চেহারা
আমি আগে টের পাই নাই পৃথিবীতে কত ধরনের চেহারা আছে।পৃথিবীতে অনেক মানুষ, কিন্তু চেহারা তারচে বেশি, কারন, সবারই কয়েকটা করে আছে।
রাইনে মারিয়া রিলকে
নোটবুকস অব মাল্টা লরিজ ব্রিজ
ফটোগ্রাফীর প্রতি আসক্তি থাকার কারণে মানুষের মুখের দিকে দীর্ঘ্যক্ষন তাকিয়ে থাকার অভ্যেস আমার আছে। মানুষের মুখ আসলে পুকুরের মত; ঘটনার মৃদুশ্পর্শে যেখানে কেবলই নতুন নতুন বিন্যাস ফুটে ওঠে, মিলিয়ে যায়। এরমধ্যে কোন্টা তার আত্নার, স্ব-ভাবের, অথবা তারও ভিতরে চুপ হয়ে থাকা তার মর্মের পরিচয়বাহী, জানিনা। মনোক্রোমের পাসপোর্ট সাইজের ছবির মধ্যে কিভাবে-তাকাবে-বুঝতে-না-পারা বিব্রত ছেলেটির অস্বস্তি কি কোন ক্লু বা করিডোর যা আমাকে তার আত্নার গভীরে নিয়ে যাবে?
ভিক্টোরিয়ান ধারনা তা-ই বলে। বলে, মানুষের মুখ তার আত্নার প্রতিচ্ছবি, প্রচ্ছন্নে থাকা শিরা, উপশিরার সাহায্যে আত্না যেখানে নিজেকে কায়ারূপে নির্মিত করে।মানুষের সুন্দর মুখ আসলে তার অম্লান আত্নার প্রতীক। কিন্তু ভিক্টোরীয় ধারনা যেহেতু প্রবলভাবে শ্বেতীগ্রস্থ, তাই এ ধারনায় চেহারাকে পাঠ করা হত এভাবে: সাদা মানুষের আত্না সাদা, আর কালো মানুষের আত্না কালো( বলা বাহুল্য, এ রংটি তাদের কাছে সমস্ত নেতির যোগফল)। রংয়ের এ রেসিস্ট পাঠটি পরবর্তীতে বিতর্কের মুখে পড়লেও চেহারার অন্তর্লীন প্রস্তাবটি অবিকৃত রয়ে গেছে।
পোর্ট্রেট ফটোগ্রাফির ইতিহাস তাই বস্তুত চেহারার মধ্যে দিয়ে আত্না খোঁজার ইতিহাস। মাবুদ জানে কে কি খুঁজে পেয়েছেন! বলে রাখা ভাল, প্রথমদিকে ফটোগ্রাফির উপর মানুষের প্রত্যাশা ছিল আজাইরা ও লাগামছাড়া। অনেকের ধারনা ছিল, ক্যামেরার মাধ্যমে জ্বীন-ভুতের ছবি তোলাও সম্ভব, এমনকি দু'একজন তুলেও দেখিয়েছেন! এসব হাস্যকর কাজের ব্যাকড্রপে আত্ন খোঁজার জেনুইন চেষ্টা জারি ছিল। ক্যামেরায় টেকনোলজির বিপ্লব হয়ত অনেককে আশাও দেখিয়েছে; কারণ, যত সার্প ছবি, আত্নার ততোই পরিস্কারভাবে হাজির হবার কথা। কিন্তু দেখা গেল, ব্যাপারটা এত সোজা না। তাই গত শতকের মাঝের পর থেকে শুরু হল নতুন জার্নি: ব্লার ছবি তোলা, এবার স্বেচ্ছায়। অনেকেতো আবার দাদার আমলের ফুটোগ্রাফার( পিনহোল ক্যামেরা দিয়ে) সেজে গেলেন। এরমধ্যে আমার রিসেন্ট ফেভ হল জেসিকা হিলটাউট, ঐ বিরল জিপসী রমণী যার জন্য আমার জান কোরবান।
এ লেখার উদ্দেশ্য এটা প্রমান করা নয় যে পোর্ট্রেট ফটোগ্রাফি আসলে লেইম; পোর্ট্রেট ফটোগ্রাফির আত্না( যদিও যত ইউরেকা শুনেছি, প্রাপ্তি অত ব্যাপক নয়)। আমার সমস্যা হল: মানুষের কয়টা চেহারা আর কোন্টা প্রতিনিধিত্বশীল।
আয়না ও আত্নপরিচয়:
অংগরাজ্যে ভিষন খরা। জমি, মানুষের মুখ, তার বাসনা ও ভবিষ্যৎচিন্তা সব ফেটে চৌচির। রাজার পাপেই যেহেতু রাজ্যনাশ তাই রাজাকেই তৎপর হতে হল। রাজার বীর্যবাহী কাপড় বন্ধ্যা জমিতে উর্বরতা আনে, কিন্তু খরার নিদানে তাও বেকার। ডাকা হল পুরোহিতদের। তারা সবাই একমত, আনা হোক ঋষ্যশৃঙ্গকে। সে সাধুপুরুষ, তার পূণ্যপদশ্পর্শে বিধাতা বিমুখ থাকবেন না।কিন্তু সেতো বনবাসী, সমাজ ও শহরের সমস্ত ইশারা ও হাহাকার থেকে স্বেচ্ছা নির্বাসিত! তাকে স্বস্থান থেকে বের করে আনা মানুষের কম্ম নয়! তাই নির্বাচন করা হল রাজ্যের শ্রেষ্ঠ নর্তকী তরঙ্গিনীকে, যার অ্যাপিল ট্রুলি ট্রান্সহিয়োমেন। তার তরঙ্গদৈর্ঘ্য বেদেরও অজানা। কিন্তু সে ভিতরে ভিতরে বেশ কর্পোরেট, তাই তার বর্তমান শিকার অর্বাচিন হলেও সে সখীসমবায়ে বেশ মান্জা মেরে গেল, দেখল। দেখল ঋষ্যশৃঙ্গও, তার জীবনের প্রথম নারীকে, এবং বলল, আনন্দ তোমার চোখে, আনন্দ তোমার মুখে, তুমি কি মানুষ নাকি ছদ্মবেশী দেবতা! নিশ্চই তুমি অনেক সাধনা করেছ, তাই এ লোকোত্তর সৌন্দর্য্য তোমার!
তরঙ্গিনী আড়ে হাসে, আর ভাবে, কি পাগলের পাল্লায় পড়েছি, বলে কিনা আনন্দ তোমার চোখে, আনন্দ তোমার মুখে! সে সখীসমেত প্রস্থান করে, পেছনে সৌন্দর্য্যের ঢেউ রেখে। ঋষ্যশৃঙ্গের সমাজবিরোধী মনে ভাবান্তর হয়, কারণ, আমরা ইতোমধ্যেই জানি, সৌন্দর্য্যই ভাবনার জন্মদাত্রী। ঋষ্যশৃঙ্গ বুকে চেপে বসা অচেনা বাসনায় কাতর হয়ে শহরের পথ ধরে।
শাস্ত্র বলে, ঋষ্যশৃঙ্গ শহরে পা দেবার সঙ্গে সঙ্গে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামে, আর অনেকদিন বৃষ্টি না হলে যেমন হয়, মানুষের স্বপ্ন ও বাস্তবতার স্পষ্ট ব্যবধান লুপ্ত হয়, তাই মানুষ ঘোর বর্ষণের মাঝেও নিজেদের সম্ভিত খুঁজে পাবার জোর চেষ্টা চালায়। ক্রমে তারা নিজেদের খুঁজে পায়, ঋষ্যশৃঙ্গ পায় রাজকন্যাকে, আর তরঙ্গিনীও স্থিত হয় তার নিজ আবাসে। সবাই সুখী, শুধু তরঙ্গিনীর ব্যাপক কর্পোরেট মনে ঘুরে ফিরে এক কথা, আনন্দ তোমার চোখে, আনন্দ তোমার মুখে! কই, কেউতো তাকে কখনো এভাবে বলেনি! তবে কি তার এমন মুখ ছিল যা শুধু ঋষ্যশৃঙ্গই দেখেছে? তরঙ্গিনী পাগল বেশে ঋষ্যশৃঙ্গের দরবারে গিয়ে দাবী জানায়, তুমি আমার ঐ মুখ ফিরিয়ে দাও।
ঋষ্যশৃঙ্গ বলে, তোমার ঐ মুখ তোমার মধ্যেই আছে। তুমি খুঁজে দেখ, পাবে।
ট্রু ফেস: বুদ্ধদেব বসু তার তপস্বী ও তরঙ্গিনী নাটকে ইয়েট্সের কবিতার ভারী সুন্দর একটা লাইন তুলে দিয়েছিলেন: I was looking for the face I had before the world was made. আমার জীবনে যে অল্প কয়েকটি বাক্য সবচে মোহগ্রস্থ করে রেখেছিল তারমধ্যে এটি অন্যতম। পরে যখন বুদ্ধধর্ম নিয়ে বিশদ পড়ি, জানতে পারি, এ চিন্তাটি মূলত বুডিস্ট কোয়ান(koan) থেকে আসা। বুডিস্ট কোয়ান হলো মেডিটেশনের জন্য প্রস্তুত আপাত-অ্যাবসার্ড কিছু প্রশ্ন, যেমন: একহাতে বাজানো তালির শব্দ কেমন? অথবা, আমার দাদার জন্মের আগে আমার চেহারা কেমন ছিল? এর আন্ডারলাইং ফিলোসফিটি বলে, আমাদের সংসারচিন্তা আমাদের মনকে বিক্ষিপ্ত করে রাখে, ভাবনাকে গভীরে যেতে বাধা দেয়। তাই, এই অ্যাবসার্ড বাক্যগুলো নিয়ে যখন কেউ ধ্যান করে, তার অগভীর ভাবনাগুলো তিরোহিত হয়, তার মন নিটোল পুকুরের মত হয়ে যায়। এই শান্ত, স্থির মনে যে মুখ ফুটে ওঠে সেটাই আমদের সত্যিকার মুখ, ট্রু-ফেস।
বিলাপ: সস্তা মাগীদের মতো গালে রং করা বিকালটাতে, বিকালের ভিতরে শুয়ে থাকা শহরের লাসটাতে, তার নাড়িভূড়ি ও বিস্তৃত মিথলজিতে, আমি মানুষ দেখি, ফ্লুইড ও পেরেশান মানুষ। তাদের সমস্ত কর্মপ্রচেষ্টা, আকুলিবিকুলি একটা চেহারাকে ঘিরে ক্রমাগত পাক খেতে থাকে।
মানুষের কয়টা চেহারা! গভীর এবং জটিল ফিলোসফি
লেখা খুব ভালো লাগলো।
লেখাটা খুব ভালো লাগলো।
এই ব্লগে কোয়ালিটি লেখার অভাব নাই।
ধন্যবাদ
বিকেলের এরকম উপমা এ জিবনে শুনি নাই। জিবনে কতটুকুই বা শুনেছি
এটুকু বাদ দিয়ে বাকি লেখাটুকু ভাল লেগেছে
হা হা।
আমি জানি শব্দটা ন্যারেটিভের সাথে যায় না।
যেদিন আমি এ পার্টটা লিখছি, আমার মন খারাপ ছিল।
তাই এটা লেখার মধ্যে চলে এসেছে।
পরে আর বাদ দেইনি, মায়া জন্মে গেছে।
জটিল, ভালো লাগছে। একটু কঠিন লাগছে আর কি
অনেক অনেক ভালো লাগলো। একটু ডিফরেন্ট।
চেহারা পড়তে এসে আপনার চেহারা পরিচিত মনে হচ্ছে।
লেখা ভালো লাগছে।
চেহারা পড়তে এসে দেখি আপনার চেহারাটা পরিচিত।
লেখাটা ভালো লাগলো
চেহারা নিয়ে আমি প্রথম ভাবি পাবলো নেরুদার একটা কবিতার প্রথম বাক্যের এক আজীব এসারশান শুনে যেখানে তিনি বলেন, " আমি বলতে অনেক লোককে বুঝায়"।
তাহলে কি মানুষ প্লুরাল, ভিতরে ভিতরে ভাঙ্গা?
'সেল্ফ' কি তাহলে জোড়াতালি মারা?
পরে দেখলাম ও দুঃখ পেলাম।
ধুর, এসব সামাজিক নির্মাণ।
এটার মধ্যে ইনেট কিছুই নাই।
ব্যক্তি সমাজের বিভিন্নখান থেকে অবিরত ধার করে করে তার সামাজিক চেহারা(public persona) বানায়।
উত্তম কুমারের হাসি+বোগার্টের দাড়ানোর ভঙ্গি+ডি নীরোর কথা বলার স্টাইল... ইত্যাদি ইত্যাদি
পুরা ইতরামি!!
এখানে এমনসব বিসদৃস বস্তু থাকে যা যোগ করলে পার্সোনালিটি হয়না; কাঁচা বাজারের ব্যাগ হয়।
এ সত্য আমার জন্য একটা ধাক্কার মত ছিল। কারন, আগে কিছু মানুষের পার্সোনালিটি দেখে সম্ভ্রম জাগতো।
এখন বাজারের ব্যাগের মত দেখি, দেখি জনাব কি কি কিনলেন।
আমরা আসলে একটা সময়ের পর আর বড় হইনা, আমরা একটা আপত্তিকর রকমের দীর্ঘ্য, বিলম্বিত শৈশবের মধ্যে নিজেদের হারিয়ে ফেলি
কেউ শৈশবকে জড়িয়ে রাখি(I go carrying my childhood like a favorite flower that perfumes my hand-Gabriela Mistral)
কেউ কেউ এটা থেকে পালাবার ব্যর্থ চেষ্টা করে যায়।
আমি নিজেই আমাকে চিনিনা, ফটোগ্রাফার সাহেব কছু বুঝবেন?
জীবন আমরা কাছে, তাই, একটা চেহারা পাবার চেষ্টা......
লেখাটা পড়ার জন্য সবাইকে ধন্যবাদ।(যেমন, এ বাক্যের মধ্যে আমার চরিত্রের মধ্যে আপ্যায়নতা যোগ করলাম, সবাই তালি দেন।)
চেহারার দর্শন বিষয়ে বড় কোনো লেখার অ্যাবস্ট্রাক্ট মতোন লাগলো...ইন্টারেস্টিং বিষয়। তবে কয়েকটা মতবিরোধও তৈরী হইছে। যেমন, সাদা আর কালো রঙের চেহারার উল্লেখে বেশ সাধারণীকরণ হইছে। আমার যেমন মনে হইছে সাদা আর কালো হইলো আলো আর অন্ধকারের সিমিলি। আলোর নিরাপত্তা আর অন্ধকারের নিরাপত্তাহীনতা থেইকা সাদা আর কালোর নৈতিকতাবোধ তৈরী হওয়ার বিপুল সম্ভাবনা আছে। তারপর সাদা'র রেইসিজমের পাশাপাশি আমরা কালো'র রেইসিস্ট অ্যাপ্রোচটাও দেখতে পারি। এইটা কেবল সাদারা অত্যাচার করে বিধায় কালো'রা সাদাগো দেখতে পারে না, বিষয়টারে আমার এমন সাধারণও লাগে না।
সস্তা মাগীদের রাঙানো গালের মতোন বিকাল বিষয়ক সিমিলিটা অন্য রকম হইছে। কিন্তু যেই পোস্টে নৈতিকতার দার্শনিক ডিসেক্ট করার চেষ্টা করা হইছে সেইখানে রাঙানো গাল কিম্বা সস্তা মাগী এই দুই সামাজিক মূল্যবোধ নিঃসৃত অস্তিত্বের উপমা খুব জুইতের লাগে না। যদি এইটা গোধুলীর রং হিসাবে উল্লেখ করা হয় তাইলে অনুভূতিটা আমারে অন্ততঃ স্পর্শ করে নাই। মাগীরা গাল রাঙাইলে বিষয়টা বেশ দৃষ্টি আকর্ষণী হয়, তার উপর সস্তা'র আরোপন আরো উচ্চকিত করে অনুভূতিরে। কিন্তু গোধুলী কখনোই উচ্চকিত কোনো অনুভূতি তৈরী করে নাই...বরং বিষন্নতা এইখানে ডমিনেন্ট বেশি।
ট্রু ফেইস উল্লেখরে আমি প্রথমে টু ফেইস পড়ছিলাম...গ্রামাটিকাল ভুল হইলেও পোস্টের সাথে তার অন্তর্নিহিত অর্থটা যায়। ডঃ জেকিল আর মিস্টার হাইড তো আসলে তাবৎ দুনিয়ার রূপকার্থে আসে।
অনেকাংশে সহমত
১।সাদা, কালো-এ বাইনারীগুলোর একরৈখিক বয়ান সম্ভব না এটা আপনি জানেন। তবে এর ভিক্টোরিয়ান পাঠটির রেসিস্ট বায়াস ছিল।
২। আমার লেখার একটা ডায়রি মুল্য আমার কাছে আছে। আমি কিছুদিন পর পড়লে যে সময় লিখেছিলাম ঐ সময়টার কথা মনে পড়ে।'সস্তা মাগী'র ইমেজটি তাই রেখে দিয়েছি যদিও জানতাম এটা ইতোপূর্বে সযত্নে তৈরী করা টোনটা নষ্ট করে দেবে। করেছেও। শব্দটা আসলেই আলাদা হয়ে দাড়াচ্ছে। কিন্তু দেখেন, আমার বাকী ইমেজগুলোও(লাশ, নাড়িভুড়ি) কিন্তু ইনটেনশানালি মরবিড।
মন্তব্য করুন