ইউজার লগইন

দ্বিজ

দ্বিজ

হাসান সাহেবের ভুরু সামান্য কুঁচকে আছে - সচরাচর এমন হয়না - তিনি আদ্যন্ত সংযত মানুষ - বিরক্তি বা রাগ সহজে প্রকাশ করেন না - কিন্তু আজকের বিকেলটা ভিন্ন - সামনের সোফায় আসীন যুবক তাকে অস্বস্তিকর বিরক্তিতে ফেলে দিয়েছে - যদিও যুবককে তিনি নিজেই আসতে বলেছিলেন.

ঘটনার সুত্রপাত তার কনিষ্ঠা কন্যাকে নিয়ে - এই মেয়েটি তার বড় আদরের - পুরো নাম তানিয়া ইসলাম - পিতৃস্নেহে সেই নাম তার কাছে কখন যেন তানি হয়ে গেছে - ভার্সিটি পড়ুয়া মেয়ে - মেধা জেদ আর সৌন্দর্য তিনটি জিনিসই মেয়েটির মধ্যে প্রবলভাবে আছে - যদিও কখনো প্রকাশ করেন না - তবু বোঝা যায় - এই মেয়েকে নিয়ে হাসান সাহেবের মনের গভীরে গোপন এক ধরনের অহংকার আছে.

সব ঠিকঠাক চলছিল - তানির পড়াশোনা শেষের দিকে - দারুণ সব বিয়ের প্রস্তাব আসছিল তানির জন্য - প্রায় এক ডজন পাত্রের ঝি কুষ্ঠি যাচাই করার পর শেষের ছেলেটিকে হাসান সাহেবের মনে ধরেছিল - অবস্থাসম্পন্ন সম্ভ্রান্ত পরিবারের ছেলে - পেশায় ইঞ্জিনিয়ার - দেখতে সুদর্শন - অসম্ভব নম্র বিনয়ী - তানির সাথে চমৎকার মানাবে - হাসান সাহেব প্রায় মনস্থির করে ফেলেছিলেন - মেয়ের জন্য এরকম ছেলেই তো তার কাম্য ছিল.

কিন্তু সমীকরণটা পাল্টে গেল - পাত্রের ছবি আর বায়োডাটা স্ত্রীর হাতে তুলে দিতে গিয়েই প্রথম অসঙ্গতিটা তার চোখে পড়ল - স্ত্রীর মাঝে স্বতস্ফুর্ত খুশির ভাবটা যেন তিনি দেখতে পেলেন না - পোড়খাওয়া মানুষ তিনি - সোমার- মানে তার স্ত্রীর আমতা আমতা সম্মতি তাই তার নজর এড়ালো না.

তবু তিনি চুপ করে রইলেন - ভাবলেন - স্ত্রী নিজে থেকেই ব্যাপারটা খোলাসা করবেন - হলোও তাই - পরের রাতেই সোমা মুখ খুললেন - হাসান সাহেব জানলেন - তানি'র নিজের পছন্দ আছে - তার রাগ হচ্ছিল - কিছুটা অভিমান ও - যে মেয়ের প্রতি তার অগাধ স্নেহ আর বিশ্বাস সে এমনটি করলো ?- তিনি ভাবতেন - মেয়ের সব কিছুই তার জানা - ঘুণাক্ষরেও ভাবেননি মেয়ে তাকে লুকিয়ে কারো সাথে সম্পর্ক গড়ছে - ওই রাতটা তার নির্ঘুম কাটল - পরের রাতটিও তাই - হাজারও আশংকা আর অস্বস্তি তাকে প্রায় বিপর্যস্ত করে ফেলল - পরিশেষে সিদ্ধান্ত নিলেন - মেয়ের সাথে তিনি খোলাখুলি কথা বলবেন.

তানি ভয় পাচ্ছিল - যে বাবার সাথে তার নিবিড় সখ্যতা - নিত্যদিন সীমাহীন আহ্লাদী আর আবদার ছিল যে বাবার কাছে - আজ সেই বাবা - সেই হাসান সাহেব যেন অন্য কেউ - এ তো সেই মানুষ যিনি সাধারণ অবস্থা থেকে অপরিমেয় উচ্চতায় উঠে এসেছেন একক প্রচেষ্টায় - সেই মানুষ যিনি কোনদিন অন্যায়ের সাথে আপোষ করেননি - একবিন্দু অসততার গ্লানি যাকে কোনদিন স্পর্শ করতে পারেনি - প্রচন্ড ব্যক্তিত্ত্ব সম্পন্ন এই মানুষটির সামনে দাঁড়িয়ে জেদী মেয়েটি আজ কেন যেন অসহায় হয়ে পড়ল - চুপ করে থাকার সুযোগ তার ছিল না - তাকে বলতে হলো - হাসান সাহেব শুধু শুনে গেলেন - জানলেন - আর অবাক হলেন.

মধ্যবিত্ত পরিবারের একটি ছেলে - দেখতে সাধারণ - মোটামুটি একটি চাকরি করে - দেশে এত ছেলে থাকতে এই ছেলেটিকেই তার মেয়ে ভালোবাসলো - যাকে তিনি চিরজীবন বুদ্ধিমতী বিবেচনা করে এলেন - এই তার বুদ্ধিমত্তা ? হাসান সাহেব রেগে যাচ্ছিলেন - কিন্তু বয়স আর অভিজ্ঞতা তাকে স্থির রাখল - তানি বারবার অনুরোধ করছিল - তিনি যেন একবার ছেলেটিকে দেখেন - খুব নাকি ভালো ছেলে - তার পছন্দ হবে - হাসান আগ্রহ বোধ করছিলেন না - শুধু মেয়ের মন রক্ষার জন্য নিমরাজি হলেন - কিন্তু মনে মনে ততক্ষণে নেতিবাচক সিদ্ধান্ত তার নেয়া হয়ে গেছে.

যুবকের বসার ভঙ্গিটা আরষ্ট - চোখের দৃষ্টি কিছুটা আনত - চেহারা সাধারণ - পরিধেয় পোশাক ও সাদাসিধে - হাসান সাহেবের সুসজ্জিত বসার ঘরে তাকে একদমই মানাচ্ছে না - বিশেষত্বহীন এই ছেলেকে তানির পাশে ভাবতে গিয়ে হাসান রীতিমত শিউরে উঠলেন - ভদ্রভাবে ছেলেটিকে কিভাবে না বলা যায় হাসান ভাবছিলেন - কঠিন শব্দগুলো সহজভাবে মনের মাঝে গুছিয়ে নিচ্ছিলেন - এই অপ্রীতিকর অপছন্দনীয় পরিস্থিতির জন্য নিজের ভাগ্যকেও দুষছিলেন .

এখন হাসান বলছেন - অসম্ভব কঠিন প্রাণঘাতী শব্দগুলো উচারণ করছেন - একই সাথে ছেলেটির প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করছেন - তার অবাক লাগছিল - ছেলেটি ভেঙ্গে পড়ছে না - মন দিয়ে তার যুক্তিগুলো শুনছে - কষ্ট পেয়ে থাকলেও তার প্রকাশ নেই - শুধু একটা আশ্চর্য ব্যাপার - যতবার তিনি তানি'র নাম উচ্চারণ করছেন - ছেলেটির অতি সাধারণ চোখ দুটো অসাধারণ দ্যুতিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠছে - কফিনে এবার শেষ পেরেক ঠোকার পালা - হাসান ঠুকলেন - স্পষ্টভাবে নিজের অসম্মতিটা জানিয়ে দিলেন - এবং এই প্রথমবার ছেলেটি পুরোপুরি সোজা হয়ে বসলো - স্পষ্ট সহজ দৃষ্টিতে হাসানের দিকে চাইল - এবার সে দাঁড়িয়ে পড়েছে - এখন আর তার মাঝে কোনো আরষ্টতা নেই - মানুষটার ব্যক্তিত্ব যেন এক লহমায় আমূল পাল্টে গেছে - ছেলেটি যখন কথা বলল - তার কন্ঠস্বরে আশ্চর্য প্রত্যয় আর সূচাগ্রতা - কোনো অনুরোধ নয় - জেদ, আত্মাভিমান আর তীব্র ভাবাবেগের যেন স্ফুরণ ঘটল - 'আমি জানতাম - আপনি রাজি হবেন না - তানি'র ধারণা যদিও ভিন্ন ছিল - তাকে বলবেন - আমার কোনো অনুযোগ নেই' .

হাসান সাহেবের সমগ্র অস্তিত্ব যেন কেঁপে উঠলো - এই শব্দগুলো এত পরিচিত লাগছে কেন - কোন সুদূর অতীতে কে যেন বলেছিল এসব ? ঠিক এই শব্দগুলি - ত্রিশ বছর আগে এভাবেই উচ্চারিত হয়েছিল - সেদিনের ঘরটাও অনেকটা এমনই ছিল তো - হাসান দাঁড়িয়ে পড়লেন - সময় যেন তিন দশক পিছে সরে গেছে - হাসান ঘামছেন - যেন কোন অদৃশ্য সূত্রধরের ইঙ্গিতে তিনি বামে চোখ ফেরালেন - বসার ঘরের ভারী পর্দাটা একটু নড়ে উঠলো না ? সেদিনও ওখানে পর্দার আড়ালে কেউ দাঁড়িয়ে ছিল - শীলা নামের এক মায়াবতী - আড়াল থেকেই তার পাজরভেদী দীর্ঘ নি:শ্বাসের শব্দ হাসানের কানে এসেছিল - আজ ওখানে কে - তানি ? তার নয়নের মণি ? হাসান যেন মোহগ্রস্ত এক মানুষ - তিন দশক পুরনো সেই নাটক আজ যেন আবার মঞ্চস্থ হচ্ছে - শুধু হাসানের ভুমিকা বদলে গেছে - হাসান নামের মানুষটি ও কি তবে বদলে গেছেন ?

পুনশ্চ : নিশুতি রাত - বিয়ে বাড়ির কোলাহল থেমে গেছে অনেকক্ষণ - শুধু তানি'র ঘরে মৃদু মায়াবী একটি আলো জ্বলছে - ওখানেই তানি'র বাসর - সারাদিনের আনন্দ-উচ্ছ্বাসের শেষে বাড়ির ক্লান্ত সদস্যরা সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে - তবু খুব ভালো করে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে - তানি'দের বাসার ছাদে এক আবছায়া মনুষ্যমূর্তি স্থানুর মত দাঁড়িয়ে আছেন - তিন দশক আগে এই মানুষটি একজন ব্যর্থ প্রেমিক ছিলেন - তিন দশক পরে আজ তিনি এক অনন্য সাধারণ বাবা - মাঝের বছরগুলিতে একটি পাজরভেদী দীর্ঘ:নিশ্বাস তাকে তাড়িয়ে বেড়িয়েছে - আজ তার চোখে দায়মুক্তির আনন্দাশ্রু - আজ অনেক বছর পর পুরোটা রাত হয়ত তিনি আকাশ দেখবেন - কিংবা কে জানে - পুরোটা আকাশকে তিনি হয়ত তার বুকেই ধারণ করে রেখেছেন.

পোস্টটি ৮ জন ব্লগার পছন্দ করেছেন

বিষণ্ণ বাউন্ডুলে's picture


অনেক দিনের পর। কোথায় ছিলেন এতদিন?ভালো আছেন তো?

হাসান আদনান's picture


বিয়ে থা করে গ্যাড়াকলে আটকে গেছি ভাই - আর সময় পাই না.

বিষণ্ণ বাউন্ডুলে's picture


আহারে!
এক কাজ করেন,
ভাবিকেও ব্লগিং নেশায় ঢুকাইয়া দেন!

সংসার হোক আনন্দময়.. Smile

হাসান আদনান's picture


আইডিয়া তো মন্দ নয়.
শুভ কামনার জন্য ধন্যবাদ.

রায়েহাত শুভ's picture


খানিকটা হুমায়ুন আহমেদ এর মত লাগলো গল্পের ভঙ্গীটা...

হাসান আদনান's picture


হুমায়ুনের স্টাইল ? ওরে বাবা - ও ভদ্রলোক তো নমস্য ভাই.

টোকাই's picture


খুউব সুন্দর লিখেছেন ভাই

হাসান আদনান's picture


ধন্যবাদ - সাহস পাচ্ছি.

সামছা আকিদা জাহান's picture


মধ্যবিত্ত জীবনাচার লেখার মাঝেও প্রকাশ পায়। ভাল লাগল।

১০

হাসান আদনান's picture


ধন্যবাদ - ব্লগার মানুষটা ও ছাপোষা মধ্যবিত্তই.

১১

নিভৃত স্বপ্নচারী's picture


ভাল লাগলো

১২

মাহবুব সুমন's picture


হুমায়ুন আহমেদ স্টাইলে লেখা

১৩

তানবীরা's picture


নিজের গলপ লিখলেন মনে হচছে Big smile

কিনতু বডড গলপ গলপ হয়েছে .........সত্যি ভাবটা কম Puzzled

মন্তব্য করুন

(আপনার প্রদান কৃত তথ্য কখনোই প্রকাশ করা হবেনা অথবা অন্য কোন মাধ্যমে শেয়ার করা হবেনা।)
ইমোটিকন
:):D:bigsmile:;):p:O:|:(:~:((8):steve:J):glasses::party::love:
  • Web page addresses and e-mail addresses turn into links automatically.
  • Allowed HTML tags: <a> <em> <strong> <cite> <code> <ul> <ol> <li> <dl> <dt> <dd> <img> <b> <u> <i> <br /> <p> <blockquote>
  • Lines and paragraphs break automatically.
  • Textual smileys will be replaced with graphical ones.

পোস্ট সাজাতে বাড়তি সুবিধাদি - ফর্মেটিং অপশন।

CAPTCHA
This question is for testing whether you are a human visitor and to prevent automated spam submissions.

বন্ধুর কথা

হাসান আদনান's picture

নিজের সম্পর্কে

কিছু মানুষ জন্মায় - একাকিত্বের বীজমন্ত্র নিয়ে - জীবন তাদেরকে খেলায় - নাকি তারা জীবন কে নিয়ে খেলে - বোঝা দায় - সম্পর্ক - সেটা বন্ধুত্বের হোক - হোক ভালবাসার কিংবা রক্তের - তারা এড়িয়ে চলে - কিংবা কে জানে - বন্ধনে জড়ানোর যোগ্যতা হয়ত প্রকৃতি তাদের কে দেয়নি - অর্থহীন জীবন - মাঝরাতে দুঃস্বপ্ন দেখে জেগে ওঠা - তারপর অঘুমো বিভীষিকাময় মুহূর্ত গুলো - তবু কাউকে ডাকা নয় - ডাকার জন্য যে প্রণোদনা লাগে তারা তা হারিয়ে ফেলেছে - শুধু ভোরের প্রতীক্ষা - যদিও জানে - ভোর আসবে না - এসব মানুষের জীবনে ভোর আসেনা- আসতে নেই - প্রসারিত কোনো হাতেই এরা হাত রাখে না - বিশ্বাস এদের নড়ে গেছে শুরুতেই - যেন সিজোফ্রেনিয়ার রোগী - এক বিচিত্র জগৎ - কোনো বন্ধন নেই - ভুল হলো- একটি বন্ধন আছে - থাকে - বিধাতার সাথে - সে বন্ধনে কখনো প্রার্থনা থাকে - কখনো ঘৃণা - কখনো অসম লড়াই - আর কখনো সীমাহীন - ব্যাখ্যাতীত অভিমান (আমি হয়ত এমনই একজন )