পৃথিবীর প্রতি ভালবাসা
জীবন নদীর মত। বিভিন্নভাবেই। নদী শুরুতে নদী থাকেনা; অন্তেও নয়। জীবনও এরকমই মাতৃঝর্ণায় শুরু হওয়া এক আকষ্মিক প্রবাহের নাম যা অনিবার্যভাবেই অকরুণ মৃত্যুসাগরে বিলীন হয়ে যায়। হ্যাঁ, আমাদের জীবন আমাদের নদীগুলোর মতই। নির্দৃষ্ট্যভাবে বললে ১৭০ টন ফর্নেস অয়েল বুকে নিয়ে শোকের মত বয়ে চলা কর্ণফুলী নদীর মত। বিবর্তনবাদ বলে, জলই জীবনদাত্রী। সে হিসেবে আমরাও নদী থেকে উঠে এসেছি। খুব অল্পকাল আগে। এখনো শরীর থেকে শুকিয়ে যায়নি জলের রেখা। আর এরই মধ্যেই আমরা পৃথিবীকে হত্যায় উদ্যত হয়েছি। আমরা মনে হয় অভিষপ্ত, একিলিসের মত। ব্রিসেইস একিলিসকে বলেছিল, Killing is your only talent is your curse. হ্যাঁ, হত্যাই আমাদের একমাত্র প্রতিভা, আমাদের অভিষাপও।
ট্রয়ের যুদ্ধে একিলিস এগামেমননের সাথে ঝগড়া করে যুদ্ধবিমুখ হয়। পেট্রোক্লাসের মৃত্যুই তাকে আবার যুদ্ধে ফিরিয়ে আনে।পেট্রোক্লাস- তার দোসর, তার অপর। লুইস গ্লুক তার কবিতায় ইঙ্গিত করেন, একিলস( যে ঘৃনা করে, প্রাণ নেয়) ও পেট্রোক্লাস(যে ভালবাসে, জীবন দেয়) -এ দুজন মিলে আসলে এক ব্যাক্তি। আমাদের মতই। আর পৌরানিক কাহিনীর মত আমাদের পেট্রোক্লাস, আমাদের ভাল, আমাদের শুভও মৃত্যুবরণ করেছে। আমাদের পশুদিক বেঁচে আছে। হত্যা করার জন্য ছুটছে। এবার নিজেকেই।
প্রাচীন মিসরে বুক অব ডেড থেকে জানা যায়, মানুষের নৈতিকতা ৪২ টি মহাপাপে অভিভূত হতে পারে। মৃত্যুর পর আত্নাকে নিজের অপাপবিদ্ধতা জাহির করতে হয় জিবিতাবস্থায় এ পাপগুলো না করার স্বীকারোত্তির মধ্য দিয়ে। এদের নেগেটিভ কনফেসন্স বলে। তালিকায় ৩৬ তম মহাপাপটি হল নদীর পানিকে নোংরা করা( তাও বিষাক্ত বর্জ্য ফেলে নয়, পানিতে হেঁটে ঘোলা করে)। আড়াই হাজার বছর আগে নদীর পানি নোংরা করা মহাপাপ ছিল। অথচ আমরা দাবী করছি, আমরা ক্রমাগত 'সভ্য' হচ্ছি আর খুন করছি একের পর এক নদী!
আমাদের হিজরত শুরু হয়ে গেছে। আফ্রিকার নারীরা পানির জন্য প্রতিবছর যে দূরত্ব অতিক্রম করতে হয় তা যোগ করলে ১৬ বার চাঁদে যাওয়া যায়।সমস্যা কি, আমরা এখন তেল বাদ দিয়ে পানির জন্য যুদ্ধ করব।
ভেতরে ভেতরে আমাদের হয়ত কোন শ্বান্তনা আছে। আমাদের অনেক গভীরে হয়ত কোন নিশ্চয়তা আছে। তা যদি নাই হবে, মানুষ কিভাবে এমন নির্বিকারভাবে নিশ্চিত মৃত্যুর দিকে যাবে? কেন তাদের একমাত্র লক্ষ্য প্রফিট ম্যাক্সিমাইজিং? আমরা ভান করি আমরা জানিই না যে যেকোন মূহুর্তেই আমাদের চেনা ঢাকা শহর তচনচ হয়ে যেতে পারে ভুমিকম্পে।আমাদের জন্ম নেয়নি যে শিশু তার কোমল টুকটুকে হৃৎপিন্ডটার জন্য আমরা রেখে যাচ্ছি কাড়ি কাড়ি টাকা, আমাদের পাপ, সবচে দূষিত বাতাস, পানি, আর বিশ্বস্বাস্থ্যসংস্থার দেওয়া মানের চে পাঁচগুন বেশি আর্সেনিকযুক্ত ভাত। শেষে হয়ত তাকে টাকাই খেতে হবে।সেইসাথে আশংকা করি, পৃথিবীর প্রতি আমাদের অপব্যবহার যত দীর্ঘ ছিল, আমাদের পতন এত দীর্ঘ হবেনা।
আচ্ছা, এই পৃথিবীটাকি আমাদের? আমরা কি এটা কিনে নিয়েছি? কার কাছ থেকে? আমার জানা নেই। তবে সুকেশী ইংরেজ দার্শনিক জন লকের হয়ত এ বিষয়ে কিছু বলার থাকতে পারে। তিনি বলেন, একটা মানুষের নিজের বলতে আছে কেবল তার শরীর ও শ্রম। অন্যদিকে, একটা নির্দিষ্ট জায়গায় যে সম্পত্তি থাকে তা হল কমন প্রপার্টি, সামগ্রীকভাবে সবার, পৃথকভাবে কারই না। এখন আপনি যখন কোন কমন প্রপার্টিতে ব্যক্তিগত শ্রম দেন, তা প্রাইভেট, বা ব্যক্তিগত সম্পত্তি হয়ে যায়। আর যেহেতু তা আপনার নিজের, আপনি এখানে যা ইচ্ছা তাই করতে পারেন; ফুলের বাগান করতে পারেন, অথবা পারেন আনুবিক বোমা পরীক্ষা করতে। পৃথিবীকে নিজের কেনা সম্পত্তি ভাবার সবচেয়ে ক্ষতিকর দিক হল এই। এতে পৃথিবীর কোন মূল্য থাকেনা, থাকে শুধু এটা আপনার কি সুবিধা দিচ্ছে তার। আর সুবিধার জন্য আমরা করি না এমন কাজ কমই আছে।
অন্যদিকে, আমাদের আদিবাসী সমাজে সম্পত্তির ধারনা ছিল অনেক মানবিক। এ ধারনায়, সম্পত্তি কারো ব্যক্তিগত নয়, বরং ঐ নির্দিষ্ট কমিউনিটির। এতে এমনকি মৃতদেরও অধিকার আছে। এই সম্পত্তি আমার না, সবার। আমার আগেও মানুষ ছিল, পরেও আসবে। আমার কাজ এটাকে সুস্থ্যভাবে পরের প্রজন্মের হাতে তুলে দেওয়া। সবগুলো ফুলসমেত।
পৃথিবীর দিকে তাকাবার এই পরস্পরবিরোধী ধারনাকে নিয়ে আমরা গৌতম বুদ্ধের শরণে যেতে পারি।বুদ্ধ একদিন বাগানে বসে আছেন। একটা বালি হাস মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছিল। হঠাৎ একটা তীর এসে পাখিটিকে বিদ্ধ করে, আর পাখিটি লুটিয়ে পড়ে বুদ্ধের পায়ের কাছে। বুদ্ধ শুশ্রুষা করে হাসটিকে সুস্থ্য করে। ইতোমধ্যে, বুদ্ধের তীরন্দাজ অপখালাত ভাই, দেবদত্ত, এসে হাসটি দাবী করে। বুদ্ধ বলেন পাখিটি তার।এর সপক্ষে যে যুক্তিটি তিনি দেন তা দর্শনের ইতিহাসে সবচে নাঈভ, এবং একইসাথে সবচে প্রোফাউন্ড( আমার মতে)। বুদ্ধ বলেন, পাখিটি আমার কারন এটাকে আমি তোমার চে বেশি ভালবাসি। এটাই বৌদ্ধ ধর্মের প্রিন্সিপাল অব প্রপার্টি। মানে, আপনি কোন কিছু নিজের করে পেতে চাইলে তাকে অন্যদের চেয়ে বেশি ভালবাসতে হবে। পৃথিবীকেও শুধু ভালবাসা দিয়েই কেনা যায়।
আগের প্রশ্নে ফিরে আসি, পৃথিবীকি আমাদের?
এখন প্রশ্ন হল, একে কি আমরা ভালবাসি?
ভালো লিখেছেন ।
কিন্তু কাজের কাজ তো কিছুই হচ্ছে না। পৃথিবীর নেতা দেশগুলো কোন রকম অঙ্গিকার করতেও রাজি না জলবায়ু বিষয়ে।
লেখাটা ভালো লেগেছে।
আমরা শুধুই নিজেদের ভালোবাসি।
৪২টি মহাপাপ কী কী। পারলে আলাদা পোস্ট দেন। আগ্রহ হচ্ছে।
টাইপোগুলো একটু দেখে নিয়েন। এমন পোষ্টে টাইপো মানায় না
ভালো লাগলো।
পৃথিবী যদি আমাদেরই হয়... তাহলে তাকে হত্যা করতেছি ক্যান?
মন্তব্য করুন