পায়ের ধুলো নেই-১১
স্যার ফুল নিবেন? তাজা গোলাপ ফুল। মাত্র বিশ টাকা।
দুই তোড়া ফুলসহ নিজের মাথা গাড়ির ভেতরে ঢুকিয়ে জানতে চায় মেয়েটি। বয়স কত হবে ? বিশ বা বাইশ। কোলে শিশু। শিশুটি মাথায় ছোট ছোট চুল তেল দিয়ে ল্যাপ্টানো। মেয়েটির চুল বেণী করা। সেই বেণী ঝুলিয়ে দেয়া আছে মাথার দুদিকে। একদিকের বেণী আঁকড়ে আছে শিশুটি।
গাড়ি মানে বাংলাভিশনের গাড়ি। আট ঘণ্টা ডিউটির ক্লান্তি দূর করতে মিশে আছি সিটের সঙ্গে। মেয়েটির বয়স বেশি বলে কৌতুহল একটু কম। আট দশ বছরের কেউ বা কোন কিশোর বা কিশোরী ফুল বেচতে এলে তার কৌতুহলের কমতি থাকে না। প্রথমে তারা জানতে চায় ফুল কিনবো কি না? তারপর উঁকিঝুঁকি দেয় নায়ক-নায়িকা দেখার আগ্রহ থেকে। তাদের কাউকে দেখতে না পেয়ে হতাশ হয়। তারপর দুয়েকটা মন্তব্য করে কেটে পড়ে। তাদের খাতায় বাকী দেয়া বলে কিছু থাকে না। পনের টাকা দাম চাইলে দশ টাকায় কেনা যায়। সে অভিজ্ঞতা এখন আর মিলছে না। মেয়েটার কৌতূহল কম কিংবা সন্ধ্যার অন্ধকারে বুঝতে পারে না এটা টিভির গাড়ি।
নিবেন? তাজা আছে।
ফুল নেয়া যায়। ঘরের মানুষ ফুল দেখে সুখি হবে। কিন্তু এ্ই ফুলের সঙ্গে লাগানো ডাঁটা থেকে কাঁটা সরানো হয়নি।যেকোন সময় হাতে ফুটে রক্তারক্তি হতে পারে। সস্তার তিন অবস্থা হবে আরকী। তারপরও একটু দামাদামি শুরু করি।
দশ টাকায় দিবেন?
পনের টাকায় কিনা।পাঁচ ট্যাকা না থাকলে খামু কী?
মানিব্যাগ বের করি। একটা পাঁচ টাকা নোট খুঁজি।পাই না। তাতে কিছুটা সময় কাটে। শিশুটি ধরে আছে তার মায়ের বেণী। আশপাশে আরো গাড়ি থেমে আছে। এটা সিগন্যাল না জ্যাম,তা বুঝা যাচ্ছে না। পেয়ে যাই একটা দু্ টাকার নো্ট।বলি, বারো টাকায় দেবেন?
ট্যাকা নাই? মেয়েটা এতোক্ষণ তাহলে বেশ মনযোগ দিয়েই দেখছিলো আমাকে।
বার টাকা হলে নেবো।
মানিব্যাগে যদি ট্যাকা না থাকে তাইলে দিমু। কিন্তু সাব আমি কিনছি পনের টাকা দিয়া।
তাহলে আপনার নেট লস মানে ক্ষতি তিন টাকা।লোকসানে কেন ফুল বেচবেন?
আপনে শখ কইরা নিতাছেন। ট্যাকার লাইগা নিতে পারতাছেন না এইডা অনেক দুক্ষের । ট্যাকার জন্য শখ মিটাইতে না পারা খুব দুক্ষের। আমরা জানি। নেন, বারো টাকাতেই দিমু।
বুঝলাম, ব্যবসা করে ওরা কখনো রাস্তা থেকে শো রুমে উঠতে পারবে না। বুঝলাম ভালোবাসা ও মমতা নামক দুটি অসাধারণ মানবীয় বিষয়ের ওপর এখনো সাধারণ মানুষের অনেক দখল আছে।
নেন স্যার
শুধু বরই নিবেন নাকি কামরাঙাও?
আমি ট্রাউজারের পকেট থেকে টাকা বের করে গুণে দেখি।না, পর্যাপ্ত টাকা নেই। এই সকালে বাইরে এসেছি দৌড়াতে। পকেটে শুধু ইমার্জেন্সি রিক্সা ভাড়া আছে। তা দিয়ে বরই হবে কিন্তু কামরাঙা হবে না।
আধা কেজি বরই দেন।
বরই এর সঙ্গে আধা কেজি কামরাঙাও তুলে দিলো লোকটা।
কামরাঙাতো নেবো না। টাকা নেই।
আপনে গুণার সময় দেখছি ট্যাকা নাই। তাই বইলা কমারাঙা নিবেন না। এইডা কেমুন কতা। বছরের পরথম ফল। নেন স্যার।ট্যাকা সমইস্যা না। পরে দিয়েন। আপনেরে চিনি । আপনে ব্যাংকে চাকরি করেন।
বুঝলাম সে আমাকে ভালোই চিনেছে। তার নাকের ডগা দিয়ে প্রতিদিন বাংলাভিশনের গাড়ি চড়ে যাই আসি। আর আমি কিনা কাজ করি ব্যাংকে!
স্যার,একসুম অনেক গরীব আছিলাম।ট্যাকার লাইগা কোন কিছু আটকায় নাই। নেন স্যার। আমি নিতে পারি না।মানুষ সব সময় ভালোবাসা গ্রহণ করতে পারে না।
আমি কী শুনি!
এবার একটা কৌতুক বলি। এটা আমার লেখা না।মতিঝিলে একলোক দেয়ালে কান পেতে কী যেন শুনছে।লম্বা চুল তার।তা দেখে একজন দাঁড়িয়ে গেল।তার সঙ্গে আরেক জন।আরো কয়েকজন। ভিড় ঠেলে একজন কান দিলো দেয়ালে। পাঁচ মিনিট পর বললো,কই কিছুতো শুনতে পেলাম না।
দেয়াল থেকে কান না তুলে লম্বা চুলের লোকটা বললো ,এতো তাড়াতাড়ি! গতকার বিকাল থেকে কান পেতে আছি এখনো কিছুই শুনলাম না। আর ওনি পাঁচ মিনিটেই সব শুনবেন?
এই কৌতুকটা সবা্ই জানেন। এমনকী রাস্তায় খোঁড়াখুড়ি হলে একদল মানুষ জড়ো হয় তা দেখতে সেটাও সবাই জানেন।রাস্তায় কেউ মাথা ঘুরে পড়ে গেলে দশজন এগিয়ে আসে সহায়তা করতে তাও সবাই জানেন।কয়েকজন মানুষ একজনকে পিটাচ্ছে, ক্রমাগত লাঠি দিয়ে মারছে, লোকটা কিছুক্ষণ ডানপাশ কিছুক্ষণ বা পাশ করে মার খাচ্ছে আর অনেক মানুষ দেখছে তা কী সবাই জানেন? মোবাইল ফটোগ্রাফি ও ইন্টারনেটের কল্যাণে তাও এখন এদেশের মানুষ নতুন করে জানলো। ফটিকছড়িতে পিটিয়ে তিন জনকে মেরে ফেলা হয়েছে।মসজিদ থেকে মাইকে ঘোষণা দিয়ে রাস্তায় মানুষ নামিয়েছে জামায়াত। আমার এক আর্টিস্ট বন্ধুর পহেলা বৈশাখে আমার কাছে আমার কথা ছিল। এই হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞের ভিডিও ইন্টারনেটে দেখে তার মন খারাপ হলো। সে আমার বাসায় আসা ভুলে গেল। বছরের প্রথম দিনই আমাকে সুনীলের কবিতা আওড়াতে হলো। কথা দিয়ে কেউ কথা রাখে না।
ঘটনা এখানেই শেষ নয়। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আশঙ্কা প্রকাশ করছেন এধরণের ঘটনা জামায়াত আরো ঘটাতে পারে। এরইমধ্যে শেষ হলো জামায়াতের সাবেক আমীর গোলাম আযমের বিরুদ্ধে দায়ের করা মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার শুনানি।রায যে কোন দিন।
শুভ নববর্ষ।
বৈশাখের বেশ কয়েকদিন আগে থেকেই লুবনাকে দেখছি সুই-সূতা নিয়ে বসে আছে। দেখতে তাকে গৃহিণী গৃহিণী লাগে। বিশেষ করে দাঁত দিয়ে সূতা কাটার সময় মুগ্ধ হয়ে চেয়ে থাকি। সুইয়ের প্রতিটি ফোঁড়ে সংসারের জন্য টান,স্বামীর জন্যে দরদই বোধহয় বাঙালি নারীকে আলাদা করে অন্যদের থেকে। আম্মাজীকে দেখতাম আব্বার জন্যে রুমাল করে দিতে। সে রুমালের কোণায় কী ভুল না আমায় লেখা থাকত? জানি না। লুবনা বানালো ইয়গ। লাল কাপড়ের ওপর। বললো, চলেন মীরপুর যাই । সাড়ে এগারো। গিয়ে দেখি এলাহী কারবার। সারি সারি কাপড়ের দোকান। লাল সাদা কমলা। নানা রঙের নানা ডিজাইনের। ওর জন্যে জামার কাপড় আমার জন্যে পাঞ্জাবীর।
কাপড় হলো কিন্তু বানাবে কে? হাতে আছে মাত্র দুদিন। এই টেইলার্সে যাই সেই টেইলার্সে যাই।কেউ রাজি হয় না। শেষে লুবণা বললো একজনকে পাওয়া গেছে কিন্তু তার শর্ত অদ্ভুত। মাপ দেয়া যাবে না। মাপের জন্য দিতে হবে পুরানো পাঞ্জাবী। টাকা দিতে হবে অগ্রীম। লেখোজোঁকার কোন বিষয় নাই। মালিক যেন না জানে সেভাবে দিতে হবে মাপ। আমরা বুঝলাম সে এক চোর।তো,চোর পাঞ্জাবী বানালো খুব ভালো। ঘরে ফেরার পথে লুবনা দেখে পাঞ্জাবী সামনে ধরে আয়নায় নিজেকে দেখছে দর্জি। তাতেই তার রাগ চরমে । দিলো ধমক।
পাঞ্জাবী নিয়ে এসব কী? আমি অবশ্য একটু সন্দেহে পরলাম। পাঞ্জাবী গায়ে দিয়ে দেখেনিতো আবার। বললাম, রাতে দেখবেন এই পাঞ্জাবী পরে খবর দেখবো। অনেক কাজ থাকলেও সে রাতে ছুটি নিয়ে পাঞ্জাবী দেখতে টিভির সামনে বসে ছিল। যাহোক, পাঞ্জাবী নিয়ে প্রশংসার শেষ নেই। নিউজের মাঝখানে হেড অব নিউজ মোস্তফা ফিরোজ চলে এলেন স্টুডিওত বললেন, দারুণ লাগছে।
যাহোক চোরের গল্পটা পরিচিত অনেককে বলি। গুরুজন বললেন, ওর একটা শাস্তি এই ঘটনায় হয়েছে।ও তো কাউকে বলতে পারবে না, ওর বানানো পাঞ্জাবী টিভিতে দেখা গেছে।উৎসর্গ
দেশের ১৬ কোটি মানুষকে কনগ্রসেনাল অ্যাওয়ার্ড উৎসর্গ করেছেন ড.ইউনুস।নোবলে বিজয়ীর এই কৃতিকে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন বেগম জিয়া। আমাদের পারিবারিক লাইব্রেরিতে তাঁরা অটোগ্রাফসহ তাঁর লেখা একটা বই আছে।সে বইটি আবার মুছে রাখলাম। এর দাম অনেক বাড়লো।
18.04.13
একদম হৃদয় ছোঁয়া লেখা...
এই দেশটার মানুষ জনের হৃদয় যে কি দিয়ে আল্লাহ বানাইছে... সেই একমাত্র জানে।
চমতকার লিখছেন ভাই্!
ফটিক ছড়ির ঘটনাটি নি:সন্দেহে নৃশংস, মধ্যযুগীয় বর্বরতা এবং ঘৃণাবহ ! নিন্দা করার ভাষা নাই । যারা নিহত হয়েছেন তারা তিন জনই আমার পাশের গ্রামগুলির । বক্তপুরের লোকটি আমার নানা বাড়ির পাশের । শুনেছি দু'টি ছোট ছোট বাচ্চা আছে । রাক্ষুসী রাজনীতির সর্বগ্রাসী ক্ষুধার বলি হল নিস্পাপ শিশু দু''টির ভবিষ্যৎ ! আমি ভেবে পাইনা, নিজেদের এলাকা থেকে ২০/২৫ কি মি দূরে শত্রু সীমানার মধ্যে হরতাল প্রতিহতের নামে " শো-ডাউন" করতে নিয়ে গিয়ে এই মানুষগুলোকে হত্যা করানোর কি এমন প্রয়োজন ছিল ? নাকি ডুবন্ত তরীখানা একটু জাগিয়ে তোলার জন্য নিজদলের ক'টা লাশের মরিয়া দরকার ছিল ?
একই রকম আর একটি ঘটনার কথা মনে পড়ে । ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর এমনই নৃশংসতায় রাজপথে হাজার হাজার মানুষের সামনে লগি-বঐটা দিয়ে পিটিয়ে মারা হয়েছিল ছয় মানব সন্তানকে । অবশ্য আমাদের মিডিয়া নিহতদের মানুষ মনে করেনি সেদিন । বেশিরভাগ মিডিয়ার কাছে নিহতরা ছিল শুধু জামাত-শিবির, মানুষ না ।
গত দু'মাসে রাজনীতির তান্ডবে পুলিশসহ দুইশতাধিক মানুষ জীবন দিয়েছে । আনতর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন, মিডিয়া যথেষ্ট গুরুত্ব সহকারে সেসব সংবাদ প্রকাশ করেছ । কিন্তু দেশের মিডিয়ায় তেমন মূ্ল্য ছিলনা এগুলুর । কারণ ওই একই, এরাতো মানুষ নয় । এরা স্রেফ জামাত শিবির আর পুলিশ । ঠোপলাদেরকে কেউ কি মানুষ মনে করে !
এবার কিন্তু ঘঠি উল্টে গেল । ফটিক ছড়ি জগত কাপিয়ে দিল । পুরো মিডিয়া জগত, অন্তরজাল, ফেইস বুক, সর্বত্র তুলকালাম । কারণ এবার কোপটি নীরিহ বিশ্বজিতের গর্দানে নয়, দানব জামাত-শিবিরের পাষাণ বুকেও নয়, ভীতু ছাত্রদলের পিঠেও নয়, পড়েছে একেবারে খোদ সোনার ছেলেদের ঘাড়ে-পিঠে-বুকে । সো মিডিয়া চুপ যায় কি করে !
ধন্যবাদ ! ভাল থাকুন ।
পুরাডা পইড়া আসতে হইবে, তয় আপনার খোমাটা বড়ই সৌন্দর্য্য!
ভালবাসা এখনো ওদের কাছেই আছে।
ভাল লেগেছে লেখাটা
মন্তব্য করুন