ইউজার লগইন

শুনবেন সেই সব গল্প ?

আড্ডা চলছে - পুরনো দুজন কলিগ বেড়াতে এসেছেন - হারানো সময়ের ভালোলাগা অনেক কথা উঠে আসতে শুরু করেছে - পরিবেশটা বেশ উপভোগ করছি - হুট করেই একজন জিজ্ঞেস করলেন - একটা চাকরি দিতে পারেন ? - আমি কিছুটা অবাক হয়েই তাকালাম - কাউকে চাকরি দেবার মত অবস্থানে আমি এখনো পৌঁছাইনি - আমার বন্ধুদের কেউ হয়ত পারবে এই ভেবে জিজ্ঞেস করলাম - কার জন্য ? ভদ্রলোক চুপ করে গেলেন - কিছুটা যেন দ্বিধাগ্রস্ত - আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম - চাকরিটা কার প্রয়োজন ? ভদ্রলোক নিরুত্তর - পরিবেশটা ও কেমন যেন একটু গুমোট হয়ে গেল - অস্বস্তি কাটাতেই প্রসঙ্গ বদলে ফেললাম - অল্পক্ষণেই আরষ্টতা কাটিয়ে আমরা আবার গল্পে মেতে উঠলাম.
'বুঝলেন - একটা মেয়ে আছে - ভালো মেয়ে' - ভদ্রলোক নিজে থেকেই বলছেন আবার - 'একটা চাকরির খুব দরকার ওর'.
আপনার কোনো আত্মীয়া নাকি ? জিজ্ঞাসা আমার.
না - চিনি আর কি.
বুঝলাম - থলের বেড়াল বেরোতে শুরু করেছে . কাছের কেউ?
না - পরিচিত - মানে- মেয়েটা একটু অন্য ধরনের পেশায় আছে.
আমার পোড় খাওয়া মনের কোথায় যেন একটা সতর্ক ঘন্টি বেজে উঠলো - মনে করার চেষ্টা করছি - ভদ্রলোক সম্বন্ধে কতটুকু জানি - বিবাহিত - দু সন্তানের জনক - ভাবীকেও দু’ একবার দেখেছি - রীতিমত সুখী পরিবার - তাহলে সমস্যা কোথায় ?
অন্য ধরনের পেশা মানে?
ওই যে আপনারা বলেন না - (...) গার্ল.
আমি মোটামুটি চমকে উঠলাম - কি বলছেন ভদ্রলোক ?
আপনি কিভাবে চেনেন ?
পরিচয় আছে আর কি - মেয়েটা এই পেশায় থাকতে চায় না - এই জন্যই চাকরিটা প্রয়োজন - আমাকে খুব ধরেছে.
আমার ততক্ষণে বিরক্ত লাগতে শুরু করেছে - চরিত্রের কথা বাদই দিলাম - ভদ্রলোকের আক্কেলটাই বা কেমন - এধরনের একটা মেয়ের তরফদারী করছেন .
সাফ না বলে দিলাম - আড্ডা আর জমল না - ভদ্রলোক লজ্জিত হয়ে উঠে দাঁড়ালেন - সাথে সঙ্গীও - তাড়াহুড়ো করে বিদায় নিয়ে তারা চলে গেলেন.
তারা যাবার পরই খারাপ লাগতে শুরু করলো - রাগ করলাম কেন - ভদ্রলোক অন্যায় কি বলেছেন ? মেয়েটার অপরাধই বা কি ? - অভাবের তাড়নায় ভুল পথ বেছে নিয়েছিল - এখন শুধরাতে চায় - আর ভদ্রলোকের চরিত্র নিশ্চয় প্রশ্নবিদ্ধ - কিন্তু ওই রকম একটা মেয়ের উপকারের জন্য নিজের সামাজিক মর্যাদার উপর ঝুঁকি নিয়ে আমার কাছে এসেছেন - নিজের অপরাধও গোপন করেননি - রীতিমত দু:সাহসের পরিচয় দিয়েছেন - মানবিক দিকটাও তো উপেক্ষার উপায় নেই - অপরাধ তো অনেকেই করেন - অপরাধ পরবর্তী এতখানি সাহস কজন দেখাতে পারেন ?

আমার মনে তখন ঝড় উঠেছে - খন্ড খন্ড সব গল্প ভাসছে চোখের সামনে - শাসাচ্ছে আমাকে - অভিযোগ তুলছে পক্ষপাতের - প্রশ্নবিদ্ধ করছে বিবেক কে - সময় হবে আপনাদের ?- শুনবেন সেই সব গল্প ?

গল্প ১ : ঢাকা - কোচটা মাত্র ছাড়ছে - গন্তব্য রাজশাহী - গল্পের শুরু এখানেই - সামনের দিকের আসনে এক সুখী যুগল কে দেখা যাচ্ছে - খুনসুটিতে ব্যস্ত তারা - একটু পেছনেই বসে আছে আরেক যুবা - সারল্য মাখা মুখে তার তীব্র ব্যথার অভিব্যক্তি - চোখ ভরা অভিমান - দৃষ্টি স্থির সামনের যুগলের উপর - বুকের মাঝে ভাঙ্গনের কর্কশ আর্তনাদ - এই যাত্রাপথে নিজের উপস্থিতি তার কাছে এক দুঃস্বপ্নের মত - যদিও শুরুটা ছিল স্বপ্নের মত সুন্দর - গল্পের সূত্রপাত রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে - প্রেমের গল্প - জগতের সবচেয়ে সুখী মানুষ তখন ওই যুবা - অসম্ভব মেধাবী ছাত্র সে - পাশে তার স্বপ্নের নারী - জীবন যেন বিরল ঐশ্বর্য্য উপঢৌকন করে সাজিয়ে দিয়েছে তার পাদমূলে - দুটি পরিবারই জানত এই সম্পর্কের কথা - বিয়ে প্রায় ঠিকঠাক - গ্র্যাজুয়েশন শেষে ছেলে পাড়ি দিল ঢাকায় - মাস্টার্স ডিগ্রী প্রাপ্তির মূল্যবান সুযোগটা অনাদরে ছেড়ে গেল সে - একটা চাকরি যে তখন খুব বেশি প্রয়োজন - চাকরি সে পেল ঠিকই - কিন্তু মেয়ের মন তাতে ভরেনি - কবে ছেলের উন্নতি হবে, বুদ্ধিমতী (!) মেয়েটি সে ধৈর্য পরীক্ষায় যায়নি - বেছে নিয়েছে অন্য একজনকে - সম্পর্কটা মিথ্যে হয়ে গেল - মিথ্যে হয়ে গেল দুটি পরিবারের মাঝে দেয়া কথাগুলো - বিশ্বাসঘাতকতার চরম নিদর্শন প্রদর্শিত হলো - কাউকে না জানিয়ে মেয়েটি বিয়ে করলো - ওই যে সুখী যুগলটি দেখতে পাচ্ছেন - ইনিই সেই রমনী - পাশে তার নতুন সঙ্গী - আর পেছনে ভাঙ্গা হৃদয় নিয়ে উপবিষ্ট মানুষটিই আমাদের সেই যুবা - এমন কেন হবে বলুন তো ? মানুষকে বিশ্বাস করা কি তবে অপরাধ?

গল্প ২ : মাঝরাত - মসজিদের পাশেই ঘুটঘুটে আঁধারে শরীর লুকিয়ে ছেলেটি দাঁড়িয়ে আছে - দৃষ্টি নিবদ্ধ সামনের বাড়িটির উপর - সম্ভবত বিয়ে বাড়ি - অন্তত আলোকসজ্জা তাই বলে - কি দেখছে ছেলেটি - আলো ? গাড়ি বারান্দায় সারি করে রাখা বাহনগুলো ? নাকি অন্যকিছু ? - ওখানে আলো - কিন্তু এখানে - ছেলেটির বুকের শুন্য কোঠরে শুধুই আঁধার - নিকষ কালো আঁধার - ওই বাড়িতেই থাকত তার ভালবাসার মানুষটি - কত স্বপ্ন - কত প্রতিশ্রুতি - সব তাহলে মিথ্যে - সব কপটতা - সবই অভিনয় - ভেজা চোখ দুটো কখন যেন শুকাতে শুরু করেছে - চোয়ালের হাড় দুটো হয়ে উঠেছে শক্ত - ভেতরের মানুষটা তার মরে যাচ্ছে - ঠায় দাঁড়িয়ে আছে সে - ভোর তো প্রায় হয়ে এলো - ওই শোনা যায় আজানের ধ্বনি - এবার হাঁটছে সে - এ যেন এক নতুন মানুষ - পিছনে ফেলে যাচ্ছে সব - ফেলে যাচ্ছে তার স্বপ্ন - তার বিশ্বাস - অকপট সারল্য - আর সম্ভবত বিধাতা নামের অপারগ সেই সত্তাকেও.

গল্প ৩ : একটি চিঠি :
শেষ চিঠি আমার - পড়বে তুমি ? সময় হবে তোমার ? আশা করতে ভয় পাই - সবার জন্য সময় আছে তোমার - শুধু আমার বেলায় তুমি অপারগ - এবার একটু সময় কর - এই চিঠিটা অন্তত পড়.
তোমার বিয়ের খবর পেয়েছি - তুমি জানাওনি - জেনেছি তোমার বন্ধুর কাছ থেকে - খুব সুন্দরী ও - তাই না? - না - রাগ করিনি - আমাদের মাঝে যা ছিল ত়া তো তুমি অনেক আগেই শেষ করেছ - তোমাকে সবার চেয়ে আলাদা ভাবতাম - ভাবনাটা যে ভুল ছিল অনেক দেরিতে বুঝেছি - বিশ্বাস করেছিলাম বলেই কি কষ্ট দিলে ? এবার সত্যিই চলে যাচ্ছি - ভালো থেক - আমাকে ঠকিয়েছ - ক্ষমা করলাম - পরিনীতাকে অন্তত ঠকিও না.

পুনশ্চ ১: ফেসবুকে লিখা খুব বিপজ্জনক - সবাই ভাবে - এটা বোধহয় মানুষটার নিজের গল্প - তিনটি গল্পই নিরেট সত্য - প্রথম দুটি আমার ঘনিষ্ঠতম দুই বন্ধুর জীবন থেকে নেয়া - তৃতীয়টি এক শুভার্থিনীর চিঠি (তার অনুমতিক্রমে মূলভাব বজায় রেখে ভাষাগত কিছু পরিবর্তন করে প্রকাশ করলাম) - আমার দায়িত্ব ছিল চিঠিটা গন্তব্যে পৌঁছানোর - যে কোনো কারণেই হোক, আমি ত়া পারিনি.

পুনশ্চ ২: অসহায় একটি মেয়ে শরীরের বিনিময়ে জীবিকা নির্বাহ করলে তাকে যদি আমরা অস্পৃশ্য বলি - নিশিকন্যা ডাকি - তবে শুধু স্বার্থের জন্য যারা মানুষের বিশ্বাস - স্বপ্ন - জীবন - এমনকি অস্তিত্ব নিয়ে খেলে - তারা ছেলে হোক কিংবা মেয়ে - তাদেরকে পতিত অথবা পতিতা বলতে আমার অন্তত বাঁধে না - সভ্য সমাজের হয়ত বাঁধে.

পোস্টটি ৭ জন ব্লগার পছন্দ করেছেন

তানবীরা's picture


অসহায় একটি মেয়ে শরীরের বিনিময়ে জীবিকা নির্বাহ করলে তাকে যদি আমরা অস্পৃশ্য বলি - নিশিকন্যা ডাকি - তবে শুধু স্বার্থের জন্য যারা মানুষের বিশ্বাস - স্বপ্ন - জীবন - এমনকি অস্তিত্ব নিয়ে খেলে - তারা ছেলে হোক কিংবা মেয়ে - তাদেরকে পতিত অথবা পতিতা বলতে আমার অন্তত বাঁধে না - সভ্য সমাজের হয়ত বাঁধে.

হুম।

গল্প ----- ভাল লেগেছে

হাসান আদনান's picture


ধন্যবাদ তানবীরা আপু।

রায়েহাত শুভ's picture


ভালো লাগলো লেখাটা...

অনিমেষ রহমান's picture


জীবনের অনেক কষ্ট সত্য না হলে জীবন নিয়ে আরো আনন্দে থাকতাম।
চমতকার লিখেছেন।

বিষণ্ণ বাউন্ডুলে's picture


টিপ সই

মন্তব্য করুন

(আপনার প্রদান কৃত তথ্য কখনোই প্রকাশ করা হবেনা অথবা অন্য কোন মাধ্যমে শেয়ার করা হবেনা।)
ইমোটিকন
:):D:bigsmile:;):p:O:|:(:~:((8):steve:J):glasses::party::love:
  • Web page addresses and e-mail addresses turn into links automatically.
  • Allowed HTML tags: <a> <em> <strong> <cite> <code> <ul> <ol> <li> <dl> <dt> <dd> <img> <b> <u> <i> <br /> <p> <blockquote>
  • Lines and paragraphs break automatically.
  • Textual smileys will be replaced with graphical ones.

পোস্ট সাজাতে বাড়তি সুবিধাদি - ফর্মেটিং অপশন।

CAPTCHA
This question is for testing whether you are a human visitor and to prevent automated spam submissions.

বন্ধুর কথা

হাসান আদনান's picture

নিজের সম্পর্কে

কিছু মানুষ জন্মায় - একাকিত্বের বীজমন্ত্র নিয়ে - জীবন তাদেরকে খেলায় - নাকি তারা জীবন কে নিয়ে খেলে - বোঝা দায় - সম্পর্ক - সেটা বন্ধুত্বের হোক - হোক ভালবাসার কিংবা রক্তের - তারা এড়িয়ে চলে - কিংবা কে জানে - বন্ধনে জড়ানোর যোগ্যতা হয়ত প্রকৃতি তাদের কে দেয়নি - অর্থহীন জীবন - মাঝরাতে দুঃস্বপ্ন দেখে জেগে ওঠা - তারপর অঘুমো বিভীষিকাময় মুহূর্ত গুলো - তবু কাউকে ডাকা নয় - ডাকার জন্য যে প্রণোদনা লাগে তারা তা হারিয়ে ফেলেছে - শুধু ভোরের প্রতীক্ষা - যদিও জানে - ভোর আসবে না - এসব মানুষের জীবনে ভোর আসেনা- আসতে নেই - প্রসারিত কোনো হাতেই এরা হাত রাখে না - বিশ্বাস এদের নড়ে গেছে শুরুতেই - যেন সিজোফ্রেনিয়ার রোগী - এক বিচিত্র জগৎ - কোনো বন্ধন নেই - ভুল হলো- একটি বন্ধন আছে - থাকে - বিধাতার সাথে - সে বন্ধনে কখনো প্রার্থনা থাকে - কখনো ঘৃণা - কখনো অসম লড়াই - আর কখনো সীমাহীন - ব্যাখ্যাতীত অভিমান (আমি হয়ত এমনই একজন )