ওয়ানস আপন আ টাইম দেয়ার লিভড আ কিং কলড আপ্পু রাজা
ওয়ানস আপন আ টাইম দেয়ার লিভড আ কিং কলড আপ্পু রাজা
নব্বই দশকের শেষের ভাগ - একটি নিশুতি রাত - রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় আবাসিক এলাকার পশ্চিম পাড়া - সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে - না ভুল হলো - ওই তো ব্যতিক্রম দেখা যায় - একখানা বাসায় এখনো আলো জ্বলছে - বাসার সদস্যরা টিভি দেখছে - কিংবা টিভি দেখার ছলে প্রতীক্ষা করছে বিশেষ একটি ক্ষণের - একজন অতিথি আসার কথা - প্রতীক্ষা তার জন্য - রাত বাড়ছে - টিভির পর্দায় চলচ্চিত্রটিও জমে উঠেছে - ব্যতিক্রমী যমজ ভাইদের গল্প - একজন বামন - অন্যজন ঠিকঠাক - দুটি চরিত্রেই অভিনয় করেছেন দক্ষিণ ভারতীয় কিংবদন্তি অভিনেতা কমল হাসান - প্রতিশোধ নির্ভর ছবিটির নাম আপ্পু রাজা - ছবিটি যখন শেষের পর্যায়ে তখনই অতিথির আগমন ঘটল - গৃহকোণ মুখরিত হলো এক নবজাতকের মিউ মিউ শব্দে - টিভির পর্দায় এখন আর কারো চোখ নেই - সস্নেহে আমরা তাকিয়ে আছি নতুন এই অতিথির দিকে - মায়ের কোলে শরীর ঠেকিয়ে শুয়ে আছে সে - হলদেটে রং - রিষ্টপুষ্ট তুলতুলে শরীর - কি অপূর্ব সুন্দর এই বিড়াল ছানা - মুগ্ধ চোখে দেখছি আমরা - মাত্র জন্ম নিয়েছে - অথচ শরীরী অবয়বটাই যেন তার রাজকীয় - খুব সচেতনভাবে নয় - অনেকটা স্বগতোক্তির মতই অস্ফুটে আমি ডেকে বসলাম - আপ্পু রাজা - ওই মুহূর্ত থেকেই তার গায়ে রাজার তকমাটা লেগে গেল - কিংবা কে জানে - সে হয়ত রাজা হয়েই জন্মেছিল.
আপ্পু এ বাড়ির একমাত্র বিড়াল ছিল না - অন্তত এক ডজন সদস্যের বিড়াল পরিবারের নবতম সংযোজন ছিল সে - কিন্তু বিশেষ কেউ হয়ে উঠতে তার সময় লাগেনি - তার বাড়ন্ত শরীর যেন সময়ের কোনো সমীকরণই মানছিল না - উজ্বল বর্ণ - ফোলানো লেজ - আয়েশী গোঁফ আর রাজকীয় কেতা যেন কনিষ্ঠ এই হুলো বেড়ালটিকে পরিবারের সবার মাঝ থেকে আলাদা করে দিত - দিনদিন আমাদের চোখের মণি হয়ে উঠেছিল আপ্পু.
আপ্পু মায়ের কোল ছাড়তেই তার নতুন অভিভাবক হলাম আমি - আমার বিছানায় তার আসন স্থায়ী হয়ে গেল - আমার গায়ে গা লাগিয়ে ঘুমাত সে - কখনো বা চড়ে বসত বুকের উপর - ডাইনিং টেবিলে আমার নির্দিষ্ট চেয়ারটা সে চিনে নিয়েছিল - খাবার সময় ওই চেয়ারের পাশে বসত সে - অন্য বিড়ালেরা ওই চেয়ারের পাশে আসলেই রাগে গরগর করে উঠত - আমার উপর তার অধিকারটা পরিষ্কারভাবেই সে সবাইকে বুঝিয়ে দিয়েছিল.
অদ্ভূত একটা সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল আমাদের মাঝে - এ যেন ঠিক প্রভু - পোষ্যের সম্পর্ক নয় - অনেকটা যেন বন্ধুত্বের - সমঝোতার - বিশ্বাসের আর নির্ভরতার একটি সেতুবন্ধ - ও ছিল আমার খেলার সাথী - অবসরের সঙ্গী - কখনো বা মন ভালো করার এক অমূল্য অনুঘটক - পক্ষান্তরে - ওর জীবনে আমার গুরুত্ব বোধহয় এর চাইতে ও অনেক বেশি ছিল.
আপ্পু বড় হচ্ছিল - তার পেশী গুলো হয়ে উঠছিল সবল আর পুরুষ্ঠ - চালচলনে ফুটে উঠছিল রাজকীয় গাম্ভীর্য - বাসার ভেতরটা ততদিনে তার দখলে এসে গেছে - পরিবারের অন্যরা মেনে নিয়েছে তার শ্রেষ্ঠত্ব - কিন্তু হাজার হোক বাঘের জাত - এত ছোট রাজত্বে আপ্পু তাই তৃপ্ত ছিল না - সে চেয়েছিল পুরো পাড়ার আধিপত্য - কিন্তু কাজটা সহজ ছিল না.
'জগা' - ভিমদেহী আরেকটি বিড়াল - এই পাড়ারই আরেক বাসার পোষ্য ছিল সে - আপ্পুর বড় হয়ে ওঠার দিনগুলোতে জগাই ছিল পাড়ার অধিপতি - বয়সে প্রবীণ - আকারে বিশাল আর প্রকৃতিতে হিংস্র জগার কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল না - তার নিরঙ্কুশ আধিপত্যে আমাদের আপ্পুই ছুড়ে দিয়েছিল প্রথম ধারালো চ্যালেঞ্জটি.
লড়াইটা সব অর্থেই অসম ছিল - বয়স অভিজ্ঞতা আকার আর হিংস্রতায় আপ্পু ছিল জগার অর্ধেকেরও কম - শুধু জেদ দিয়ে লড়াই জেতা যায় না - আপ্পু ও জিততে পারেনি - আপ্পু তবু লড়ছিল - মরণপণ লড়াই - এটাই হতে পারত তার জীবনের শেষ লড়াই - হয়নি - আমি তাকে ছিনিয়ে এনেছিলাম জগার মৃত্যু আলিঙ্গন থেকে - আপ্পু খোড়াচ্ছিল - রক্ত ঝরছিল তার মুখ থেকে - গজরাচ্ছিলো অক্ষম ক্রোধ আর ব্যথায় - কিন্তু তার চোখের তারায় ইস্পাত কঠিন সংকল্পটা ঠিকই আমার নজরে পড়েছিল.
এরপর থেকেই পরিবর্তনটা স্পষ্ট হয়ে উঠছিল - আপ্পু বদলে যাচ্ছিল - নিজেকে প্রস্তুত করছিল - প্রস্তুত করছিল চূড়ান্ত একটি লড়াইয়ের জন্য - বাড়ন্ত শরীরটা ঈর্ষনীয় আকার ধারণ করছিল - আহারের পরিমাণ বাড়ছিল ক্রমশ - অবিশ্বাস্য ক্ষিপ্রতায় আপ্পু গাছে চড়ত - অকল্পনীয় দক্ষতায় শুন্যে ঝাঁপাত - আপাত দৃষ্টিতে মনে হত যেন নিছক খেলা - কিন্তু এই সবই ছিল আসলে একটি বৃহৎ প্রস্তুতির অংশ বিশেষ - অবোধ প্রাণী - তবু নিঁখুত পরিকল্পনায় এগোচ্ছিল সে - তার জেনেটিক কোডে সুপ্ত শক্তিশালী প্রাকৃতিক ইন্সট্রাকশনগুলোর নির্বাহ আসলে শুরু হয়ে গিয়েছিল - আর তারাই নিশ্চিত করছিল তার রূপান্তর - জন্ম হচ্ছিল এক সুনিপুন যোদ্ধার.
মহার্ঘ্য দিনটি এসে গেল - আমার এখনো কেন যেন মনে হয় - দিনটি আপ্পুই বেছে নিয়েছিল - চোখ বন্ধ করলে এখনো দৃশ্যটি আমি দেখতে পাই - দুই যোদ্ধা কাল্পনিক একটি বৃত্তের কেন্দ্রে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে - ঘাড়গুলো ঈষৎ ঝোকানো - মুখ চিরে বেরোচ্ছে চাপা গর্জন - চোখ স্থির প্রতিপক্ষের উপর - লড়াইটা আমি থামাতে পারতাম - থামাইনি - প্রাকৃতিক সিদ্ধান্তের মাঝে হাত দিতে মন চায়নি - আপ্পুই প্রথম আক্রমণে গেল - পেছনের পা দুটো যেন মাটিতে একটা ধাক্কা দিল - তৈরী হলো শুন্যে উত্তরণের মোমেন্টাম - শরীরটা তির্যকভাবে শুন্যে ভাসছে - সামনের পা দুটো প্রসারিত - যেন হলদেটে এক বিদ্যুত ঝলক - আক্রমণের এই অভিনব ধারাই জানিয়ে দিল - যোদ্ধা হিসেবে আপ্পুর উতকর্ষতা - পরের অংশটুকু ছিল শুধুই লড়াইয়ের নিয়মরক্ষা - পুরোটা সময় আপ্পু আঘাত শানিয়ে গেল - জগার ভুমিকা ছিল শুধুই আত্মরক্ষার - পরাজিত জগা যখন পিছে সরছে - আগ্রাসী আপ্পুর কন্ঠে তখন বিজয়োল্লাস - সত্যিকারের রাজা হিসেবে সেটাই ছিল আপ্পুর অভিষেক.
মুকুটহীন সম্রাটের জায়গাটা আপ্পু পেয়ে গিয়েছিল সত্যি - কিন্তু ঘাত প্রতিঘাত কখনই তার পিছু ছাড়েনি - বারবারই তাকে নবাগত প্রতিদ্বন্দ্বীদের মোকাবিলা করতে হয়েছে - নৈপুণ্য আর আসুরিক শক্তিমত্তায় সকলকেই সে পরাভূত করেছে - বিনিময়ে প্রতিটি লড়াই তার শরীরে এঁকে দিয়েছে অসংখ্য ক্ষতচিহ্ন - জগার থেকে কেড়ে নেওয়া রাজত্বের সীমা কুশলী একজন শাসকের মতই সে বৃদ্ধি করেছে - আপ্পুর দুর্ভাগ্য - মনুষ্য সমাজে জন্ম নিলে নিশ্চয় ইতিহাসে তার নাম লিখা হত - এত সুনিপুন যোদ্ধা - এত কুশলী রাজা ইতিহাসের পাতায়ও হয়ত বিরল.
আঘাতটা ছিল অপ্রত্যাশিত - স্বজাতির কাছ থেকে নয় - আঘাত এসেছিল বিবেকবান (?) কোনো মানুষের কাছ থেকে - ধারালো অস্ত্রের আঘাতে গলার অনেকখানি অংশ কেটে গিয়েছিল আপ্পুর - অনেক কষ্টে সে বাসায় ফিরেছিল - হাঁটার শক্তি ছিল না - তবু সে ফিরেছিল - আমি যখন তাকে কোলে নিচ্ছি - রক্তে ভাসছিল তার শরীর - দু'চোখের তারায় বোবা বেদনা ছিল - ছিল আহত বিস্ময় - তার হয়ত জানা ছিল না - সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীবেদের হৃদয় এত কঠিন হতে পারে – তার কল্পনাতেও হয়ত আসেনি - নখরবিহীন প্রাণীরা যে এত হিংস্র হতে পারে .
আপ্পু বাঁচবে আমরা ভাবিনি – কিন্তু ধীরে ধীরে সে বেঁচে উঠলো – হয়ত মায়ের নফল নামাজের বিনিময়ে বিধাতা তাকে নবজন্ম দিলেন – অফুরান প্রাণশক্তিতে সে একদিন আবার উঠে দাঁড়ালো – কিন্তু হারিয়ে গেল তার কন্ঠস্বর – সম্ভবত কন্ঠনালী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল.
এরপরও আপ্পু রাজাই ছিল – শুধু মাঝে মাঝেই সে উধাও হয়ে যেত – তার দেখা পেতাম না – অপেক্ষার প্রহর গুনতাম – তারপর হঠাৎ একদিন – হয়ত মাঝরাতে আমার ঘুম ভেঙ্গে যেত – পরিচিত বন্ধুর উপস্থিতি টের পেতাম পাশে – হাত বাড়ালেই বিশ্বস্ত লোমশ দেহটা নড়েচড়ে উঠত – বুঝতাম আপ্পু ফিরে এসেছে – ফিরে এসেছে পুরনো বন্ধুর কাছে.
আপ্পুর বয়স বাড়ছিল – প্রাকৃতিক নিয়মেই কমছিল তার শৌর্য আর ক্ষিপ্রতা – তবু সে রাজত্ব টিকিয়ে রেখেছিল – অসাধারণ লড়াকু মনোভাবই তাকে সমস্ত প্রতিকুলতার বিরুদ্ধে উতরে দিত.
রাজশাহীর সাথে আমার সম্পর্কের স্থায়িত্ব প্রায় দুই যুগ – সব সম্পর্কই একসময় ছিন্ন হয় – এক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম হলো না – আমাকে রাজশাহী ছাড়তে হবে – সেই সাথে ফেলে আসতে হবে আপ্পুকে – কে দেখবে তাকে – বয়স তার শিকারের ক্ষিপ্রতা কেড়ে নিচ্ছিল ক্রমশ – প্রাণঘাতী লড়াইগুলোর উপযুক্ততা হারিয়ে ফেলছিল সে দিনদিন – মনটা বড় খারাপ ছিল – তবে কি আপ্পুকে অসহায় অবস্থায় রেখেই আমাকে চলে আসতে হবে ?
বিধাতা হাসলেন অলক্ষ্যে – এক বিকেলে আপ্পু আমার পাশে বসে আছে – আমি ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি – হঠাৎ সে উঠে দাড়ালো – বুঝলাম নতুন কোনো বিহারে যাচ্ছে – যাবার সময় কখনো সে ঘাড় ফিরিয়ে তাকাত না – এবার কেন যেন তাকালো – তাকিয়েই রইলো - দু জোড়া চোখ এক হলো – কি যেন তার বলার ছিল – অবোধ প্রাণী বলতে পারেনি – সেই তার শেষ যাওয়া – আপ্পু আর ফিরে আসেনি.
কেন সে ওভাবে তাকিয়েছিল – ওই চোখে কি তবে বিদায় সম্ভাষণ ছিল – অলক্ষ্য কোনো সূত্রধর কি তাকে জানিয়ে দিয়েছিলেন – এই তার অগন্ত্য যাত্রা – আমি জানি না – আপ্পু চলে গেছে – হয়ত লোকচক্ষুর অন্তরালে বসুধার নির্জন কোনো কোণে তার দেহখানি মাটিতে মিশে গেছে – তবু মাঝে মাঝে এখনো রাতে আমার ঘুম ভেঙ্গে যায় – অবচেতন মনে পুরনো অভ্যাসে বিছানা হাতড়াই – মনে হয় ওপারের জগত থেকে আপ্পু বোধহয় আবার ফিরে এসেছে – কিন্তু না - আপ্পু ফিরে আসেনি – আপ্পু ফিরে আসে না – প্রকৃতি তাকে ফিরিয়ে নিয়েছে নিজের কোলে – কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে আমার আপ্পু – আপ্পু রাজা.
মন খারাপ করা দারুণ...
:'(
এই লেখাটার প্রায় প্রত্যেকটা লাইনের অনুভূতি আমারও ভীষণ ভাবে চেনা।
মন্তব্য করুন