ঈদ শপিং বিড়ম্বনা
কেনাকাটা শব্দের আভিধানিক অর্থ যাই হোক না কেন, এর অন্তর্নিহিত ভাবার্থ হলো, ‘কিনতে গিয়ে কাটা পড়া’। অন্তত ঈদ মৌসুমে এ কথাটি ১০০% সত্যি। ঈদের মার্কেটে ঢুকলেই আমার নিজকে বকরি বকরি মনে হয়, আর দোকানীকে মনে হয়, ‘খড়গহস্ত-ধারী এক কসাই’। কোন কিছু কিনতে গেলেই সে ‘মূল্য’ নামক খড়গের এক কোপে আমার ‘সামর্থ্য’ আর ক্রয় ক্ষমতাকে জবাই করে দেবে। এ প্রসঙ্গে নিজের একটি অতি তিক্ত অভিজ্ঞতার বয়ান দিচ্ছি।
তখন সবেমাত্র বিয়ে করেছি। ‘প্রেস্টিজ’ রক্ষার জন্য বিয়েতে হাত খুলে খরচও করেছি। তাই বিয়ের পর পকেট রীতি মতো আউটার স্টেডিয়াম। ধার-দেনা করে চলতে হচ্ছে। এমন সময় ‘মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা’ এর মতো উদয় হলো ঈদ। আমি দু’চোখে তারাবাতি দেখতে শুরু করলাম...। ঈদের চাঁদকে মনে হলেন ‘কাস্তের ফলার মতো বাঁকানো ছুরি’।
সামনে ঈদ-এ ভাবনায় আমার দু’চোখে নিদ নেই। এদিকে নববধূর নিত্য তাগাদা-চলো যাই শপিং’এ। ঈদ যতো এগুচ্ছে, তার অস্থিরতাও ততো বাড়ছে, বাড়ছে অভিমান। চেহারায় ঘনাচ্ছে শ্রাবণের কালো মেঘ। অবশেষে বেতন-বোনাস হাতে পাওয়ার পর একটু ভরসা পেলাম। মাথার ওপর বিবাহ জনিত ঋণের বোঝা, কুছ পরোয়া নেই, আগে তো বউয়ের মন রক্ষা করি। কিন্তু মার্কেটে পা রাখতে রাখতেই মেজাজ বিগড়ে যায় আমার। কারণ সবার নজর বউয়ের প্রতি, ‘আপা আসেন... ম্যাডাম এদিকে আসেন... মেমসাব আসেন ভালো শাড়ি দেখাই...’। অথচ আমার দিকে কেউ ফিরেও তাকায় না, কেউ বলেনা, ‘দুলাভাই... কিংবা ভাইজান এদিকে...’। বউ আমার রাজহংসীর মতো মরাল গ্রীবা বাড়িয়ে, সগর্ব হাসি ছড়িয়ে মার্কেটের করিডোর ধরে হাঁটছে, আর দু’পাশের দোকানীরা বিভিন্নভাবে তার দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করছে...। এ দৃশ্য আমার জন্য বড্ড অসহ্য এবং বিব্রতকর। তবু্ও...বউয়ের পেছনে হাঁটতে থাকি।
আসলে শপিং সেন্টার গুলো হলো ‘নারী রাজত্ব’। এখানে তারা ঘোড়ার মতো দাবড়ে বেড়াবে, আর পুরুষেরা ভারবাহী গর্দভের মতো পিছু পিছু হাঁটবে-এটাই নিয়ম। বউ অত:পর একটি শাড়ির দোকানে তসরিফ রাখে। দোকানে একটাই চেয়ার খালি, তাই আমাকে বউয়ের পেছনে ‘স্ট্যান্ডবাই’ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। দোকানীর মধ্যে কোন ভাবান্তর নেই, সে আমার বউকে নিয়ে শশব্যস্ত হয়ে পড়ে...। দোকানের প্রায় অর্ধেক শাড়ি ওলট-পালট করার পর অবশেষে একটি নীল বেনারসি বউয়ের পছন্দ হয়। দোকানী এবার বউয়ের পছন্দের তারিফ শুরু করে, ‘জব্বর একখান শাড়ি চয়েস করছেন আপা, পড়লে যা লাগবোনা, একেবারে ডানাকাটা... আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থেমে যায় দোকানী। ‘ঠিক আছে, দামটা বলুন’। ‘দাম আর কতো ! আপনার কাছ থেকে বেশী রাখুমনা আপা, পাঁচ হাজার টাকা দিয়েন’। সঙ্গে সঙ্গে কেউ যেন হাতুড়ি দিয়ে আমার মাথায় সজোরে একটি বাড়ি বসিয়ে দেয়। বলে কি হারামজাদা ! এ শাড়ির দাম পাঁচ হাজার ! (দশ বছর আগে পাঁচ হাজার টাকা ছিল অনেক টাকা) এদিকে আমার বাজেট মাত্র আড়াই হাজার। বউও দাম শুনে হতাশ হয়, ‘না ভাই, এতো দাম দিয়ে শাড়ি কেনা সম্ভব নয়’। আসন ছেড়ে ওঠে দাঁড়ায় সে। দোকানী তড়িঘড়ি করে বলে, ‘কি আপা, রাগ করলেন?’ আপনি হলেন আমাগো নিজের লোক, যদি নেন আপনের জন্য চার হাজারই সই’। শালার কথা শুনে রাগে পিত্তি জ্বলে যায় আমার। মনে মনে বলি, আমার বউ তোর নিজের লোক হয় কিভাবেরে হারামজাদা! চড়িয়ে তোর দাঁত ফেলে দেবো...। শালাকে একটা শিক্ষা দেয়া দরকার। ‘চার হাজার টাকা একটু বেশী হয়ে যায়না ভাই !’ অতি মোলায়েম কন্ঠ আমার। দোকানীও বিগলিত হয়ে বলে, ‘কত দিবেন স্যার আপনিই বলেন’। ‘তিন’শ টাকা দিব’। ‘কত কইলেন !’ দোকানী রীতি মতো আঁতকে ওঠার ভঙ্গি করে। ‘তিন’শ...আচ্ছা ঠিক আছে পাঁচ’শই দেবো, নেন প্যাকেট করেন’। দোকানী এবার গম্ভীরকন্ঠে বলে, ‘ভাইজান কি আমার সঙ্গে মশকরা করতেছেন’? ‘মশকরা করবো কেন আপনি কি আমার দুলাভাই’? আমার কথা শুনে দোকানীর মুখটা হাঁ হয়ে যায়, চোখ বড় বড় করে সে তাকিয়ে থাকে আমার দিকে। আমার দশাসই ফিগার আর রাগী চোখ দেখে সে আর কথা বাড়ায় না। নচেৎ নির্ঘাত সে বলে বসতো, ‘এই দামে বেনারসি কিনা লাগবো না, বাবুর হাটের এক পিস গামছা কিনা বাড়ীতে যান’।
একই শাড়ি পরে অন্য দোকান থেকে বাইশ’শ টাকা দিয়ে কিনি। এজন্য অবশ্য পাক্কা দু’ঘণ্টা সময় নষ্ট করতে হয়। শাড়ীর পর ম্যাচিং করে ব্লাউজ, পেটি কোট,জুতা ইত্যাদি ইত্যাদি। ওফ্ ঝাড়া তিন ঘণ্টা ঘুরাঘুরির পরও বউয়ের শপিং শেষ হয় না। এদিকে ওর আর আমার হাতে প্যাকেটের সংখ্যা যত বাড়ছে, আমার মানিব্যাগও ততো হালকা হচ্ছে। ঈদের পর কি করে চলবে-এ দুশ্চিন্তায় তখন আমার কুত্তা পাগল দশা।
কেনাকাটা শেষ করে মার্কেট থেকে বের হওয়ার মুহূর্তেই হঠাৎ লোডশেডিং। সঙ্গে সঙ্গে গাঢ় অন্ধকার...। অন্ধকারে ভিড় ঠেলে বউয়ের হাত ধরে অনেক কষ্টে বেরিয়ে আসি। কিন্তু...একি ! তাড়াহুড়া করে বের হতে গিয়ে এ আমি কাকে হাত ধরে টেনে বের করে নিয়ে এসেছি ! এযে অন্য নারী ! তবে আমার বউ ? মহিলারও এতক্ষণে হুঁশ হয় আমি তার হাজবেন্ড নই। ‘এই যে আপনি কে ? আমাকে এভাবে টেনে হিঁচড়ে টেনে নিয়ে এসেছেন কেন, ইতরামির আর জায়গা পান না ?’ ‘সরি ম্যাডাম ভুল হয়ে গেছে, আমি ভাবছিলাম আমার বউ...’। ‘কি বললি বদমাশ কোথাকার ! দাঁড়া তোকে জুতিয়ে...’। বলতে বলতে মহিলা সত্যি পা থেকে জুতা খুলতে উদ্যত হয়। ওখানে দাঁড়ানো আর নিরাপদ মনে না হওয়ায় আমি দ্রুত ভিড়ের মধ্যে গা ঢাকা দেই। মার্কেটে ইতোমধ্যেই জেনারেটর চালু হয়ে গেছে। তাড়াতাড়ি ভিতরে গিয়ে দেখি, আমার নববধূ এক দোকানের ভেতর বসে চোখের পানি মুছছে...। আর দোকানের স্টাফরা তাকে সান্ত্বনা দিচ্ছে। আমাকে দেখে গরম তেলে বেগুনভাজা হয়ে বলে, ‘অসভ্য,ইতর... ওই মহিলার হাত ধরে তুমি কোথায় চলে গিয়েছিলে? এদিকে যে আমার সর্বনাশ হয়ে গেছে...’। এরপর নাকের পানি আর চোখের পানিতে একাকার হয়ে সে যা বলে, তার মর্মার্থ হলো, লোডশেডিং’র অন্ধকারে কে যেন তার হাত থেকে নীল বেনারসির প্যাকেট আর গলা থেকে চেইনটা খুলে নিয়ে গেছে...।
দারুন লেখা! খুব মজাক পাইলাম।
শর্মি আপনাকে......
দশ বছর আগেই মার্কেটে লোডশেডিং এর অন্ধকারে শাড়ি প্যাকেট আর গলার চেইন হাওয়া...তাহলে এখন কি হতে পারে?
~
হা হা হা স্বপ্নের ফেরীওয়ালা, আপনি যা বুঝাতে চেয়েছেন, আমি বুঝতে পেরেছি...।

এতো দিন পর?
টান তো ঠিকই দিছিলেন। বাসায় নিয়া গেলেই পারতেন।
জুতা পেটা খাওয়ার ঝুঁকি ছিল বস্। তাছাড়া 'রমণী বিষয়ক' সাহস আমার কোন কালেই ছিল না।
অনেক দিন পর ..
এক কথায় অসাধারণ হইছে বস...
হা জনাব, অনেক দিন পর....। আছেন কেমন ?
গড়াগড়ি খাইয়া হাসার কি হইলো !
আহা!ঐ দিন কি বাসায় ফেরার পর নিজের ঘরে ঢুকার চান্স পাইসিলেন আর?!
অন্ধকারে আপনে বউ চিনলেন না আর ভাবী ঠিকই দেখলো আপনে অন্য নারীর হাত ধরে টানা টানি করছেন???
: ভাবীর তো উচিত ছিল আপনার আগাপাশতলা সমান করা।

বাহ্ , আপনি হেভী একখান পয়েন্ট ধরছেন তো ! আপনার বুদ্ধির তারিফ করতে হয় । আর হা, আমাকে "আগাপাশতলা সমান করা"র ঔচিত্যের কারণটা কি বলবেন ?
আমিও একটা সরল প্রশ্ন জিগাই, ভাবী আপনারে মাইর দেয় নাই? আপনে যে আরেকজনের হাত ধরলেন!
হুম্ (দীর্ঘশ্বাসের ইমো) । সে আরেক করুন ইতিহাস ।
মজারু লেখা
আপনার দু:খে সবাই মজা পেয়েছে
অনেকদিন পর!! আছেন কেমন?
অনেক মজার লেখা।
আমি ভালো আছি, আপনি কেমন আছেন ? অনেক ধন্যবাদ ।
হা হা হা খুব মজা লাগল, লেখাটা পড়ে...।
আমার এক বান্ধবী বয় ফ্রেন্ডের সঙ্গে হেঁটে যাচ্ছিল, ঢাকার কোন এক রাস্তায়। রাস্তার ভিড়ের মধ্যেও সে গল্প করতে করতে মশগুল। এক জায়গায় থেমে, বয়ফ্রেণ্ডের হাত নিজের হাতে পাকড়াও করে-তাকে একটা সিনেমার পোষ্টার দেখাচ্ছিল।

হঠাত এক বুড়ো লোক বলে উঠলেন, "মা আমার হাতটা এবার ছাড়...।"
ভাগ্যিস লোকটি 'বুড়ো' ছিল ।
হিহিহিহি...মজাইলাম
দোস্ত, যা শুনাইলা!
গতকাল বসুন্দরায় গিয়েছিলাম! ভীষন খোলামেলা। আগামীতে এমন খোলামেলা মার্কেটে ভাবীকে নিয়ে যেও! পকেটে বেশী বেশী টাকা.।।।
বছর বা তারো বেশী হবে, মালিবাগ মোড়ে রিক্সা থেকে এক সন্ধ্যায় আমরা দুজনে বের হয়েছিলাম। হোসাফের সামনে উনার গলা থেকে বাজ পাখীর মত চোঁ মেরে হারটা নিয়ে যায় ছিনতাইকারী!
উল্টা আমার উপর চোট পাট! মনে হয়েছিল, আমিই ছিনতাইকারী!
(কে কারে বুঝাবে, দুই দিনের দুনিয়া!)
কে কারে বুঝাবে, দুই দিনের দুনিয়া!

আরে ঈশান ভাই যে, আছেন কেমন? ভাবী কেমন আছে? তাকে আমার পক্ষ থেকে একটা সালাম দিয়েন তো।
আপনার ভাবীকে সালাম পৌঁছিয়ে দিতেই সে বলে, 'তুমি আবার ব্লগে ঢুকছ !'
ব্যাপক হাসি হাসলাম।
আপনি লুকটা ভালু না।
আমার স্ত্রীরও তাই ধারনা। আপনে জানলেন ক্যামনে ?

মন্তব্য করুন