সমুদ্দুর রাখে না জমা সব সাঁতারের দাগ
যাযাবর জীবন সবার হয় না। জগতের বেশীর ভাগ মানুষই, বুড়ো বটগাছের মত শেকড় গেড়ে ঘোর সংসারী হতে ভালোবাসে। শাখা প্রশাখায় ভালবাসার জল সিঞ্চন করে, সেগুলোকে আঁকড়ে ধরে একজায়গায় থিতু থাকে। আসলে যাযাবর হতে হলে, সাহস লাগে। একটা যাযাবর মন লাগে, মনের সঙ্গী লাগে। কোন পিছুটান রাখতে নেই, যাযাবর জীবনে।
আবার সংসারে কিছু গ্রহণ লাগা মানুষও থাকে, যারা একটা ঘোর সংসারী জীবন পায়, কিন্তু মনটা পায় যাযাবরের। ছন্নছাড়া। সংসার মন লাগিয়ে করতে পারেনা। এরা না সংসারী না বিবাগী। এদের মত হতভাগা আর সংসারে দ্বিতীয়টি নেই।
আমিও সেইসব হতভাগাদের একজন। ঘোর সংসারে থেকে সিঁধেল চোরের মত সিঁধ কাটি। পিছলে বের হয়ে যাই, সংসারের চৌহদ্দি থেকে। জলের মগ্নতায় মুখ লুকিয়ে থাকি। এক সময় জল আমার বড় প্রিয় ছিল। জলের ধারে কেটেছে আমার পুরো শৈশব আর কৈশর। ঘুরে বেড়াই মেঘনার পাড়ে। রোজ বিকেলে দাঁড়িয়ে দেখি, মেঘনা-পদ্মার সঙ্গম স্থল। একই চেহারার জল, তবুও কি দর্পে জানিয়ে দিচ্ছে নিজেদের অস্তিত্বের কথা। নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না।
না না মেঘনায় নয়, অন্য কোথাও নাও ভাসাই,এবার পদ্মায়। মাঝ নদীতে ভাসতে ভাসতে সন্ধ্যা। সন্ধ্যায় সূর্য তখন ডোবে ডোবে, কেউ হাঁকে- দূর বহুদূর থেকে, “এই... মাঝি, নাও ভেড়াও।“ মাঝির নৌকায় ফিরে আসি মধ্য পদ্মা থেকে। চারিদিকে ফিকে ধূসর অন্ধকার, সূর্যটাকে গিলে খেতে আসে---সূর্যটা তখন টুপ করে জলের বুকের মধ্যে মুখ লুকায়। বাতাসে ছড়ায় বাদাম পোড়ার গন্ধ।
কোথা থেকে শুরু করব, বুঝতে পারিনা। সংসারে যে মজে, সে মজে। আজ পর্যন্ত সংসারে মজে যাওয়া হলনা। বন্ধুরা বলে, বউ খিটখিট না করলে, রোজ রাতে ঘুম আসেনা। আহা! কি প্রেম। কি জমিয়ে সংসার।
আমার প্রেমে গদ গদ ভক্তি আসে না, মধ্যরাতে সারা শহর শুনশান হয়ে যাবার পর, যখন ঢাকা শহরের বুকের মধ্যে সমস্ত দানব ট্রাকগুলো সাঁই সাঁই গতি নিয়ে ঢুকতে থাকে, বিকট চিৎকারে একটু খানি ঝিমিয়ে পড়া, একটু খানি একা হতে চাওয়া রাতের নিস্তব্ধতাকে খান খান করে...তখনো মনে হয়, এরকম ভাবে চেঁচিয়ে নিজের অস্তিত্ব প্রকাশ করে, একবার সংসারে ভিড়ে যাই। এই সংসারে আমি কি কেউ নই? কিছু নই?
না, সংসার সংসার খেলায় পেছনে পড়ে থাকি। আমি হাঁটি বুড়িগঙ্গার পাশ দিয়ে। পুরোনো ভেঙ্গে পড়া প্রাণহীন ময়লা শ্যাঁওলায় প্রাচীন বুড়িগঙ্গার ঘাট সাবধানে মাড়িয়ে উঠে পড়ি নৌকায়।
শাঁ শাঁ করে ছুটতে থাকে কলের নৌকা। আকাশ জোড়া মেঘ দেখে, মাঝি থমকে যায়। “নাম্বেন নি, ঐ পাড়ে?” রাজী হয়ে যাই।“
নেমে পড়লাম, চারিদিকে জনমানব নেই। অনেকটা পথ পার হয়ে উঁচু গ্রামটায় উঠতে হবে। উঠতে ইচ্ছা করেনা। ইটের ভাঁটা তৈরীর শ্রমিকদের জন্য বানানো ছাউনির মধ্যে ঢুকে যাবার আগেই ঝুম বৃষ্টি এসে আমাকে ধোঁয়াশা করে ফেলে। বুড়িগঙ্গা মুছে যায় জলের তোড়ে। কেঁপে উড়ে যায় ছাউনির চাল। আমার আর বুড়ি গঙ্গায় থাকা হয় না।
আমি উড়ে যাই বলেশ্বর নদে । মন যাযাবকর হলে, পাহাড়া দিয়ে লাভ নেই। বোকা মাঝি ফ্যালফ্যাল করে আমাকে দেখে। আমি স্পিডবোটে চলতে থাকি। গন্তব্য কুয়াকাটা। আহা কি গতি!
যারা স্পিডবোটে এক শহর থেকে আরেক শহরে ছুটেছেন, তারা বুঝতে পারবেন, সে চলার কি আনন্দ। কত কিছু যে পেছনে ফেলে যাওয়া। উপরে আকাশ। হাতের নাগালে জল, কানের কাছে বাতাস শিষ দিয়ে সঙ্গে ছোটে। দুপাশে নদীর ধারে খন্ড খন্ড দৃশ্যকাব্য মর্মমূল কাঁপিয়ে তোলে। মন থেকে যেতে চায়, ছুঁয়ে যেতে চায়, সে সব কাহিনী। আমার বিন্যাস্ত কাহিনী আরেক মোড় নেয়।
আমি চিত্রা নদীর ঘাটে পা ঝুলিয়ে বসে বসে ভাবি, এই তো রবীন্দ্রনাথ, এখানে বসেই লিখেছেন। আমিও বসেছি। কি ভাগ্য আমার। চিত্রা সাঁতরে পার হই। সাঁতরাতে পারিনা ঠিক মত। ভরা জোয়ার ঠেলে নিয়ে যায়। কেউ কেউ এগিয়ে আসে। সঙ্গে সঙ্গে সাঁতার কেটে তীরে তুলে দিয়ে যায়। শা্সিয়ে দেয়, জোয়ারে নেমেছ, নেমেছ-ভাটার টান কিন্তু সামলাতে পারবে না। সাবধান!
সংসারে আবার সাবধানে ফিরে আসি। আমার ভেসে যাওয়া হয়না। আমার কাঁধে চাকরী নামের দাসত্ব। আমার পায়ে দাম্পত্য নামের শেকল। আমার চোখে সন্তান নামের মায়া। আমাকে ঠিক আটকে রাখে।
এখন ঝড় বৃষ্টি এলে আমি জানালা বন্ধ রাখি। শক্ত করে কপাট দেই। রাতে নিয়ম করে ঝগড়া করি। রোজা সকালে কাজে গিয়ে ঝিমাই। রোজ রোজ এক তরকারী, ডাল-ভাত আর ভালো লাগেনা।
আমি যমুনার ধার দিয়ে হাঁটি। বালু কিচকিচে কবুতরের মাংস গরম গরম মোটা চালের লালচে আঊশ ভাত, মুখে অমৃতের মত লাগে। খোলা আকাশের নীচে মাটির খোলায় ভাজা চিতুই পিঠার সাথে খেজুরের ঝোলা গুড়...আমার যন্ত্রণা সব ভুলিয়ে দেয়। আমি ভরা পেটে মাঝ রাতে সদর ঘাটে যাই। বরিশালের লঞ্চে উঠি। মাঝ রাতে কালো অন্ধকারের ভেতর দুই একটা বিজলী বাতি যখন, দূরের নিশানা ঠিক করে দেয়, তার ফাঁক দিয়ে জলে এক থাল চাঁদের আলো যখন পুরো উপুর হয়ে কাঁদে, জলের গায়ে আগুন ধরায়-সেই সেই থৈ থৈ জোৎস্নায় অথৈ জলে কে যেন খালি গলায় গান ধরে---“ভ্রমর কইও গিয়া, শ্রী কৃষ্ণের বিচ্ছেদের অনলে----- প্রলম্বিত লয়ে।“
ভ্রমর কইও গিয়া (এখানে ক্লিক করলে গানটা শোনা যাবে।)
আমি অন্ধকারে জলের ভেতর ডুব দিয়ে খুঁজতে থাকি, আমার জন্য তার কি এত বিচ্ছেদ? আমি জানি, আমার জন্যই সে বিচ্ছেদের অনলে পোড়ে।
আমিও তাকে খুঁজি অথবা কিছু একটা খুঁজে বেড়াই। আমি জানি না কি সেটা? কেউ কি জানে? মনে মনে রোজ হাঁটি আর হাঁটি। আমাকে বহুদূর যেতে হবে। সেই জন্যই তো আমি রোজ রোজ সংসার ছেড়ে ভোকাট্টা। আমি ডুব দিয়ে জীবনের জল-কাঁদা খঁচে খুঁজে বেড়াই অন্য কারো বুকের গহীন—কেউ কি আছে, সেই বিবাগী? যে সঙ্গী হবে আমার সাথে।
খুব খুব চমত্কার একটা লেখা।
ঘোরলাগানো কথকতা।
এখন মিক্স কালচারের যুগ। বাউলা মন নিয়াও নিস্পৃহ ভাবে কাটিয়ে দিতে হয় একটা জীবন।
আপনার এই লেখাটার ধরন কেন জানি সঞ্জীবকে মনে পড়িয়ে দিল।
ধন্যবাদ বিষণ্ন।
ভালো থাকুন।
প্রত্যেকটা লাইন, প্রত্যেকটা কথা কি দারুণ! মনের ভেতর বিঁধে গেছে।
আপু পোস্টে লেখাটা দুইবার আসছে। একটা অংশ মুছে দেন।
ধন্যবাদ জ্যোতি।
তোমার প্রশংসা পেতেও ভালো লাগে।
দারুন হইছে আপু!
টানা কয়েকবার পড়লাম
আমি ধইন্যা বাচ্চু।
আজাকের দিনে সবাই সাবধানে থেক।
অসাধারণ শিরোনাম। খুব ভালো লাগলো পড়তে। নিজের কথাই মনে হলো।
মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে ঘন্টার পর ঘন্টা একটা কোথাও বসে কাটিয়ে দিতে পারতাম!! কোথাও যাওয়ার তাড়া থাকতো না!!
সবার ভেতরেই বোধ হয় একটা যাযাবর মন থাকে।
ভালো থাকুন সামিয়া।
গানটা চেনো সামিয়া?
(
দুইবার গানের লিন্কটা দিলাম আসল না।
কি যে আল্লাই জানে!!!
চমৎকার লেখা।
( অটঃ ফেইসবুকে আরেকটা একাউন্ট খুলেছো? )
ধন্যবাদ আপা।
তোমার উৎসাহ আমাকে লিখতে অনুপ্রেরণা যোগাবে।
বরাবর দেখেছি, প্রকৃত কবিরা চমৎকার গদ্য লিখে। তাদের হাতে গদ্য কবিতাময় হয়ে ওঠে। আপনার ক্ষেত্রেও বিষয়টি সত্যি। এতো চমৎকার আপনার শব্দ বুনন, ভাষার ব্যবহার...। মুগ্ধ। খুবই মুগ্ধ হলাম শাপলা !
ধন্যবাদ লীনা।
কি বলব প্রতি মন্তব্যে বুঝতে পারছি না।
দারুন লেখা।।
ধন্যবাদ উচ্ছল।
শুভ কামনা আপনার জন্য।
চমৎকার লেখা।
ধন্যবাদ নিভৃত স্বপ্নচারী।
তোমার লেখা পড়ে এটাই বলি, নিজেকে হারিয়ে আমি পাই ফিরে ফিরে
এই গানটা আমার খুব পছনদ সখী। দেখেছোতো কতো কিছু নিজেদের অজানতেই এক
দারুণ, মুগ্ধ
মন্তব্য করুন