন, শহীদ আসাদের মা তার এইসবের অন্যতম স্পন্সর। দেশভাগের আগে যে নতুন মুসলিম মধ্যবিত্ত গড়ে উঠছে, উর্দুর আভিজাত্যকে বাসায় রেখে এসে, বাংলাকে বড় করে দেখছে, রশীদ করীম সেই অংশের মানুষ। দারুণ এক কিশোর বেলা কাটিয়েছেন, কলেজ ড্রপ আউট দিয়েছেন ঠিক মতো এক্সামে যান নি, তারুন্যে টুকটাক গল্প ও রেডিওতে কথিকা পড়ে নিজেকে স্টার ভাবতেন। পরিনত বয়সে চাকরী নিয়েছেন কারন দারিদ্র্যতাকে উনি মহান ভাবতেন না কখনো। মধ্যবয়সে এসে উপন্যাস লিখছেন। উত্তম পুরুষ ও প্রষন্ন পাষাণ প্রকাশের ১০ বছর পর তিনি লিখেন 'আমার যত গ্লানি।' এই তিন উপন্যাস যে পড়বে তার রশীদ করীম ভালো লাগবেই। এরপর গোটা সত্তর আশির দশক জুড়ে উপন্যাস লিখে গেছেন। নব্বইয়ের দিকে পত্রিকায় কলামও লিখেছেন। বন্ধু শামসুর রাহমানের কবিতা নিয়ে দারুণ প্রবন্ধ লিখেছেন। বিচিত্র বিষয়ে লিখতেন, যাদের লেখা উনার ভালো লাগতো, যেচে গিয়ে প্রশংসা করতেন, প্রবন্ধ লিখতেন। হুট করেই প্যারালাইজড হলেন, তারপর চুপচাপ হয়ে চলে গেল ২০ বছর। উনার কারনে আমার প্রমথেশ বড়ুয়ার সিনেমা দেখার আগ্রহ জাগে, উনার প্রিয় হিরো গ্যারি কুপারের কিছু সিনেমা আমি দেখেছি, সেই কবেকার সৈয়দ মুশতাক আলীর ব্যাটিং নিয়ে রোমাঞ্চ অনুভব করি, কলকাতা মোহামেডানের হাফিজ নামের এক স্ট্রাইকারের খেলার দৃশ্য কল্পনা করি উনার বর্ননামতে। অনেক বড় বড় লেখক বাংলাদেশে ছিল আসবে কিন্তু নিজের সময়, নিজের ভালো লাগা, নিজের অদ্ভুত সব মতামত, নিজের নষ্টালজিয়া কে নিয়ে এত ফ্যান্টাসটিক সব লেখা একমাত্র রশীদ করীমই লিখতে পেরেছেন।
রশীদ করীম, আপনাকে পড়তে আমার ভালো লাগে সবসময়। ইদানিং পড়া হয় না। আগে পড়তাম, তারপর ইচ্ছে করেই বই গুলো হাতছাড়া করেছি, যেন আপনাকে পড়তে না হয়। তবুও আপনার কথা মনে পড়ে। এই নগরে আজকাল নতুন নতুন বই এর দোকানে আপনার বইয়ের উপস্থিতি চিত্তকে আনন্দ দেয়। ইচ্ছে করেই বই হাতে নিয়ে পাতা উল্টাই। আপনার অজনপ্রিয় উপন্যাসও আমার ভালো লাগে, যেমন ধরুন প্রসন্ন পাষাণ। কই জানি পড়লাম আপনার এক উপন্যাস নিয়ে বিটিভিতে নাটক হয়েছে, চিত্রনাট্য প্রস্তুত করেছে মারুফ রায়হান। খুঁজলাম অনলাইনে পেলাম না। মাঝেমধ্যে ভারতের পত্রিকায় কলকাতা মোহামেডানের খবর দেখি, আমার আপনার কথা মনে পড়ে। কলকাতা মোহামেডান এ জামাল ভূঁইয়ার খেলার খবরে সব থেকে খুশী হতেন হয়তো আপনি। ট্রেনে কোথাও গেলে ও খাবার কিনলে আপনার উপন্যাসের এক প্লটের কথা মনে পড়ে যায়। সকালে হাঁটতে গিয়ে কিশোরদের খেলাধুলা দেখলে আপনার উত্তম পুরুষের নায়কের ফুটবল খেলার কথা মনে পড়ে। এইভাবে কতকিছুতে আপনি জড়িয়ে আছেন। কোনোদিন টাকা পয়সা হলে আপনার উপন্যাস থেকেই সিনেমা বানাবো। আপনার লেখার আরেকটা জিনিস আমার সব চাইতে প্রিয় তা হলো আপনার দোদুল্যমানতা। কোথাও আপনি স্থির রাখেন না কাউকে। মানুষের মতামত যে কিভাবে ক্ষমতার পালাবদলের সাথে সাথে আমূল পাল্টে যায় তা আপনার লেখায় ফিরে ফিরে আসে বারবার। আপনার লেখা দেখলে কে বুঝবে আপনার পিতা মাতা কেউ বাংলাতে তেমন কথা বলতো না। বড় বড় মানুষদের সাথে ছিল আপনার উঠাবসা, স্নেহ পেয়েছেন বরেন্য সব মানুষদের। আবু সাঈদ আয়্যুব থেকে সৈয়দ মুজতবা আলী সব মহারথীদের অনুরাগে হয়েছেন সিক্ত। তারপরেও আপনি নিজেকে খুবই সাধারণ ভাবতেন। আপনি এখনকার আধুনিক মানুষদের চেয়েও বেশী আধুনিক, সেই কবে থেকেই আপনি ক্রিকেট-সিনেমা-মিউজিক নিয়ে কথা বলতে লিখতে ভালোবাসতেন। এই বাংলাদেশে পাঠক হিসাবে আপনাকে আমার চাইতে আর কেউ মিস করে না, এ আমি বাজি ধরে বলতে পারি। ওপারে ভালো থাকুন প্রিয় লেখক।
তুমি এখনো ব্লগে লিখো? বাহ! দারুন তোকতদিনপর শান্ত এবং আমরা বন্ধু ব্লগ....
মন্তব্য করুন