ফেসবুকের রকমফের
‘সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং’ শব্দটা বতর্মানে বহুল প্রচলিত শব্দ, আর ‘ফেসবুক’ সেতো আবাল-বৃদ্ধা-বনিতা সকলেরই মুখস্ত!বন্ধুত্বের মানেটাই পালটে গেছে ফেসবুকে এসে। আমার চেনাজানা, যার সাথে দেখাসাক্ষাত ঘটে প্রায়ই,আলাপচারিতায় মেতে উঠতে ভনিতা লাগে না, যার সান্নিধ্য উপভোগ্য লাগে সেই না আমার বন্ধু। কিন্তু ফেসবুকে কেবল এড করা হয়েছে বলে কতশতজন এসে জুড়ে যাচ্ছে আমার বন্ধু তালিকায়, তাদের সাথে আমার দু’দন্ড কথাও হচ্ছে না, তাদের কি হলো না হলো তার কোন পরোয়াই নেই আমার, কিন্তু আমার একাউন্টের বন্ধু তালিকায় তাদের নাম জ্বলজ্বল করে! ভেবেই পাই না একজন মানুষের হাজারে হাজারে বন্ধু হয় কি করে! এমনি করে চললে তো বন্ধু আর চিনপরিচিতের মাঝে পার্থক্যই বুঝাতে পারবো না নতুন প্রজন্মকে!
বিশ্বের সর্ববৃহৎ সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইট ফেসবুকে সবাই কেবল বন্ধুত্বের পরিচর্যাতেই ব্যস্ত তা কিন্তু নয়।কি না চলছে ইদানিং ফেসবুকে ইদানিং!একে অপরের সুখ-দুঃখের আনন্দরাজি ভাগাভাগির পাশাপাশি শিল্প-সাহিত্য চর্চা,সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে নেয়া মহতী উদ্যোগ,রাজনৈতিক কুটচাল,ব্যবসা, নোংরামি,কাদা ছোড়াঁছুড়ি সবই চলছে দেদারসে। ফেসবুকে সবাই একে অপরের বন্ধুত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হবার পরেই পথচলা শুরু হয়, সহজ করে বললে একাউন্ট তৈরীর পর ফ্রেন্ডলিষ্টে এড হয়ে/করে তবেই ফেসবুকিং শুরু। তাই এই বন্ধু তালিকায় চলে আসেন বন্ধুস্থানীয় ছাড়াও আর সবাইও। এমনি নানান পদের বন্ধুর সম্ভার নিয়ে চলা একজনের অবস্থা নিয়ে কৌতুক –
এক ছেলের ফেসবুক স্ট্যাটাস
“ক্লাসে লেকচার চলছে...আর আমি ফেসবুকে অনলাইনে...হাহাহাহা”
তার শিক্ষকের কমেন্ট -“বের হয়ে যাও ক্লাস থেকে এখনি”
বন্ধুর কমেন্ট - “আরে ক্যান্টিনে আয়... কার্ড খেলবো...
গেটকিপারের কমেন্ট - “আগে নিজের বাইক লক করে যাও... ডীন ঘুরতে বের হইছে”
মায়ের কমেন্ট - “অসভ্য! ক্লাস না করলে ১ কেজি পিয়াজ নিয়ে সোজা বাসা চলে আয়”
বাবার কমেন্ট -“দেখো দেখো তোমার ছেলের কাজকারবার দেখো!!”
প্রেমিকার কমেন্ট -“I hate u, বললাম আজকে দেখা করি,বলে কি,দাদা হাসপাতালে ডেটিং এ যেতে পারবো না!
দাদার কমেন্ট - “নালায়েক!বাসায় আয় আগে, দেখাচ্ছি কে হাসপাতালে যায়”
দিনমান ফেসবুক জিজ্ঞেস করেই চলে –‘আজ আপনার মনে কি চলছে’? কথায়, ছবিতে, ভিডিওতে সম্মন্বিত করে হরেক স্ট্যটাস আপডেটের মাধ্যমে নিজের প্রতিমূহুর্তের হাল জানিয়ে দিচ্ছি আমরা বন্ধু তালিকায় থাকা সবার মাঝে। এই তালিকায় হতো হাতেগোনা কিছু আছেন আমাদের বন্ধু যাদের সাথে চেনাজানা রয়েছে কিন্তু বাকি অজানা-অচেনার মাঝেও চলে যাচ্ছে তা। কেবল কি তাই! যেই বন্ধু এই স্ট্যাটাসে লাইক কিবা কমেন্ট করছেন তার বন্ধুদের (যারা আদৌ আপনার বন্ধুতালিকাতেও নেই!)টিকারের ভেসে উঠছে আপনার মনের কথা!’টিকার’ ফেসবুকের মোটামুটি নতুন সংযোজিত এক অংশ!তো এ থেকে অতি দ্রুততায় সবাইকে জানিয়ে দিতে পারছেন - সকালে আপনি কি দিয়ে নাস্তা করেছেন তার কারনে পেট গুড়গুড় করছে!অবস্থা বেগতিক!
স্ট্যাটাস চুরি তো নিত্যদিনকার ঘটনা!নিজে খেটেখুটে সাম্প্রতিক ঘটনা কিংবা দারুন কিছু লিখলেন, অনায়াসেই তা অন্য কেউ কপি করে নিজের লেখা বলে চালিয়ে দিচ্ছেন, তাও খোদ ফেসবুকেই!
তবে সবকিছুরই যেমন ভালোমন্দ দু’দিক আছে তেমনি এই স্ট্যাটাস আপডেটেরও। কারন অনেকেই সোশ্যাল এ্যাওয়ার্নেস মূলক কথা,সুসংবাদ,কোন দূর্লভ ছবি, কিংবা সাম্প্রতিক ঘটনা শেয়ার করতে পারছেন এর মাধ্যমেই। সবচেয়ে তরতাজা উদাহরন হচ্ছে,কিছুদিন আগে ঘটে যাওয়া রামু’র সেই ন্যাক্কার জনক ঘটনার খবর কোন জনমাধ্যমে প্রকাশের আগেই সোশ্যাল মিডিয়ার কারনেই সবার মাঝে ছড়িয়ে পড়ে। আবার এই ঘৃন্য ঘটনার সূত্রপাতও এই ফেসবুকের ট্যাগিং থেকেই!
সুন্দর,দূর্লভ অথবা মজার ছবিতে/গানে বন্ধুকে ট্যাগ করে দেয়া হয়ে যাতে সেটি সহজেই তার নজরে আসে,তার মতামত পাওয়া যায়। সেটিকেই হাতিয়ার করে অমানুষেরা কিভাবে মানুষ মারার নোংরা খেলায় মেতে উঠেছে সে প্রমান এখন সবার সামনে!আর বিরক্তিকর নানান ছবিতে কোন একবন্ধুকে ট্যাগ করা হলে তা চলে আসে তার তালিকায় থাকা অন্যবন্ধুদের নিউজফিডে! সে যে কি যন্ত্রনাকর বিষয় তা ভুক্তোভোগীরাই মাত্র জানেন!
গ্রুপিং আর ইভেন্ট হচ্ছে আরেক ফেসবুকিও অধ্যায়,যা্তেও আছে ভালোখারাপের এপাশ-ওপাশ! যে কেউ অনায়াসেই অনুমতির বালাই ছাড়াই তালিকাভুক্ত করে নিচ্ছেন আপনাকে কোন বিজাতীয় গ্রুপে কিংবা কোন ইভেন্টে যেসবে আপনার নাই বিন্দুমাত্র আগ্রহ!এদিকে সেসবের নোটিফিকেশন পেতে পেতে কাহিল হবার জোগাড় আপনার একাউন্টের।বিরক্তি প্রকাশ করবেন তো গোস্বা হয়ে যাবেন তথাকথিত বন্ধু!তাই ভদ্রতাই বংশের পরিচয় দেখিয়ে চুপচাপে সেইসব থেকে বেরিয়ে আসাই বুদ্ধিমানের কাজ করবেন।
আবার অনেক গ্রুপে দারুন সব আলোচনা হয়,নির্মল আনন্দ হয়,শেখার সুযোগ থাকে বেশ,কত অজানারে হয় জানা। যেমন বইপড়ুয়া গ্রুপ,ফটোগ্রাফি গ্রুপ ইত্যাদি। এতো গেলো ওপেন গ্রুপগুলোর কথা, অনেক গ্রুপ থাকে যারা হয় সিক্রেট গ্রুপ। দরকারী তথ্য আদানপ্রদান কিংবা আড্ডাবাজী অথবা গভীর কুটচালি – সবই চলে সেসবে সদস্যদের পছন্দমতোন।
এই ডিজিটাল যুগে প্রচন্ড ব্যস্ততায় বিয়ের দাওয়াত দেবার মোক্ষম পদ্ধতি ফেসবুকের ইভেন্ট অধ্যায়টি। বিয়েরকার্ড স্ক্যান করে সুন্দর ভাষায় বর্ননা দিয়ে দাওয়াতী বন্ধুদের একবারে একটা ইভেন্টে এনে দিলেই দারুন একটা দাওয়াত দেয়া হয়ে যায়!ইদানিং বেশ জনপ্রিয়ই এই পদ্ধতিটি।
শেয়ারকৃত ছবিটা কতটা ‘লাইক’ পেতে পারে? – বহুল ব্যবহৃত বললেও কম বলা হয় এই লাইনটিকে বুঝাতে! নানান ধর্মীয় কিংবা অসুস্থ শিশুর নয়তো কুরুচীপূর্ন ছবি কিছুই বাদ পড়ে না ফেসবুকে এই লাইক ভিক্ষার দৌরাত্ম থেকে!
শহরের অলিতে গলিতে গজিয়ে চলছে শপিংমল, বাদ নেই ফেসবুকও!নানান কোম্পানীর সোশ্যাল মার্কেটিংও চলে ফেসবুকে, কর্মীরা রীতিমত ক্লায়েন্টদের সাথে ডীল করেন। ইদানিং ফেসবুকের পাতায় পাতায় কেবল বাজারের দেখা মিলে, কাপড়, গহনা, আসবাব,বই, নানান যন্ত্রপাতি সবপন্যের সমাহার ঘটে সেখানে। ট্রাফিক ঠেলে দোকানে গিয়ে গিয়ে কেনার চেয়ে অর্ডার দিয়ে ছবি দেখে পছন্দসই পন্য আগাম টাকা দিয়ে কুরিয়ারের মাধ্যমে পাওয়া কত্তো আরামের,ঘরে বসেই শপিং।অনেক দরকারী ভালো জিনিস যেমন পাওয়া যায় আবার অনেক পন্যের মানসম্পন্নতা নিয়ে বেশ প্রশ্ন উঠেই। জামা কিনে ঘরে পৌছাবার পর দেখা গেলো কাপড় কাটা, কিবা রঙ উঠে একবারের দফারফা হাল!
ফেসবুক কেড়ে নেয় মূল্যবান কর্মঘন্টা,সম্পর্কে বিরুপতা আনে,লোকদেখানি অহমিকা বাড়ায় – এমনি আরো আরো দোষের কথা আনলেও ফেসবুকিং কি ছেড়ে দিবো, উলটে এই দোষগুলো থেকেই তো উপলব্ধি আসতে পারে সতর্কতার, ফেসবুকিং এর পরিমিত বোধের।ফেসবুকে নাকি প্রায় ৫০ লক্ষাধিক বাংলাদেশীর পদচারনা চলে নিত্যদিন। তিন গোয়েন্দায় পড়া ‘ভূত থেকে ভূতে’ পদ্ধতির যথার্থ উপযোগিতা পেতে পারি আমরা এই ফেসবুক থেকেই।মূল্যবান তথ্য কমসময়ে খুজেঁ নেয়া যায় বন্ধুদের সহায়তায়,যথাযথ তথ্যের আদানপ্রদানের মাধ্যমে যেকোন গনসচেতনতার একটা মোক্ষম হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে পারি।সবকিছুরই রকমফের আছে ভালোমন্দের নিজস্ব বোধবিবেচনা দিয়ে তার ব্যবহার সুনিশ্চিত করতে হবে আমাদেরই।
এই লেখাটা http://amader-shomoy.org/wp-content/uploads/vabnabinemoye1.png
কোথাও বেড়াতে গেলে সেখান থেকে ফিরে যখনই ফেসবুকে বসি দেখি আমার কন্যা সে জায়গা থেকেই স্ট্যাটাস দিয়ে রেখেছে।
ভাল মন্দ দুই ই আছে যে যেভাবে ব্যবহার করে, তবে আমার কাছে এটা ভাল মনে হয় । আজকের এই পর্যায়ে এসে খুব অবাক হয়ে দেখি আমার স্কুল/কলেজ/ ভার্সিটি জীবনের করও সাথে আমার যোগাযোগ নেই। ফেসবুকে বন্ধু হচ্ছে,যাদের সাথে মন ও মতের মিল হচ্ছে তারা টিকে থাকছে, বন্ধুত্ব গভীর হচ্ছে।সহমর্মিতা, সহযোগীতা, স্নেহ,ভালবাসার হাত সবাই বাড়িয়ে রেখেছে। যে যেভাবে পারে সাহায্য করে। মানসিক সাপোর্ট ও অনেক সময় অনেক বড় পাওয়া।
দারুণ লিখছো
ফাটায়া দিছেন পুরা!
দারুন পোষ্ট। অনেক ভাল লাগল পড়তে।
কৌতুক তো জটিল হইসে

সবচেয়ে হাস্যকর লাগে মূহুর্তে মূহুর্তে মানুষের আপডেট দেয়া দেখে। পারলে যেন প্রতি সিগন্যালে আপডেট করে 'ইজ @ ধানমন্ডি ২৭, ২ মিনিট পর আড়ং এর সামনে আবার ৩ মিনিট পর মানিক মিয়া এভিনিউ।
বহুদিন ফেসবুক ছাড়াই আছি। এইটাও এক রকম ভালোই
ফেসবুক দারুণ জিনিস!
এতো গুরুত্বপূরন পয়েনট উদাহরণ ছাড়াই চলে গলো? এমন দু একটা গ্রুপ এর উদাহরণ চাইইই
ফেসবুক ভালু না। তোমার লেখা ব্যপক।
আপুমনি, কমেন্টের রিপ্লাই দেয়া হয় নাই
কি পাইছেন আপ্নে! কোন নতুন লেখা নাই ক্যান?!

মন্তব্য করুন