শাস্তি না-- এতটুকু ভালোবাসা চাই
শাস্তি শব্দটা আমাদের জীবনে অতি পরিচিত যে শুধু তা নয়-সর্বাপেক্ষা পরিচিত।মানুষ হয়ে জন্মাবার জন্য এ পৃথিবির প্রতিটা মানুষের জন্য বরাদ্দ থাকে শাস্তি।কিন্তু বাংলার দামাল ছেলেদের জন্য “বিশ্ব লয়ে খেলা করা বিরাট শিশু”’র রাগ কোন একটা কারণে খুব বেশি তাই বিদ্যালয়ের ছাত্র জীবনে শিক্ষকদের হাতে মার খায়নি এমন বালক কমই আছে। বালিকা বললাম না। কারণ নানাবিধ কারণে বালিকারা বেচে যায় বলে বালকেরাই বেশি ভুক্তভোগী বলে আমি মনে করি।না আমি কখনো মার খাইনি। সবসময় পড়া শিখে আসতাম তো!!বটে –কিন্তু যে এই কথা বলে তার নিতম্বের কাপড় উঠালে আজো হয়ত জালি বেতের চিকন খান কয়েক দাগ পাওয়া যাবে এই আমি বলে দিলাম।যেহেতু বাংলার দামাল ছেলেদের মাঝে আমিও একজন সেহেতু মাইর মুরা আমিও খেয়েছি স্কুল জীবনে,বাসায় পিতৃদেবের কাছে, রান্নাঘরে জননী সাহসিকার ডাল ঘূটনির বাড়ি খাইছি, মক্তবে হুজুরের মাইর।
আমি আমার শিক্ষাজীবনের সবচাইতে উজ্জ্বল সময়টা কাটিয়েছি সিলেটে।আমার বাবা বছরের অর্ধেক সময় বদলি হয়ে এলেন সিলেট। আমি সেবার ক্লাস থ্রিতে ভর্তি হলাম এলাকার আব্দুল গফুর আদর্শ উচচ বিদ্যালয়ে।সেখানে পেলাম এক ভয়াবহ স্যারকে। তার আসল নাম মনে নেই-সবাই তাকে ডাকত কলাপাড়া স্যার।সে কি মার মারত বাবারে।এক বার স্কুলে এক দরখাস্তে সবিনয় আর বিনীত উলটাপাল্টা করার অপরাধে আমায় যে মারটা দেয়া হল এখনো ব্যাথা লাগে মনে হলেই।জীবনে দরখাস্ত লেখার সময় আর ভুল হয়নাই।কিন্তু সেই মারের পর আমার আর ঐ স্কুলে পড়াও হয়নাই।পরের বছর আমি চলে আসি সিলেট সরকারি পাইলট উচচ বিদ্যালয়ে।আমি আমার জীবনে এই স্কুল টার কথা সারা জীবনেও ভুলবনা।ক্লাস ফোরে ভর্তি হলাম।এই ক্লাসে তেমন মার খাইনি।ধর্মের এক স্যার যাও একটু আধটু মারতেন কিন্তু অধিকাংশ সময় ই তিনি গোলাম আজমের মহানুভবতার কথা আর পাকিস্তান বাংলাদেশের বন্ধুত্বপুর্ন সম্পর্কের প্রয়োজনীয়তা বিষয়ক বয়ানে ব্যস্ত থাকতেন বিধায় খুব মারধোর করার সময় পেতেন না। মার খাওয়া শুরু হল-কিলাস সিক্স থেকে।আমার ক্লাস টিচার ভাল লোক ছিলেন খুব মারতেন না;কেউ পড়া না পারলে অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকতেন আর বলতেন ইটাও পারলিনা?অন্যদের কথা জানিনা কিন্তু স্যারের চোখে অন্য এক আভা ছিল।কোন দিন আমরা তাই বাংলা রচনা না শিখে আসতামনা।মঈনুল স্যার আমাদের বিজ্ঞান পড়াতেন। না পারলে হলুদ রঙের মোটা বেত দিয়ে এমন মার দিতেন যে তাকানো যেতোনা।আমরা নান বিদেশি ছবিতে সেখান কার যেসব শিক্ষক দেখতাম তাদের সাথে আমাদের শিক্ষকদের এত পার্থক্য দেখে ভয়ে কাপ্তে থাকা ছাড়া আমাদের কিছুই করার ছিলনা।আমাদের ইংরেজি রচনা পড়াতেন শিল স্যার। তার পুরা নাম ছিল কৃষনপদ শিল।সাইকেলে করে স্যার আসতেন।পিছনে থাকত চিকন দুটা জালিবেত।স্যারের সিস্টেম ছিল ক্লাসে একটা রচনার নাম বলবেন- পরের ক্লাসে রচনা নোট খাতায় তা নোট করে লাইন টু লাইন মুখস্ত করে আসতে হবে।একলাইন মিস হলে বাবারে বলবনা কি হয়!!ব্লগে সিলেট সরকারি পাইলট উচচ বিদ্যালয়ের কেউ আছেন কিনা জানিনা তবে থাকলে তো জানেন ই শিল স্যারের বেত মারার তিব্রতা।কোনদিন বেত না আনলেও আছে “জুলফির উর্ধমুখি টান”।লিখতে গিয়ে লোম খাড়া হয়ে যাচ্ছে।স্যারের “জুলফির উর্ধমুখি টান” থেকে বাচতে ক্লাস সিক্স হয়ে গিয়েছিল একটুকরা ক্যাডেট কলেজ।সবাই আর্মি ছাট।আবার আমরা সবাই একে অপরের চুল ও জুলফি টেনে পরীক্ষা করতাম কোন ব্যাথা লাগে কি না? স্যারের সাইকেল কি আর বাতাসে পুরান হইছে। স্যার নিয়মিত বেত নিয়ে আসতেন এই ঘটনা দেখে এবং পাইকারি হারে সবাইকে জান্নাতে যাবার টিকেট দিতেন।তখন একটা কথা ছিল স্যারেরা যেখানে মারে সে জায়গা বেহেস্তে যাবে বা দোজখের আগুন মুক্ত থাকবে।শিল স্যার যে মার আমাদের দিয়েছেন তাতে আমরা পুরা শরীর নিয়েই জান্নাতে যাব আশা করি।এরপর এল ইংরেজির আরেক শিক্ষক ওবায়েদ স্যার।উনি আবার নাকি মিলিটারি থেকে আসছিলেন।কেন জানি অনেকে তাকে পছন্দ করলেও আমি করতাম না। আমার কাছে লোকটাকে ভয়াবহ ভন্ড প্রকৃতির লোক মনে হত।পড়াতেন ভালো কিন্তু তিনি কি করতেন –সবার সাথে ভালো ভাবে মিশার ভান করে অন্য স্যারদের দুর্নাম শুনতেন – তারপর ছাত্রদের দুর্নাম করার অভিযোগে অদ্ভুত সব স্টাইলে বেতাতেন।যেমন দেয়ালে হাত রেখে আঙুলের উপর বেত মারা,টেবিলের তলায় মাথা ঢুকিয়ে পাসায় সজোড়ে বেতানো ইত্যাদি।আবার তাকে এক ডাক্তারের ছেলে আমাদের বন্ধু প্যাড উপহার দিত।তিনি ঐ ছেলেকে সবসময় এক্সট্রা খাতির করতেন যা দৃষ্টিকটু ছিল।রোকেয়া না রাবেয়া নামের এক ম্যাডাম ছিল সমাজ পড়াতেন।তিনি ক্লাস এইটে পড়ার সময় একবার ক্লাস ক্যাপ্টেন কে দাড়াতে বললেন।অত্যন্ত আনন্দের সাথে আমি দাড়ালে তিনি সবার সামনে বলেন এই গাধাটা ক্লাস ক্যাপ্টেন?আমি তাকে বলেছিলাম ম্যাডাম আমি ক্লাসের ফার্স্ট বয়। উনি বলেছিলেন চুপ গাধা।উনার কথামত আমি আমি গাধা আর উনার বোনের ছেলে রোল ৪৯ যাকে পরের ক্লাসে উঠানোর জন্য আমি ক্লাস টিচারকে এপ্লিকেশন লিখেছিলাম সে মহা বুদ্ধিমান।হায় শাস্তি???
ভাবছেন কি মানুষ শিক্ষকদের বদনাম ই করে গেল ভাল কিছুই বললনা।স্মৃতিতে না থাকলে কি করে বলব বলেন? তবে হ্যা শিল স্যার লোকটা মানুষ বোধ হয় ভালৈ ছিলেন। এক বার হঠাত করে বৃষ্টি নেমেছিল আমরা তিন বন্ধু ভিজে আসছিলাম।শিল স্যার কমন রুম থেকে তার বড় ছাতাটা নিয়ে দৌড়ে মাঠে এসে আমাদের বুকে করে নিজে ভিজে ক্লাসে দিয়ে গেলেন বুঝলাম লোকটা আমাদের খারাপ চাননা।কিংবা শিলা ম্যাডাম বা ধর্মের এক হুজুর তারা খুব বেশি পেটাতেন বলে মনে পড়েনা।আমরা যে তাদের সাবজেক্টে কাচা হয়ে গেছি এমন তো না।বেতিয়ে বেতিয়ে পড়া মুখস্ত করানো যায় কিন্তু শিখানো যায় না।শিখা আর মুখস্ত করার মাঝে হাজার মাইলের ব্যাবধান।আজ তাই জাতীয় জীবনে আমরা দেখি অসহিষ্ণুতা আর হার্ড লাইনে যাবার হিড়িক তা তো এই ছাত্র জীবনেই পাওয়া।এক জীবনে সবাই সব কিছু পায় না।সবাই সব কিছু পারেনা।তাই বলে পড়া না পারার অপরাধে মেরে মেরে তাকে মনটাকে ধুসর করে ফেলা কি ঠিক?
অবশেষে বোধ হয় আমাদের বোধোদয় হল।
সরকার স্কুলে “শাস্তি দান” শাস্তিযোগ্য অপরাধ ঘোষনা করেছে।
এতে এক শ্রেণির মানুষের মাঝে গেল গেল রব উঠেছে। খাইছি।মাইর আর মাইর-বাংলার ঘরে ঘরে এই প্রক্রিয়াতেই জন্ম নিয়েছে ইউনুস আর জাফর ইকবালেরা।এই যে বল সবাই এম.আর.আখতার মুকুলের কথা- তার রসবোধের জন্ম ও তো হয়েছে বাসায় পুলিশ বাবার নিরস হান্টারের বাড়ি থেকে। এবার সত্যই মেধাশুন্য হবে দেশ। যারা এমন ভাবে তারা বোকার স্বর্গে বাস করছে বললেও কম হবে।ডঃ ইউনুস, ডঃ ইকবাল এরা ক্ষণজন্মা মানুষ।কিন্তু সবাই তো আর তারা নন।বেতিয়ে বেতিয়ে দু চার টা ইউনুস বা জাফর ইকবাল করার চেয়ে ভালবেসে বুকে নিয়ে হাজার টা সাধারন মানুষ করাই কি ভাল নয়?-যারা পাখি দেখে হাসতে জানে, কান্না শুনে বুক বাড়িয়ে দিতে জানে।জানিনা অন্যরা কি ভাবেন আমি বলি অনেক তো অসাধরনের জন্ম দিলাম বেতিয়ে বেতিয়ে।এবার ভালবেসে কিছু সাধারন “মানুষ” আসুক।
লেখাটা গুছিয়ে লিখতে পারলাম কি না জানিনা। আশা করি কি বলতে চেয়েছি বুঝেছেন।
ভাই, ব্যপক পোস্ট। পড়তে গিয়ে মনে হলো আপনার লেখাটা রিচ টেক্সট এনাবল হয়ে আছে। এটার কিছু করা যায় কিনা দেখেন।
আর আমি এই লেখাটা পড়ে একটা লেখা তৈরী করছি, আগে থেকে জানিয়ে রাখলাম।
ধন্যবাদ। আপনার লেখাটা পড়ে আসলাম।ঐটার তুলনায় আমার লেখাটা কিছুই না। রিচ টেক্সট এনাবল হয়ে গেছে? আচ্ছা আমি ঠিক করে নিব সামনে। আচ্ছা এই ব্যাপারটা কি আমাকে একটু বুঝিয়ে বলবেন? আমি আসলে ব্লগের অনেক কারিগরি ব্যাপারে অদক্ষ।
লেখা কমপ্লিট করে পোস্ট দেয়ার আগে 'রিচ টেক্সট এনাবল করুন' অপশনটির আগে সম্মতিসূচক টিক যেন না থাকে, সেইদিকে খেয়াল রাইখেন; তাইলেই হবে।
অবশ্যই শিশুদের গায়ে হাত তোলা শাস্তিযোগ্য অপরাধ । এবং এই আইন কাজে লাগুক সেটাই চাই। কিন্তু অবাক লাগে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পুলিশ দিয়ে অত্যাচার চালিয়ে এই আইন যারা করে , তারা কি গরু মেরে জুতা দান করতে চায় নাকি !
পোস্ট ভালো লেগেছে ।
বাছা, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা শিশু না, পুলিশও শিক্ষক না
হা হা হা হা ভালো বলছেন আপু।
ধন্যবাদ।
বহু দিন হল দেশের প ত্রিকা অতটা পড়ি না। কি হচ্ছে অতটা ওয়াকিবহাল না। তবে শারিরীক শাস্তি মোটেও ভালো কিছু নয়। আমি অবশ্যই এর বিপক্ষে।
কিন্তু আগেকার শিক্ষকরা বিস্তর রাগী হলেও তাঁদের সুযোগ্য ছাত্র/ছাত্রীরা কি করে যেন তাঁদের উপরে রাগ হবার বদলে উল্টো শ্রদ্ধাই করেন।
এটা দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাপারও হতে পারে।
মার দেয়াটা খুবই খারাপ একটা বিষয় , এটা বন্ধ করে সরকার ভালো কাজ করেছে ।
খুব ভালো লাগলো লেখা। কিছু জায়গায় যতিচিহ্নের পর স্পেস দিয়ে দিলে পড়তে আরাম লাগতো।
সিরাম হইসে রে !!

সবাইকে আমার লেখাটা পড়ে সুন্দর ও উপকারি সব কমেন্ট করার জন্য অনেক ধন্যবাদ।শাপলা আপু,নুশেরাপু,এপুপু আর সাঈদ ভাই সবাইকে
খুব সুন্দর করে লেখছেন ।
স্কুল লাইফে আমি কয়েক জন স্যারের ক্লাসে যেতাম ভয়ানক ভয় নিয়ে অথচ আমার যাওয়ার কথা ছিল আনন্দ নিয়ে, ক্লাস করার বা নতুন কিছু শিখার আনন্দ নিয়ে। পিচ্ছি কিউট কিউট বাচ্চাগুলার স্কুলে যাওয়ার কথা গভীর আনন্দ নিয়ে কিন্তু তারা স্কুলে যাচ্ছে স্যারের পিটানি খাওয়ার ভয়ে। আশা করি এই আইনের ফলে এই ধরনের ভয় শিশুদের মনে আর কাজ করবে না ।
আর বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের বিদেশী বিশাল বিশাল ডিগ্রীওয়ালা কিছু শিক্ষকের কিছু আচরন দেখে মাঝে মাঝে কনফিউজড হয়ে যেতাম যে আমি "বিশ্ববিদ্যালয়ে" নাকি বিদ্যালয়ে পড়তে আসছি। বাংলাদেশের টিচিং এপ্রোচ এখনও ভয়ানক খারাপ।
আমার বউ স্কুলে পড়ায়। তার কলিগদের কেউ কেউ নাকি না মারার সিদ্ধান্তে থুশী না।
আমাদের স্কুলের এক ম্যাডাম ছিলেন, কোনদিন কারো গায়ে হাত তোলেন নাই, কিন্তু স্কুলের কোন ভয়ঙ্কর শিক্ষকের কথা শুনলে ঐ ম্যাডামের কথাই মনে আসে।। এমনকি, এইটাও মনে পড়ে, ঐ ম্যাডামের ভয়ে আমার এক বন্ধু ক্লাশ টেনে ম্যাডামের ক্লাশ যেদিন থাকতো স্কুলেই আসতো না ( যদিও সে কোন দিন কথাটা স্বীকার করতো না
)।। ম্যাডামের শাস্তির তো কোন শারীরিক দাগ নেই, কিন্তু ঐ ভয়ঙ্কর মানসিক শাস্তি ঠেকাবে কীভাবে??
লেখাটা পড়ে খুব ভালো লাগলো।
পোষ্ট ভাল্লাগছে।
আপনার লেখার সারল্য মুগ্ধ করলো। বিশেষ করে এই লাইনটা "এই স্কুলটার কথা আমি জীবনেও ভুলবো না", এভাবে আমরা ছোটবেলায় কথা বলতাম
:
:
মন্তব্য করুন