ইউজার লগইন

অল্পস্বল্প গল্পঃ হজ্ব ২০১৮ (২)

অল্পস্বল্প গল্পঃ হজ্ব ২০১৮ (২)

হজ্বের সময়ে কাবা শরীফ প্রথম নজরে আসার সাথে সাথে যে দোয়া করা হয়, আল্লাহ সুবহানাল্লাহতালা সেটি অবশ্যই কবুল করেন। কিন্তু কাবা নজরে আসামাত্রই মনমগজে যেই ধাক্কাটা লাগে, কি দোয়া বলতে কি বলা হবে তা তালগোল পাকিয়ে যাওয়াই স্বাভাবিক। এক্ষেত্রে কাফেলা থেকে শিখিয়ে দেয়া বাংগালী চিপাবুদ্ধি হলো, কাবা দেখামাত্র ঝটপট বলে দেয়া, "ইয়া আল্লাহ, এই হজ্বের কালে যতো দোয়া করবো, সেসব কবুল করে নেন মাবুদ"।

ছোটবেলা থেকেই ঘরে পড়াতে আসা হুজুরের পাশাপাশি আম্মাও নানান দোয়াদরুদ শেখাতেন, পড়া ধরতেন। অন্যান্য বড়রাও নানান ধর্মীয় গল্পে গল্পে জীবনের ভালোমন্দ শেখাতেন। নানান গল্পের বই, বিভিন্ন পত্রিকার সাথে ধর্মীয় পত্রিকাও ঘরে রাখা হতো। বাড়িতে ধর্ম নিয়ে কোন রকমের জবরদস্তি করা হয়নি। মা-বাবা, বড়রা সব নিয়ম পালন করতেন, সেই দেখে দেখে ছোটরাও করতাম। স্কুলের লেখাপড়া নিয়ে যেটুকু মার কপালে জুটেছে, কোরান পড়াতে আসা কোন হুজুরের হাতে তেমন কোন মারও খাইনি এই জীবনে। 'নামায রোজা পালন করাতো জীবনের অতি স্বাভাবিক কাজ' - এই মানসিকতা গড়ে উঠা সম্ভব হয়েছে অবশ্যই এমন পারিবারিক আবহের জন্যেই।

হজ্বের সময়ে আশেপাশে যাদের দেখলাম, কতো কতো সূরা দোয়া মুখস্ত উনাদের। আমার ভান্ডার সেই তুলনায় নিতান্তই কম। এই নিয়ে আফসোস লাগলেই নিজেই নিজে বুঝাতাম, "আল্লাহ ভরসা, যাই পারি না পারি, নিজের ভাষায় তো আল্লাহর কাছে চাইতেই পারবো।" বারবার পড়ার কিছু ছোটখাট দোয়াদূরুদের লিস্ট ছিলো সাথে একটা, আগে সেভাবে চেক করিনি, হজ্বে এসে দেখি সেই লিস্টের বেশকিছু আমার মুখস্ত! মনভরে কৃতজ্ঞতা এসেছিল একবন্ধুর প্রতি যার সাথে শেষ দেখা হয়েছিল সেই এসএসসির সময়ে। স্কুলের র‍্যাগ ডে'র আগে বন্ধুরা একে অন্যকে ছোটখাট উপহার দিচ্ছিলাম। সেদিন তাসনীম নিয়ে এলো উপহার ধর্মীয় বই! তিনগোয়েন্দা, কিশোর ক্লাসিক, মাসুদরানা'র ভিড়ে ধর্মীয় বই কিছুটা অন্যরকমই ছিলো বটে। আমার ভাগে পড়েছিল যেই বই সেটির নাম, 'আমলে জান্নাত', মাঝারি আকারের শক্ত মলাটের বই। এসএসসি'র পরের সময়ে রেজাল্টের ভয়েই, নাকি হাতে সময় অফুরান বলেই খুব করে ইবাদত শুরু করেছিলাম। সেসময়ে নিয়ম করে এই বইও পড়া শুরু করেছিলাম। পড়তে পড়তে নামাযের পরে পড়ার মতন কিছু দোয়ার একটা সেট বানিয়ে ফেলেছিলাম নিজে নিজেই। হজ্বে এসে দেখি সেই টুকিটাকি দোয়াগুলোই দরকারি সব দোয়া! অন্তর থেকে দোয়া এসেছে তাসনীমের জন্যে। দেশে ফিরে এসে সেই ২৫/২৬ বছর পুরোনো ছেঁড়াখোড়া বইটা খুঁজে বের করে, ওর লেখা শুভেচ্ছা জানানোর কথাগুলো পড়ে ভালোলাগা ছুঁয়ে গেছে অনেক।

হজ্বের শুরু থেকেই সব কিছুতে মুশকিল আসান হয়ে যাচ্ছিল আপনা আপনাতেই। বিমান বন্দরের দীর্ঘ সময়ের নিয়মনীতি মানতে মানতে আব্বা-আম্মা দুইজনেই ক্লান্ত হয়ে নেতিয়ে যাচ্ছিলেন। শেষ সময় পর্যন্ত দুইভাই আগলে রয়েছিল, পরে ভাইয়ের কলিগ যিনি সেসময়ে ডিউটিতে ছিলেন, উনি সাথে রইলেন ফাইনাল গেইট পর্যন্ত , আর একদম সৌদি এয়ারলাইন্সে উঠার লাইনে যেতেই এক কাজিন ফোন দিয়ে বলে, "লাইনের সবার শেষে যা, সিট পাল্টে দেয়া হচ্ছে তোদের"। সেই সময়ে নতুন তথ্য জানলাম, হজ্বের মৌসুমে সৌদি এয়ারলাইন্সের বিজনেস ক্লাশ প্রায় ফাঁকাই যায়। কোন সমস্যা না থাকলে, ডিউটিরত কর্মীদের বলে দেয়া হলে ইকোনমি ক্লাসের যাত্রী ট্রাভেল করতে পারেন ফাঁকা রয়ে যাওয়া সিটের বিজনেস ক্লাসেই। হাজীদের দেয়া এই সুবিধাটুকুর কথা কাফেলায় আগে হজ্বে আসা অনেকেই জানেন দেখলাম।

জেদ্দা এয়ারপোর্টের অপেক্ষার পেরেশানির কথা সব্বার মুখে মুখে শুনেছি। প্লেন জার্নির শেষে হোটেলে নেয়ার বাস আসার অপেক্ষার প্রহর নাকি অনেকটাই দীর্ঘ আর সবার জন্যেই কষ্টকর। তাই সময়ে আব্বা আম্মার খাবারের ব্যবস্থা হাতের কাছে করে রেখেছি, অসুধপথ্যে ঠাসা হাতের ব্যাগ, কোন দিকে যেন যাওয়া না লাগে দু'জনকে ফেলে। বাসে উঠার সময়েই কাফেলার আয়োজকদের হাতে নিজস্ব কাগজপত্র দিয়ে দিতে হয়, সাথে থাকে হজ্বের সময়ের আইডি। একটা ভাষা অজানা ভিনদেশে চলবো নিজের কোন কাগজপত্র ছাড়া, ব্যাপারটা ভাবতেই আতংক লাগে। এজন্যেই পাসপোর্ট আর যাবতীয় কাগজপত্রের ২সেট ফটোকপি করে একটা মেইন লাগেজ, অন্যটা হ্যান্ডব্যাগে রেখেছিলাম। ফজরের আযান দেয়ার সময় ঘনিয়ে গেছে যখন জেদ্দাতে নামলাম। আল্লাহর কি রহমত, দুইজনকে সুস্থির করে বসিয়ে খাবার দিয়ে, নিজে ফ্রেশ হয়ে ওযু শেষ করতে না করতেই শুনি যে বাস এসে গেছে। সবাই অবাক এতো জলদি নাকি কখনো বাস এসে হাজির হয়না। বাসে চলতে চলতেই ফজরের আযান শুনলাম, আঁধার কেটে ভোরের আলো ফুটতে লাগলো। ধূলিধূসরিত বিবর্ণ একটা শহর, রাতে তাও নানান বাতির আলোতে ঝকঝকা লাগে কিছুটা, দিনের শহর একটুও টানে নাই। এই তো গেলো আপাতদর্শনের কথা, কিন্তু এই রুক্ষ পথগুলোতে হেঁটেচলে বেড়িয়েছেন আল্লাহর রাসূল, পৃথিবীর শ্রেষ্ঠমানব হযরত মুহাম্মদ মোস্তাফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, এখানেই রয়েছে আল্লাহর ঘর কাবাশরীফ - মক্কাকে অতুলনী, অতি আকাংখিত করে তোলার জন্যে এটাই যথেষ্ট।

পোস্টটি ৬ জন ব্লগার পছন্দ করেছেন

মন্তব্য করুন

(আপনার প্রদান কৃত তথ্য কখনোই প্রকাশ করা হবেনা অথবা অন্য কোন মাধ্যমে শেয়ার করা হবেনা।)
ইমোটিকন
:):D:bigsmile:;):p:O:|:(:~:((8):steve:J):glasses::party::love:
  • Web page addresses and e-mail addresses turn into links automatically.
  • Allowed HTML tags: <a> <em> <strong> <cite> <code> <ul> <ol> <li> <dl> <dt> <dd> <img> <b> <u> <i> <br /> <p> <blockquote>
  • Lines and paragraphs break automatically.
  • Textual smileys will be replaced with graphical ones.

পোস্ট সাজাতে বাড়তি সুবিধাদি - ফর্মেটিং অপশন।

CAPTCHA
This question is for testing whether you are a human visitor and to prevent automated spam submissions.