ইউজার লগইন

সুন্দরবন ভ্রমন ২০১৩ (পর্ব ৩)

সুন্দরবনে ভ্রমন ঠিক যতটা এডভেঞ্চারের ততটাই প্রশান্তিময়। একদিকে শহরের ধূলায়ভরা, কালো ধোয়াঁতে ভারি বাতাসের মাঝ দিয়ে জীবনের নানান ব্যস্ততায় ছুটাছুটির পরিবর্তে কোলাহল বিহীন পাখির কুজনের মাঝ দিয়ে স্রোতের সাথে কলকলিয়ে চলা, সাথে রয়েছে সম্পূর্ন এক গা ছমছমে বন্য পরিবেশের মাঝে দিয়ে পরিভ্রমন যা কিনা সুবিখ্যাত রয়েল বেঙ্গল টাইগার ছাড়াও নানান হিংস্র বন্যপ্রানীতে পরিপূর্ন!

১৪ ডিসেম্বর, সকাল ৫টার এলার্ম বাজার আগেই উঠে জানালা দিয়ে তীরে খাবার খুটে খেতে আসা পাখি দেখছিলাম, চারপাশের এত্তো নিস্তব্ধতা খুব যেন মনে লাগে, এত্তো নিশ্চুপতাতে অভ্যস্ত নই যে! ট্রলার ছেড়ে দেবে বলে তাড়া দিতে আসা লঞ্চের স্টাফের হুইসেলের শব্দে গিয়ে রেডী হয়ে উঠে এলাম। কাকডাকা ভোরে ঘুম ভেঙ্গেই ট্রলারে চেপে জুবুথুবু হালে বেরিয়ে পড়লেও কারুর মাঝে আলসেমি নেই, উলটো দারুন কিছু দেখার প্রত্যাশার উত্তেজনায় ছেলেবুড়ো সবাই। সকালে পানি খেতে বের হওয়া বাঘের দেখা পাবার ইচ্ছে নিয়েই কটকা’র জামতলার উদ্দেশ্যে যাত্রা। আমাদের সর্বকনিষ্ঠ সদস্য বোধকরি চার মাস বয়েসি। আমাদের ৪০জনের গ্রুপের ১১জন বাদ পড়ায় ট্যুর অপারেটর খুলনা থেকে তাদের নিকট আত্নীয়দের আমাদের সাথে নিয়েছেন। মনোবল আর সদিচ্ছা রইলেই সব ট্যুর করা সম্ভব।

চারপাশ জুড়ে রহস্যময় সুন্দরের হাতছানি। ঢেউহীন শান্ত পানির উপর দিয়ে ছুটে চললাম গভীর বনের দিকে। আস্তে আস্তে ঘন থেকে ঘন হতে হতে এসে আবেশিত করে যাচ্ছিল আমাদের অতি আকাঙ্ক্ষিত সুন্দরবন। দু’ধার ঘিরে থাকা বন, কিছুদূর পার হলে আবছা আধাঁর ঘেরা সরু সরু খাল। বেশ কিছুক্ষন চলার পর বনের মাঝে ট্রলার বাধাঁর একটা জায়গা, জামতলাতে পৌছেঁ গেছি। সবার হাতে হাতে পানি বিতরন করতে করতে গাইড জানাচ্ছিলেন, শব্দ করবেন না, দল বেধেঁ থাকুন –ইত্যাকার জানা কথাগুলোই। কিন্তু কিছুটা কম রইলেও কথার ছটা কমছে কই! ট্রলার থেকে নেমে একটা প্রবেশদ্বারের মতোন জায়গা পেরিয়েই একটা ওয়াচ টাওয়ার। দুড়দাড় করে সব উঠতে লাগলো টাওয়ারে, গাইড বারেবার ডাক দিচ্ছে ৮/১০জনের বেশি উঠবেন না যেন। যারাই উঠেছে প্রথমবারে আর নামার নামই নেই! সামান্য আগেই কলকলানো কথার তুবড়ি ছোটানো সব যেন স্তব্ধ হয়ে গেছে!

4_2.jpg

হালকা নীলাকাশের আশপাশ লালিমা ছড়িয়ে পূবের সূর্য জেগে উঠছে কুয়াশার চাদর সরিয়ে, সামনের যতদূর চোখ যায় বিস্তীর্নভূমি জুড়ে সবুজের মেলা, মাঝ দিয়ে এক পায়ে চলা পথ শীর্ন হতে হতে চলে গেছে ঘন বনের দিকে।

স্তম্ভিত ফিরে পেতেই সমানে ক্যামেরা ক্লিকের শব্দ কেবল শোনা যেতে লাগলো, তাও কারুর মুখে কথা নেই। আমার তো রীতিমতো ভয় লাগতে লাগলো, এতো সুন্দর মূহুর্তের ছবি তুলবো কি না! কারন এতো সৌন্দর্য্য তো ধরতে পারবোই না জানি, তবে কি ক্যামেরাবাজি করতে গিয়ে এই অতুলনীয় দৃশ্য দেখা থেকে বঞ্চিত হবো। বেশকিছু সময় লেগেছে আমার ছবি তুলতে, এর মাঝে অন্যদল টাওয়ারে উঠবেন সেই তাড়া। পায়ে চলা পথে যখন হাটা শুরু করলাম, সত্যিকারে রোমাঞ্চের ভাব যেন এলো পুরোপুরি, আর লাগছিলোই দারুন যাবে সময়টা। শুকনা মাটির পথ ধরে নিচুস্বরে গল্প করতে করতে গাইড এটাওটা জানাচ্ছিলেন, কত রকমের কত ধরনের গাছ ঘিরে রয়েছে আমাদের। বারংবার আশপাশ দেখে চলার কথা বলছেন কারন বাঘের দেখা হতেই পারে, যেখানে সেখানে না দেখে যেন পা না ফেলি সাপখোপের দেখা মিলতেই পারে। কতটা ভয় লাগানো কিবা গল্পবাজি হোক না কেন, প্রথমদিন অনুযায়ী কিছুটা হলেও ভড়কে দিতে পেরেছেন তারা। হরিনের পায়ের ছাপ আরো কত কি দেখতে দেখতে অনেকদূর পথচলার পর চলে এলাম আপাত খোলা অংশে।

বহুল পঠিত শ্বাসমূলে ছেয়ে আছে চারপাশ। পা বাঁচিয়ে সাবধানে সেসব পেরিয়ে সমুদ্রের দেখা পেলাম। এতো বিশাল সুন্দর যেন ঠিক উপভোগ্য নয়, কারন সবটা এলাকা জুড়ে ছড়িয়ে আছে সিডরের আঘাতের চিহ্ন।

5_1.jpg

6_0.jpg

8.jpg

মৃত্যুর পরোয়ানা গোনা কতো কতো গাছের গুড়ি দাঁড়িয়ে আছে, কিছু কিছু মূলসহ উপড়ানো গাছের ভগ্নাংশ, অন্যরকমের মাত্রা এনে দেয় পরিবেশে। হয়তো আপাত দৃষ্টিতে ছবি্র ফ্রেমে নান্দনিকতা ফুটিয়ে তোলে সেসব কিন্তু আদতে গোটা পরিস্থিতে কি যে ভীষন বিষন্নতা এনে দেয়! এই গাছগুলো না রইলে আমাদের এই সুন্দরবনের কতটা মুছে যেত, কিবা লোকালয়ের আরো কতো ক্ষতিসাধন করতো সিডর। গাছের মূল্য যা বুঝেই এসব কেটে সাফ করতে উঠেপড়ে লেগেছি আমরা, সভ্য নগরীর প্রয়োজনীতা মেটানোর নিমিত্তে! সৃষ্টিকর্তা আমাদের শুভ বুদ্ধির উদয় দিন।

খানিকক্ষন থাকার পর গাইডরা আবার ফিরতি পথে নিয়ে চললেন সবাইকে। চেনারাস্তা এবার পথচলায় সবার মাঝেই স্বতোস্ফুর্ততা বেশিই। তবে যথারীতি গাইডদের হুশহাস, চারপাশ দেখে চলার সাবধানবানী শুনতেই হচ্ছে। প্রায় ২কি.মি.মতো হেটে এলাম কোন হাপধরা ছাড়াই কারুরই, তবে ফেরার সময় প্রায় পৌছেঁ যেতে যেতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছি কিছুটা হলেও। বাঘ, হরিনদের সুপেয় পানি খাবার জন্যে বন কর্তৃপক্ষ বানানো ছোট্ট একটা পুকুরের দেখা মিললো, এর পানি নাকি বেশ মিষ্টি, চেখে দেখা হয়নি যদিও। টাইগার ফার্নের একটা ঝোপ পুকুরের পাশেই, বাঘ নাকি বন থেকে বেরিয়ে পানি খেতে আসে এখানে আর মাঝে মাঝে ঘাপটি মেরে বসে রয় এই ঝোপের আড়ালে। অনেকটাই ক্যামোফ্লাজের কাজ করে এই ফার্নের ঝোপ। দেখি না কোনকিছু এই আশায় গাইডকে বলে কয়েই ঝোপের ভেতরের দিকে সামান্য কিছুটা গেলাম আমরা ক’জন, বেশি মাত্রায় কাদা ছাড়া সবই দুরাশা! অনেকেই দাতাঁল শুয়োর, নাম না জানা সুন্দর পাখি ইত্যাদির দেখা পেয়ে গেছেন এই হাটার সময়েই, আমিই অভাগা।

9.jpg
টাইগার ফার্ণের ঝোপ

10.jpg

হেটেঁ পার হয়েছি প্রায় ৪ কিমি.মতো পথ, সূর্য মাথার উপর উঠছে, সবার খিদে জোর কদমে বেড়েই চলছে! ফিরতে ফিরতে দলবাধাঁ হরিনের দেখাও মিললো কিছু। লঞ্চে ফিরেই সব খাবারের লাইনে দাঁড়িয়ে গেছে, আর সেকি খাবারের আইটেমের বাহার, পুরোই জিভে জল আনা। পুরা ট্যুরে ভীষন রকমের খাওয়াদাওয়ার উপর ছিলাম সবাই, বাবুর্চিও ছিলেন দারুন পাকা রাধুঁনী নাকি বলবো রাধঁক! খেতে খেতেই খোজঁ নিলাম গতকাল রাতে লঞ্চ থেমে থাকার কারন। সুন্দরবনে প্রবেশের সময় বনবিভাগকে জনপ্রতি ৬৯০টাকা এন্ট্রি ফি দিতে হয়। ঘুম ভেঙ্গে আতঁকে উঠলাম যখন কি না কি ভেবে, সেসময় এই ফি জমা দেয়া হচ্ছিল।

সুন্দরবন ভ্রমন ২০১৩ (পর্ব ২)

সুন্দরবন ভ্রমন ২০১৩ (পর্ব ১)

পোস্টটি ২০ জন ব্লগার পছন্দ করেছেন

বিষণ্ণ বাউন্ডুলে's picture


এইটা ঠিকঠাক হইছে! Smile

মাথা নষ্ট ছবি পুরাই,
ইস্পিশালি প্রথমটা।

বর্ণনাও ভালা হইছে, ক্যারি অন!

জেবীন's picture


সময়টাই ছিলো মাথানষ্টের মতোন Smile

ধন্যবাদ, দেখি কদ্দুর পারি

সাঈদ's picture


দুর্দান্ত

জেবীন's picture


আপ্নের স্টকে কেবল এক শব্দ কেন? ধইন্যা পাতা

টুটুল's picture


কোক

জেবীন's picture


Beer কোক খাইলেন এইবার কফি নেন!

মীর's picture


দারুণ হচ্ছে এই ভ্রমণকাহিনীটা। চমৎকার বর্ণনা। মনোযোগ দিয়ে কাজটা করছেন বোঝা যাচ্ছে। কিপিটাপ।

জেবীন's picture


গেলাম, খাইলাম - ধাচেঁর কিছু না লিখে এট্টু বাড়ানো চেষ্টা করেছি, পারি কিনা দেখি।
মন্তব্যের জন্যে ধন্যবাদ Smile

রাসেল আশরাফ's picture


চলছে চলুক Big smile Big smile

১০

জেবীন's picture


Cool

১১

শুভ্র সরকার's picture


ভ্রমণকাহিনীটি পড়ছিলাম আর মনে হচ্ছিল আমি সুন্দরবনে ঘুরছি৤ দারুণ অনুভূতি৤

১২

জেবীন's picture


:ধন্যবাদ Smile

১৩

তুহিন's picture


দুর্দান্ত

১৪

জেবীন's picture


ধ্যনবাদ Smile

তুহিনভাই, আপনি রেজিস্ট্রার করে ফেলেন ব্লগে, চাইলে নিজেও মনের মতো করে লিখবেন

১৫

আরাফাত শান্ত's picture


জোস!

১৬

জেবীন's picture


Cool

১৭

তানবীরা's picture


দুর্দান্ত

১৮

জেবীন's picture


সাইদ্ভাই'র কমেন্টের কপি-পেষ্ট Tongue

মন্তব্য করুন

(আপনার প্রদান কৃত তথ্য কখনোই প্রকাশ করা হবেনা অথবা অন্য কোন মাধ্যমে শেয়ার করা হবেনা।)
ইমোটিকন
:):D:bigsmile:;):p:O:|:(:~:((8):steve:J):glasses::party::love:
  • Web page addresses and e-mail addresses turn into links automatically.
  • Allowed HTML tags: <a> <em> <strong> <cite> <code> <ul> <ol> <li> <dl> <dt> <dd> <img> <b> <u> <i> <br /> <p> <blockquote>
  • Lines and paragraphs break automatically.
  • Textual smileys will be replaced with graphical ones.

পোস্ট সাজাতে বাড়তি সুবিধাদি - ফর্মেটিং অপশন।

CAPTCHA
This question is for testing whether you are a human visitor and to prevent automated spam submissions.