নদীর জীবন থেকে নদী যায় সরে!
অরূপ রাহীর কয়েকটা গানের কথাকে ভীষণ সত্য মনে হয়। দেখো নদীর কলতানে/ কিসের সন্ধানে/ নদীর জীবন থেকে নদী যায় সরে। আমি গানের ভেতরে নিজের কথা ঢুকিয়ে বানাই, মানুষের জীবন থেকে মানুষ যায় সরে। আমাদের জীবন তো এমনি, ক্রমশ সরে যাচ্ছি। আর এই সরে যাওয়ার নাম দিয়েছি, পজেটিভিটি। যতভাবে ধ্বংস হোক হবো, কিন্তু আমাকে থাকতে হবে পজেটিভ। ওতো ত্যাল আমার নাই। এত নবযৌবনের অগ্রদূতরা কি হয়েছে তা আমার দেখা আছে। নিজেকে আমি মৈনাক ভৌমিকের একটা সিরিজে উজান চ্যাটার্জির বলা খিস্তি, বোকাচোদার বাটখারা ছাড়া আর কিছু ভাবি না। কিন্তু এ শহরের আচারনিষ্ঠ ভদ্রলোক ভদ্রমহিলারা নিজেদের কত কিছু ভাবে। তারাও তো একেকটা বোকাচোদার বাটখারার বাইরে কিছু না তাই শুধু ভাবে না।
পিসি নষ্ট তাই অনেক লেখাই হয় না। আমার এত বন্ধু কেউ একটা পিসি ম্যানেজ করে দিতে পারলো না। তাতে আমার আলসেমির সুবিধা হয়েছে। না লিখলে বলে দেই পিসি তো নষ্ট। আসলে আমরা যারা শুন্য দশকে অন্তর্জাল ব্যবহারের আশীর্বাদ পুষ্ট হয়েছি, তাদের কাছে কম্পিউটারের চেয়ে আপন কিছু নাই। নেট না থাকলেও মাসের পর মাস শুধু পিসি দিয়েই কাটিয়েছে। ডিভিডি কিনে সিনেমা আর সিডি কিনে গান শোনা যে কত কুল ব্যাপার ছিল তা এখন বোঝাই কেমনে। আমার বয়সে বড় ভ্রাতার কত কিছু রাইট করা ছিল সিডিতে। একটা ভালো গান কিনতে কত কষ্ট করতে হতো। রাইফেলসের ডিভিডির দোকান গুলোতে কত সিনেমা উল্টাতাম। কিছু মালিক লিখে দিতো অযথা হাতাবেন না। না খুঁজলে বুঝবো কিভাবে, কোনটা চাই? আমাকে এখন নিজেকে ডিভিডি রম মনে হয়। আছি পড়ে, কিন্তু কোনো কাজে লাগি না।
একটা বাচ্চা ছেলে কিছুদিন আগে মারা গেল। তার মা খালি বকেছিল। তার বাবাকে খুঁজছিল, তার বাবা বাইরে। সেই বাবাটির সাথে দেখা হয়। দুনিয়ার সব হতাশা তার চোখে মুখে। নয়নতারাকে বোঝায়, পোলাকে কিছু কইয়ো না। পোলা গেলে গা আর জীবনে কিছুই নাই। এইদেশে সন্তান সন্ততি ভালোবাসার এক মাত্র প্রতীক। এর বাইরে অনেকের জীবন নাই। তাই সন্তানের শোক ভোলাটাই কষ্টকর। বাবা মা হারানোর শোক মানুষ বয়স আর স্রষ্টার টাইম টেবলের অযুহাত দিয়ে মেনে নেয়। তবে আগের মানুষজনকে আমার কুল লাগতো। যেমন আমি তখন ছোট, আমার এক প্রতিবেশী বাচ্চাটা পানিতে ডুবে মারা যায়। কদিন পর তাদের আরেক বাচ্চা হয়, তারা সব শোক ভুলে যায়। আন্টিকে কে বুদ্ধি দিয়েছিল মৃত বাচ্চার ছবি রাইখেন না। কয়েকটা ছবি ছিল এ্যালবামে তা উল্টো করে রাখা। আগে এ অভ্যাসটা ভালো ছিল, কারো বাসায় বসে থাকলে এ্যালবাম ধরিয়ে দিতো। দেখা যেত আজ যে বিশাল হুজুর, ছবি তে নায়ক আলমগীরের পোজে তোলা ছবি। আর সব বাচ্চাদের থাকতো ইয়া কালো টিপ মার্কা কাজল দেয়া ছবি। পারিবারিক এ্যালবামও আমার ভালো লাগতো। আমি আর আমার ভাই হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছি কিংবা কোথাও বেড়াতে গিয়েছি। আমার মায়ের অমূল্য হাসি। তার কলেজ জীবনের লুক, দেখে আনন্দ লাগে। আমার বাবা আর আমি সেম ছবি তুলতে গেলেই ভ্রুু কুচকে আসে, সিরিয়াস হয়ে যায়। আমার বাবার কিছু তারুণ্যে ছবি এত প্রানবন্ত, মনে হয় জীবন ছিল এদের। নব্বই দশকের চার্ম এটাই। সবকিছুই ছিল নষ্টালজিক। ফেসবুকে একটা গ্রুপে দেখলাম পুরাতন টেলিভিশন সূচি। গত দশ বছর ধরে এ জিনিসটা আর নেই। যায় যায় দিনে থাকতো বেতারের সূচী। আর তাদের ফিল্ম ইন্সটিটিউটের প্রদর্শনীর তালিকা। কত ছবি আর অভিনেতার নাম জেনেছি আমি এভাবে। অরাত্রিকা রোজী কিংবা ফ্লোরা ফেরদৌসী নামের দুজন টেলিভিশন রিভিউ লিখতো এত সুন্দর। আমি অনেক রিভিউ এখন পড়ি, নিজেও লিখি, তখনকার মতো রিভিউ লেখা আসলেই অসম্ভব। আমার মনে হতো তারা সারাদিন টিভি দেখে। আর তাদের এনালাইসিস এত গভীরে ছিল, টিভি দেখাকেও গুরুত্বপূর্ণ ভাবতাম। এখন কোথায় গেল ডেমোক্রসি ওয়াচ আর কোথায় গেল সেই দিন। একটা সফল সাপ্তাহিক ২০০০ এর পর কেউ তেমন একটা পত্রিকা বের করতে পারলো না। গেদু চাচার চিঠি পড়ার জন্য কত লোক আজকের সুর্যোদয় কিনতো। কই গেল দিন। এখন হাত বাড়ালেই খবর, জানার আগ্রহ নাই কারোর। আসাদ গেটে মাঝেমধ্যে সকালে হাঁটতে গিয়ে দেখা হয়ে গেলে সেই চাচা বলেন, মামা আগে আপনি যে পত্রিকা ম্যাগাজিন কিনতেন। আমার বলা হয় না কিছুই, নদীর জীবন থেকে নদী যায় সরে।
মন্তব্য করুন