সুন্দরবন ভ্রমন ২০১৩ (পর্ব ৫)
সময় সুযোগ পেলে হরহামেশাই কক্সবাজার ঘুরে আসেন প্রায় সকলেই, কিন্তু সেই তুলনায় সুন্দরবন ঘুরতে যাওয়া মানুষের সংখ্যা খুবই কম। যোগাযোগ ব্যবস্থা ভাল হলেও, সুন্দরবন বেড়াতে যাওয়ার নানান নিয়মকানুন আর অমূলক ভয়ের কারনেই অনেকের যাওয়া হয়ে ওঠে না । এই ক্ষেত্রে সুন্দরবন যেতে চাইলে ট্যুর কোম্পানী অথবা অভিজ্ঞ কারো সাথে যাওয়াই ভালো। সুন্দরবন ঢোকার ব্যাপারে হরেক রকমের বাধ্যবাধকতা আর নিয়মকানুনের ঝামেলা পোহাতে হবে না যদি কোন ট্যুর কোম্পানী কিবা অভিজ্ঞ কারুর সাথে যান। অনেকেই আবার বাঘের ভয়ে সুন্দরবন যেতে চাননা। কিন্তু বাঘের এই আকালের সময়ে বাঘের দেখা পেয়েছেন এমন কারুর দেখা মেলাই ভার! আর প্রকৃতির কোন কিছুকে বিরক্ত না করলে তাও নিশ্চয়ই বিরূপ হবে না মানুষের প্রতি। বাঘও বিরক্ত করেনা। তাই এইসবের চিন্তায় সুন্দরবনের যে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য তা না দেখা থেকে নিজেকে বঞ্চিত করার মানেই হয় না।
অন্যান্য স্থানে বেড়াতে গিয়ে সেখানকার লোকজনের দেখা মেলা, বাজার-লোকালয় কত কি, কিন্তু সুন্দরবনের এই ভ্রমনে আমরা দেখেছি কেবল দিগন্ত বিস্তীর্ন বিপুল জলরাশি, যা কিনা প্রায়শই মিলেছে মেঘহীন আকাশের সাথে, কিবা দু'ধারে সাথে চলা সারিসারি গাছের সমারোহ তাতে মাঝেমাঝেই হরিনের পাল, হরেক পাখির দল। জানি না কেন, যতদূর দেখা যায় গাছের সারি, পানি, আকাশ – এই যে একই জিনিস দেখলাম ক’টা দিন জুড়ে ক্লান্তি আসেনি একবারো।
আগেরদিন কটকা ঘুরে পড়ন্ত বিকেলে গিয়েছিলাম দুবলার চরে। বঙ্গোপসাগরের এই দ্বীপটি শুটকিপল্লী হিসেবেই পরিচিত । বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানের জেলেরা মাছ ধরার মৌশুমে প্রতি বছর এখানে অস্থায়ী ঘরবাড়ি তৈরী করে সাগরে বিপুল পরিমান মাছ ধরে এবং তা থেকে শুটকি বানিয়ে বাজারে বিক্রি করে । এছাড়াও দুবলারচরে প্রতি বছর কার্তিক মাসে রাসপূর্ণিমায় 'রাসমেলা' বসে । হিন্দুদের পূণ্যস্নান উপলক্ষে এ রাস মেলা বসে । হিন্দু ধর্মাবলম্বিরা বিশ্বাস করেন, রাসমেলা হচ্ছে 'রাধা-কৃষ্ণের মিলন উৎসব'। রাসমেলা উপলক্ষে অনেক দেশীবিদেশী লোকজন ও পর্যটকরা আসেন দুবলারচরে।
তীরের যেখানে লঞ্চ ভেড়ানো হয়েছিল সেখান থেকে পাড়ে নামার জায়গায় দেখলাম হাটুঅব্দি কাদা, তবে এর মাঝেও অনেকেই পারে নেমে গেলেন, কেন যেন আলসেমি করে নামিনি নীচে। লঞ্চের খোলা জায়গায় বসে থেকেই পারের লোকজন দেখলাম।ট বড়বড় নৌকায় মালপত্র তোলা হচ্ছে, অনেকপাখির আনাগোনা চারপাশের সৈকতে। কিছু পরেই বেলা নামছে তাই সবাই ফিরে এলেন আস্তে আস্তে। দুবলারচরে না নেমে যে কি ভুল করেছি, এতো সুন্দর একটা গ্রাম দেখা থেকে বঞ্চিত হয়েছি কেবল আলসেমির কারনে! বেড়াতে বেরিয়ে কোন কিছু না দেখে আসা মানেই আফসোস করা, তা সে যা কিছুই হোক, ছোট কিবা বড়, প্রত্যেক কিছুতেই ছোটছোট্ট সৌন্দর্য্যতা জড়িয়ে থাকে! অন্যদের ক্যামেরায় দুবলার চরের শুটকিপল্লীর ছবি দেখে আফসোস যেন কুরে কুরে খেয়েছে!
সুন্দরবনে ফোনের নেটওয়ার্ক না থাকাটা সত্যিই ভ্রমনটাকে আরো শান্তির করে তোলে, নইলে একসাথে এতোগুলো মানুষ আছি, ক্ষনেক্ষনেই ফোনের নানান রিংটোন বনের নিস্তব্ধতাকে চুরচুর করে দিতোই। আজ চলেছি আমরা হিরন পয়েন্টের দিকে।
ভ্রমনের দ্বিতীয়দিন ভোরে উঠবার তাড়া ছিলো না তাও ভোরবেলাতেই ঘুম ভেঙ্গে গেছে। বিছানাতে থেকেই চেয়ে চেয়ে দেখি সেই বনের সারি, মাঝে মাঝেই ম্যানগ্রোভের অস্তিত্ব, বকের ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকা, হুটহাট 'মদনটাক' পাখির অলস হেটে যাওয়া। সব চলছে নিয়মমতোই কিন্তু ভীষন আলগোছে, সৌন্দর্য্যের অনুভূতি চকিতেই আনন্দ দিয়ে চলে যায় না এখানে, মন ভরে শ্বাস নিয়ে তারিয়ে তারিয়ে উপলব্ধির আমেজ পাওয়া যায়। রয়েসয়ে আরাম করে বিছানা ছেড়ে নাস্তার লাইন ধরাতেই যা কিছু তাড়া! নাস্তা-গল্পগুজবেই বেলা পার।
এর মাঝে শোনা গেল কি এক জায়গায় দুপুরের দিকে ট্রলারে করে নেয়া হবে কেবল ছেলেদেরই, কোন মেয়ে সেখানে যেতে পারবে না! ভাবলাম হয়তো কষ্টসাধ্য পথচলার জন্যে মেয়েদের নিতে চাইছে না ট্যুর অপারেটর। রাগই হলো কারন আগেরদিন হাটতে কেউ আপত্তি-অভিযোগ করেনি, তাও কেন এহেন সিদ্ধান্ত! পরে জানা গেল, সামনেই আছে এক মিঠাপানির পুকুর, সেখানে গোসল করতে যাবে ছেলেরা দল বেধেঁ! মেয়েরাতো রুমের এটাচড বাথরুমে দিব্বি গোসল সেরে নিতাম নোনাপানিতেই, একজনে তো চেয়ে নিয়ে গরমপানিরও ব্যবস্থা করে ফেলেছিলেন, সাধে কি বলি, ট্যুরের লোকজন ভীষণ সহযোগিতা করেছেন। তো ছেলেরা গামছা-কাপড় কাধেঁ চাপিয়ে আটঘাট বেধেঁ ট্রলারে করে তাঁরা গেলেন গোসলে!
হিরনপয়েন্ট, যার আরেক নাম নীলকমল। এতো সুন্দর এক নাম থাকতে জায়গাটা কেন হিরন পয়েন্ট নামে পরিচিত হলো বোধগম্য হলো না। এখানে আছে বন বিভাগের সুদৃশ্য অফিস, মিঠাপানির পুকুর, পুকুরপাড়ের কাছেই ওয়াচ টাওয়ার। সেই পুকুরেই নাইতে গিয়েছিলেন ছেলেরা, পরে দুপুরের খাবার খেয়ে ঝুপঝাপ ট্রলারে চেপে রওনা দিলো সবাই, মাঝপথে যারা হাটবেন না তাদের নামিয়ে দেয়া হলো বনবিভাগের অফিসের ওখানে, অফিস ঘেরা বাগান ঘুরেফিরে দেখার জন্যে ভালই জায়গা। বাকিরা চললাম আমরা বনের দিকে। যেখানে থামানো হলো, ম্যানগ্রোভের সারি, কাদামাটি পিচ্ছিল, সবাইকে দল বেধেঁ চলার সাবধানবানী জানিয়ে আবারো চলা শুরু করলেন ট্যুর অপারেটররা। অপেক্ষাকৃত ঘন বনের দিকে আগানোর সময় গাইডরা বারবার জানাচ্ছিলেন পথ হারিয়ে যেন না যায় তাই মাঝে মাঝেই পাতা ছিড়ে ফেলে রাখতে, কেন যেন বারেবারেই লাগছিলো কেবলি ভয় দেখানোই এদের উদ্দেশ্য!
বনের মধ্যে চলার সময়ে আমাদের সাথে ২জন উর্দিধারী গাদাবন্দুক নিয়ে বনরক্ষী, ২/৩জন গাইড আগে পেছনে থাকতেন। অন্যান্য গাইড কিবা বনরক্ষীদের সাথে চলার চেয়ে আমাদের ট্যুর অপারেটর বিপুলভাইয়ের সাথে চলার সময়টা বেশ ভাল ছিলো, কারন উনি নানান তথ্য, বিভিন্ন সময়ের গল্প বলেছেন যেতে যেতে। উনার কাছ থেকেই জানলাম সুন্দরবনে কিন্তু বেশ ডাকাতের প্রকোপ আছে। বনের মাঝে কাদাতে একখানে জায়গায় জায়গায় ডালপালা ভেঙ্গে কিছুটা স্তুপ করে রাখা, বিপুলভাই বললেন জলদস্যুরা রাত কাটিয়েছে বোধকরি এখানে, এগুলো তাদের বিছানা! চোরাচালান করাই এইসব ডাকাতদের মূল পেশা। আরো ঘন বনের ভেতর রীতিমতো তাদের সুদৃশ্য ঘরবাড়িই নাকি দেখতে পাওয়া যায়। তবে আরেক গাইড জানালেন আরেক মজার কথা, যে ডাকাতরা কখনো টুরিস্টদের উপর হামলা করে না, সেদিক দিয়ে আমরা পুরোপুরি নিরাপদ। ডাকাতেরা বড়লোকদের তুলনায় গরীদেরই বেশি আক্রমন করে থাকে, কারন বড়লোকদের অভিযোগের ভিত্তিতে পুলিশ কিবা কোষ্টগার্ডদের তল্লাশি যায় বেড়ে যা গরীবরা তেমন একটা অভিযোগ করে থাকে না।
বনের বাঘ দেখার আগ্রহেই সুন্দরবনে যাবার এতো ইচ্ছে মানুষের। কিন্তু সুন্দরবন গিয়েই রাজসিক রয়েল বেঙ্গল টাইগারের দেখা পেয়ে যাবেন এটার নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারে না, এমনকি এ যেন সবার কাছেই একটুর জন্যে না হাতছাড়া হয়ে যাওয়া বহুকাংক্ষিত মূহুর্ত, সবসময়ই যেন বাঘ এই কিছুক্ষন আগেই পেরিয়ে যায় ছেড়ে যায় তার চলার ছাপ। এই ক্ষেত্রে একটা কথা প্রচলিত আছে যে, বনরক্ষীরাই ট্যুর অপারেটরদের সাথে যোগসাজে এই সব ‘বাঘের ছাপ’ওলা ডাইস ব্যবহার করে থাকেন। আমরাও দেখেছি সদ্য ছেড়ে যাওয়া বাঘের পায়ের ছাপ, হুড়মুড় করে ছবিও তুলেছি তবে সাথের গাইডকে এই ডাইসের কথা বলতেই তার মুখ ভার হয়ে চুন! বেরসিক ছেলেপেলেরা তো আবার এমনটাও প্রশ্ন তুললো, বাঘের পায়ের ছাপ কেবল দু’টা কেন দেখা যাচ্ছে, আর কেবল চলার পথের নাগালেই কেন ছাপ, ঘন বনের দিকে যেতে যেতে কই মিলিয়ে যেল ছাপ, তবে কি বাঘ উড়াল দিয়ে গেল! তবে সুন্দরবন ভ্রমনে গেলেন আর বাঘের দেখা পেলেন না, এই আফসোস যতই করুন আপনার মনের আর হাতের ক্যামেরার মেমোরি কার্ড কিন্তু বোঝাই হয়ে যাবেন সুদৃশ্য অপরুপ মুহুর্তগুলোতে।
বেড়ায় আসছ মজা করেছ। অনেক বার ঈ হিংসায় কোন মন্তব্য করি নাই। কিন্তু এবার লিখে জানালাম শুধু যে আমি পড়লাম।
জোস!
আবার যাইতে ইচ্ছা করে আপনাদের সাথে। নিয়ে যাবেন ?
আবার মনে করাইয়া দিলেন
। লেখাটা কিন্তু চমৎকার হয়েছে
জোস!
মন্তব্য করুন