আয় আরেকটিবার আয়...
অনেক দিন ধরেই স্কুল নিয়ে কিছু লিখতে ইচ্ছে হচ্ছে। কিন্তু সমস্যা হলো স্কুল নিয়ে লিখতে গেলে পাতার পর পাতা যদি লিখে ফেলি তবুও শেষ হবে না। অল্প পরিসরে স্কুল নিয়ে কিছু লেখা শুধু কষ্টকরই না, অসাধ্যও।
স্কুলে ভর্তি হওয়া নিয়ে আমার একটা কাহিনী আছে। প্লে গ্রুপে ভর্তি করানোর জন্যে আম্মু আমাকে নিয়ে গেলো সুরবাণী সংসদে। সেখানে আমাকে আমার নাম লিখতে বলা হলো। বাসা থেকে খুব করে নাম লেখা শিখে গেছিলাম। কিন্তু ওখানে গিয়ে কনফিউজড হয়ে গেলাম। “দ” এর হাঁটুটা ভাঙ্গবে কোনদিকে? ডানদিকে না বামদিকে। “দ” যদি ডানদিকে ভেঙ্গে লিখতে হয় তাহলে “ন” নিশ্চয়ই বাম দিকে ভাঁজ দিয়ে লিখতে হবে। কি লিখবো না লিখবো ভাবতে ভাবতে নিজের নাম “আনন্দ” না লিখে লিখলাম “আদদ্ন”। আমাকে আর সুরবাণী সংসদ ভর্তি নিলো না। মোটকথা আমি আমার জীবনের প্রথম এডমিশান টেস্টে কৃতিত্বের সাথে ফেল করলাম। আমার এডমিশান টেস্ট ফাঁড়া জীবনের পরবর্তী পর্যায়েও খেল দেখিয়েছে। সে কথা এখন না হয় থাক।
আম্মু আমার পিছনে ক্ষার খেয়ে লেগে গ্যালো। আরো একবছর আমার উপর স্টীম রোলার চালিয়ে ভর্তি করাতে নিয়ে এলো আহম্মদ উদ্দিন শাহ শিশু নিকেতন নামের স্কুলে। স্পষ্ট মনে আছে শেষ বিকেলের আলোয় আমার এক বড়োমা কে সাথে নিয়ে আমাকে কোলে বসিয়ে আম্মু স্কুল দেখাতে নিয়ে গিয়েছিলো। আমি ভেতরটা তখনও দেখি নি। বাহিরটা দেখে আমি হতাশ। ঘিঞ্জি বস্তির মত দেখতে। ভিতরে পা রাখার মত জায়গা থাকবে কি না, একটু দৌড়াদৌড়ি করতে পারবো কি না তা ভেবে ঘুম হারাম হবার যোগাড়। যা হোক। তার ক’দিন পরেই স্কুলে আমার এডমিশান টেস্ট। প্রথমবারের মতন পা রাখলাম স্কুলটার আঙ্গিনায়। দেখলাম, যা ভেবেছি তা না। ভিতরে বেশ বড়ো একটা মাঠ যার তিনপাশে তিনটি টিনশেড টানা বিল্ডিং। কেমন একটা মায়া মায়া ভাব। সালটা ১৯৯২। আজ ২০১৩। সেদিন কী আমি কল্পনা করেছিলাম আজ ২২ বছর পরেও আমি ঘুরে ঘুরে বারংবার ঐ জায়গাতেই ফিরে যাবো আর আমার সব প্রাপ্তি অপ্রাপ্তির খেরোখাতার হিসাব মেলাতে হবে ঐ জায়গাতেই!
ভর্তি পরীক্ষায় দ্বিতীয় হলাম। ক্লাস রোল হলো ৩২ আর আমাকে ভর্তি করানো হলো নার্সারিতে। কয়েকদিনের মাঝেই প্রিন্সিপাল স্যারের বিকট কণ্ঠের সাথে পরিচিত হয়ে গেলাম। উনি স্কুলে পা রাখার সাথে সাথে দশ দিক থেকে আমরা সবাই উনাকে ঘিরে ধরে তারস্বরে “আচ-ছালামালেকুম প্রিঞ্ছিপাল টিচ্যার” বলা শুরু করতাম। তখনও ছাত্রছাত্রী শ’তিনেকের কম নয়। সবাইকে আলাদা করে সালামের উত্তর দেয়া অসম্ভব। কাজেই বিকট কণ্ঠে স্যার “ওয়ালাইকুম সালাম” বলে দিয়ে তাঁর চেম্বারে ঢুকে যেতেন যে হাঁক আমার ধারণা আমরা সবাই তো বটেই, পশ্চিমপাড়ার প্রতিটা ঘরের মানুষ শুনতে পারত। এক সালামের উত্তরই বুকের মাঝে ধুক পুকানি তুলে দেবার জন্যে যথেষ্ট ছিলো।
সেই মানুষ যদি আমাকে তাঁর চেম্বারে ডেকে নিয়ে যান তাহলে কী অবস্থা হবার কথা? ভয়ে আমি প্যান্ট ভিজিয়ে দিবো দিবো এরকম সময়ে স্যার আমাকে কাছে ডেকে নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “বড়ো ছাত্র কেমন আছে?” বড়ো ছাত্র হলো আমার বাবা। তিনি আমার বাবা-মা দুইজনেরই শিক্ষক। গাইবান্ধার এমন মানুষ আসলে কয়জন আছে যারা রমজান স্যারের ছাত্র নন তা নিয়ে আমার হিসাব আমি এখনো মিলাতে পারি নি। যা হোক। বড়ো ছাত্রের কুশল জিজ্ঞেস করার পর আমি উত্তর দিলাম যে সে ভালোই আছে। এই সময় উনি গলা নামিয়ে ষড়যন্ত্রীদের মতন করে আমাকে প্রশ্ন করলেন, “তোমার আম্মা তোমার আব্বা কে কী বলে ডাকে?” আমি একটু চিন্তা করে বললাম, “ও গো বলে ডাকে!” স্যার ফ্যাঁক করে হেসে দিয়ে আমাকে ক্লাসে যেতে বললেন। আমি মাথা চুলকাতে চুলকাতে ক্লাসে চলে গেলাম।
স্কুলের সব স্যার ম্যাডাম বড় ভাই আর আপুরা আমাকে বেশিরভাগ সময় কোলে কেন তুলে রাখতো আমি জানি না। তবে মূর্তিমান আতঙ্ক ছিলো পিটি টিচার। তাঁকে নিয়ে গল্প সবারই আছে। অন্য কেউ না হয় তাঁকে নিয়ে লিখুক।
প্রিন্সিপাল স্যার আমাকে অনেক ভালোবাসতেন। এবং বাসেন। কিন্তু একবার, ক্লাস ফাইভের বৃত্তিপরীক্ষার কোচিং এর সময় একটা অকাজ হয়ে গেলো। ক্লাসে তোমিন পড়তো। যার সাথে কেন জানি আমার একটা দা-কুমড়া সম্পর্ক ছিলো। কী কারণে জানি না, সেই সম্পর্ক আজও স্বাভাবিক হয় নি। তো, ওর সাথে একদিন কী যেন নিয়ে লাগলো। তুমুল মারপিট। আমাদের দুইজনের একজনের উপর বিগ-শো এবং আরেকজনের উপর আন্ডারটেকার ভর করে ফেলায় সেই মারপিট দেখতে না দেখতেই একটা অন্য মাত্রা নিলো। থামেই না। যখন বাকিরা আমাদেরকে টেনে আলাদা করলো তখন ওর আর আমার দুজনেরই ঠোঁট কেটে গেছে আর নাক দিয়ে রক্ত পড়ছে। এখানে ওখানে খামচি দিয়ে আমরা একে অপরের ছাল মাংস তুলে ফেলেছি। আরেকটু সময় পেলে হাড্ডিও পাউডার করে দিতাম। ফুঁসতে ফুঁসতে সেইদিন পার করলাম। পরেরদিন স্যারের কানে খবর গেল। সেইদিন আবার স্যারেরই কোচিং ছিলো। উনি আমাদেরকে ইংরেজি পড়াতেন।
সেইদিন আমাদেরকে টেলিগ্রাম লেখা শেখাচ্ছেন। টেলিগ্রাম লিখতে হলে ডায়াগ্রামটা আগে এঁকে নিতে হয়। আমি স্কেল আনতে ভুলে গেছি। ঘাড় ঘুরিয়ে বৃষ্টি নামে আমাদের এক ক্লাসমেট ছিলো ওর কাছে স্কেল চাচ্ছি হাতের ইশারা করে কারণ শব্দ করলেই মহা মুশকিল। কিন্তু স্যার তবুও নোটিশ করে ফেললেন যে উনার কথা না শুনে আমি ঘাড় ঘুরিয়ে দু হাত এক সাথে করে “আপত্তিকর” ভঙ্গিতে কী যেনো চাইছি। আর যায় কোথায়। ধুম ধুম করে কয়েকটা বাড়ি লাগিয়ে সেই বাজখাঁই গলায় বলে দিলেন, “বেরিয়ে যাও। তোমার মতন ছাত্রের আমার দরকার নেই” ।
কাঁদতে কাঁদতে বের হয়ে গেলাম। এই খবর অল্প সময়ের মাঝে বাসাতেও পৌঁছে গেল। আমার উপরে আরো একবার স্টীম রোলার চললো। ক্ষত বিক্ষত শরীর আর মন নিয়ে পরদিন আম্মুর সাথে স্কুলে এসে স্যারের কাছে মাফ চাইলাম। আম্মু পা ধরতে বললেন। আমি পা ধরতে গেলাম। স্যার মাথায় হাত রেখে পা সরিয়ে নিলেন। উনার মনে কী ছিলো আমি জানি না। কিন্তু আমার রোখ চেপে গেলো। পশুর মতন পড়া শুরু করে দিলাম। কোন বইএর একটা শব্দও ছিলো না যেটা আমি মুখস্থ করি নি। বুঝি বা না বুঝি। এখন মুখস্থ করাটা আমার কাছে অশালীন লাগে কিন্তু তখন সেটাই কাজে দিয়েছিলো। পুরো রাজশাহী বোর্ডের মাঝে ২য় হয়ে গেলাম প্রাইমারি স্কলারশিপ পরীক্ষায়। মজার ব্যাপার হলো প্রথম যে হয়েছিলো সেও আমাদের স্কুলের। নাম শিমুলি। এখন জার্মানিতে থাকে । দেবশিশুর মতন ফুটফুটে দুটি সন্তানের জননী সে এখন।
স্কুলের খুব স্মরণীয় দিন ছিল একটি। যেদিন আমরা ক্লাস ফাইভের শেষ ক্লাস করি। তখন কেবল হাই স্কুল খোলা হয়েছে। ক্লাস ফাইভের পরই সাধারণত সবাই অন্য স্কুলে চলে যায়। কাজেই ক্লাস ফাইভেই বিদায়ের ঘণ্টা তখন ঢং ঢং করে বাজতো। সবাই দিনটা মনে রাখার মত করে সাজানোর জন্যে যা পেরেছে নিয়ে এসেছে যার মাঝে খুব বেশি পরিমানে রয়েছে চিকমিকি জরিগুলো যেগুলোতে সরিষার তেল মাখিয়ে আচ্ছা করে কারো মুখে ডলে দিতে হয়। আমি নিয়ে গেছিলাম দুটা বড়ো বড়ো বক্সে ভরে ন্যুডুলস। কারণ স্কুলে আমার ন্যুডুলস একটা ট্রেডমার্ক ছিলো, ওটা বাদে কিছু আমি টিফিনে খেতে চাইতাম না। বলা বাহুল্য ন্যুডুলসের সাথে প্রচুর পরিমাণ পঁচানিও খেতে হতো। তাই ভেবেছিলাম সবাইকে যাবার আগে ন্যুডুলসই খাওয়ায়ে যাবো।
আমাদের প্রথম ভাইস প্রিন্সিপাল স্যার ছিলেন শ্রদ্ধেয় হাবিবুর রহমান স্যার। হবিবার বিএসসি নামে অধিক খ্যাত ছিলেন তিনি। ভয়ংকর বদরাগী কিন্তু হৃদয়বান একজন মানুষ ছিলেন যাকে আমরা শ্রদ্ধাও করতাম আবার যমের মতন ভয়ও পেতাম। তখনই স্যারের অনেক বয়েস হয়ে গেছিলো। সেইদিন আমাদের সব ক্লাস মাফ। কিন্তু স্যার পড়াবেনই। আমরা হতাশ। নিজেরা নিজেরা স্যারকে জব্দ করে ক্ষেপিয়ে দেবার জন্যে প্ল্যানও করে ফেললাম। প্ল্যান মোতাবেক যখন স্যার টেবিলে বই রেখে চেয়ারে ঝুঁকে বসে বিড় বিড় করে পড়িয়ে যাচ্ছেন তখন ব্ল্যাকবোর্ড পরিষ্কার করার ছুতোয় স্যারের পিছনে দাঁড়িয়ে উজান একটু একটু করে জরি উনার টাকের উপরে ফেলতে লাগলো। চকচকে টাকের উপর চিকচিকি জরী- এই দৃশ্য আমাদের ক্লাসের কেউ ভুলেছে বলে আমার মনে হয় না।
স্যার যখন বুঝে গেলেন যে তাঁর সাথে এই অকামটা করা হয়েছে তখন তিনি কেন যেন রাগ হলেন না। চলে গেলেন। আমাদেরও মন খারাপ হয়ে গেলো। প্রথমে শুরু করলো বৃষ্টি। নামের স্বার্থকতা রাখতেই সে চোখ দিয়ে অঝোরে বর্ষণ শুরু করে দিলো। তা দেখে একযোগে নানানসুরে সবার হাউমাউ করে সে কী কান্না। পরে অবশ্য স্যারদের অনুরোধে আমরা মোটামুটি সবাই আবার এই স্কুলেই ক্লাস সিক্সে ভর্তি হয়েছিলাম। আমাদের ব্যাচটা দিয়েই হাইস্কুল সত্যিকার অর্থে দৌড়ানো শুরু করে।
আগেই বলে নিয়েছি, বলতে গেলে কাহিনী শেষ হবে না। শেষ করে ফেলি। শেষ করার আগে বলি ক্লাস সেভেনে আমার প্রথম প্রেম স্কুলের মাঠে হাঁটাহাঁটি করা শুরু করলো। সে আমার অতিপ্রিয় ১ম স্থানটাও পাকাপাকিভাবে নিজের করে নিলো। সে আরেক কাহিনী। ওদিকে না যাই। দুই জনই আলাদা আলাদা মানুষকে বিয়ে করে ফেলেছি। এখন ওসব কথা না বলাই ভালো।
তবে দিনগুলো অনেক সুন্দর ছিলো।
সুইট পোষ্ট!
আনন্দবাবু আমাদের আরো আনন্দের কারণ হবেন সে প্রত্যাশা করছি!
খুব ভাল লাগছিল পড়তে। আরো লিখবেন? বেশ বড় করে?
আমাকে দিয়ে ও - কাজ হবে কি না তা নিয়ে আমার ব্যাপক সন্দেহ আছে। তবে একটু আনন্দ দিতে পেরেছি ভাবতেই ভালো লাগছে।
খুব খুব খুব ভালো লাগলো আপনার ছেলেবেলা পোস্ট। এইসব গল্প নিয়ে একটা সিরিজ করে ফেলেন, চমত্কার হবে।
আমার মাথায় বিষয়টা ছিলোই না। এখন মাথায় পোকা ঢুকিয়ে দিলেন। কাজেই অবশ্যই চেষ্টা করবো।
লেখা ভালো লেগেছে বলে ধন্যবাদ।
চমৎকার লাগলো এই স্মৃতিচারন। আর সত্যই বলেছেন স্কুলজীবন নিয়ে লেখা শুরু করলে শেষ করাই মুষ্কিল। কত স্মৃতি কত্তো মজা, যেন ফুরায় না। স্মৃতিকারত করে দিলেন যে ভাই
আমারো পছন্দের স্কুলটা মনে লেগেছিল, এর বিশাল মাঠ আর গাছপালা দেখে, পুরাই যেন প্রেমে পড়ার হাল, সেকি অস্থিরতা - "আচ্ছা আমি ভর্তি পরীক্ষায় টিকবো তো, ইশ, এট্টু কেন পড়লাম না আগে"
আমি এডমিশান টেস্ট ঘিন্না করি।
আহা স্কুল ... আহা নস্টালজিয়া ...
( ( ( (
চমৎকার লাগলো পড়তে
মনের গভীর থেকে আসা ধন্যবাদ রইলো মাসুম ভাই। আপনাদের লেখা পড়ে অ আ ক খ লিখতে শিখেছি।
লেখাটা কাল দেখেছিলাম ফেসবুকের কমেন্টের সুবাদে, কিন্তু পড়তে পারি নাই। ব্লগে দিয়ে ভালো করেছো, পড়ে আরাম পাইলাম।
তা রেলভাই রেলগাড়ির কাহিনী টাহিনী লিখো না ক্যান?
সমস্যা হলো আমার মুখে কিছু আটকায় না। কাজেই রেল নিয়ে লিখতে গ্যালে কিছু বিষয় আসবে, বুঝতেই পারছেন। তারউপর এখন লেখালেখিতেও বাধা আছে। উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের অনুমতি ফনুমতি, আজাইরা ব্যাপার স্যাপার।
এইটা পোস্ট করার আগে বসকে পড়াইছিলাম।
এ দেখি পুরাই ক্যারফা অবস্থা।
হ
শুভ জন্মদিন।
সুইট পোষ্ট!
মন্তব্য করুন