ইউজার লগইন

অনিমেষ রহমানের নাগরিক গল্পঃ ১৩-থমকে যাওয়া শহর

ঝির ঝিরে বৃষ্টির মাঝে বেরিয়ে পড়ে অরুপ। ছাতা হাতে নিয়ে বের হওয়ার মতো বিরক্তিকর কাজ আর দুনিয়াতে দ্বিতীয়টা নেই। মানুষের হাত থাকবে খালি। সে হাত উড়বে বাতাসের সাথে। হাত স্বাধীন তো দুনিয়া স্বাধীন! আর আজকে পরাধীন হাত নিয়ে বের হলো অরুপ। মোড়ের টং দোকানে হালকা বৃষ্টির মাঝে দাঁড়িয়ে দিনের প্রথম চা। না ছাতা মেলতেই হলো। বৃষ্টি আরো ঘন হয়ে নামছে। কিন্তু আজব ব্যাপার হলো সুর্যের আলো আছে। ছেলেবেলার কথা মনে পড়ে গেলো অরুপের। এমন রোদ বৃষ্টির খেলা শুরু হলেই চিতকারঃ রোদ হচ্ছে বৃষ্টি হচ্ছে খেঁকশিয়ালের বিয়ে হচ্ছে। খেঁকশিয়ালের বিয়ের মাঝেই অরুপ নেমে পড়লো রাস্তায়।আজকে অফিস নেই কিন্তু অনেক কাজ। সেলফোন নড়ে চড়ে উঠলোঃ
-মামা আমি মতিঝিলে; তুমি থেকো কলেজের কাছেই।
-কিসে আসতেছিস? বাস না সি এন জি?
-না মামা বাস! অনেক আওয়াজে হারিয়ে যায় অন্তুর শব্দ।

ফার্মগেটে এসে অবাক হয়ে গেলো অরুপ। সমস্ত বাস-প্রাইভেট কার-সি এন জি-সব চুপচাপ দাঁড়িয়ে। নড়া-চড়া নেই। বাস ষ্ট্যান্ডে অফিসযাত্রী হাজারো মানুষ। কিন্তু গ্রীন রোড ফাঁকা। একটা খালি রিক্সা পেয়ে ইশারা করে অরুপ- সামনে চলো। রিক্সাওয়ালা চালাতে থাকে হাওয়াই গতিতে। মীরপুরে রোডের মুখে আবারো চুপ-চাপ রাস্তা। গাড়ী ঘোড়া সব আবারো ধ্যানি বকের মতো দাঁড়িয়ে। এবার ভয় পেলো অরুপ। অন্তু আসবে কিভাবে? সারা শহর তো আজকে দাঁড়িয়ে আছে। সে ঢাকার এই অঞ্চল ভালো ভাবে চেনার কোনো কারন নেই। এবার রিং দিলো অন্তুর ফোনেঃ
-মামু তুই কই?
-মামা আমি আব্দুল গনি রোড!
-আব্দুল গনি রোড কেনো?
হঠাত মনে পড়ে অরুপের, আব্দুল গনি রোড হলো সচিবালয়ের উল্টোদিকের রাস্তা। অন্তু সেখানে কেন?
-অন্তু তুই আব্দুল গনি রোডে কেনো?
-মামা প্রেসক্লাবের সামনে মিটিং। রাস্তা বন্ধ করে দিছে-তাই বাসের ড্রাইভার ভিতর দিয়ে যাচ্ছে।
-তুই কলেজ পর্যন্ত আসতে পারবি?
-মনে হয় পারবো। কেমন যেনো অনিশ্চিত শোনায় অন্তুর গলা।
-আসলেই পারবি?
-পারবো মামা-তুমি কলেজের সামনে যাও।

কলেজের সামনে এসে মনে পড়লো মামুন ভাইয়ের কথা। মামুন ভাই এই কলেজেই পড়ায়। ডায়াল লিষ্ট থেকে নাম্বার বের করে কল দিলোঃ
-মামুন ভাই কলেজে আছেন?
-আছি অরুপ; তুমি কই?
-আপনার কলেজের সামনে।
-কেন? ভিতরে আসো।
-হা আসতে হবে।
-কেউ ভর্তি হবে?
-হাঁ আমার ভাইগ্না অন্তু।
-আরে তুমি ভিতরে আসো-আমি অডিটোরিয়ামে আছি।

অডিটোরিয়ামে মামুন ভাই ব্যস্ত ভাবে কাজ করছেন। সাথে আরো দুই তিনজন সহকর্মী। মাত্র সদ্য কৈশোর উত্তীর্ণ তরুনরা ফর্মি নিচ্ছে ঝলমলে চোখে।সবাই ব্যস্ত।
-তোমার ভাগিনার পজিশন কেমন?
-উপরের দিকেই।
-কাগজ পত্র?
-না ওর সাথেই।
-সে কোথায়?
-রাস্তায়-জ্যামে পড়েছে মনে হয়।
-সাথে ফোন আছে?
-আছে।
-কল করে পজিশনটা জেনে নাও-আমি ফরম আর ব্যাঙ্কের জমা পাতা দিচ্ছি-তুমি টাকা জমা দিয়ে আসতে আসতে সে এসে পড়লে ট্রান্সক্রিপ্ট আর স্কুলের টেষ্টিমনিয়াল সহ ফর্ম ফিল আপ করে জমা দিলেই ভর্তি শেষ!
দুই বার রিং হতেই অন্তু ফোন উঠালো।
-অন্তু কই?
-বাংলা একাডেমীর সামনে মামা।
-তোর পজিশন কতো রে?
-দুইশ ছাব্বিশ!

জমা পাতা নিয়ে অরুপ ব্যাঙ্কে গিয়ে টাকা জমা দিয়ে আসলো। ফিরে এসে জমা পাতা দিতেই মামুন ভাই ফর্ম দিয়ে দিলো।
-তোমার ভাগিনা কোথায়?
-ইউনিভার্সিটির ভিতর দিয়ে আস্তেছে মনে হয়।
-সমস্যা নেই-বিকেল তিনটা পর্যন্ত সময় আছে।এখন শুধু একপাতার এই ফর্ম ফিল আপ করে জমা দিলেই হবে। আরো প্রায় আধা ঘন্টা পরে ঘেমে নেয়ে অন্তু আসলো। আর দশ মিনিটে কাজ শেষ।
-মামা আমি ভয় পাইছিলাম।
-কেনো রে?
-প্রেসক্লাবের সামনে অল্প কিছু মানুষ রাস্তা বন্ধ করে মিটিং করছিলো; আর কি যে জ্যাম।
-আরে তুই ঢাকায় থাকিস একটু ঘুরা-ঘুরি করতে পারিসনা?
-মামা এখন ঘুরবো; কলেজে উঠেছি তো।
-ধুর বোকা তোর বয়সে আমি মিছিলের সামনে থাকতাম।
-না মামা রাজনীতি আমার ভয় লাগে।
-ধুর বোকা ভয়ের কি আছে?
-এখন রাজনীতিতে অনেক মারামারি!
-মারামারি আমাদের সময়েও ছিলো; আর বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিলো ‘যুদ্ধ’ করে।
-তা তো জানি।
-কি জানিস? জাহানারা ইমামের ‘একাত্তরের দিনগুলি’ পড়েছিস?
-না মামা।
-চল শাহবাগ যাই। আজকে দুইজনে মিলে ঘুরি আর তোকে কিছু বই কিনে দেই।
-চল।
-পানি খাবি? যা গরম!
-খাবো।
-চল লাচ্ছি খাই না শুধু পানি খাব?
-মামা শুধু পানি খাবো।

বাটার মোড়ে আসতেই আবার ফোন। হাতে নিয়ে দেখলো কংকনা। প্যারিস থেকে।
-তুমি কোথায়?
-এলিফ্যান্ট রোড, বাটা সিগ্নাল!
-বাটা সিগনালে কি করো? আজকে উত্তর ঢাকা যাও নাই? তুমি তো উত্তর ঢাকার বাসিন্দা।
-না আজকে অন্তুকে কলেজে দিলাম; আমিও সাথে ছিলাম।
-অন্তু কলেজে ভর্তি হইছে?
-হ্যাঁ।
-কি বলো? এইতো সেদিন দেখলাম গুট্টু গুট্টু বাবু।
-আরে না এখন প্রায় ছয় ফিট লম্বা ইয়ংম্যান।
-অন্তু’র কি আমারে মনে আছে?
-মনে থাকার তো কথা!
-হুম! সবাই আসলে ভুলে যায়।
-তা ঠিক!
-আমি ভাবছি আমি নেই অথচ তুমি কি অবলীলায় ঘুরে বেড়াচ্ছো!
-উল্টোভাবেও বলা যায়-আমাকে ছাড়া তুমি কি অবলীলায় সারা ইউরোপ দাপিয়ে বেড়াচ্ছো!
-তুমি আসবা ইউরোপে?
-ধুর না-আসবোনা।এই শহর কিংবা মাঝে মাঝে মাকে দেখতে গ্রামে যাওয়া-যানজট-রিক্সা-মানিক মিয়া এভিনিউ-সোনাঝুরি-বেগুনি জারুল-ফার্মগেটের হাজার মানুষ-টং দোকানের চা সাথে সিগারেটের ধোঁয়া-আমার কাছে ভালো লাগে।
-তা ঠিক-আমিও মিস করি বাংলাদেশ।
-কিন্তু আমি তোমাকেও মিস করি।
-সত্যি?
-হাঁ সত্যি!
-ঠিক আছে ফিরে আসবো সহসা।এখন রাখি। ভালো থেকো!
-তুমিও ভালো থেকো।

আজিজে ঘন্টাখানেক ঘুরে ফিরে অরুপ আর অন্তু যখন শাহবাগের মোড়ে দাঁড়ালো তখন শেষ বিকেল। তখনো জমে আছে গাড়িগুলো। কিছু উত্তরা কিংবা টঙ্গি যাবে বলে আর কিছু মতিঝিল যাবার জন্য। অদ্ভুত নীরবতা-না ঠিক নীরবতা নয়! কেমন যেনো অলসভাবে দাঁড়িয়ে আছে মানুষ-সড়ক কিংবা সড়ক-শকট! অরুপ হাঁটতে থাকে শহরের নতুন পথচারী অন্তুর কাঁধে হাত রেখে।

নতুন মানুষরাই নতুন দেশ গড়বে!

পোস্টটি ৯ জন ব্লগার পছন্দ করেছেন

অকিঞ্চনের বৃথা আস্ফালন's picture


নতুন মানুষরা নতুন দেশ গড়বে আর পুরাতনরা বিদেশে চলে যাবে? Tongue

লেখাটা দুইবার কপি পড়েছে মনে হয়

অনিমেষ রহমান's picture


Nerd Nerd
হ্যাঁ সাইজ কইরা দিলাম।
পুরাতনদের ক্ষমতা সব সময় কম থাকে।
Smile

নিভৃত স্বপ্নচারী's picture


  • পুরাতনদের ক্ষমতা সব সময় কম থাকে।


Thinking Thinking

বৃক্ষের পরিচয় তো- ফলে।
টিপ সই

অনিমেষ রহমান's picture


Big smile Big smile

নিভৃত স্বপ্নচারী's picture


  • পুরাতনদের ক্ষমতা সব সময় কম থাকে।

Thinking Thinking

বৃক্ষের পরিচয় তো ফলে।
টিপ সই

অনিমেষ রহমান's picture


বৃক্ষের পরিচয় তো ফলে।

আমগাছে তো আর জাম ধরবেনা।
Wink
কবিগুরু বলেছিলেন-

ওরে সবুজ ওরে আমার কাঁচা-

সেই অর্থেই।
Smile

আরাফাত শান্ত's picture


নতুন মানুষরাই নতুন দেশ গড়বে!

অনিমেষ রহমান's picture


ধন্যবাদ সাথে থাকার জন্য।
Smile Smile

বিষণ্ণ বাউন্ডুলে's picture


আপনার গল্প লেখার হাত ভাল।
নিয়মিত লিখবেন। ভাল থাকুন।

১০

টুটুল's picture


নতুন মানুষরাই নতুন দেশ গড়বে!

ঠিক কোন হোপ পাইনা আজকাল Sad

১১

দেব মুখার্জি's picture


অনিদা, কেমন আছেন?? Smile

১২

অনিমেষ রহমান's picture


ভালু আছি; আপনার কবিতাতে কমেন্টস দিয়া আসলাম।
স্বাগতম আমরাবন্ধুতে!!
Smile Smile

১৩

দেব মুখার্জি's picture


হুম, দেখলাম!

১৪

দেব মুখার্জি's picture


অনিদা, কেমন আছেন?? Smile

১৫

কর্নফুলির মাঝি's picture


নতুন মানুষেরা কি পারবে?? দিন যত যাবে মানুষ তত স্বার্থপর হবে।
দেশ কি এভাবে কোন স্বপ্নপুরুষ পাবে যে দেশকে উদ্ধার করতে পারবে??

১৬

অনিমেষ রহমান's picture


৭০ দশকে যারা রাজনীতিতে এসেছিলো তারা দেশের মঙ্গলের জন্যই রাজনীতিতে এসেছিলো; তারা আমাদের স্বাধীন দেশ উপহার দিয়েছিলো। সামরিক শাসনের খাল বেয়ে নোংরা পানিতে ভিজে তারা নোংরা হবার পর আজকের বাংলাদেশে যারা তথাকথিত রাজনীতি কিংবা ছাত্ররাজনীতিতে আছেন তারা ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে আছেন তা বলার অপেক্ষা রাখেনা। প্রমান চাইলে ভুরি ভুরি দেওন যাইবো। ক্ষমতায় আসার আগে বাড়ী ভাড়া দেওনের সামর্থ নাই এখন বি এম ডব্লিউ চালায়। আর মধ্যবিত্ত কিংবা মেধাবী তরুনরা আজকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে ছাত্র রাজনীতি থেকে। সুতরাং আজকের তরুনরা আর যাই হোক লুন্ঠঙ্কারী হবার কথা ভাবছেনা। এটাই হলো আসল কথা।

আর মানুষ স্বার্থপর হলে সমস্যা নাই; কিন্তু মানুষ চোর-ডাকাত হলে সমস্যা আছে। ভয়ংকর সমস্যা। আর তারা সমাজের নেতৃত্ব দিলে আরো বেশী সমস্যা! এখন একটা প্রশ্ন আসতে পারে স্বার্থপর মানুষ কি চোর ডাকাত হয়? জানিনা! মানুষ জন্মগতভাবে স্বার্থপর। তাইতো এতো মতাদর্শ।

১৭

তানবীরা's picture


আমি আপনার লেখার মুগ্ধ পাঠিক ভাই। আপনার লেখা পড়লে মনখোলা জিনিসটা টের পাওয়া যায়। মনের আনন্দে লিখছেন। অনেক লেখা পড়লেই বোঝা যায়, আগে ঠিক করে নিয়েছে, কি ফরম্যাট আর কি পটভূমি নিয়ে কি লিখবে। সব ছকে বাঁধা থাকে। আর আপনার লেখা পড়লে বোঝা যায়, কলমে যা আসছে তাই লিখছেন। হ্যাটস অফ।

১৮

অনিমেষ রহমান's picture


ধন্যবাদ!!

মন্তব্য করুন

(আপনার প্রদান কৃত তথ্য কখনোই প্রকাশ করা হবেনা অথবা অন্য কোন মাধ্যমে শেয়ার করা হবেনা।)
ইমোটিকন
:):D:bigsmile:;):p:O:|:(:~:((8):steve:J):glasses::party::love:
  • Web page addresses and e-mail addresses turn into links automatically.
  • Allowed HTML tags: <a> <em> <strong> <cite> <code> <ul> <ol> <li> <dl> <dt> <dd> <img> <b> <u> <i> <br /> <p> <blockquote>
  • Lines and paragraphs break automatically.
  • Textual smileys will be replaced with graphical ones.

পোস্ট সাজাতে বাড়তি সুবিধাদি - ফর্মেটিং অপশন।

CAPTCHA
This question is for testing whether you are a human visitor and to prevent automated spam submissions.

বন্ধুর কথা

অনিমেষ রহমান's picture

নিজের সম্পর্কে

শুধু-শুধু লিখি !!