শ্রাবণের সন্ধ্যা...
শ্রাবণের ঘোলাটে মেঘের বিকেলে, সরু পাকা পথ ধরে হেঁটে এসেছি বহুদূর। তেজহীন মৃদু আলোর বিষণ্ণ বিকেল, বরষার আহাজারি, মেঘদলের অন্তহীন ছুটে চলা, প্রেমাসক্ত হৃদয়ে ক্ষরণ, চঞ্চল হওয়ার উন্মাদ ছুটে চলা সবই প্রাণ ছুয়ে গেছে। দেখেছি– সীমানা ছেড়ে আসা গরুর পাল, ভেজা বাতাসে কাকের স্বর, সীমান্তহীন আকাশের অকারণ গর্জন, সন্ধ্যার আধারের স্বচ্ছ আচ্ছাদন। ভেজা কাপড়ে পথিক চলেছে উওর দক্ষিণ বরাবর। এখানে জীবনের স্থবিরতা আছে, তবু মিলে চাঞ্চল্যের দৃশ্য। দূরের বিলে জাল ঠেলে যাচ্ছে কেউ, কেউ ছুটছে গরু নিয়ে, রিক্সা চলছে দুই একটা, আকাশ মিলে যাওয়া দূরের গ্রাম থেকে আসছে আযানের ধ্বণি। আমি তবু হেঁটে চলেছি নিরুদ্দেশ পথে, অকারণে। দিনান্তে ঘরে ফেরা পথিক, সাদা আকাশে ডানা মেলা বলাকা, আপন দ্রুতিতে ছুটে চলা রেল, পাটের আঁশ ছাড়ানো বৃদ্ধ কেউ ভ্রুক্ষেপ করছে না আমায়। দিন দিন ক্লান্ত হয়ে যাচ্ছে মন, আজকের দিনকে অর্ভ্যথনা জানাতে ইচ্ছা হয় না, কৌতূহল নেই আগামী প্রভাত নিয়ে। অথচ কত কর্মনিষ্ঠায় মগ্ন পৃথিবী। শ্রাবণের আকাশের ক্রন্দন, মেঘ রোদের যুদ্ধ বিগ্রহে চলছে এই মনকে নিরেট গড়ে তোলার নিরন্তন প্রচেষ্টা, যেন আজকের সকালে চঞ্চল হাওয়ায় ফুলে ওঠা মনটা সন্ধ্যাতেই চুপসে না যায়। বরং রোদ ঝড়ে হয়ে ওঠে কঠিন প্রস্তর খন্ড যাতে দুঃখের সংর্স্পশেই জ্বলে উঠবে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ। ছোট মানুষের এর চেয়ে বড় আর কি চাওয়ার থাকতে পারে?
সন্ধ্যার আধার জমেছে, গুড়িগুড়ি বৃষ্টি পড়ছে আর আধারের ফাঁক গলে ভিজছে বিষণ্ণতা। রিক্ত পৃথিবী উন্মুখ হয়ে বসে আলোর ঝলকানি দেখার, খোলা প্রান্তর জুড়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে অশান্ত হাওয়া, দূরে কোথাও অবিরত ডেকে যাচ্ছে একটা ব্যাঙ, সরু পাকা পথ ধরে ছুটছে একটা রিক্সা, নিচে ঝুলছে একটা হারিকেন - জলে আলোর মায়া বন্ধনে মোহিত আধার। আমি নির্লিপ্ত প্রাণ নিয়ে হেঁটেই যাচ্ছি মায়ার শহরে। গা ভিজে গেছে, প্রাণের তৃষ্ণা ফুরায় নি, হৃদয় সিক্ত হতে চায়, মন জুড়ে আলোড়ন - মিশে যাও আধারে। ‘আজকের পর কাল যদি বাঁচতেই হয় তবে প্রাণটাকে বাঁচিয়ে রাখো, মনটাকে দাও মুক্তি। মন বাঁচাতে গিয়ে না পাছে খোয়াতে হয় প্রাণটাই। সোনার রথে চড়ে যদি যেতেই হয় মহাযুদ্ধে তবে মহা আড়ম্বরেই গ্রহন করো সেই সম্ভাষণ। লোকের নিন্দে গায়ে ডুবিয়ে মনকে কলুষিত করো না, বরং মানপত্র লিখ হৃদয়ের ঠিকানায়; আধারের বুক চিড়ে। প্রাণের বন্দনায় খুলো আঁখি – দেখবে নতুন চাঁদের আলো, মিলবে নতুন বাণী।’ আরো কত কিছু বলেছি আপন মনে, ফের হেসে হই কুটিকুটি!
টিমটিমে আলোর হারিকেন আর রিক্সা ফেরত আসছে, ভেজা বাতাসে ভাসছে চালকের অপক্ব সুর। তবে গলায় কেমন যেন একটা হাহাকার ছিল, ভেসে আসছিল ‘আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম...’। আমারো খানিক স্মৃতির জ্বরে আক্রান্ত হতে ইচ্ছে হয়, সোনালি অতীতে ডুবে যেতে মন চায়। সময়ের নির্মম শাসনে কত ক্ষয়ে গেছি ভাবতেই আঁতকে উঠি, র্দীঘশ্বাস বের হয়। শ্রাবণের আকাশ তখনো কেঁদে যাচ্ছে। ঐ গ্রামের বুড়ো বাচ্চারা চেঁচিয়ে বলছে, ‘ইবার বরষা পরাণ ফিরা পাইছে, বিলে মাছ জমছে, গত কয় বছর ত মেঘই বিষ্টি কিছুই অয় নাই।’ আকস্মিক অনাকাঙ্খিত এই চেঁচানোয় আমি ভয় পেয়েছি কিন্তু এই ভর্য়াত চোখ জুড়ে যেন ভাসে সোনায় মুড়ানো শৈশব। বাদলা দিনে ফুটবল নিয়ে মাঠ, উঠোনে দাপাদাপির তৃপ্তি কত মধুর হতে পারে তা অন্যকে বুঝানো সাধ্যের বাইরে। আর্দ্র মনে রঙ চড়ানোর পরিতৃপ্তিতে যেন আকাশে মেঘেরা ঘোষণা দিচ্ছে তুমুল র্গজনে। ধূলি-বালি, সিসাহীন নির্মল বাতাসে ফুসফুস ভরে ভাবছিলাম, কত রূপ লীলার এই জীবন কত রঙ খেলায় চলে যাচ্ছে, কত রাঙা ছবির পট এসেছি ফেলে। শ্রাবণের প্লাবণ জলে ভাসিয়েছি কত কলার ভেলা, কত কাদা জলে গা মেখে ধরেছি পুঁটির পোনা, স্কুল ফাঁকির জালে লিখিয়েছি কত মিথ্যা অলীক বাহানা! আজো স্নায়ু চেপে ধরে সেই স্মৃতি।
সন্ধ্যায় রেজাল্ট পেয়েছি, সম্মান প্রথম র্বষের। ছয় বিষয়ের মধ্যে একটায় F, বরাবরের মত জঘন্য ফল এবং আমি অখুশি নই। তবু কোথায় যেন একটু অস্বস্তি কাজ করে, প্রথম ফেল! প্রাণ ভরে বর্ষার গান শুনছি, ভিজতে পারছি, বুঝতে পারছি এটাই বা কম কিসে? লোকে জয় উদযাপন করে, আমি হার উদযাপন করলাম। মনে মনে নিজেকে আর্শীবাদ করে দিলাম, ‘মন খারাপ করো না জাকির, পরের বার ঠিক সব বিষয়েই পাস করবে! বেঁচে থাকো, ভালো থাকো আর মনকে দাও মুক্তি।’ তবে শ্রাবণের এই অর্পূব সন্ধ্যা নিশ্চয়ই অনেক দিন মনে রাখার মত। বর্ষা ভিজিয়ে দিক শত বিষণ্ণ হৃদয়, সহস্র অন্তর, সাফ করে দিক সব কলুষতা।
গুড রাইট আপ, কিপ ইট আপ ব্রো!
চিন্তা করবেন না সব ঠিক হবে সামনেই।
ধন্যবাদ ভাই।
মন্তব্য করুন