ইউজার লগইন

পিতৃত্বের মূল্য

পুরুষ বন্ধ্যা প্রাণী(barren animal)- এ অভিযোগের বয়স অনেক।এ বন্ধ্যাত্ব ছোট্ট একটি কণাকে প্রাণ করে তুলতে না পারার, প্রাণকে লালন করতে না পারার। কলকাতার কবি জয়া মিত্র এই অভিযোগের সচ্ছল কাব্যভাষা দিয়েছেন। কবিতাটা খুব প্রিয় বিধায় পুরটাই কোট করছি। পড়ুন:

ওড টু অ্যালিস ওয়াকার

ইভ, তুমি কালো মেয়ে
তাই আদি সরীসৃপ
আদিম রহস্যবার্তা
বলে গেছে তোরই কানে কানে
বলে কি যাদুবিদ্যা বলে
তীব্রতম রূপোল্লাস গোপনে সঙ্চয় করে
গর্ভে ধরতে পারে শুধু তোমার শরীর
গভীর যোনীর মধ্যে
যে রৌদ্র চুঁইয়ে পড়ে
তাকে তুমি পরমরহস্য বলে
প্রাণকণা করে তোল

পুরুষ, সে কতদূরে
কেবল ইন্দ্রিয়সুখ সম্বল করে
অভাগ্য দাঁড়িয়ে থাকে
তোমার রাজ্যের বাইরে দীনহীন
হাতে হাতে মূল্য চুকিয়ে নিয়ে
একা
আমি ডেকে বলছি তোমাকে
ইভ, আদিম জননী নও
জায়া কিংবা ভার্যা নও
জন্ম সাম্রাজ্যের রহস্য ঐশ্বর্যমূলে
অধীশ্বরী তুমি
আর আমি তোর নিজস্ব জাদুর অংশীদার
লতা গাছ পাখি ও ফড়িং দিয়ে
ভরে দেব
আমাদের শাকম্ভরী উত্তরাধিকার

(প্ল্যান হল আমরা এই কবিতার কনটেক্সট, এর গুড় ইকোলজিকাল কনসার্নকে(লতা গাছ পাখি ও ফড়িং) না দেখার ভান করব।)

তাহলে সন্তান জন্মদানে পুরুষের ভুমিকা অনেকটা কারখানার শ্রমিকের মত; মজুরী পাবে, কিন্তু প্রোডাকশানে ভাগ বসাতে পারবে না।লক্ষ্য করুন, সঙ্গম শুধু ক্ষেত্র প্রস্তুত করে, জন্মদানকে অনিবার্য করতে পারে না।এটা প্রোলগ, পর্দা উন্মোচনের ইশারা, কিন্তু আগামি দশ মাস যে অতীন্দ্রিয় নাটকটি অনুষ্ঠিত হবে তার মন্ঞ মায়ের গর্ভ। পুরুষ এখানে 'দীনহীন', ও উদ্বাস্তু।কারন, সঙ্গম একটি তীব্র, ক্ষনিক, সয়ম্ভু, ও সেল্ফ সাফিসেন্ট আবেগ। সন্তান জন্মদান, অন্যদিকে, সময়হীন, ও অনির্বাণ। তাই একটা করে যে অন্যটার কৃতিত্ব নেওয়া যায়না, পুরুষতন্ত্র তা ভালই বুঝত। বুঝত বললে ভুল হবে, পুরুষ বোধী এই সত্যে রক্তাক্ত থেকেছে শতাব্দীময়। সত্যের যে একটা ঘাতক চেহারা আছে আমরা তা ভুলে থাকি, ভুলে যাই, ভুলিয়ে দিতে চাই। লাভ হ্য় না। যেমন লাভ হয়নি পুরুষের মা সাজার চেষ্টা। ক্লাসিকাল ও ভেদিক মিথলজিতে অনেক দেবতাই মা সেজেছেন, এটা জানা কথা। অগস্ত্য মুনি তো পৃথিবীর সমস্ত রূপ সমবায়ে যে নারীর জন্ম দেন, বয়সকালে আবার তাকেই বিয়ে করেন।তবে যে ব্যাপারটা লক্ষ্যনীয় তা হল, তারা সন্তান জন্মদানের সনাতন পদ্ধতিটি সযত্নে পরিহার করেছেন। যেমন, জিয়ুসকে দেখি চুলের অগ্রভাগ থেকে কন্যা সন্তানের জন্ম দেন।ভেবে দেখুন, ঘটনা সিরিয়াস। জিয়ুস যে টাইপের পাব্লিক, যিনি অলিম্পাসকে প্রায় কিন্ডরগার্টেন বানিয়ে ফেলেছেন, যিনি রেপকে রীতিমত আবেগ প্রকাশের ভাষা বানিয়ে ফেলেছেন, তিনি কেন হঠাৎ সন্তান জন্মদানে 'চুলের' ব্যবহার করলেন তা বুঝতে কষ্ট হয়না।তারা নিশ্চিত জানেন, কি আনন্দ সন্তান ধারনে!

বাস্তবে হেরে গিয়ে মিথলজিতে বায়লজির ধারা পাল্টে দিয়েই থেমে যায়নি প্রতিশোধের পালা।উত্তরাধীকার চিহ্নিত কারার কথা বলে সে 'দীনহীন'ই সম্রাট সেজেছে। এই মেটামরফসিস পুরুষতন্ত্রের ফসল, যার ফলে সন্তান জন্মদানে নারীরা গুরুত্ব হারাতে হারাতে এখন 'চাষ(অ)যোগ্য' জমির পর্যায়ে নেমে গেছে। চিহ্নিতকরণের প্রধান টুল হল নামকরণ। আজ আওয়ামীলীগ, বিএনপি যে খেলা খেলছে তার সুপ্রচীন ইতিহাস আছে। ইহুদি ধর্মগ্রন্থে দেখি, ঈশ্বর Adam কে মাটি(Adama) থেকে তৈরী করেন বলেই তার নাম Adam. কিন্তু পরবর্তী পন্ডিতরা দাবী করেন, Adam কে জন্ম দেয়ার জন্যই নাকি মাটিকে Adama বলা হয়েছে। অর্থাৎ, ছেলে দিচ্ছে মায়ের নাম। কারন, ক্ষমতা যার, নামকরণের অধিকার তারই।

মহাভারতে দ্রৌপদীর নাম যে কৃষ্ণা একথা আমরা প্রায় ভুলতে বসেছি। তাকে বলি দ্রৌপদী(দ্রুপদ রাজার মেয়ে), পান্চালী( পঁাচ স্বামী আছে এজন্য)। অন্য যে একমাত্র নারী গতরে খেটে সন্তানদের নাম দেবার অধিকার অর্জন করেন তিনি সাবিত্রী, গরীবদের আর্থগডেস।

পুরুষের বন্ধ্যাত্ব ঘোচানোর শেষ উপায় হিসাবে নারীকে নিজের শরীরের মধ্যে পাওয়ার গভীর চেষ্টাও দেখা গেছে। বলা হল, সৃষ্টিশীল হতে হলে পুরুষের মধ্যে ফেমেনিন আসপেক্ট থাকা জরুরী। শুধু কথার কথা না, প্রচুর সৃষ্টিশীল মানুষ আছেন যাদের আমরা গোপনে লেডিস বলে ডাকি। আমাদের প্রিয় লালমিয়াকে(শিল্পী সুলতান) একটা সময়ে(যাকে রাধাকাল বলে ডাকা হয়) শাড়ি পড়ে ঘুরতে দেখা গেছে।মহাত্না গান্ধীকে তার পত্নী কস্তুর্বা মৃত্যুশয্যায় মনুকে(তার নাতনি) দেখিয়ে অনুরোধ করেছিলেন, 'তুমি তার মা হয়ো'। গান্ধী চেষ্টা করেছেন। মনু বড় হয়ে বই লিখল Bapu- My Mother.

কিন্তু কি হল?

পোস্টটি ১৪ জন ব্লগার পছন্দ করেছেন

অরিত্র's picture


আপনি এত কম লিখেন ক্যান? আপনার লেখাগুলো অসাধারন।
রেগুলার পড়তে চাই।
নিরাশ করবেন না আশা করছি

চাঁদবেনে's picture


ভাই, আমি সিরিয়াস অলস। বাফড়ার যন্ত্রনায় এগুলো লিখলাম। আমার লিখব, লিখব এটা ভাবতেই ভাল লাগে। তবে এখন থেকে আসলেই লিখব।

ভাস্কর's picture


অনেকদিন পর এমন একটা লেখা পড়লাম...অনেক ভালো লাগলো...অনেক!

চাঁদবেনে's picture


ধন্যবাদ। লেখাটার মধ্যে শরীর, পরিচয়, ইত্যাদি আরো কিছু বিষয় যোগ করার কথা ছিল, কিন্তু ঐ যে বললাম অলস, আর লেখা হয়নি।

লীনা দিলরুবা's picture


তাহলে সন্তান জন্মদানে পুরুষের ভুমিকা অনেকটা কারখানার শ্রমিকের মত; মজুরী পাবে, কিন্তু প্রোডাকশানে ভাগ বসাতে পারবে না।

তেমন ভাবনা হয় নাকী? পুরুষতন্ত্রতো সব কিছুর উপর নিজের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে রেখেছে। পুরুষকে এত অসহায়তো মনে হয় না।

লিজা's picture


হ্যা তাইতো ।

চাঁদবেনে's picture


সব কিছুর উপর যার নিয়ন্ত্রনে আছে, সে কি আক্রমন করে? যে আক্রমন করে, তার চেয়ে অসহায় আর হয়না, ভেতরে ভেতরে সে ব্যাংক্রাফট হয়ে গেছে। নিজের অহমের কাছে হেরে সে নারীকে ছোট করে, কিন্তু নিজের বাসনার কাছে হেরে আবার তার কাছেই হাত পাততে হয়- এই ডিলেমা পুরুষকে শেষ করে দিয়েছে। নারী যুগপৎ তার অসুখ, ও অষুধ।

যা ছুইলে প্রানে মরি, এ জগতে তাইতে তরি (লালন ফকির)

লীনা দিলরুবা's picture


আপনার প্রতিত্তর পড়ে মজা পেলাম। পুরুষের এমন অন্তর্গত বেদনা টের পাইনি কখনো। ভাবালো কথাগুলো।

মীর's picture


আমি তো দুইবার লাইক দিয়ে ফেললাম। দারুণ লেখা!

১০

চাঁদবেনে's picture


হা হা। যাক, পরের লেখায় ব্যালেন্স হয়ে যাবে আশা করি।

১১

নাজমুল হুদা's picture


পছন্দ করলাম ।

১২

শওকত মাসুম's picture


পছন্দ করলাম

১৩

আরণ্যক's picture


পুরুষের বন্ধ্যাত্ব ঘোচানোর শেষ উপায় হিসাবে নারীকে নিজের শরীরের মধ্যে পাওয়ার গভীর চেষ্টাও দেখা গেছে। বলা হল, সৃষ্টিশীল হতে হলে পুরুষের মধ্যে ফেমেনিন আসপেক্ট থাকা জরুরী। শুধু কথার কথা না, প্রচুর সৃষ্টিশীল মানুষ আছেন যাদের আমরা গোপনে লেডিস বলে ডাকি। আমাদের প্রিয় লালমিয়াকে(শিল্পী সুলতান) একটা সময়ে(যাকে রাধাকাল বলে ডাকা হয়) শাড়ি পড়ে ঘুরতে দেখা গেছে।মহাত্না গান্ধীকে তার পত্নী কস্তুর্বা মৃত্যুশয্যায় মনুকে(তার নাতনি) দেখিয়ে অনুরোধ করেছিলেন, 'তুমি তার মা হয়ো'। গান্ধী চেষ্টা করেছেন। মনু বড় হয়ে বই লিখল Bapu- My Mother.

একদম নতুন পার্সপেক্টিভে দেখলাম বিষয়টা -- বিশেষ করে সৃষ্টিশীল হবার ব্যাপারটা নতুন করে ভাবালো।
এটা নিয়া চিন্তা করতে হবে - সো ফার জিনিষটা এমনই দেখা যাচ্ছে বটে।
বাফড়ার শেয়ার থেকে দেখেছিলাম পোস্টটা ।

গুড পোষ্ট।

১৪

চাঁদবেনে's picture


ট্রু নলেজকে সবসময় বিপরীতের সমবায় হিসাবে ভাবা হয়। নারী + পুরুষ, ইন + ইয়ান।
গ্রীক মিথলজিতে টাইরেসিয়াসকে সবচে ওয়াইজ ভাবা হয় কারন জীবনের একটা পর্যায় সে নারী হয়ে অতিবাহিত করেছে।

'বনমালী তুমি পর জনমে হইয়ো রাধা'

শ্রীকৃষ্ণ নিজেই ভগবান(ভগবানের আট ভাগের এক অংশ, টু বি প্রিসাইজ), তবুও উপলব্ধির পূর্ণতার জন্য তাকেও নারীজন্মের প্রতীক্ষা করতে হয়!

১৫

নুশেরা's picture


খুবই ইন্টারেস্টিং বিষয়। লিখেছেন চমৎকার!

আমি একজন পুরুষকে চিনি যিনি সন্তান জন্মের পর হরমোন ইঞ্জেকশনের সন্ধান করেছিলেন স্তন্যদানের অভিজ্ঞতার জন্য। তখন হাস্যকর মনে হয়েছিলো; আপনার লেখা পড়ে অন্য উপলব্ধি ঘটলো।

১৬

চাঁদবেনে's picture


একটা সময় ছিল যখন আমরা পিতার, মাতার, দেশের পরিচয়ে পরিচিত হতে লজ্জা পেতে শিখেছি। ভেবেছি সবি ভুল, এগুলো আমাকে প্রকাশ করেনা। আমরা আমাদের শরীরে এসে থিতু হয়েছি। আমাদের ধারনা ছিল শরীর(মেল বা ফিমেল) অমোঘ, স্থিত- একে আশ্রয় করে আমার পরিচয় দানা বাঁধবে।এখন ট্রান্সসেকসুয়ালদের দেখি। তাদের এই জার্নিকে সিরিয়াসলি নেবার সময় এসেছে বলে মনে করি। শরীর আসল নয়।আসল হল ওয়াট ইয়ু ফিল লাইক। বুঝি, বায়লজিও একটা চয়েস(সিগমুন্ড ফ্রয়েডের জন্য দু্ঃখ হয়)।

১৭

তানবীরা's picture


আজকাল প্রবাসে কিছু নতুন জেনারেশনের ছেলে দেখছি, সন্তান জন্মানোর পর যেভাবে তাকে লালন পালন করছেন, রাত জাগছেন তাতে আবার নতুন করে অনেক ভাবনা আসছে মাথায়

১৮

বাফড়া's picture


ভালো ক্যাচালে পড়া গেল তো!!! আগে নিজেরে গেইনার ভাবতাম কঝ আইভ গট আ পিনিস... অহন দেখি চারদিকেই ''গতি নাই, গতি নাই'' রব... পোস্টের জিনিস-পাতি জানার পর আমার তো নিজের এবং মানব সম্প্রদায়ের পুরুষ প্রজাতির উপর মায়া লাগতাছে অহন...

পোস্ট মারাত্মক...

আগে ভাবতাম বাপ হইলে এইটা করুম সেইটা করুম... সামুতে দুইখান পোস্ট-ও মারছিলাম রিলেটেড টপিকে... আজকাল মনে হয় এই লাইনে শাইন করুম না.. বাচ্চা কাচ্চারে দেড়-দুইমাস লুতুপুতু কইরা তারপর ইন্ট্রেস্ট হারায়া ফেলুম Sad ... নির্বোধ মানব শিশুর ক্যাচর ম্যাচর সহ্য কইরা তারে মানুষের মত সম্মান দিয়া তারে একজন ব্যাক্তি হিসেবে ট্রিট কইরা বড় করা বড়ই ঘাপলার... (গর্ভধারণ করার কথা তো জানাই নাই)....

===

আচ্ছা পুরুষ রা তাইলে পারে টা কি??!!

১৯

এস এম শাহাদাত হোসেন's picture


প্রথম 'পরিচয়ে'ই আপনার অনুরাগী হয়ে গেলাম। চালিয়ে যান ভায়া। করোটির ধূসর বস্তুতে ঝাঁকি লাগতে থাকুক।

নারীর প্রতি অসহায় নির্ভরশীল হিসেবে আমার উপলব্ধি হচ্ছে, শ্রমিক হওয়ার বাইরে জগতে পুরুষের বিশেষ কোনো মূল্য নেই। যে শুক্রাণুর জন্য তার এত বাহাদুরি, তুলনা করলে দেখা যাবে শরীর গঠনে যেসব পুষ্টি উপাদানের প্রয়োজন (যা ছাড়া প্রাণী পূর্ণাঙ্গ হয় না) তাদের বাহাদুরিও তেমনই।

ব্যাপার হচ্ছে, এসব ভাবনা প্রতিপক্ষ পুরুষ ভাববে কখন? নারী নিজেইতো ভাবতে সক্ষম হয়নি। তাঁদের সক্ষমতা অর্জিত হলেই জগতের সব জঞ্জাল অপসারিত হবে। তখন পুরুষরাও আরো ভালো থাকবে।

মানুষ অপেক্ষায় থাকুক সেই দিনের।

২০

চাঁদবেনে's picture


ধন্যবাদ

মন্তব্য করুন

(আপনার প্রদান কৃত তথ্য কখনোই প্রকাশ করা হবেনা অথবা অন্য কোন মাধ্যমে শেয়ার করা হবেনা।)
ইমোটিকন
:):D:bigsmile:;):p:O:|:(:~:((8):steve:J):glasses::party::love:
  • Web page addresses and e-mail addresses turn into links automatically.
  • Allowed HTML tags: <a> <em> <strong> <cite> <code> <ul> <ol> <li> <dl> <dt> <dd> <img> <b> <u> <i> <br /> <p> <blockquote>
  • Lines and paragraphs break automatically.
  • Textual smileys will be replaced with graphical ones.

পোস্ট সাজাতে বাড়তি সুবিধাদি - ফর্মেটিং অপশন।

CAPTCHA
This question is for testing whether you are a human visitor and to prevent automated spam submissions.