বিষাদলোকের জোছনায় ভেসে যেতে, ভালোবেসে – কিছু কথকতা..
বেশ অনেকদিন ধরেই মনে হচ্ছিল আজকাল লুপে ফেলার মত নতুন গান বলতে গেলে আসছেই না। মাঝে মাঝে কালে কদাচিৎ কিছু হয়তো মিলে। কিন্তু তার জন্যও আজকাল হাত বাড়াতে হয় ওপার বাংলায়। কিছু কিছু সময়ে একসাথে যখন অনেকগুলি এলবাম রিলিজ পায় তখন দেখা যায় কয়েকটা গান পাওয়া যায় যা হয়তো কয়েকবার শোনা যায়। কিন্তু টানা শুনে নেয়া যাবে, আবার শোনা যাবে এমন কোন গানের এ্যালবামের কথা ভাবলে কিছুই মাথায় আসে না আমার।
খারাপই লাগে ভাবতে। সেই কবে পেয়েছিলাম কৃষ্ণকলি'র 'সূর্যে বাঁধি বাসা', অর্ণবের 'হোক কলরব' অথবা হাবিবের 'শোনো'। প্রায় সবগুলা গানই ছিল শোনার মত, দুয়েকটা ছাড়া কোন গানই স্কিপ করতে হত না। একবার ছেড়ে দিলেই হত, দিব্যি হারিয়ে যাওয়া যেত। তেমন এ্যালবাম আর পাওয়াই যায় না, এই আফসোস আমার মাঝে মাঝেই ঘুরে ঘুরে ফিরে আসে।
প্রায় মাসখানেক ধরেই একটা নতুন এ্যালবামের অপেক্ষায় ছিলাম। মাত্র একটা গান শুনেই যার কণ্ঠের প্রেমে পড়ে তলিয়ে হারিয়ে গেছি বলা যায়! সেই প্রিয় শিল্পী মণিকা রশিদ আপুর প্রথম গানের এ্যালবাম প্রকাশিত হয়েছে ৩/৪ দিন হল। গত দুইদিন কয়েকটা মার্কেট খুঁজেও পাইনি। আজ দুপুরে এলিফেন্ট রোডে গীতাঞ্জলির শো রুমে গিয়ে অবশেষে হাতে পেলাম 'বরষার শেষে এসে'।
সেই তখন বাসায় ফেরার পর থেকে শুনছি আর শুনছি, শুনেই চলছি। হোক তা বাসায় নিজের ঘরটাকে সুরের সাগরে ভাসিয়ে অথবা ট্রাফিক জ্যামের যন্ত্রনায় বসেও পুরো দুনিয়া থেকে একটু আলাদা হয়ে যেতে। একটার পর একটা গান, বারেবার এবং আবার। একটা গানও স্কিপ পর্যন্ত করতে হচ্ছে না, অভাবনীয় লাগছে ভাবতেই! এখন পর্যন্ত পুরো এ্যালবাম শোনা হয়ে গেছে ৬/৭ বার, এখনও চলছে। আসলে, থামতেই পারছি না।
এ্যালবামে গান আছে মোট দশটা। প্রথম ছয়টা গানই কণ্ঠের পাশাপাশি কথা ও সুর শিল্পীর নিজেরই। কথা সুর নিজের হোক বা অন্য কারও, গায়কী যখন মণিকাদির প্রত্যেকটা গান ঠিক একইরকম মায়ায় অদ্ভুত সুন্দর দরদভরা কণ্ঠে মন জয় করে নেয়। সবগুলি গানের মধ্যেই একটা জিনিস সুস্পষ্টভাবে টের পাওয়া যায়, তা হল - ভয়ংকর তীব্র অভিমান ছাপিয়ে উঠা অসাধারন এক ভালোবাসার আকুতি। প্রত্যেকটা গানের কথা, সুর আর কণ্ঠের সাথে চমৎকার কম্বিনেশন হয়ে আছে দূর্বাদল চট্টোপাধ্যায় এর অপূর্ব সঙ্গীতায়োজন।
প্রত্যেকটা গান শুনি আর বুকের ভেতর কেমন জানি একটা বিষণ্ণতার মতন বোধের সৃষ্টি হয়। একই সাথে বুক ভাঙ্গা একটা হাহাকার আবার নিঃশর্ত ভালোবাসার পরশে মন ভরে যায়।
গানগুলি শুনতে শুনতে বারবার একটা চমৎকার কথা মনে পরে যাচ্ছে।
“There is some kind of a sweet innocence in being human- in not having to be just happy or just sad- in the nature of being able to be both broken and whole, at the same time.”
― C. JoyBell C.
একবার কোথায় যেন শুনেছিলাম, কিছুটা দুঃখের মিশেল না থাকলে আনন্দ কখনই পরিপূর্ণতা পায় না। ঠিক তেমনি আমার মনে হয়, ভালোবাসা তে এরকম একটু আধটু গাঢ় বিষাদমাখা অনুযোগ-অভিমান না থাকলে আসলে তাও পূর্ণতা পায় না!
খুব একটা গুছিয়ে লিখতে পারছি না আজকে, বরাবরের চাইতেও একটু বেশিই অগোছালো হয়ে যাচ্ছে ন বলা কথা গুলো। কিছুই করার নেই। টানা শুনতে শুনতে আমি গানগুলোর ভিতর আর গানগুলি আমার ভিতর হারিয়ে যাচ্ছি। মনে হচ্ছে অদ্ভুত বিষণ্ণ এক জোছনায় আমার চারপাশ ভেসে যাচ্ছে আর তার মাঝে চুপচাপ বসে আছি। মনে হচ্ছে কেউ একজন আছে যাকে আমি আমার নিজের চাইতেও বেশি করে ভালবাসি অথচ সে কখনই আমার হয়ে আমার হবে না, কি অদ্ভুত।
আর কোন অনুভূতি কাজ করছে না আর এই মুহূর্তে।
যাই হোক, এখন একেকটা গান নিয়ে আরও কিছু কথা।
প্রথমেই, 'প্রেম মরে যায়'।
ভালোবাসা শব্দটা আমার অনেক ভালোবাসার। প্রেম অতটা নয়, প্রেম শুনতেই কেমন জানি স্বার্থপর লাগে আমার কাছে। এই প্রথম কোন গানের কথায় প্রেম থাকার পরও অনেক ভাল লাগলো শুনতে।
কয়েকটা লাইন এমন,
প্রেম মরে যায় মরে যায়
এত কাছাকাছি থেকো না আমার
এত বেঁধে বেঁধে রেখো না আমায়
প্রেম মরে যায়
আবার -
যদি উড়ে যেতে চাও, যাও
নেব তুলে পথের বাঁধা
মন যদি চায় ভেজো নীল বর্ষায়যদি হৃদয় না চায়
সাথে থাকা কি যায়?
প্রেম মরে যায়
এরপর, 'বরষার শেষে এসে' - এ্যালবামের টাইটেল সং।
এই গানটার কিছু কথা এরকম -
বরষার শেষে এসে
কেন তুমি নীলাকাশে
রামধনু এঁকে দিয়ে যাওআমি বরষাই ভালোবাসি
সাত রঙে বানভাসি
রঙে রঙে কেন তুমি আমারে রাঙাও
আরও চমৎকার কয়েকটা কথা -
এই এত আসা যাওয়া
ডাক দিয়ে সাড়া পাওয়া
আলোর গভীরে আলো জ্বালামনোজ কবিতা যাকে
জড়িয়ে জড়িয়ে রাখে
খোঁজোনি আমাতে তার ছায়া
তারপর, 'তুমি ছাড়া চাঁদ'।
এই গানটা আমার খুব ভাল লেগেছে, ছন্দটা খুব মিষ্টি।
শুরুতেই -
তুমি ছাড়া চাঁদ জোছনাবিহীন
তুমি দূরে তাই দিন বর্ণহীন
দিন গুনে কি জীবন চলে
ভাবনা ভাসাই সময়ের জলে
তারপর -
তুমি বলোনি তবু যাই জেনে
ভালোবাসোনি, নিতে হয় মেনে
আবার -
ডেকেছ কাছে, দূরে সরালে
যাবো না
আবার হাত বাড়ালে
চারে আছে, 'এখানে মেঘেরা কাঁদে'।
শুরুতে -
এখানে মেঘেরা কাঁদে
এখানে মেঘেরা কাঁদে
তুমি তাকে ডাকো নীল বরষা
আমি বলি মায়া অধরা
ঘিরেছে আঁধার অন্ধকারের রাতে
ঘিরেছে আঁধার অন্ধকারের রাতে
এখানে মেঘেরা কাঁদে
আবার -
বুকের গভীরে তির বেঁধে দিয়ে
নাম দিলে ভালোবাসা
ঠিকানায় ভুল ছিল না কখনো
মরে গেছে প্রত্যাশা
পাঁচে আছে, 'ভোরবেলাতে বৃষ্টি এলে'।
এই গানের শুরুর দিকটাই বেশি ভাল লেগেছে।
ভোরবেলাতে বৃষ্টি এলে ইচ্ছে করে
সে কেমন আছে কোথায় আছে
কোন সাগরে নাও ভাসাচ্ছে
জানতে ইচ্ছে করে
ছয়-এ এসে আমার সবচাইতে প্রিয় গান,
'ও নিঠুর বাঁশিওয়ালা'।
এই গান নিয়ে নতুন করে কিছু বলার নেই।
সব আগেই বলা হয়ে গেছে এখানে ।
তবে এ্যালবামের জন্য রেকর্ডিং এর সময়
এই গানের মাঝামাঝি যায়গায় 'গোধূলি যে রাত্রি হবে'
লাইনের একটা নোটে বোধহয় একটা কিছু সমস্যা আছে,
কেমন কেমন জানি লাগলো শুনতে।
সাতে 'তোমায় দেখে'।
এই গানের চমৎকার কথাগুলি লিখেছেন সেজান মাহমুদ।
শুরুর কথাগুলি এমন -
তোমায় দেখে
বেদনার নীল রং
জানা হলো আজ
বোঝা গেল বিরহের
কি যে কারুকাজ
শেষটাও দারুন -
নীরবে লিখেছি সুর চাঁদেরই তারে
জ্যোৎস্না নামে তুমি ডেকেছো যারে
সেই আলোর মুকুটে
তুমি রাজাধিরাজ
এই গানটার মিউজিক একটু বেশিই মন খারাপ করা,
বলে বোঝানোর মত নয়।
তারপর, 'সর্বনাশা পথের পথিক'।
কথা ও সুর দিয়েছেন হাসান মাহমুদ।
এই গানটা একটু অন্যরকম।
দ্রুত লয়ের, একটু দুষ্টু মিস্টি একটা সুর।
কয়েকটা লাইন এমন -
কোন অচিন ধরনে গড়া সে
অচিন গড়নে
আলোতে আঁধারে বাঁধা সে চিরদিন
হিয়ার চরনে
সে-ই জানে কার সন্ধানে
তার চলা তো শেষ হলো না
কথাগুলো সুন্দর কিন্তু আমার কেন জানি খুব ভাল লাগেনি গানটা।
নয়-এ আছে 'কেন মনে রাখনি'।
কথা ও সুর দিয়েছেন তাজুল ইমাম।
এই গানের শুরুর আবেগটা অনেক বেশি।
গানটার চমৎকার কথাগুলো এরকম -
কেন মনে রাখনি
কেন ভুলেছ আমায়
কেন আপন হলে না বলো
কোন বেদনায়অশ্রুর মত কেন মুছে দিলে ভালোবাসা
হিমেল হাওয়ার ঝড়ে ভেঙে গেল যত আশা
যতটা চিনেছি তারে অজানা ভুলের আঁধারে
ঢেকে দিয়ে গেলে দূরে কোন অচেনায়বুকের গভীরে এক নদী ছিলো টলোমলো
অবহেলা অভিমানে কোথায় হারিয়ে গেলো
তোমার মেঘের ছায়া
তোমার রোদের মায়া
নামেনি বাদল হয়ে ভিজে বরষায়
শেষ গান, 'তোমাকে ছাড়া ভালো লাগে না'।
কথা ও সুরে আরও একবার তাজুল ইমাম।
এই গানের কথাগুলি অনেকটাই আজকালকার।
মনিকাদির অন্যান্য গানগুলির তুলনায় একটু বেমানান।
তবুও,
গানটা শুনতে খারাপ লাগে না।
তোমাকে ছাড়া ভালো লাগে না
টেলিফোনে কথা বলে মন ভরে নাকোথায় যে খুঁজে ফিরি সাইবার স্পেস জুড়ে
কোথায় লুকিয়ে থাকো নানান কথার ভিড়ে
অভিমানী এসএমএস বারবার আসে ফিরে
নেটওয়ার্ক প্রহরী দেয়ালেতে মাথা খোঁড়ে
তোমার মধুর ছোঁয়া তাতে মিশে থাকে নাসেলফোন বেজে উঠে নানান বিচিত্র সুরে
কখনও বা বেটোফেন কখনও রবিশঙ্করে
কখনও বাউল গান ভাটিয়ালি কেঁদে উঠে
হৃদয়ের দুই কূল নিতে চায় লুটেপুটে
তোমার মধুর বাণী তাতে মিশে থাকে না
এই তো, আমার কথা এখানেই শেষ। ভাল কোন গান শুনলে তা কাছের বন্ধুদের সাথে শেয়ার করতে না পারলে আসলে ভালই লাগে না।
কতটুকু কি ঠিকঠাক বলতে পেরেছি জানি না তবে এখন বেশ শান্তি শান্তি লাগতেছে।
আমার ভালোলাগাটুকু যদি কোনভাবে কারও মন ছুঁয়ে যায়,
এ্যালবামটা সংগ্রহ করে গানগুলো একটু সময় নিয়ে শুনে দেখার অনুরোধ রইল।
আমার কথা থাকলো, ঠকবেন না।
গানগুলো শুনে যদি একজনেরও ভাল না লাগে, সত্যিই অবাক হব খুব।
ভালো থাকুন সবাই, অনেক ভাল। প্রতিটি দিন, প্রতিটি ক্ষণ।
গানের কথাগুলো সুন্দর!
চমৎকার অনুভূতির প্রকাশ ঘটেছে লেখায়।
অনেক অনেক ধন্যবাদ।
পিচ্চিও কি জানে
দারুণ লাগলো গান নিয়ে তোমার আলোচনা । গানের কথাগুলি সৃন্দর । শোনার আগ্রহ জাগলো ।
ঢাকায় যেয়ে কিনে শুনবো।
মণিকা দারুণ গান করে। ইউটিউবের একটা লিংক দিলাম-
http://www.youtube.com/watch?v=xpcpnXqaGZE
গানালোচনা ভাল লাগলো। দেশে যেয়ে কেনার ইচছে আছে।
ধন্যবাদ, জেনে ভাল লাগলো।
মন্তব্য করুন