ম্যান বিহাইন্ড দা গ্লাস বার
এই মিলে তিনবার গোনা হলো - না - কোনো ভুল নেই- দশ হাজার টাকা কম পড়ছে - এই শীতের সন্ধ্যায়ও মাসুমের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম - মাথাটা কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে - তার ভাগ্যটা এত খারাপ কেন - এত সতর্ক থাকে- তবু ... আজকে কাস্টমারের চাপটা বেশি ছিল - অনেকগুলো বড় পেমেন্ট হয়েছে - কোথাও একটা ভুল হয়ে গেছে - কিন্তু শোধরাবার সুযোগ কি আছে?
দু'বছর হলো এই চাকরিতে ঢুকেছে মাসুম - ব্যাঙ্কের চাকরি - ক্যাশ অফিসার - কাজের চাপটা বেশি - সেটা সমস্যা না - কিন্তু সার্বক্ষণিক ঝুঁকিটা বড় পীড়াদায়ক- সামান্য অসতর্কতার দণ্ডি দিতে হয় গুনে গুনে - উপরন্তু আছে ম্যানেজারের গালাগালি - না - মাসুম অসতর্ক নয় - কাজের সময় সাধ্যমত সাবধানতা অবলম্বন করে - কাজেও সে দক্ষ - তবু নিয়তির মার তো এড়ানো যায় না.
মাসুম পেমেন্টে বসে - তার দায়িত্বটাও বেশি - রিসিভের ছেলেটি একেবারেই নতুন - মাসুম তাকে চোখে চোখে রাখে - পাছে বেচারা বিপদে পড়ে - কিন্তু আজকের বেচারা যে সে নিজেই.
পোস্টিং রিপোর্টটা হাতে তুলে নেয় মাসুম - অভ্যস্ত হাতে পেমেন্ট ইন্সট্রুমেন্টগুলো ট্যালি করতে থাকে - অভিজ্ঞ চোখে খুঁজতে থাকে অসঙ্গতিটা - না - কোথাও ভুল নেই - সব ঠিক আছে - তাহলে টাকাটা গেল কোথায় ? মাসুমের অস্থির লাগে - বুঝতে পারে - কোনো একটা পেমেন্টে সে ভুল করেছে - হাজার দশেক টাকা বেশি দিয়েছে কাউকে - কিভাবে সে এত বড় একটা ভুল করলো - মাথার চুল ছিড়তে ইচ্ছে করে তার.
কি একটা জীবন - এন্ট্রি লেভেল পোস্ট - সীমিত বেতন - সর্বোচ্চ ঝুঁকি - রাগ হয় - অক্ষম রাগ - হয়ত নিজের উপরই - এই যে গ্লাসের পেছনে সকাল থেকে দাঁড়িয়ে থাকা - প্রতিটি মুহূর্ত চাপে থাকা - কাস্টমারদের হুড়াহুড়ি - তাড়া দেয়া - কখনো বা ভব্যতার সীমা ছাড়ানো মুখ খিস্তি - ঊর্ধ্বতন অফিসারের কটুক্তি - ম্যানেজারের তাচ্ছিল্য ভরা ভ্রুকুটি - মনটা তিতা হয়ে যায় - তবুও চাকরি - দরিদ্র দেশে জীবিকার একটা অবলম্বন - তাই মানিয়ে চলা.
মাসুমের কেমন যেন দিশেহারা লাগে - মনে করতে চেষ্টা করে - আজকের পেমেন্টের মুহুর্তগুলো - কোথাও কোনো অস্বাভাবিকতা ছিল কি - কই - কিছু তো মনে পড়ে না - আজ কিভাবে সে ক্যাশ মিলিয়ে যাবে - চিন্তা থমকে যায় তার.
মাসের আজ বারো তারিখ মাত্র - এর মাঝেই হাত প্রায় শুন্য - বাবাকে ডাক্তার দেখাতে হবে - নব্য পরিনীতার সামান্য আবদার - সেটাও পূরণ করা হয়নি - ছোট বোনটার কলেজের ফিস - নিত্যদিনের এই না
থাকার হাহাকারে জীবন যখন বিপর্যস্ত - এই উপরি দশ হাজারের সংস্থান সে কিভাবে করবে?
কাঁচ ঢাকা ঘরটায় ম্যানেজার বসেন - বদরাগী মানুষ - কটুভাষী - ক্যাশ অফিসার দেরকে তিনি মানুষ মনে করেন না - এমনিতেই অপমানজনক কথা বলেন - ভুল পেলে তো কথাই নেই - মাসুমের গলা শুকিয়ে আসে.
ক্যাশের লাগা ডেস্কেই হাসান ভাই বসেন - ব্রাঞ্চে এসেছেন মাস তিনেক মাত্র - প্রবেশনারী অফিসার - চুপচাপ মানুষ - কাজ নিয়ে মগ্ন থাকেন - আন্তরিক - মাসুমের বড় ভালো লাগে - মনে মনে ভাবে - এই মানুষটা ম্যানেজার হলে কি ভালই না হত - কি ঠান্ডা মানুষ - রাগের লেশমাত্র নেই - না - ভুল হলো - ওই ঠান্ডা চেহারার পিছনে এক ধরনের আগুনও যেন লুকানো আছে - সময় সময় তার ঝলক যেন দেখা যায় - সব প্রবেশনারী অফিসাররাই বুঝি এমন হয়.
মাসুম বুঝতে পারে না কি করবে - ম্যানেজার কে বললে ব্রাঞ্চে এখনই আগুন লাগবে - হাসান ভাইকে কি টাকার ব্যাপারে বলবে - উনি হয়ত ব্যবস্থা করে দেবেন - মাসুমের বড় লজ্জা লাগে - কিভাবে বলবে - হতে পারে সে ছোট অফিসার - কিন্তু আত্মসম্মান জ্ঞান তার প্রখর - কিভাবে সে টাকা চাইবে - ভাই তাকে কি মনে করবেন - হাজারটা চিন্তা খেলা করতে থাকে মনের ভিতর.
মাসুম ভাই - কোনো সমস্যা ?
মাসুম চমকে যায় - খেয়ালই করেনি কখন যেন হাসান ডেস্ক ছেড়ে উঠে এসেছে.
মাসুম কোনো উত্তর দিতে পারে না - তবু কিভাবে যেন হাসান সব বুঝে ফেলে - নরম সুরে জিজ্ঞেস করে - কত টাকা? মাসুম এবার উত্তর দেয় - হাসান নিজেই চেক করতে বসে - এক পর্যায়ে নিশ্চিত হয় টাকাটা পাওয়া যাবে না - তবু হেসে আশ্বাস দেয় - নিজেই ম্যানেজারের চেম্বারে যায় - ওখানে কি কথা হয় মাসুমের জানা হয় না - কিন্তু কিভাবে যেন টাকাটা ম্যানেজ করা হয় - ম্যানেজার আগুন চোখে তাকান - কিন্তু কেন যেন কিছু বলেন না - মাসুমের ক্ষীণ সন্দেহ হয় - এখানে হয়ত হাসান ভাইয়ের হাত আছে - হাসান কিছুই স্বীকার করে না - শুধু ভবিষ্যত সতর্কতার পরামর্শ দেয়.
একজন মাসুমের গল্প এখানেই শেষ - শেষ ওই হাসানের গল্পও - মাসুম একদিকে ভাগ্যবান যে টাকার পরিমাণ খুব বেশি ছিল না - যদি সেটা হত - তবে হাসানের ভুমিকা হয়ত কোনো কাজেই আসত না - ম্যানেজারের মুখ এবং কলম কোনটাই থেমে থাকত না - তার ভয়াবহ পরিণতি সহজেই অনুমেয়.
পরিশিষ্ট ১: আমি শুধু একজন মাসুমের গল্প বললাম - কিন্তু আরো অনেক মাসুমের গল্প যে না বলা রয়ে গেল - ব্যাংকের এন্ট্রান্স ঠেলে ঢুকলেই দেখবেন কাঁচ ঢাকা কাউন্টার গুলোতে মাসুমেরা দাঁড়িয়ে আছে - শুধু আপনাদেরকে সার্ভিস দেবার জন্য - ওরা দিনমান ওখানে দাঁড়িয়ে থাকে - যাদের চতুর্দিকে লক্ষ কোটি টাকার সার্বক্ষণিক উপস্থিতি - তাদের মজুরি বড় স্বল্প - প্রতি মুহুর্তে কঠিন স্নায়ু পরীক্ষা - সীমাহীন ঝুঁকির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে দায়িত্ব পালন - তবু ওদের রাগ নেই - ক্ষোভ নেই - লোভ নেই- ক্লেশের প্রকাশ নেই - সনির্বন্ধ অনুরোধ আমার - কাউন্টারের সামনে দাঁড়িয়ে ওদেরকে তাড়া দেবেন না - অযথা চাপে ফেলবেন না - কটু মন্তব্যে ওদের আত্মসম্মানকে খাটো করবেন না - জানি - আপনাদের সময়ের দাম আছে - তবু একবার ভেবে দেখবেন - আপনার দুটো মিনিট বাঁচানোর জন্য হয়ত ওদের পুরো জীবনটাই ধ্বংস হয়ে যাবে.
পরিশিষ্ট ২ : আমার ক্ষুদ্র ব্যাংকিং ক্যারিয়ারে সহকর্মী ক্যাশ অফিসারদের কাছ থেকে পেয়েছি উষ্ণ ভালবাসা আর অমূল্য সহমর্মিতা - কোটি টাকার মাঝে দাঁড়ানো এই স্নায়ুযোদ্ধাদেরকে নিজের সহোদর ভাবতে আমার বড় ভালো লাগে - এরাই তো প্রকৃত নায়ক - আমার চোখে এরা যেন - 'ম্যান বিহাইন্ড দা গ্লাস বার'.
ঠিক বলেছেন
কবে যে দেশ থেকে ক্যাশ হ্যানডেলিং বিদায় হবে আর মাসুমরা শানতি পাবে
মন্তব্য করুন