একজন গ্ল্যাডিয়েটর
একজন গ্ল্যাডিয়েটর
বিরক্তিকর অথচ অবশ্য প্রয়োজনীয় অ্যালার্মটা বাজতে শুরু করেছে - অনাকাঙ্খিত শব্দ তরঙ্গ চিরে দিচ্ছে ঘরের নিস্তব্ধ আবহ - মানুষটার সুপ্ত স্নায়ুতে সাড়া পড়তে থাকে - মস্তিস্ক শরীরকে জানান দেয় - এবার জাগতে হবে - ধীরে ধীরে মানুষটা চোখ মেলে - এ যেন প্রাণান্ত আয়াস - শরীরের প্রতিটি কণিকা যেন অতিরিক্ত পাঁচটি মিনিট সুখনিদ্রার জন্য আকুল হয়ে থাকে - কিন্তু না - সেটা সম্ভব নয় - যদিও ঘর এখনো অন্ধকার - জানালার শার্সিতে লালচে আভাস দিনের আগমনী বার্তা ঘোষণা করছে.
পাশে শুয়ে থাকা সঙ্গিনীর ঘুম এখনো ভাঙ্গেনি - ঘুমে অচেতন প্রাণপ্রিয় শিশুপুত্র ও - মানুষটা এক মুহূর্ত যেন থমকে যায় - কি এক নির্মোঘ মোহে তাকিয়ে রয় ভালবাসার মানুষগুলোর দিকে - বুক চিরে বেরোয় অকারণ দীর্ঘ নি:শ্বাস - অত:পর গা ঝাড়া দিয়ে আলস্য কাটায় - স্নায়ু এখন তার পূর্ণ সজাগ এবং প্রস্তুত - প্রস্তুত লড়াইমুখর একটি নতুন দিনের জন্য - রাতে বিছানায় ঘুমিয়েছিল একজন বাবা - একজন স্বামী - জেগে উঠেছে একজন লড়াকু যোদ্ধা - একজন গ্ল্যাডিয়েটর.
তারপরের কাজগুলো রুটিন বাঁধা - প্রাত:কৃত্য - স্নান - ক্ষৌরি - কাজের ফাঁকেই মাথাটা খেলতে থাকে - দিনের কর্ম তালিকা গুছিয়ে নেয় মনের কোণে - যদিও জানে - তালিকার অধিকাংশ দায়িত্বই অসমাপ্ত থেকে যাবে দিনের শেষে - এর মাঝে সঙ্গিনীর ঘুম ভাঙ্গে - রান্নাঘর থেকে ভেসে আসে পরিচিত গৃহস্থালী শব্দ - সংক্ষিপ্ত প্রার্থনা আর প্রস্তুতি সেরে গ্ল্যাডিয়েটর যখন নাস্তার টেবিলে - ঘড়ির কাঁটা তখন বিপদসীমা ছুঁইছুঁই - টেবিলে তেমন একটা কথা হয়না - সঙ্গিনী এটা ওটা এগিয়ে দেয় - সময়ের তাড়াটা দুজনেই বোঝে - নাকে মুখে খানিকটা গুঁজেই গ্ল্যাডিয়েটর উঠে দাঁড়ায় - সঙ্গিনীর চোখে ফুটে ওঠা হতাশা দেখেও যেন না দেখার ভান করে - বেরোবার আগে পুত্রের মুখটা একবার দেখে নেয়া - টিফিন ব্যাগটা হাতে তুলে নেয়া - এটাই যেন শরীরী বিদায় সম্ভাষণ - এর চেয়ে বেশি নয় - এস্ত পায়ে সিঁড়ি বেয়ে নেমে যায় গ্ল্যাডিয়েটর - সঙ্গিনী তখনও দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে - হয়ত কিছুটা আশাহত - যাবার সময় মানুষটা কিছুই বলে গেল না - নিদেন পক্ষে একবার ................ এই যান্ত্রিক শহর মানুষটার সব আবেগ কি তবে কেড়ে নিল ? বুক চিরে বেরিয়ে আশা দীর্ঘনি:শ্বাসটা অনেক কষ্টে আটকে রাখে মেয়েটি - কিন্তু তার জানা নেই - ওই একই দীর্ঘ নি:শ্বাস সিঁড়ি বেয়ে নেমে যাওয়া মানুষটিকে ক্ষত বিক্ষত করে প্রতিনিয়ত.
রাস্তায় নেমেই গ্ল্যাডিয়েটর ডানে বামে তাকায় - সুলভ কোনো বাহন চোখে পড়ে না - শহরের প্রান্তিক এলাকা এটা - ছয় তলা ভবনের পঞ্চম তলায় তার বাস - একটু নিরিবিলি পরিবেশই তার পছন্দ - কিংবা কে জানে - এই বেশি দুরে বেশি উচ্চতায় থাকার অভিলাষটা আর্থিক অসঙ্গতি থেকেই উদ্ভূত কিনা ?
বাস ধরার জন্য বেশ খানিকটা হেঁটে মূল রাস্তায় আসতে হয় - এটা যাত্রাপথের শুরুর দিক বলে আগে তেমন ভীড় হত না - এখন আর সে দিন নেই - উপচে পরা ভীড় এখানেও - মাত্র সকাল হয়েছে - এর মাঝেই বাস কাউন্টার গুলোতে দীর্ঘ লাইন - গ্ল্যাডিয়েটর খানিকটা দমে যায় - পরক্ষণেই সাহসে বুক বাঁধে - এই শহরে ভীতু সত্তার কোনো স্থান নেই - টিকিট কেটে লাইনে দাঁড়ায় - চঞ্চল চোখ থাকে ঈপ্সিত বাসের অপেক্ষায় - বাড়তে থাকে স্নায়বিক চাপ - মূল্যবান মুহুর্তগুলো পার হয়ে যাচ্ছে এই ভাবনা তাকে অস্থির করে তোলে.
অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে বাসটা দৃষ্টি গোচর হয় - অপেক্ষমান দীর্ঘ লাইনটাতে যেন একটা আলোড়ন ওঠে - গ্ল্যাডিয়েটরের সবগুলো স্নায়ু সজাগ হয়ে ওঠে - টিফিন ব্যাগটা হাত বদল করে ডান হাতটা মুক্ত করে নেয় - বাসটা তখনও পুরো থামেনি - লাইনটাতে যেন বিস্ফোরণ ঘটে - চাক ভাঙ্গা মৌমাছির মত যাত্রীরা ছুটে যায় বাসের দিকে - গ্ল্যাডিয়েটরও ব্যতিক্রম নয় - যেন অনন্য এক স্প্রিন্টার সে - কিংবা অসাধারণ একজন রাগবি খেলোয়াড় - চোখ ধাঁধানো দৌড়ের মাঝেই সবল কনুইয়ের ধাক্কায় ছিটকে দেয় আশেপাশের অপেক্ষাকৃত দুর্বল প্রতিদ্বন্দ্বীদের - দৌড়ের শেষটা যেন নান্দনিক - অসাধারণ রিফ্লেক্সে ডান হাতে আড়াআড়ি ভাবে আঁকড়ে ধরে বাসের হ্যান্ডেল - একটা পা রাখে পাদানিতে - নিখুঁত স্ট্র্যাটেজি - এখন আর কেউ তাকে টপকে বাসে উঠতে পারবে না - কন্ডাক্টর টিকিট ছিঁড়েছে কি ছিঁড়েনি এর মাঝেই কিছুটা স্বেচ্ছায় কিছুটা পৃষ্ঠ চাপে গ্ল্যাডিয়েটর পৌঁছে যায় বাসের অভ্যন্তরে - প্রাথমিক বিজয় অর্জিত হয় - এখন চূড়ান্ত বিজয়ের অপেক্ষা - অপেক্ষা বসার জন্য একটি আসন প্রাপ্তির.
এই অপেক্ষা সহজে শেষ হবার নয় - বাস ভর্তি লোক - সীট বা ফ্লোর কোনটাতেই তিল ধারণের জায়গা নেই - গ্ল্যাডিয়েটর তবু হতাশ হয় না - অনেকটা গায়ের জোরেই দাঁড়াবার একটা জায়গা করে নেয় - বাস চলতে শুরু করে - উপচে ভরা ভীড় - সামান্য দুলুনিতেই যাত্রীদের ঠোকাঠুকি হয়ে যায় - বহুমুখী খিস্তি খেউরের ঝড় ওঠে - কোনটা চালকের প্রতি - কোনটা বা পারস্পরিক.
গ্ল্যাডিয়েটর পোড় খাওয়া চোখে সব দেখে - কিছুই তার চোখের আড়াল নয় - ঘাঘু শকুনের মত সীটে আসীন যাত্রীদের হাবভাব লক্ষ্য করে - কে কোথায় নামবে বোঝার চেষ্টা করে - উদ্দেশ্য একটাই - খালি হওয়া আসনের দখল নেয়া - নিজের দিকেও তাকে খেয়াল রাখতে হয় - মানিব্যাগটা জায়গা মত আছে তো ? বুক পকেটের মোবাইলটা কেউ তুলে নিচ্ছে না তো ? তেলাপোকার নাকি সহস্র চোখ থাকে - তার আছে মাত্র দুটো - তবু সে সবদিকে নজর রাখে - রাখতে হয় তাকে.
পাশে দন্ডায়মান যাত্রীর সাথে ধাক্কা লাগে - লোকটা খিস্তি করে ওঠে - গ্ল্যাডিয়েটর ঠান্ডা শীতল চোখে তাকে দেখে - সেই দৃষ্টির সামনে লোকটা কেমন যেন কুকড়ে যায় - অস্ফুটে কি যেন বলে - শব্দটা বোধয় 'সরি'.
সুযোগটা আচমকা তৈরী হয় - পার্শ্ববর্তী একটি আসন খালি হয় - কেউ কিছু বোঝার আগেই গ্ল্যাডিয়েটর আসনটা হস্তগত করে - এতক্ষণে সে কিছুটা স্বস্তিবোধ করে - পাশের দন্ডায়মান মানুষদের ভ্রুকুটি মোটেও গায়ে মাখে না সে.
গ্ল্যাডিয়েটর জানালা দিয়ে বাইরে তাকে - দেখে নগরীর ব্যস্ত জনপথ - কর্মজীবী মানুষের গন্তব্যে পৌঁছানোর সাহসী সংগ্রাম - বাস - ট্রাক - সিএনজি - রিক্সা - এমনকি পায়ে হেঁটে - কত বিচিত্র উপায়ে মানুষ চলেছে কর্মস্থলে - কি সীমাহীন ভোগান্তি তাদের - ভাবা যায় না - তবে ব্যতিক্রম আছে - ঐ যে দৌড়ায় লেক্সাস - ল্যান্সার - পাজেরো - বলেরো - দৌড়ায় টয়োটা - করোলা - প্রাডো - প্রিমিও - মাঝে সাঝে রাজকীয় বিএমডব্লিউ - এখানে ভিন্ন গল্প - এই আরোহীরা ভিন্ন জগতের মানুষ - গ্যালারিতে বসা মধ্যযুগীয় রাজন্যদের মত - গ্ল্যাডিয়েটরদের মৃত্যু সংগ্রাম যাদের বিকৃত আনন্দের খোরাক - গ্ল্যাডিয়েটরের মন কেমন এক বিতৃষ্ণায় ভরে যায় - তার ভেতরে কি তবে ঈর্ষা কাজ করে - নাকি গ্যালারিতে বসার অপূর্ণ ইচ্ছা তাকে আগ্রাসী করে তোলে ?
আজকের দিনটা তার নয় (কবেই বা দিনটা তার হয় ? ) - সীটটা হাতছাড়া হয়ে যায় - নিজের নির্বুদ্ধিতাতেই - বাস তখন গন্তব্যের মধ্যপথ পেরিয়ে গেছে - আগের স্টপেজে ওঠা এক বৃদ্ধ ভদ্রলোক তার পাশেই দাঁড়িয়েছিলেন - কি যে হলো তার - মুখ ফসকে বলে ফেলল - 'আপনি এখানে বসুন' - ভদ্রলোক কৃতজ্ঞ চোখে তাকিয়ে সীটে আসীন হলেন - আর গ্ল্যাডিয়েটর আবার দন্ডায়মান - নিজের উপরই বিরক্ত হয় সে - কিছুটা যেন বিস্মিত ও - কি হলো তার ? মানবিক আবেগ কি তাকে মানায় - টিকে থাকার এই নিত্য সংগ্রামে উদারতার অবকাশই বা কোথায় ? তবে কি মনের গভীরে আজও সে আগের মানুষটিই রয়ে গেছে ?
বাকি পথটুকু সেই চিরন্তন দুলুনি - শক্তি পরীক্ষা - টালমাটাল শরীরের ভারসাম্য রক্ষা - অর্থহীন সিগন্যালে আটকে থেকে হারিয়ে ফেলা অমূল্য সময় - কখনো বা অক্ষম ক্রোধান্ধ গর্জন আর ক্রমবর্ধমান স্নায়বিক পীড়নের গল্প.
শেষ পর্যন্ত গ্ল্যাডিয়েটর অফিসে পৌঁছায় - ঘড়ির কাঁটা তখন নির্ধারিত সময় পেরিয়ে গেছে - বসের ভ্রুকুটি - সহকর্মীদের তির্যক হাসি - সব উপেক্ষা করেই সে কাজে ডুবে যায় - গ্ল্যাডিয়েটর কাজ করে - পথশ্রমের কথা তার মনে থাকে না - মনে থাকে না ন্যস্ত কাজ আর পারিশ্রমিকের অসম অনুপাতের কথা - শত অপ্রাপ্তি আর বঞ্চনার গল্প কিভাবে যেন সে বিস্মৃত হয় - সে কাজ করে যায় - যান্ত্রিক দক্ষতায় - জিডিপির বর্ধিত ইন্ডিকেটর কোনদিন তার হয়ে সাক্ষ্য দেবে না - তবু সে কাজ করে যায়.
দশটা পাঁচটা অফিসের গল্প তো রুপকথা - গ্ল্যাডিয়েটর যখন অফিস ছাড়ে - তখন দিনরাত্রির শেষ আজানের ধ্বনি বাতাসে ভাসে - তবু গ্ল্যাডিয়েটরের ভ্রুক্ষেপ নেই - ফিরতি যাত্রার আয়োজনে তখন সে ব্যস্ত - একই ভোগান্তি - একই পথ পরিক্রমা - এ যেন পুলসিরাত পার হওয়া - গ্ল্যাডিয়েটর অবশেষে ঘরে পৌঁছায় - সঙ্গিনী ছিল তার অপেক্ষায় - কিছুটা অভিমান - কিছুটা শঙ্কায় - দুটো মানুষ অন্তত কিছুটা সময় নিজেদের এক করে পায় - তৃতীয়টি তখন ঘুমন্ত - শয্যায় - শ্রান্ত গ্ল্যাডিয়েটরের খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসে একজন আবেগী স্বামী - এক স্নেহাকুল পিতা - এক টেবিলে সাদাসিধে খাওয়া - এক শয্যায় কিছু আবেগী মুহূর্ত - ভালবাসার দুটো বিমূর্ত উচ্চারণ - ঘুমন্ত শিশুপুত্রের কপালে স্নেহের চুম্বন - সুখের মানবিক মুহুর্তগুলো এত ক্ষণকালের কেন ? রাত বাড়ে - গ্ল্যাডিয়েটর প্রাণপণ চেষ্টা করে জেগে থাকার - কিন্তু ঘুম ভর করে তার চোখের পাতায় - দিনমান হারেনি যে একবারও - এখন শ্রান্তির কাছে তার হার হয়.
শুনছ গ্ল্যাডিয়েটর - অ্যালার্ম বাজছে আবার - রাজন্যরা আসছে গ্যালারিতে - যোদ্ধারা দাপাচ্ছে মাঠ - ওঠ - সময় হয়েছে আবার যুদ্ধে যাবার.
পরিশিষ্ট :শক্ত মুষ্ঠির সংগ্রামী মানুষগুলোর সাথে প্রতিদিন আমার দেখা হয় - আমরা পরস্পরের শত্রু নই - অস্তিত্বের খাতিরে তবু ডুয়েল লড়ি - কখনো হারি কখনো জিতি - রাজন্যর়া হাসছ নাকি - হেসো না - গ্যালারির নিশ্চিদ্র নিরাপত্তায় বসে আমাদের বিদ্রুপ কর না - একদিন আমরা জাগব নিশ্চয় - আর সেদিন জেন - সীমানা ছাড়িয়ে মাঠ গড়াবে গ্যালারী পর্যন্ত - আমরা আজ যারা ডুয়েল লড়ছি নিয়ত - সেদিন দাঁড়াব সহযোদ্ধার বেশে - তোমাদের হাসির দাঁত ভাঙ্গা জবাব সেদিন পাবে - শক্ত ঢাল যদি উঁচিয়েও রাখো - মুষ্টাঘাত কাকে বলে - তবুও সেদিন টের পাবে.
উপরের বর্ননা মোতাবেক আমি একজন গ্ল্যাডিয়েটর । এই চক্রে ঘুরছে জীবন.....বের হবার কোন উপায় নাই.....চলছে আর চলছে............এর নামই কি বেচেঁ থাকা?
বেশ ভাল লেগেছে লেখাটা।
লেখাটা অনেক অনেক অনেক ভাল লাগছে, প্রিয়তে রেখে দিলাম।
মন্তব্য করুন