ভারতকে ঠেকাতে পাকিস্তানে গোপন মিশন :: ১৯৭৫ নভেম্বর মার্কিন দলিল-৮
৭ নভেম্বর বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের অভিষেকের তিন সপ্তাহেরও কম সময়ের মধ্যে তত্কালীন বাংলাদেশ সরকার ‘জরুরি ভিত্তিতে’ পাকিস্তানকে জানিয়েছিল যে, ভারত বাংলাদেশে আগ্রাসন চালিয়েছে! কিছু এলাকা ইতিমধ্যেই দখল করে নিয়েছে! এখন এটা প্রতিরোধে পাকিস্তানের জনগণ এবং পাকিস্তানি নেতাদের সহানুভূতি ও সমর্থন বাংলাদেশের দরকার। বাংলাদেশের তত্কালীন সরকার এ জন্য এক ‘গোপন মিশনে’ বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির একজন বিশেষ দূতকে ইসলামাবাদে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। বাংলাদেশের ওই আকস্মিক প্রস্তাবে সেদিন ভুট্টোর নেতৃত্বাধীন পাকিস্তান সরকার পর্যন্ত ‘বিব্রত’ হয়েছিল।
২৫ নভেম্বর ১৯৭৫ পাকিস্তানে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত হেনরি এ. বাইরোড মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরে পাঠানো এক তারবার্তায় (নং-১৯৭৫ইসলামা১০৯০০) ওই নাটকীয় ঘটনার বিবরণ দেন। যুক্তরাষ্ট্র সরকার ওই গোপন তারবার্তাটি ২০০৩ সালের ১৭ জুন অবমুক্ত করে। ২৫ নভেম্বর বাইরোড লিখেছেন, ‘পাকিস্তানের পররাষ্ট্রসচিব আগা শাহি আজ রাতে জরুরি ভিত্তিতে আমার সঙ্গে দেখা করতে চান।’ তিনি বললেন, ‘প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টোর অনুরোধেই তাঁর সঙ্গে সাক্ষাতের এই উদ্যোগ। শাহি উল্লেখ করেন যে, মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে রেঙ্গুনে নিযুক্ত তাঁদের রাষ্ট্রদূতের কাছ থেকে তাঁরা একটি বার্তা পেয়েছেন। রেঙ্গুনে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত কে.এম. কায়সার ব্যাংকক থেকে ফিরে সেখানে আমাদের রাষ্ট্রদূতকে অনুরোধ জানান যে, তিনি তাঁর সঙ্গে বৈঠক করতে চান।’এখানে উল্লেখ্য, ওই সময়ে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত খুনি মেজররা বাংলাদেশ, যুক্তরাষ্ট্র ও পাকিস্তানি দূতাবাসের আনুকূল্যে ব্যাংককে অবস্থান করছিলেন। ওই তারবার্তা অনুযায়ী, কায়সার রেঙ্গুনের পাকিস্তানি দূতকে বলেন, তিনি যখন ব্যাংককে অবস্থান করছিলেন, তখন তিনি ঢাকা থেকে ফোন পান। রাষ্ট্রপতি সায়েমের পক্ষে তাঁকে বলা হয়েছে, রাষ্ট্রপতির বিশেষ দূত হিসেবে তিনি যেন অনতিবিলম্বে এক ‘গোপন সফরে’ পাকিস্তানে পৌঁছান। তিনি সেখানে গিয়ে ভুট্টোকে ব্যক্তিগতভাবে রাষ্ট্রপতির উষ্ণ অভিনন্দন জানাবেন। অতঃপর বাংলাদেশের সংকট সম্পর্কে তাঁকে অবহিত করবেন। তিনি ভুট্টোকে বলবেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও নিরাপত্তা আজ ভারতীয়দের দ্বারা হুমকির মুখে। আমরা ইতিমধ্যেই ভারতীয় আগ্রাসনের শিকার হয়েছি। তাঁদের বাহিনী বাংলাদেশের কিছু এলাকা দখল করে নিয়েছে। উপরন্তু বাংলাদেশ জানতে পেরেছে যে, কেওয়াল সিং (তত্কালীন ভারতীয় পররাষ্ট্রসচিব) এই লক্ষ্যে মস্কো সফরে গেছেন। বাংলাদেশের বিরুদ্ধে পরিচালিত প্রত্যক্ষ ভারতীয় সামরিক হস্তক্ষেপের প্রতি সোভিয়েত সমর্থন ও সহযোগিতা আদায় করাই তাঁর লক্ষ্য। কায়সার রেঙ্গুনে পাকিস্তানি দূতকে বলেন, পাকিস্তানে তাঁর মিশনের লক্ষ্য হলো, ভুট্টোকে ভারতীয় হস্তক্ষেপের বিষয়ে ব্যক্তিগতভাবে অবহিত করা এবং বাঙালি জাতির এই ক্রান্তিলগ্নে পাকিস্তানি জনগণ ও তাঁদের নেতাদের সমর্থন আদায়। কায়সার এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করেন, জেনারেল জিয়াউর রহমান ২৩-২৪ নভেম্বর রাত দেড়টায় বাংলাদেশ বেতারে ভাষণ দেন। এবং এতে তিনি এই ক্রান্তিলগ্নে জাতীয় ঐক্য সুরক্ষার আহ্বান জানান।
পাকিস্তানের পররাষ্ট্রসচিব শাহি এ পর্যায়ে বলেন যে, কায়সার পাকিস্তানে আসতে তাঁর নিজের ও অপর একজন সহকারীর জন্য ভিসা চেয়েছেন এবং মাত্র কিছুক্ষণ আগেই রেঙ্গুনের দূতাবাসকে সে অনুমতি দেওয়া হয়েছে। এরপরই ভুট্টো তাঁকে বলেন যে, আপনাকে যেন এ বিষয়ে পুরোটা অবগত রাখা হয়।
জিয়ার বিশ্লেষণ: কায়সার তাঁর ওই গোপন মিশনে পাকিস্তানে গিয়েছিলেন কি না, সে সম্পর্কে নিশ্চিত জানা যায় না। তবে ১৯৭৫ সালের ওই দিনগুলোতে ঢাকা-দিল্লি সম্পর্কে উত্তেজনার পারদ অতি দ্রুত ওঠানামা করছিল। কায়সার ২৫ নভেম্বর যখন বাংলাদেশে কথিত মতে ভারতীয় আগ্রাসনের বিষয়ে পাকিস্তানের হস্তক্ষেপ কামনা করেছিলেন, এর ঠিক পরদিন ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশনার সমর সেনের ওপর হামলা হয়। ২৬ নভেম্বর ওই রাতেই জরুরি ভিত্তিতে জিয়াউর রহমান মার্কিন দূতাবাসের উপপ্রধান চেসলকে ডেকে পাঠান। এদিন জিয়া, কমোডর খান ও পররাষ্ট্রসচিব তোবারক হোসেন বাংলা-ভারত সম্পর্ক নিয়ে খোলামেলা কথা বলেন। এর বিবরণ দিয়ে চেসল ওই দিনই পররাষ্ট্র দপ্তরকে জানান, জিয়ার ভাষায়, এটা কেবল এভাবেই ব্যাখ্যা করা সম্ভব যে, ভারত ঢাকায় একটি তাঁবেদার সরকার প্রতিষ্ঠা করতে চায়। ভারতীয় প্রেস তো টগবগিয়ে ফুটছে। তাঁদের কাছে সীমান্তে ভারতীয় সামরিক তত্পরতার প্রমাণ রয়েছে। ১৯৭১ সালের মতো একই এলাকাগুলোতে তাঁরা প্রশিক্ষণ শিবির ও উদ্বাস্তু কেন্দ্র খুলেছে। বাংলাদেশ থেকে একটি হিন্দু উদ্বাস্তু স্রোত সৃষ্টিতে তারা মদদ দিচ্ছে।
জিয়া ভারতীয় রণকৌশল ব্যাখ্যা করে বলেন, সীমান্তের কাছাকাছি বৃহত্ সামরিক ইউনিটের কোনো তত্পরতা চালানোর দরকার নেই। কারণ ইতিমধ্যেই তারা এমন নিকট দূরত্বে অবস্থান নিয়েছে যে তারা স্বল্প সময়ের মধ্যে সীমান্তে পৌঁছাতে পারে। ক্ষুদ্র ইউনিটের মধ্যে রয়েছে ব্যাটালিয়ন ও ব্রিগেড। জিয়া এ সময় সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে অস্ত্রের অনুপ্রেবেশের কথা উল্লেখ করেন। তিনি আরও বলেন, এর আগে সিকিমে মোতায়েন করা স্পেশাল ফোর্সকে পুনরায় সংগঠিত করা হচ্ছে। ভারতীয় পক্ষ থেকে ১০ দিন ধরে গুজব ছড়ানো হচ্ছে যে, ২৭-২৮ নভেম্বর বা ৭ ডিসেম্বরের দিকে বাংলাদেশে কিছু একটা ঘটানো হতে পারে। সেই পটভূমিতে তিনি ধারণা করেন, ভারতীয় হাইকমিশনারের ওপর আজকের দুর্ঘটনা কাকতালীয় বিষয় নয়। এক প্রশ্নের জবাবে জিয়া বলেন, ভারতীয় রাজনীতিকদের ওপর প্রভাব খাটাতে উদগ্রীব ভারতীয় সেনাবাহিনী হয়তো খুব শিগগির, এমনকি কয়েক দিনের মধ্যেই বাংলাদেশে অভিযান চালাতে পারে। এখন ভারত যাতে এ রকম পাগলামি না করে, সে জন্য সব দিক থেকে দিল্লির ওপর সর্বাত্মক চাপ সৃষ্টি করা উচিত। ভারতের বোঝা উচিত, এটা ১৯৭১ সাল নয়, ১৯৭৫। জিয়ার ধারণা, ভারতীয় সেনাবাহিনী মনে করে, ভারতের এবং ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় প্রতিবেশীদের ভূখণ্ডের মধ্যবর্তী এলাকায় তাদেরই নিয়ন্ত্রণ উচিত। ভারতীয় সেনাবাহিনী বিশ্বাস করে, এ কাজটা সেরে ফেলা এখন সহজতর। কারণ ভারত এখন পাকিস্তানিদের ঠেকাতে পারবে এবং হিমালয়ের গিরিপথও তুষারাবৃত। জিয়ার চূড়ান্ত যুক্তি ছিল, ভারত এখানে এ ধরনের কিছু ঘটালে তা এমনই গোলযোগের জন্ম দেবে, যা অন্যান্য বিশ্বশক্তির স্বার্থসংশ্লিষ্টতা ডেকে আনবে। এবং তখন তা প্রত্যেকের জন্য সমস্যা সৃষ্টি করবে।
চেসল তাঁর এই বার্তার উপসংহারে উল্লেখ করেন, ‘আমি কি একথা আপনাদের জন্য অনুকূল ফল লাভের আশায় ব্রিটিশ, অস্ট্রেলিয়া বা অন্য মিশনকে জানাতে পারি?’ উত্তরে পররাষ্ট্রসচিব তোবারক হোসেন সম্মতি দেন।
তিন কূটনীতিক একমত: অনুসন্ধানে দেখা যাচ্ছে, ঢাকার মার্কিন মিশনের উপপ্রধান আরভিং চেসল পরদিন ২৭ নভেম্বর ঢাকার তত্কালীন ভারপ্রাপ্ত ব্রিটিশ হাইকমিশনার হুইটনি ও অস্ট্রেলীয় হাইকমিশনার ফ্লাডের সঙ্গে ওই বিষয়ে এক বৈঠক করেন। এক পৃথক তারবার্তায় (সিক্রেটঢাকা৫৮৬৫) তিনি উল্লেখ করেন, গতরাতের আলোচনা সম্পর্কে তাঁদের কাছে তুলে ধরতে গিয়ে আমি তাঁদের স্মরণ করিয়ে দিই যে, আমার এই উদ্যোগ কোনো কূটনৈতিক উদ্যোগের অংশ নয়। বরং পররাষ্ট্রসচিবের পরামর্শ মতে, আমি আপনাদের কাছে সম্ভাব্য ভারতীয় অভিযান সম্পর্কে তাঁদের আশঙ্কা আপনাদের কাছে তুলে ধরছি। হুইটনি ও ফ্লাড উভয়ে বৈঠকে একমত হন যে, বাংলাদেশে নতুন কোনো সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার আলামত নেই। হিন্দুদের কোনো অস্বাভাবিক চলাচলও চোখে পড়ে না। হুইটনি বলেন, দিল্লিতে তাঁদের অ্যাটাশেরা হন্য হয়ে এই খবরের পেছনে ছুটেছেন। কিন্তু তাঁরা এমন কোনো নিরেট প্রমাণ পাননি যে, যাতে মনে হতে পারে, ভারত শিগগিরই বাংলাদেশে সেনা অভিযান চালাতে পারে। হুইটনি আরও মন্তব্য করেন যে, জিয়াউর রহমান যেভাবে ভারতীয় সেনাবাহিনী সম্পর্কে বলেছেন যে, ভারতীয় রাজনীতিকদের ওপর তাদের প্রভাব রয়েছে, সেটা আসলে অতিরঞ্জিত। তবে হুইটনি ভারতীয় সেনাবাহিনীর হতাশার দিক বাদ দেননি। ভারতীয়রা হয়তো চোখের সামনে দেখছেন, ১৯৭১ সালে তাদের অর্জিত বিজয় বাংলাদেশের একটি কম বান্ধব সরকারের কাছে হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে। ব্রিটেনের ভারপ্রাপ্ত হাইকমিশনার অবশ্য বলেন যে, দিল্লিতে তাঁদের সহকর্মীরা এটাও বিশ্বাস করেন বলে মনে হয় যে, সিদ্ধান্তটা (বাংলাদেশে ভারতীয় হস্তক্ষেপ) প্রকৃতপক্ষে ‘তালাবদ্ধ হয়ে আছে ওই ছোটখাটো ভদ্রমহিলার (ইন্দিরা গান্ধী) হূদয়ে।’ এর অর্থ হলো, হুইটনি স্বীকার করেন যে, ইন্দিরা হয়তো কাল সকালে জেগে উঠতে পারেন এবং বলতে পারেন, ‘চলো’।
চেসল এরপর লিখেছেন, বাংলাদেশের এই ধাঁধাপূর্ণ অবস্থায় পরিমাপ করা যায় না এমন একটি বিষয়ও আছে। আর সেটা হলো জিয়ার নিজের প্রয়োজন মেটানো। একটি অনুমিত ভারতীয় বহিস্থ হুমকি বজায় থাকবে। সেই সঙ্গে জাসদের একটি অভ্যন্তরীণ ভারতপন্থী অনুমিত ষড়যন্ত্র বজায় থাকবে। তিনি তখন ওই দুই অবস্থাকে কাজে লাগিয়ে বিদ্যমান দুর্বল অন্তর্বর্তী সরকারের সমর্থনে একটি ঐক্য গড়তে পারবেন। আমরা তিনজন জিয়ার কৌশল সম্পর্কে এ মর্মে একমত হলাম যে, ১. এটি আপাতদৃষ্টিতে যুক্তিসংগত কৌশল, ২. অবশ্যই তা ভয়ঙ্কর,৩. আর এটাও প্রতীয়মান হচ্ছে যে, জিয়াউর রহমান পরিস্থিতি বাগে আনতে কাজে লাগে, এমন কোনো কিছুই তাঁর কাছে এখন ফেলনা নয়। জিয়ার এমনতর প্রয়োজন মেটাতে যতটুকু দরকার, তার চেয়ে ভারতীয়রা তাঁকে অনেক বেশি দিয়ে চলেছে!
পাকিস্তান বিব্রত!: ২৫ নভেম্বর পাকিস্তানে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত হেনরি বাইরোড, যিনি তরুণ বয়সে ১৯৪৬ সালে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল হয়েছিলেন, তিনি ওয়াশিংটনে প্রেরিত তাঁর ওই বার্তায় বলেন, ‘আমি শাহির কাছে জানতে চাইলাম, বাংলাদেশে ভারত কখন কথিত অভিযানটা চালাল? আরও সুনির্দিষ্ট করে আমি বললাম, এটা কি তাহলে কয়েক দিন আগে যে রিপোর্ট আমরা পেয়েছিলাম যে, বাংলাদেশের অভ্যন্তরে সীমান্ত এলাকায় ভারত পরিখা খনন করছে, সেই ঘটনা? তাহলে কি অতি সম্প্রতি কোনো ঘটনা ঘটাল ভারতীয়রা? জবাবে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রসচিব শাহি বললেন, এ বিষয়ে তাঁর কিছুই জানা নেই। কায়সার মিশনের গোপনীয়তা বজায় রাখার বিষয়টি পুরোপুরি বুঝতে না পেরে আমি শাহির কাছে জানতে চাইলাম, আচ্ছা, বাংলাদেশি দূতের এ ধরনের সফরকে কাজে লাগিয়ে ভারত বড় ধরনের কোনো পদক্ষেপ নিতে পারে বলে তিনি শঙ্কিত কি না। উত্তরে আগা শাহি বলেন, বাংলাদেশের বিশেষ দূতকে পাকিস্তানে ঢুকতে দেওয়ার প্রশ্নে শাহি উল্লেখ করেন, ভুট্টো অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে সে দিকটিও সতর্কতার সঙ্গে বিবেচনায় নিয়েছেন। শাহি বলেন যে, বাংলাদেশের এই অনুরোধ তাঁদের কিছুটা বিব্রতকর অবস্থায় ফেলেছে। এবং তাঁরাও এটা ভেবে অবাক যে, এ রকম সফরের আর সত্যি কোনো প্রয়োজন আছে কি না; বিশেষ করে কায়সারের বার্তা যেখানে তাঁরা জেনেই গেছেন।’
ফোনে আড়িপাতা: ১৪ নভেম্বর সন্ধ্যায় কলকাতায় নিযুক্ত মার্কিন কনসাল জেনারেল ডেভিড এ. কর্ন এক সামাজিক অনুষ্ঠানে ভারতীয় সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের অধিনায়ক জেনারেল জ্যাক জ্যাকবের সঙ্গে কথা বলেন। কর্ন লিখেছেন, জ্যাকব তাঁকে বলেন যে, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরীণ যোগাযোগ নেটওয়ার্ক মনিটর করে তাঁরা জানাতে পারেন যে, বিভিন্ন সেনা ইউনিটের মধ্যে লড়াই চলছে। আমি জানতে চাইলাম, এই পরিস্থিতিতে তিনি তাঁর বাহিনী মোতায়েনে নতুন করে চিন্তাভাবনা করবেন কি না। জবাবে জ্যাকব বলেন, না। তিনি একজন সেনাকেও নড়চড় করাচ্ছেন না এবং এ রকম কোনো উদ্দেশ্যই তাঁদের নেই। তিনি বলেন, আমি আপনাদের আগেই বলেছি, বাংলাদেশের সীমান্তের কাছাকাছি আমাদের কেবল তিন ব্যাটালিয়ন সেনা আছে। এবং আপনি জানেন, তিন ব্যাটালিয়ন সেনা দিয়ে কোনো দেশ দখল করা যায় না। জ্যাকব বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরীণ টেলিযোগাযোগে আড়িপেতে জানা তথ্যের উল্লেখ করে বলেন, ভারতীয় সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপ প্রশ্নে তাঁদের মধ্যে কী সব আজগুবি কথাবার্তা চলছে। তাঁরা বলাবলি করছে, আমাদের সেনারা সেখানে ঢুকে পড়েছে। আমরা তাদের ভূখণ্ডে অবস্থান করছি। পরিখা খনন করছি এবং ট্যাংক নিয়ে বাংলাদেশে আগ্রাসন চালানোর পরিকল্পনা করছি। এ কথা জানিয়ে জ্যাকব বলেন, এ ধরনের রিপোর্ট দেখেশুনে তিনি খুব হেসেছেন। কারণ এসবের একেবারেই সত্যতা নেই। বাংলাদেশ সীমান্তের কাছাকাছি কেবল ত্রিপুরা ব্যাটালিয়নে তাঁদের খুব পুরোনো কিছু ট্যাংক রয়েছে। কর্ন লিখেছেন, আমি তাঁর কাছে ভারতীয় সীমান্তরক্ষীদের সম্পর্কে জানতে চাইলাম। জ্যাকব জবাব দিলেন, তারা যথারীতি আগের মতোই মোতায়েন রয়েছে এবং যত দূর তাঁর জানা রয়েছে, তাতে তারা কোনোভাবেই সামরিক তত্পরতা চালাচ্ছে না। তাদের কাছে ট্যাংক নেই, এমনকি খোলা জিপও নেই। আর সাঁজোয়া জিপ ছাড়া তাঁদের কাছে ভারী কিছুই নেই। জ্যাকব বলেন, বাংলাদেশের সেনারা হয় নিজেদের মধ্যে কিংবা অজ্ঞাতনামা বিদ্রোহীদের সঙ্গে লড়াই করছে; কিন্তু কোনোভাবেই ভারতীয়দের সঙ্গে নয়।
পাগলামি: ডেভিড কর্ন এরপর লিখেছেন, জ্যাকব পুনরায় আমাকে নিশ্চিত করেন যে, আমি আপনাকে কথা দিতে পারি এবং আপনি আমাকে উদ্ধৃত করে এ কথা জানিয়ে দিতে পারেন যে, আমার অধীনস্থ কোনো বাহিনী কিংবা আমার জানামতে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বাংলাদেশ সীমান্ত এলাকায় কোনোভাবেই সামরিকভাবে তত্পর নয়। বাংলাদেশে ঢুকে পড়ার কোনো ইচ্ছাই বর্তমানে তাদের নেই। জ্যাকব বলেন, আসলে সেখানে যাওয়ার অর্থ পাগলামি ছাড়া কিছুই নয়। আমরা যদি সেখানে যাই, তার একটাই অর্থ হবে—হিন্দুদের মারাত্মক সমস্যার মধ্যে ফেলে দেওয়া। সরকারের রাজনৈতিক জটিলতা তখন আর বিবেচ্য হবে না। জ্যাকব আরও উল্লেখ করেন, সেখানে পাকিস্তানি ও চীনাদের উপস্থিতি আমরা পছন্দ করি না বটে, কিন্তু সে কারণে আমরা বাংলাদেশে আগ্রাসন চালাতে পারি না।
উল্লেখ্য, এক প্রশ্নের জবাবে সম্প্রতি বর্ষীয়ান জেনারেল জ্যাক জ্যাকব এক ই-মেইলে এই প্রতিবেদককে নিশ্চিত করেন যে, আমার বেশ মনে পড়ে, ওই সময় ডেভিড কর্ন সব সময় বাংলাদেশে সামরিক হস্তক্ষেপের বিষয়ে জানতে চাইতেন। গত আগস্টে বর্তমানে ওয়াশিংটনে বসবাসরত প্রবীণ রাষ্ট্রদূত ডেভিড এ. কর্নের কাছে ওই সময়ে ভারতীয় হস্তক্ষেপের আশঙ্কার বিষয়ে এতগুলো বছর পরে তাঁর বর্তমান মূল্যায়ন জানতে চেয়ে এই প্রতিবেদক ই-মেইল করেন। তিনি এর জবাব দেননি। তবে এটুকু বলেছেন, জেনারেল জ্যাকবের মতামতের প্রতি তিনি শ্রদ্ধাশীল।
উল্লেখ্য, ডেভিড কর্ন ১৪ নভেম্বরের কথোপকথন সম্পর্কে তাঁর বার্তায় মন্তব্য করেছিলেন যে, বাংলাদেশের বিষয়ে ভারত সরকার কী পরিকল্পনা করছে, এর সবটুকুই হয়তো জ্যাকবের পক্ষে জানা সম্ভব নয়। কিন্তু তিনি যা জানেন, সে বিষয়ে তাঁর বক্তব্যের সত্যতা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশের আমি কোনো কারণ দেখি না। জ্যাকব পুনঃপুন আমাকে বলেছেন, কোনোভাবেই ভারতীয় সামরিক তত্পরতা ঘটেনি। ওই দিন সন্ধ্যায় আমাকে এক পাশে ডেকে নিয়ে পুনঃপুন বলেছেন, বাংলাদেশের বিষয়ে জড়িত হতে ভারতের কোনো ইচ্ছা নেই। এ বিষয়ে তাঁর ধারণা এতটাই শক্তিশালী যে, আমি যখন তাঁকে বললাম, এ বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত দিল্লি নিয়ে বসতে পারে, তখন তিনি হাত ঝাঁকিয়ে তা দৃঢ়তার সঙ্গে নাকচ করেন।
জিয়াকেই ভরসা: ৮ নভেম্বর সকালে পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দক্ষিণ এশিয়া বিভাগের মহাপরিচালক হায়াত মেহেদি ইসলামাবাদের মার্কিন দূতাবাসের পলিটিক্যাল কাউন্সিলরের সঙ্গে বাংলাদেশ পরিস্থিতি নিয়ে মতবিনিময় করেন। এ সম্পর্কে রাষ্ট্রদূত হেনরি বাইরোড লিখেছেন, মেহেদি স্পষ্ট করেন যে, খালেদ মোশাররফের চেয়ে পাকিস্তান জিয়াউর রহমানকেই অগ্রাধিকার দেয়। পাকিস্তান মনে করে, খালেদ ‘পাকিস্তানবিরোধী’ ছিলেন। বাইরোডের মন্তব্য, এখানে ‘পাকিস্তানবিরোধী’ মানে ‘ভারতপন্থী’। খালেদ মোশাররফের অভ্যুত্থানের পরদিন পাকিস্তানের কিছু প্রেস তাঁকে সুনজরে দেখেনি। খালেদ মোশাররফের বিরোধিতায় মেহেদি খোঁড়া যুক্তিই দেখান। তাঁদের অন্যান্য কর্মকর্তার মধ্যেও এটা লক্ষ করেছি। মেহেদিই যুক্তি দিলেন, ভারত যদি বাংলাদেশে কোনো প্রকাশ্য হস্তক্ষেপ করে, তাহলে লাভের চেয়ে তার ক্ষতির পরিমাণ হবে অনেক বেশি। মিসেস গান্ধী অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে শক্তিশালী অবস্থানে রয়েছেন। সুতরাং বাংলাদেশে হস্তক্ষেপের রাজনীতির কোনো প্রয়োজন তাঁর নেই। এবং তিনি এই বিপদ সম্পর্কে সজাগ থাকবেন যে, এটা তাঁর জন্য হিতে বিপরীত হতে পারে। মেহেদি বলেন, তাঁর বিশ্বাস, হিন্দু উদ্বাস্তুদের স্রোত বইয়ে যাওয়ার মতো কোনো আশু কারণ না ঘটলে তাঁরা হস্তক্ষেপ করবেন না।
চীনের সন্তোষ: পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দক্ষিণ এশিয়া বিভাগের মহাপরিচালক হায়াত মেহেদির মতে এ সপ্তাহের গোড়ায় পিকিংয়ে পাকিস্তান দূতাবাসের চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্সকে চীনারা বলেছে, জিয়াউর রহমানের ক্ষমতা গ্রহণকে চীন সন্তোষের সঙ্গে লক্ষ করছে। কিন্তু তারা নিশ্চিত নয় যে, জিয়াউর রহমান কত দিন ক্ষমতায় থাকতে পারবেন। মেহেদি বলেন, চীনারা মনে করে, বাংলাদেশে ভারতীয় হস্তক্ষেপ সম্ভব। কিন্তু তা তারা তাদের মতো করেই করবে। তারা এটা বিবেচনায় রাখবে যে, বাংলাদেশে কোনো হস্তক্ষেপের ঘটনায় ভারতের আধিপত্যবাদী কূটকৌশল এতে আরও স্পষ্ট হবে এবং এর বিরুদ্ধে বাংলাদেশের জনগণ ঐক্যবদ্ধ হবে।
সৌদি মনোভাব: পাকিস্তান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বাংলাদেশ ডেস্কের পরিচালক আজমত হাসান উল্লেখ করেন যে, ইসলামাবাদে চীনা কূটনীতিকদের সঙ্গে আলোচনা থেকে ইঙ্গিত মিলছে যে, সোভিয়েতের সঙ্গে তাদের সম্পর্কের সমীকরণের নিরিখে বাংলাদেশের ঘটনাবলির দিকে তারা নজর রাখছে এবং তারা মনে করে, চীন ও রাশিয়ার মধ্যে টানাপোড়েনের আরেক নতুন ক্ষেত্র হলো বাংলাদেশ। আজমত হাসান আরও বলেন, সৌদি আরবের দৃষ্টিভঙ্গি হলো, যদি কোনো মুজিববাদী স্টাইলে অধিকতর সেক্যুলার রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ মোড় নেয়, তাহলে তাদের সরকার ঢাকায় তাদের রাষ্ট্রদূত পাঠাবে না। এমনকি তখন বাংলাদেশকে কোনো অর্থনৈতিক সহায়তাও দেবে না। সে কারণে সৌদি আরব সরকার অপেক্ষা করার নীতি নিয়েছে। হাসান আরও ইঙ্গিত দেন যে, ঢাকার পরিস্থিতি মূল্যায়নে রিয়াদ ইসলামাবাদকেই অনুসরণ করতে পারে। (শেষ)
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।
mrkhanbd@gmail.com
Linku: http://prothom-alo.com/detail/date/2009-11-10/news/18412
৭ নভেম্বর বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের অভিষেকের তিন সপ্তাহেরও কম সময়ের মধ্যে তত্কালীন বাংলাদেশ সরকার ‘জরুরি ভিত্তিতে’ পাকিস্তানকে জানিয়েছিল যে, ভারত বাংলাদেশে আগ্রাসন চালিয়েছে! কিছু এলাকা ইতিমধ্যেই দখল করে নিয়েছে! এখন এটা প্রতিরোধে পাকিস্তানের জনগণ এবং পাকিস্তানি নেতাদের সহানুভূতি ও সমর্থন বাংলাদেশের দরকার। বাংলাদেশের তত্কালীন সরকার এ জন্য এক ‘গোপন মিশনে’ বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির একজন বিশেষ দূতকে ইসলামাবাদে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। বাংলাদেশের ওই আকস্মিক প্রস্তাবে সেদিন ভুট্টোর নেতৃত্বাধীন পাকিস্তান সরকার পর্যন্ত ‘বিব্রত’ হয়েছিল।
২৫ নভেম্বর ১৯৭৫ পাকিস্তানে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত হেনরি এ. বাইরোড মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরে পাঠানো এক তারবার্তায় (নং-১৯৭৫ইসলামা১০৯০০) ওই নাটকীয় ঘটনার বিবরণ দেন। যুক্তরাষ্ট্র সরকার ওই গোপন তারবার্তাটি ২০০৩ সালের ১৭ জুন অবমুক্ত করে।
২৫ নভেম্বর বাইরোড লিখেছেন, ‘পাকিস্তানের পররাষ্ট্রসচিব আগা শাহি আজ রাতে জরুরি ভিত্তিতে আমার সঙ্গে দেখা করতে চান।’ তিনি বললেন, ‘প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টোর অনুরোধেই তাঁর সঙ্গে সাক্ষাতের এই উদ্যোগ। শাহি উল্লেখ করেন যে, মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে রেঙ্গুনে নিযুক্ত তাঁদের রাষ্ট্রদূতের কাছ থেকে তাঁরা একটি বার্তা পেয়েছেন। রেঙ্গুনে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত কে.এম. কায়সার ব্যাংকক থেকে ফিরে সেখানে আমাদের রাষ্ট্রদূতকে অনুরোধ জানান যে, তিনি তাঁর সঙ্গে বৈঠক করতে চান।’
এখানে উল্লেখ্য, ওই সময়ে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত খুনি মেজররা বাংলাদেশ, যুক্তরাষ্ট্র ও পাকিস্তানি দূতাবাসের আনুকূল্যে ব্যাংককে অবস্থান করছিলেন। ওই তারবার্তা অনুযায়ী, কায়সার রেঙ্গুনের পাকিস্তানি দূতকে বলেন, তিনি যখন ব্যাংককে অবস্থান করছিলেন, তখন তিনি ঢাকা থেকে ফোন পান। রাষ্ট্রপতি সায়েমের পক্ষে তাঁকে বলা হয়েছে, রাষ্ট্রপতির বিশেষ দূত হিসেবে তিনি যেন অনতিবিলম্বে এক ‘গোপন সফরে’ পাকিস্তানে পৌঁছান।
তিনি সেখানে গিয়ে ভুট্টোকে ব্যক্তিগতভাবে রাষ্ট্রপতির উষ্ণ অভিনন্দন জানাবেন। অতঃপর বাংলাদেশের সংকট সম্পর্কে তাঁকে অবহিত করবেন। তিনি ভুট্টোকে বলবেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও নিরাপত্তা আজ ভারতীয়দের দ্বারা হুমকির মুখে। আমরা ইতিমধ্যেই ভারতীয় আগ্রাসনের শিকার হয়েছি। তাঁদের বাহিনী বাংলাদেশের কিছু এলাকা দখল করে নিয়েছে। উপরন্তু বাংলাদেশ জানতে পেরেছে যে, কেওয়াল সিং (তত্কালীন ভারতীয় পররাষ্ট্রসচিব) এই লক্ষ্যে মস্কো সফরে গেছেন। বাংলাদেশের বিরুদ্ধে পরিচালিত প্রত্যক্ষ ভারতীয় সামরিক হস্তক্ষেপের প্রতি সোভিয়েত সমর্থন ও সহযোগিতা আদায় করাই তাঁর লক্ষ্য। কায়সার রেঙ্গুনে পাকিস্তানি দূতকে বলেন, পাকিস্তানে তাঁর মিশনের লক্ষ্য হলো, ভুট্টোকে ভারতীয় হস্তক্ষেপের বিষয়ে ব্যক্তিগতভাবে অবহিত করা এবং বাঙালি জাতির এই ক্রান্তিলগ্নে পাকিস্তানি জনগণ ও তাঁদের নেতাদের সমর্থন আদায়। কায়সার এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করেন, জেনারেল জিয়াউর রহমান ২৩-২৪ নভেম্বর রাত দেড়টায় বাংলাদেশ বেতারে ভাষণ দেন। এবং এতে তিনি এই ক্রান্তিলগ্নে জাতীয় ঐক্য সুরক্ষার আহ্বান জানান।
পাকিস্তানের পররাষ্ট্রসচিব শাহি এ পর্যায়ে বলেন যে, কায়সার পাকিস্তানে আসতে তাঁর নিজের ও অপর একজন সহকারীর জন্য ভিসা চেয়েছেন এবং মাত্র কিছুক্ষণ আগেই রেঙ্গুনের দূতাবাসকে সে অনুমতি দেওয়া হয়েছে। এরপরই ভুট্টো তাঁকে বলেন যে, আপনাকে যেন এ বিষয়ে পুরোটা অবগত রাখা হয়।
জিয়ার বিশ্লেষণ: কায়সার তাঁর ওই গোপন মিশনে পাকিস্তানে গিয়েছিলেন কি না, সে সম্পর্কে নিশ্চিত জানা যায় না। তবে ১৯৭৫ সালের ওই দিনগুলোতে ঢাকা-দিল্লি সম্পর্কে উত্তেজনার পারদ অতি দ্রুত ওঠানামা করছিল। কায়সার ২৫ নভেম্বর যখন বাংলাদেশে কথিত মতে ভারতীয় আগ্রাসনের বিষয়ে পাকিস্তানের হস্তক্ষেপ কামনা করেছিলেন, এর ঠিক পরদিন ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশনার সমর সেনের ওপর হামলা হয়। ২৬ নভেম্বর ওই রাতেই জরুরি ভিত্তিতে জিয়াউর রহমান মার্কিন দূতাবাসের উপপ্রধান চেসলকে ডেকে পাঠান। এদিন জিয়া, কমোডর খান ও পররাষ্ট্রসচিব তোবারক হোসেন বাংলা-ভারত সম্পর্ক নিয়ে খোলামেলা কথা বলেন। এর বিবরণ দিয়ে চেসল ওই দিনই পররাষ্ট্র দপ্তরকে জানান, জিয়ার ভাষায়, এটা কেবল এভাবেই ব্যাখ্যা করা সম্ভব যে, ভারত ঢাকায় একটি তাঁবেদার সরকার প্রতিষ্ঠা করতে চায়। ভারতীয় প্রেস তো টগবগিয়ে ফুটছে। তাঁদের কাছে সীমান্তে ভারতীয় সামরিক তত্পরতার প্রমাণ রয়েছে। ১৯৭১ সালের মতো একই এলাকাগুলোতে তাঁরা প্রশিক্ষণ শিবির ও উদ্বাস্তু কেন্দ্র খুলেছে। বাংলাদেশ থেকে একটি হিন্দু উদ্বাস্তু স্রোত সৃষ্টিতে তারা মদদ দিচ্ছে।
জিয়া ভারতীয় রণকৌশল ব্যাখ্যা করে বলেন, সীমান্তের কাছাকাছি বৃহত্ সামরিক ইউনিটের কোনো তত্পরতা চালানোর দরকার নেই। কারণ ইতিমধ্যেই তারা এমন নিকট দূরত্বে অবস্থান নিয়েছে যে তারা স্বল্প সময়ের মধ্যে সীমান্তে পৌঁছাতে পারে। ক্ষুদ্র ইউনিটের মধ্যে রয়েছে ব্যাটালিয়ন ও ব্রিগেড। জিয়া এ সময় সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে অস্ত্রের অনুপ্রেবেশের কথা উল্লেখ করেন। তিনি আরও বলেন, এর আগে সিকিমে মোতায়েন করা স্পেশাল ফোর্সকে পুনরায় সংগঠিত করা হচ্ছে। ভারতীয় পক্ষ থেকে ১০ দিন ধরে গুজব ছড়ানো হচ্ছে যে, ২৭-২৮ নভেম্বর বা ৭ ডিসেম্বরের দিকে বাংলাদেশে কিছু একটা ঘটানো হতে পারে। সেই পটভূমিতে তিনি ধারণা করেন, ভারতীয় হাইকমিশনারের ওপর আজকের দুর্ঘটনা কাকতালীয় বিষয় নয়। এক প্রশ্নের জবাবে জিয়া বলেন, ভারতীয় রাজনীতিকদের ওপর প্রভাব খাটাতে উদগ্রীব ভারতীয় সেনাবাহিনী হয়তো খুব শিগগির, এমনকি কয়েক দিনের মধ্যেই বাংলাদেশে অভিযান চালাতে পারে। এখন ভারত যাতে এ রকম পাগলামি না করে, সে জন্য সব দিক থেকে দিল্লির ওপর সর্বাত্মক চাপ সৃষ্টি করা উচিত। ভারতের বোঝা উচিত, এটা ১৯৭১ সাল নয়, ১৯৭৫। জিয়ার ধারণা, ভারতীয় সেনাবাহিনী মনে করে, ভারতের এবং ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় প্রতিবেশীদের ভূখণ্ডের মধ্যবর্তী এলাকায় তাদেরই নিয়ন্ত্রণ উচিত। ভারতীয় সেনাবাহিনী বিশ্বাস করে, এ কাজটা সেরে ফেলা এখন সহজতর। কারণ ভারত এখন পাকিস্তানিদের ঠেকাতে পারবে এবং হিমালয়ের গিরিপথও তুষারাবৃত। জিয়ার চূড়ান্ত যুক্তি ছিল, ভারত এখানে এ ধরনের কিছু ঘটালে তা এমনই গোলযোগের জন্ম দেবে, যা অন্যান্য বিশ্বশক্তির স্বার্থসংশ্লিষ্টতা ডেকে আনবে। এবং তখন তা প্রত্যেকের জন্য সমস্যা সৃষ্টি করবে।
চেসল তাঁর এই বার্তার উপসংহারে উল্লেখ করেন, ‘আমি কি একথা আপনাদের জন্য অনুকূল ফল লাভের আশায় ব্রিটিশ, অস্ট্রেলিয়া বা অন্য মিশনকে জানাতে পারি?’ উত্তরে পররাষ্ট্রসচিব তোবারক হোসেন সম্মতি দেন।
তিন কূটনীতিক একমত: অনুসন্ধানে দেখা যাচ্ছে, ঢাকার মার্কিন মিশনের উপপ্রধান আরভিং চেসল পরদিন ২৭ নভেম্বর ঢাকার তত্কালীন ভারপ্রাপ্ত ব্রিটিশ হাইকমিশনার হুইটনি ও অস্ট্রেলীয় হাইকমিশনার ফ্লাডের সঙ্গে ওই বিষয়ে এক বৈঠক করেন। এক পৃথক তারবার্তায় (সিক্রেটঢাকা৫৮৬৫) তিনি উল্লেখ করেন, গতরাতের আলোচনা সম্পর্কে তাঁদের কাছে তুলে ধরতে গিয়ে আমি তাঁদের স্মরণ করিয়ে দিই যে, আমার এই উদ্যোগ কোনো কূটনৈতিক উদ্যোগের অংশ নয়। বরং পররাষ্ট্রসচিবের পরামর্শ মতে, আমি আপনাদের কাছে সম্ভাব্য ভারতীয় অভিযান সম্পর্কে তাঁদের আশঙ্কা আপনাদের কাছে তুলে ধরছি। হুইটনি ও ফ্লাড উভয়ে বৈঠকে একমত হন যে, বাংলাদেশে নতুন কোনো সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার আলামত নেই। হিন্দুদের কোনো অস্বাভাবিক চলাচলও চোখে পড়ে না। হুইটনি বলেন, দিল্লিতে তাঁদের অ্যাটাশেরা হন্য হয়ে এই খবরের পেছনে ছুটেছেন। কিন্তু তাঁরা এমন কোনো নিরেট প্রমাণ পাননি যে, যাতে মনে হতে পারে, ভারত শিগগিরই বাংলাদেশে সেনা অভিযান চালাতে পারে। হুইটনি আরও মন্তব্য করেন যে, জিয়াউর রহমান যেভাবে ভারতীয় সেনাবাহিনী সম্পর্কে বলেছেন যে, ভারতীয় রাজনীতিকদের ওপর তাদের প্রভাব রয়েছে, সেটা আসলে অতিরঞ্জিত। তবে হুইটনি ভারতীয় সেনাবাহিনীর হতাশার দিক বাদ দেননি। ভারতীয়রা হয়তো চোখের সামনে দেখছেন, ১৯৭১ সালে তাদের অর্জিত বিজয় বাংলাদেশের একটি কম বান্ধব সরকারের কাছে হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে। ব্রিটেনের ভারপ্রাপ্ত হাইকমিশনার অবশ্য বলেন যে, দিল্লিতে তাঁদের সহকর্মীরা এটাও বিশ্বাস করেন বলে মনে হয় যে, সিদ্ধান্তটা (বাংলাদেশে ভারতীয় হস্তক্ষেপ) প্রকৃতপক্ষে ‘তালাবদ্ধ হয়ে আছে ওই ছোটখাটো ভদ্রমহিলার (ইন্দিরা গান্ধী) হূদয়ে।’ এর অর্থ হলো, হুইটনি স্বীকার করেন যে, ইন্দিরা হয়তো কাল সকালে জেগে উঠতে পারেন এবং বলতে পারেন, ‘চলো’।
চেসল এরপর লিখেছেন, বাংলাদেশের এই ধাঁধাপূর্ণ অবস্থায় পরিমাপ করা যায় না এমন একটি বিষয়ও আছে। আর সেটা হলো জিয়ার নিজের প্রয়োজন মেটানো। একটি অনুমিত ভারতীয় বহিস্থ হুমকি বজায় থাকবে। সেই সঙ্গে জাসদের একটি অভ্যন্তরীণ ভারতপন্থী অনুমিত ষড়যন্ত্র বজায় থাকবে। তিনি তখন ওই দুই অবস্থাকে কাজে লাগিয়ে বিদ্যমান দুর্বল অন্তর্বর্তী সরকারের সমর্থনে একটি ঐক্য গড়তে পারবেন। আমরা তিনজন জিয়ার কৌশল সম্পর্কে এ মর্মে একমত হলাম যে, ১. এটি আপাতদৃষ্টিতে যুক্তিসংগত কৌশল, ২. অবশ্যই তা ভয়ঙ্কর,৩. আর এটাও প্রতীয়মান হচ্ছে যে, জিয়াউর রহমান পরিস্থিতি বাগে আনতে কাজে লাগে, এমন কোনো কিছুই তাঁর কাছে এখন ফেলনা নয়। জিয়ার এমনতর প্রয়োজন মেটাতে যতটুকু দরকার, তার চেয়ে ভারতীয়রা তাঁকে অনেক বেশি দিয়ে চলেছে!
পাকিস্তান বিব্রত!: ২৫ নভেম্বর পাকিস্তানে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত হেনরি বাইরোড, যিনি তরুণ বয়সে ১৯৪৬ সালে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল হয়েছিলেন, তিনি ওয়াশিংটনে প্রেরিত তাঁর ওই বার্তায় বলেন, ‘আমি শাহির কাছে জানতে চাইলাম, বাংলাদেশে ভারত কখন কথিত অভিযানটা চালাল? আরও সুনির্দিষ্ট করে আমি বললাম, এটা কি তাহলে কয়েক দিন আগে যে রিপোর্ট আমরা পেয়েছিলাম যে, বাংলাদেশের অভ্যন্তরে সীমান্ত এলাকায় ভারত পরিখা খনন করছে, সেই ঘটনা? তাহলে কি অতি সম্প্রতি কোনো ঘটনা ঘটাল ভারতীয়রা? জবাবে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রসচিব শাহি বললেন, এ বিষয়ে তাঁর কিছুই জানা নেই। কায়সার মিশনের গোপনীয়তা বজায় রাখার বিষয়টি পুরোপুরি বুঝতে না পেরে আমি শাহির কাছে জানতে চাইলাম, আচ্ছা, বাংলাদেশি দূতের এ ধরনের সফরকে কাজে লাগিয়ে ভারত বড় ধরনের কোনো পদক্ষেপ নিতে পারে বলে তিনি শঙ্কিত কি না। উত্তরে আগা শাহি বলেন, বাংলাদেশের বিশেষ দূতকে পাকিস্তানে ঢুকতে দেওয়ার প্রশ্নে শাহি উল্লেখ করেন, ভুট্টো অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে সে দিকটিও সতর্কতার সঙ্গে বিবেচনায় নিয়েছেন। শাহি বলেন যে, বাংলাদেশের এই অনুরোধ তাঁদের কিছুটা বিব্রতকর অবস্থায় ফেলেছে। এবং তাঁরাও এটা ভেবে অবাক যে, এ রকম সফরের আর সত্যি কোনো প্রয়োজন আছে কি না; বিশেষ করে কায়সারের বার্তা যেখানে তাঁরা জেনেই গেছেন।’
ফোনে আড়িপাতা: ১৪ নভেম্বর সন্ধ্যায় কলকাতায় নিযুক্ত মার্কিন কনসাল জেনারেল ডেভিড এ. কর্ন এক সামাজিক অনুষ্ঠানে ভারতীয় সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের অধিনায়ক জেনারেল জ্যাক জ্যাকবের সঙ্গে কথা বলেন। কর্ন লিখেছেন, জ্যাকব তাঁকে বলেন যে, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরীণ যোগাযোগ নেটওয়ার্ক মনিটর করে তাঁরা জানাতে পারেন যে, বিভিন্ন সেনা ইউনিটের মধ্যে লড়াই চলছে। আমি জানতে চাইলাম, এই পরিস্থিতিতে তিনি তাঁর বাহিনী মোতায়েনে নতুন করে চিন্তাভাবনা করবেন কি না। জবাবে জ্যাকব বলেন, না। তিনি একজন সেনাকেও নড়চড় করাচ্ছেন না এবং এ রকম কোনো উদ্দেশ্যই তাঁদের নেই। তিনি বলেন, আমি আপনাদের আগেই বলেছি, বাংলাদেশের সীমান্তের কাছাকাছি আমাদের কেবল তিন ব্যাটালিয়ন সেনা আছে। এবং আপনি জানেন, তিন ব্যাটালিয়ন সেনা দিয়ে কোনো দেশ দখল করা যায় না। জ্যাকব বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরীণ টেলিযোগাযোগে আড়িপেতে জানা তথ্যের উল্লেখ করে বলেন, ভারতীয় সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপ প্রশ্নে তাঁদের মধ্যে কী সব আজগুবি কথাবার্তা চলছে। তাঁরা বলাবলি করছে, আমাদের সেনারা সেখানে ঢুকে পড়েছে। আমরা তাদের ভূখণ্ডে অবস্থান করছি। পরিখা খনন করছি এবং ট্যাংক নিয়ে বাংলাদেশে আগ্রাসন চালানোর পরিকল্পনা করছি। এ কথা জানিয়ে জ্যাকব বলেন, এ ধরনের রিপোর্ট দেখেশুনে তিনি খুব হেসেছেন। কারণ এসবের একেবারেই সত্যতা নেই। বাংলাদেশ সীমান্তের কাছাকাছি কেবল ত্রিপুরা ব্যাটালিয়নে তাঁদের খুব পুরোনো কিছু ট্যাংক রয়েছে। কর্ন লিখেছেন, আমি তাঁর কাছে ভারতীয় সীমান্তরক্ষীদের সম্পর্কে জানতে চাইলাম। জ্যাকব জবাব দিলেন, তারা যথারীতি আগের মতোই মোতায়েন রয়েছে এবং যত দূর তাঁর জানা রয়েছে, তাতে তারা কোনোভাবেই সামরিক তত্পরতা চালাচ্ছে না। তাদের কাছে ট্যাংক নেই, এমনকি খোলা জিপও নেই। আর সাঁজোয়া জিপ ছাড়া তাঁদের কাছে ভারী কিছুই নেই। জ্যাকব বলেন, বাংলাদেশের সেনারা হয় নিজেদের মধ্যে কিংবা অজ্ঞাতনামা বিদ্রোহীদের সঙ্গে লড়াই করছে; কিন্তু কোনোভাবেই ভারতীয়দের সঙ্গে নয়।
পাগলামি: ডেভিড কর্ন এরপর লিখেছেন, জ্যাকব পুনরায় আমাকে নিশ্চিত করেন যে, আমি আপনাকে কথা দিতে পারি এবং আপনি আমাকে উদ্ধৃত করে এ কথা জানিয়ে দিতে পারেন যে, আমার অধীনস্থ কোনো বাহিনী কিংবা আমার জানামতে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বাংলাদেশ সীমান্ত এলাকায় কোনোভাবেই সামরিকভাবে তত্পর নয়। বাংলাদেশে ঢুকে পড়ার কোনো ইচ্ছাই বর্তমানে তাদের নেই। জ্যাকব বলেন, আসলে সেখানে যাওয়ার অর্থ পাগলামি ছাড়া কিছুই নয়। আমরা যদি সেখানে যাই, তার একটাই অর্থ হবে—হিন্দুদের মারাত্মক সমস্যার মধ্যে ফেলে দেওয়া। সরকারের রাজনৈতিক জটিলতা তখন আর বিবেচ্য হবে না। জ্যাকব আরও উল্লেখ করেন, সেখানে পাকিস্তানি ও চীনাদের উপস্থিতি আমরা পছন্দ করি না বটে, কিন্তু সে কারণে আমরা বাংলাদেশে আগ্রাসন চালাতে পারি না।
উল্লেখ্য, এক প্রশ্নের জবাবে সম্প্রতি বর্ষীয়ান জেনারেল জ্যাক জ্যাকব এক ই-মেইলে এই প্রতিবেদককে নিশ্চিত করেন যে, আমার বেশ মনে পড়ে, ওই সময় ডেভিড কর্ন সব সময় বাংলাদেশে সামরিক হস্তক্ষেপের বিষয়ে জানতে চাইতেন। গত আগস্টে বর্তমানে ওয়াশিংটনে বসবাসরত প্রবীণ রাষ্ট্রদূত ডেভিড এ. কর্নের কাছে ওই সময়ে ভারতীয় হস্তক্ষেপের আশঙ্কার বিষয়ে এতগুলো বছর পরে তাঁর বর্তমান মূল্যায়ন জানতে চেয়ে এই প্রতিবেদক ই-মেইল করেন। তিনি এর জবাব দেননি। তবে এটুকু বলেছেন, জেনারেল জ্যাকবের মতামতের প্রতি তিনি শ্রদ্ধাশীল।
উল্লেখ্য, ডেভিড কর্ন ১৪ নভেম্বরের কথোপকথন সম্পর্কে তাঁর বার্তায় মন্তব্য করেছিলেন যে, বাংলাদেশের বিষয়ে ভারত সরকার কী পরিকল্পনা করছে, এর সবটুকুই হয়তো জ্যাকবের পক্ষে জানা সম্ভব নয়। কিন্তু তিনি যা জানেন, সে বিষয়ে তাঁর বক্তব্যের সত্যতা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশের আমি কোনো কারণ দেখি না। জ্যাকব পুনঃপুন আমাকে বলেছেন, কোনোভাবেই ভারতীয় সামরিক তত্পরতা ঘটেনি। ওই দিন সন্ধ্যায় আমাকে এক পাশে ডেকে নিয়ে পুনঃপুন বলেছেন, বাংলাদেশের বিষয়ে জড়িত হতে ভারতের কোনো ইচ্ছা নেই। এ বিষয়ে তাঁর ধারণা এতটাই শক্তিশালী যে, আমি যখন তাঁকে বললাম, এ বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত দিল্লি নিয়ে বসতে পারে, তখন তিনি হাত ঝাঁকিয়ে তা দৃঢ়তার সঙ্গে নাকচ করেন।
জিয়াকেই ভরসা: ৮ নভেম্বর সকালে পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দক্ষিণ এশিয়া বিভাগের মহাপরিচালক হায়াত মেহেদি ইসলামাবাদের মার্কিন দূতাবাসের পলিটিক্যাল কাউন্সিলরের সঙ্গে বাংলাদেশ পরিস্থিতি নিয়ে মতবিনিময় করেন। এ সম্পর্কে রাষ্ট্রদূত হেনরি বাইরোড লিখেছেন, মেহেদি স্পষ্ট করেন যে, খালেদ মোশাররফের চেয়ে পাকিস্তান জিয়াউর রহমানকেই অগ্রাধিকার দেয়। পাকিস্তান মনে করে, খালেদ ‘পাকিস্তানবিরোধী’ ছিলেন। বাইরোডের মন্তব্য, এখানে ‘পাকিস্তানবিরোধী’ মানে ‘ভারতপন্থী’। খালেদ মোশাররফের অভ্যুত্থানের পরদিন পাকিস্তানের কিছু প্রেস তাঁকে সুনজরে দেখেনি। খালেদ মোশাররফের বিরোধিতায় মেহেদি খোঁড়া যুক্তিই দেখান। তাঁদের অন্যান্য কর্মকর্তার মধ্যেও এটা লক্ষ করেছি। মেহেদিই যুক্তি দিলেন, ভারত যদি বাংলাদেশে কোনো প্রকাশ্য হস্তক্ষেপ করে, তাহলে লাভের চেয়ে তার ক্ষতির পরিমাণ হবে অনেক বেশি। মিসেস গান্ধী অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে শক্তিশালী অবস্থানে রয়েছেন। সুতরাং বাংলাদেশে হস্তক্ষেপের রাজনীতির কোনো প্রয়োজন তাঁর নেই। এবং তিনি এই বিপদ সম্পর্কে সজাগ থাকবেন যে, এটা তাঁর জন্য হিতে বিপরীত হতে পারে। মেহেদি বলেন, তাঁর বিশ্বাস, হিন্দু উদ্বাস্তুদের স্রোত বইয়ে যাওয়ার মতো কোনো আশু কারণ না ঘটলে তাঁরা হস্তক্ষেপ করবেন না।
চীনের সন্তোষ: পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দক্ষিণ এশিয়া বিভাগের মহাপরিচালক হায়াত মেহেদির মতে এ সপ্তাহের গোড়ায় পিকিংয়ে পাকিস্তান দূতাবাসের চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্সকে চীনারা বলেছে, জিয়াউর রহমানের ক্ষমতা গ্রহণকে চীন সন্তোষের সঙ্গে লক্ষ করছে। কিন্তু তারা নিশ্চিত নয় যে, জিয়াউর রহমান কত দিন ক্ষমতায় থাকতে পারবেন। মেহেদি বলেন, চীনারা মনে করে, বাংলাদেশে ভারতীয় হস্তক্ষেপ সম্ভব। কিন্তু তা তারা তাদের মতো করেই করবে। তারা এটা বিবেচনায় রাখবে যে, বাংলাদেশে কোনো হস্তক্ষেপের ঘটনায় ভারতের আধিপত্যবাদী কূটকৌশল এতে আরও স্পষ্ট হবে এবং এর বিরুদ্ধে বাংলাদেশের জনগণ ঐক্যবদ্ধ হবে।
সৌদি মনোভাব: পাকিস্তান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বাংলাদেশ ডেস্কের পরিচালক আজমত হাসান উল্লেখ করেন যে, ইসলামাবাদে চীনা কূটনীতিকদের সঙ্গে আলোচনা থেকে ইঙ্গিত মিলছে যে, সোভিয়েতের সঙ্গে তাদের সম্পর্কের সমীকরণের নিরিখে বাংলাদেশের ঘটনাবলির দিকে তারা নজর রাখছে এবং তারা মনে করে, চীন ও রাশিয়ার মধ্যে টানাপোড়েনের আরেক নতুন ক্ষেত্র হলো বাংলাদেশ। আজমত হাসান আরও বলেন, সৌদি আরবের দৃষ্টিভঙ্গি হলো, যদি কোনো মুজিববাদী স্টাইলে অধিকতর সেক্যুলার রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ মোড় নেয়, তাহলে তাদের সরকার ঢাকায় তাদের রাষ্ট্রদূত পাঠাবে না। এমনকি তখন বাংলাদেশকে কোনো অর্থনৈতিক সহায়তাও দেবে না। সে কারণে সৌদি আরব সরকার অপেক্ষা করার নীতি নিয়েছে। হাসান আরও ইঙ্গিত দেন যে, ঢাকার পরিস্থিতি মূল্যায়নে রিয়াদ ইসলামাবাদকেই অনুসরণ করতে পারে। (শেষ)
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।
mrkhanbd@gmail.com
http://prothom-alo.com/detail/date/2009-11-10/news/18412
এই পোস্টের টেক্সট প্রথমে বাগে খাইয়া ফেলছিল :(
এতো বড লিখা !! এতো সিরিয়াস লিখা !!! পডতে পডতে ঘুমায় গেছিলাম
ইভান ভাই উঠেন...সকাল হইছে......
ধৈর্য নিয়ে পুরোটা পড়লাম। মিজানুর রহমান খান সাংবাদিক হিসেবে সিম্পলি গ্রেট। এইরকস সাংবাদিক হৈতে মুঞ্চায়।
ধৈর্য নিয়ে পুরোটা পড়লাম। মিজানুর রহমান খান সাংবাদিক হিসেবে সিম্পলি গ্রেট। এইরকম সাংবাদিক হৈতে মুঞ্চায়।
মন্তব্য করুন